মায়ের জন্য ভালোবাসা

মা (জুন ২০১৪)

মিলন বনিক
  • ৩১
আজ জনির মনটা ভালো নেই।
খুব সকালে উঠেছে। তার অনেক কাজ। স্কুলের দিদিমণি বলেছে আজ যেন অবশ্যই স্কুলে যায়। আজ একটা বিশেষ দিন। সেইতো দুইটায় স্কুল। সকালের রেগুলার শিফট-এর বাচ্চাদের ছুটির পরে জনিদের স্কুল। দুইটা থেকে পাঁচটা। ছিন্নমূল শিশু-কিশোররা একটা এনজিও-র সহযোগিতায় বিনা খরচে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। তাও প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া সম্ভব হয় না। আজ যেতে হবে। দিদিমণি বলেছে আজ স্কুলে যারা উপস্থিত থাকবে তাদের সবাইকে উপহার দেবে।

জনি ট্রেন ষ্টেশনে অপেক্ষা করছে। ক’দিন ধরে বিশ্রী গরম। খালি গায়ে বের হয়ে পিঠে চটের বস্তাটা ঝুলিয়ে নিয়েছে জনি। ঝুপড়ির বাইরে করিম চাচার দোকান থেকে একটা চা আর বনরুটি খেয়েছে। বলেছে কাগজ বেইচ্যা বিকালে পয়সা দিয়া দিমুনে। করিম চাচা না করেনি। আইচ্ছ্যা দিস বলে নিজের কাজে লেগে গেল।

এর মধ্যে মন্টু আর মোতালেব এসে পরেছে। অপেক্ষা শুধু মতির জন্য। কত আর বয়স হবে ওদের। আট দশ বছর হবে। এই বয়সে কাক ডাকা ভোরে উঠে কাগজ কুড়াতে বের হয়ে যেতে হয়। তারপর বস্তাভর্তি ছেড়া কাগজ, জুতা, প্লাস্টিক ভাঙ্গাচোরা জিনিষপত্র কুড়িয়ে আড়তে দিয়ে আসতে হয়। তাতে কোন দিন বিশ টাকা কোনদিন চল্লিশ আবার কোনদিন পঞ্চাশ একশ টাকাও হয়। মতির জন্য অপেক্ষা করতে করতে বুঝি রোদটা চাঙ্গা হয়ে উঠল। কি হলো কিছুই বুঝতে পারছে না। এত দেরী তো করে না। এর মধ্যে মোতালেবের তর সইছে না। বলল-চল আমরা বড় বাজারের আড়তে ঢুইক্যা পড়ি। বেলা হইয়া গেলে মোট পামু না। সবাই বাজার কইর‌্যা চইল্যা গেলে তারপর যা পামু কুড়াইয়া নিমু নে। তাইলে আগে একবার মতির খোঁজ নিয়া লই। হ, ল যাই বলে সায় দিল মন্টু।

মতির ঝুপড়ির দরজায় গিয়ে ডাকল জনি। ও চাচী মতি কই। অহনও কামে বাইর অয় না ক্যান। যে রইদের ত্যাজ, বেলা হইয়া গেলে কিছুই পামু না। কান্না ভেজা কণ্ঠে জবাব দিল মতির মা। মতি যাইবো নারে বাপ। কাইল রাইতে দুই তিনবার পায়খানা আর বমি হওনের পর অর চোখ মুখ কেমন ঘোলা ঘোলা হইয়া গেছে। আমার পুতটা উঠতে বসতে পারতাছে না। সবাই ভিতরে গিয়ে মতির পাশে বসল। জনি জিজ্ঞাসা করল-
- কি কও চাচী। মতিরে তো ডাক্তারের কাছে নেওন দরকার। এই গরমে এইটা খুব খারাপ লক্ষণ। চাচা কই। চাচা কিছু কয় নাই।
- হে ব্যাটা মরদ মানুষ। হে আর কি কইবো। কইলো এই সিজানে সবার এইরকম রোগ বালাই হইতাছে। সব ঠিক হইয়া যাইবো কইয়া বাইর হইয়্যা গেলো। এই টুকুন বয়সে পুতের রোজগার খাওনের লাইগ্যা উইঠ্যা পইর‌্যা লাগছে। আমার মানিকটার গায়ে জ্বর। কেমন নিঠুর মানুষ। গায়ে একটু হাত দিয়াও দেখল না। বুঝছস বাপ, আমি তো মা। পেডে ধরছি যখন, আমি তো বুঝি পোলার অসুখে বিসুখে মায়ের কি যন্ত্রণা। আমার পোলাডা সকাল থেকে কিছু মুখে দেয় নাই। কথা কওনের শক্তি নাই। খালি কতক্ষণ পর পর আমারে আদর কইরা কইতেছে, ও মা, আমি তরে খুব ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি। আমি মইরা গেলে আমারে মাফ কইরা দিস। আমি আর বাঁচুম না।

জনির খুব খারাপ লাগছে। মতির জন্য মায়ের কি কষ্টটায় না হচ্ছে। কাঁদছে। জনির ভিতরের কষ্টটা অন্যরকম। আজ সকালে মা কে বলেছে, মা কিছু খাইতে দাও। সকাল সকাল কামে যামু। মা রেগে আগুন। বলল-আগে কামাই কইরা লইয়া আয়, তারপরে খাওন। অথচ রিমিকে সকালে উঠে পান্তা ভাতের সাথে একটা ডিম ভেজে দিয়েছে। কথায় কথায় চড় থাপ্পড় মারে। জনির পাঁচ বছর বয়স থেকে এমনটি দেখে আসছে। তবুও বোনটার জন্য সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে। জনি জানে সৎ মা তো সৎমা-ই। কখনও আসল মা হয় না। সৎ মায়ের ঘরে বোনটা আসার পর জনিকে দু’চোখে দেখতে পারেনা।

মতির মাকে দেখে জনির মায়ের কথা খুব মনে পরছে। জনির তখন চার বছর বয়স। মা’টা মরে যাচ্ছে। কি একটা বড় অসুখ। বাপ কিছুই করতে পারে নাই। খালি জনিকে বুকের ভিতর চেপে ধরে কপালে চুমু দিচ্ছে আর বার বার বাবারে বলতেছে, তুমি আমার পোলাডারে লেখাপড়া শিখাইবা। কোন কষ্ট দিবা না। দেখবা আমাগো জনি একদিন মানুষের মত মানুষ হইবো। অনেক বড় হইবো। তোমার আর কোন দুঃখ থাকবো না। তুমি কথা দেও আমারে, আমার প্রাণের কইলজাটারে তুমি দেইখ্যা রাখবা। কষ্ট দিবা না। আমার বাপে চুপ কইরা আছিলো।

জনির মাকে কবর দিয়ে আসার তিন মাসের মধ্যে এই নতুন মা ঘরে আসল। জনিও অনেক খুশী। নতুন মা পেয়েছে। সবাই তো মা। এই মাও নিশ্চয় অনেক আদর করবে। একদিন কাগজ কুড়াতে না গিয়ে বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করে দুপুরে খেতে আসল বলে মায়ের সে কি রাগ। খাবার তো দিলই না বরং জনিকে অনেক মারল। তিন দিন জ্বর নিয়ে বিছানায় শুয়েছিল জনি। আর শুধু মার কথা মনে পড়ছিল। আজ মতি বিছানায় পড়ে থাকাতে মতির মার কষ্ট দেখে জনির মনটা ডুকরে কেঁদে উঠল। ভাবল মতির কিছু হয়ে গেলে মতির মা পাগল হয়ে যাবে। জনি দৌড়ে গিয়ে করিম চাচার দোকান থেকে দুইটা ডাব এনে বলল-ও চাচী, আগে একটা খাইয়ে দাও। তারপর পানি চাইলে ডাবের পানি দিবা। ভালো না হইলে বিকালে ডাক্তারের কাছে নিয়া যামুনে। মতির মা জনিকে কাছে টেনে পরম মমতায় মুখে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, তুই কোন জনমে আমার পুত আছিলিরে বাপ। আল্লাহ তোরে অনেক বড় করবো।

আজ আর তেমন কাজ হয়নি। যা পেয়েছে তাতে বিশ টাকার মত হবে। দিদিমণি বলেছে স্কুলে যেতে হবে। তাই দুপুরে এসেই নীল রঙ্গের শার্টটা গায়ে দিয়ে স্কুলের দিকে ছুটল। ক্লাসের দিদিমণির টেবিলে অনেকগুলো গোলাপ ফুল। দিদিমণি মাকে নিয়ে অনেক কথা বলল। যে ছেলেমেয়ে মা বাবাকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা ভক্তি করে তাদেরকে স্বয়ং ঈশ্বরও ভালোবাসে। আজ সবাইকে একটি করে গোলাপ আর চকলেট দেবো। তোমরা বাড়ী গেয়ে মাকে সালাম করে ফুলটা দিয়ে বলবে, মা আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।

স্কুল থেকে বের হয়ে জনি ভেবে পাচ্ছে না কি করবে। মায়ের জন্য মন কেমন করছে। দিদিমণির গোলাপ ফুলটা সে কাকে দেবে। তার তো মা নেই। সৎমা আছে। কিন্তু সৎমা জনিকে খুব কষ্ট দেয়। অনেক মারে। ঠিকমত খেতে দেয় না। স্কুলে যেতে দেয় না। রাতে শুয়ে শুয়ে কাঁদে জনি। আবার সকাল হলে সেই কাজের খোঁজে বেরিয়ে পরে। জনি ভাবে, কষ্ট হলেও আমাকে বড় হতে হবে। আমি প্রতিদিন স্কুলে যাবো।

জনি ফুলটা নিয়ে সোজা রেল লাইনের পাশের কবরস্থানে চলে যায়। যেখানে ওর মা শুয়ে আছে। জনির খুব কান্না পাচ্ছে। টপ টপ করে ক’ফোটা চোখের জল পরে কবরের মাটিতে। তারপর ফুলটা মায়ের কবরের উপর রেখে বলে, মা আমি তরে খুব ভালোবাসি। আইজ তুই নাই, তাই আমার কষ্টেরও শেষ নাই। তুই আমার জন্য দোয়া করিস মা। আমি যেন মানুষ হইতে পারি।

তারপর আস্তে আস্তে মতির ঝুপড়ির দিকে পা বাড়ায়। হয়তো মতিটাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ওয়াহিদ মামুন লাভলু খুব যত্ন করে মূল্যবান জীবন চিত্র তুলে ধরেছেন যা পড়লে মানবতার অনুভূতি জাগ্রত হবে। জনির মত যে মাকে হারিয়েছে সেই বুঝতে পারে মা হারানোর কি বেদনা। খুব ভাল লাগল। শ্রদ্ধা জানবেন।

০৭ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১১৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪