কে সি দে রোডের ফুটপাতের উপর শমশু মিয়ার ঝুপড়ি দোকান।
সারা রাত খোলা থাকে। রাতের বেলা কাষ্টমারও বেশি। দোকানে শুধু চা, গরুর দুধ, বনরুটি আর টোষ্ট বিক্রি হয়। দূরপাল্লার বাস টার্মিনাল। চট্টগ্রাম থেকে গাড়িগুলো সব এখান থেকেই ছাড়ে। যাত্রীদের ভীড় লেগেই থাকে। রাত দু’টোর পর ভীড়টা একটু কম। দু’টোর পরে দূরপাল্লার কোনো গাড়ি ছাড়ে না, পৌঁছায়ও না। ওদিকে পাঁচটার পর এক এক করে দূরের গাড়িগুলো পৌঁছতে থাকে। লোকজনের ভীড় বাড়তে থাকে। মাঝখানের সময়টােেত শমশুমিয়া একটু জিরিয়ে নেয়। সাথে থাকে দশ বারো বছরের নুরু। পুরো নাম নুরুল ইসলাম।
মাঘ মাসের কনকনে ঠা-া। দু’একজন কাষ্টমার আছে। তারা সবাই রাস্তার ছিন্নমুল মানুষ। গায়ে ময়লা চাদর, মাথায় মাফলার মুড়ি দিয়ে ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ে চুমুক দিয়ে জিরিয়ে নিচ্ছে। মাথার ওপর তেলপারের ছাউনি। বাইরে কুয়াশার আস্তর। শহরের নিয়নবাতিগুলো খুব কাছে থেকেও ঝাপসা দেখাচ্ছে। কাষ্টমারকে চা দিয়ে নুরু তাড়াতাড়ি আগুনের চুলাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আগুনের তাপ নিয়ে দুই হাতের তালু সেঁকে নেয়। তারপর আগুনে স্যাঁকা গরম হাতের তালু দুইটা কতক্ষন পর পর নাকে মুখে বুলিয়ে নেয়। তাতে একটু গরম আঁচ লাগে। কিছুটা আরাম বোধ হয়। শরীর চাঁঙ্গা হয়। ভালো লাগে।
রঞ্জুর সাথে সুব্রত এই প্রথম সিনেমা দেখতে এসেছে শহরে। বিকাল তিনটার শো দেখাবে রঞ্জু। ছয়টায় শেষ। ব্যাস। সিনেমা শেষে সন্ধ্যার পর পর বাড়ি ফিরে যাবে দুই বন্ধু। সিনেমা প্যালেসে জীবনে এই প্রথম সিনেমা দেখবে সুব্রত। একেবারে আনাড়ি। অপরদিকে রঞ্জু পুরানো চালু মাল। বয়সেও বড়। পেটে মিউনিসিপ্যালিটির পানি পরেছে আরও অনেক আগে। লেখাপড়া বেশিদূর এগোয়নি। জীবন জীবিকার তাগিদে স্যাঁকরার কাজে লেগে পরেছে অল্প বয়সে। কাজ শেখা প্রায়ই শেষ। এখন নিজেই জমাদারি বসবে। নিজের একটা গদি হবে। নিজেই কাজ করবে। নিজেই আয় রোজগার করবে। জীবন ও জীবিকার কঠোর সংগ্রামে আজ সে জয়ী হতে চলেছে। সেই সাথে ছোট ভাইবোনদের মানুষ করার গুরুদায়িত্ব রঞ্জুর কাঁধে। অনেকদিন পর গ্রামে এসেছে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা, আনন্দ, হৈচৈ করে আবার ফিরে যেতে হবে শহরে। জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে।
আড্ডার এক পর্যায়ে সুব্রতই প্রশ্নটা করলো,
- এবার তো জমাদারি বসলি। কী খাওয়াবি বল?
- গ্রামে আর কী খাবি? চল, শহরে। সিনেমা দেখাবো। আর যা খেতে চাইবি তাই খাওয়াবো।
- সে কী? কোন হলে?
- সিনেমা প্যালেস।
- কখন?
সিকো ফাইভ হাত ঘড়িটা দেখে বললো,
- তিনটা ছয়টা। এখন বারোটা বাজে। খেয়ে বের হলে তিনটার মধ্যে শহরে পৌঁছে যাবো।
আসার ভাবনাটা সুব্রত ভাবেনি। এই প্রথম সিনেমা দেখা হবে। এতো কম আনন্দের কথা নয়! সবে মেট্রিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। ছোটবেলায় একবার বড়’দার সাথে সিনেমা দেখেছিলো। কোন হলে মনে নেয়। শুধু এটুকু মনে আছে যে, হলের মধ্যে যখন মুষলধারে বৃষ্টি আর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিলো তখন সুব্রত ভয়ে কান্না করে দিয়েছিলো। বৌদি হেসে বলেছিলো, এই সবু, কান্না করছিস কেনো? এতো সিনেমায় হচ্ছে।
আজ রঞ্জুর সাথে সিনেমা দেখা হলো, রাতে আর বাড়ি ফেরা হলোনা। এই হাঁড় কাঁপানো শীতে রীতিমতো কান্না পাচ্ছে সুব্রতর। এই শীতের রাতে এত কষ্ট কেও করে? শহরের একটা কাক-পক্ষি পর্যন্ত জেগে নেই। গায়ে গরম জামা নেই। একটা সুইসবল কাপড়ের ফুল শার্ট। কে জানতো যে সারারাত থাকতে হবে? যত রাতই হোক বাড়ি ফিরে গেলে এতো কষ্ট হতো না। বাবা না হয় একটু বকা দিতো। এখন বাড়িতে নিশ্চয় সবাই চিন্তা করছে। সমশুমিয়া বার বার আড়চোখে তাকাচ্ছে ওদের দু’জনের দিকে। রাতের শহর। কত কিছিমের লোকজনের আসা যাওয়া। কার মনে কী আছে? কে কোন উদ্দ্যেশে পথ চলছে তা কে জানে?
সমশু মিয়ার দোকানের একপাশে টুলের ওপর হাত পা গুটিয়ে জবুথবু হয়ে বসে আছে রঞ্জু আর সুব্রত। একজন চোখ বুজে ঝিমোচ্ছে তো অন্যজন চোখ মেলে পাহারা দিচ্ছে। যদি কোনো অঘটন ঘটে যায় সেজন্য সতর্ক থাকা। মাঝে মধ্যে গরম দুধ আর চা খাওয়া হচ্ছে। কিন্তু তাতেও সমশুমিয়ার মন ভরছে না। রাত প্রায় দু’টো। অবশেষে সমশুমিয়া বলেই ফেললো-
- তোমরা কই যাবা? হেই রাত সাড়ে বারোটা থেইকা বইসা আছো। মতলব কী?
রঞ্জু চালাক। খুব স্বাভাবিকভাবেই বললো,
- আমাদের এক আত্মীয় আসবে। তাই অপেক্ষা করছি।
রঞ্জু মিথ্যা বললো কেন তা সুব্রতর মাথায় আসছে না। কোনো আত্মীয় তো আসবে না। বরং বিপদে পরে এই শীতের মধ্যে ফুটপাতে বসে রাত কাটাতে হচ্ছে। সেটা বললেই হতো। সমশুমিয়া ভালোই জানে, এটা ¯্রফে মিথ্যা কথা। তাই জোড় দিয়ে বললো,
- মিছা কথা কও ক্যান? অহন তো আর কোনো গাড়ি আইবো না।
রঞ্জু চুপসে গেলো। রঞ্জুর চেয়েও বড় চালাক এই সমশুমিয়া। ফিক করে হেসে দিলো নুরু। বললো,
- ওস্তাদ, মামারা মনে অ’য় বিপদে পড়ছে। অহন কই যাইবো এত রাইতে। দোকান বন্ধ কইরা দিমু।
লোকজনের চলাচল থেমে গেছে। সমশুমিয়া গদিতে বসে ঝিমুচ্ছে। নুরু একটা টুলে হাত দু’টো দুই উরুর মধ্যে গুঁজে দিয়ে শুয়ে পরেছে। জেগে আছে রঞ্জু। সুব্রতর মোটেও ঠা-া সহ্য হচ্ছে না। রীতিমতো শরীর কাঁপছে। ঘুমে চোখ ঢুলুঢুলু করছে। একটু ওম পেলে এখনি ঘুমিয়ে পড়তো। লাল হয়ে আছে চোখ দুটো। এত রাতে মেয়েলি কণ্ঠ শুনে খরগোশের মতো কান খাড়া করে দিয়েছে রঞ্জু। এ আবার কোন বিপদ? চোখ মেলে তাকিয়ে আছে সুব্রত। মেয়ে দু’টোর উগ্র সাজ পোষাক। পরনে লাল টকটকে প্রিন্টের শাড়ি। দুজন সমশু মিয়ার দুপাশে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে।
একজন সমশুমিয়ার কাঁধে হাত রেখে বললো,
- ঐ ছমশু, দুইটা টাটকা গরম লাল চা লাগা।
- ঐ শেফালি, এত রাইতে কত্তুন আইলি?
- আমাগো কাম তো রাইতে। রাইতে না আইসা দিনে আসুম ক্যা? আর কইছ না। এক মাগীর পুতে ডাইকা নিয়া গেলো।
কই নিয়ে গেলো তা সমশু ভালোই জানে। মেয়েদের কথাবার্তাগুলো সুব্রতর মোটেও ভালো লাগছে না। কেমন বিশ্রি রকম করে তাকাচ্ছে। চোখের দুৃষ্টি অন্যরকম। তীক্ষ, রুক্ষ। রঞ্জুর দিকে বার বার তাকাচ্ছে। কথা বলছে সমশুমিয়ার সাথে কিন্তু চোখ দুটো রঞ্জুর দিকে স্থির। রঞ্জুও বুঝে গেছে ওরা কারা। এই শহরে রঞ্জুর অনেক দিনের যাওয়া আসা। অলি গলি ভালোই চেনে। ঠোঁঠে টকটকে লাল লিপষ্টিক। বাঁকা ঠোটে রঞ্জুর দিয়ে তাকিয়ে বললো-
- মাগীর পুতে কাম কইরা কয়, ট্যাহা নাই।
- ব্যাটার লুঙ্গিটা খুইলা রাখলি না ক্যান? পাল্টা প্রশ্ন করলো সমশুমিয়া।
- মাদারি ছোৎ এর লগে কিছু নাই। একটা হাতঘড়ি আছে। ঘড়ি আর শার্টটা খুইলা খালি গায়ে হান্দাইয়া দিছি।
সুব্রতর শরীর ঘামছে। যেভাবে ওদের দিকে তাকাচ্ছে তাতে সুব্রতর ভীষণ ভয় করছে। এই শীতেও শরীরে কোনো ঠা-া অনুভব হচ্ছে না। মিটমিট করে হাসছে রঞ্জু। ফিসফিস করে বললো- ‘চুপ করে বসে থাক।’
সমশুমিয়া চা বানিয়ে দেয়। চায়ে চুমুক দেয় শেফালি। আবার তীক্ষ বিশ্রি চোখে সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বললো,
- ঐ রেহানা, ঠা-া পরতাছে। শরীর গরম কইরা ল। নতুন নাগর পাইলে কামে লাগা।
সুব্রতর মাথাটা ঝিমঝিম করছে। এই মুহূর্তে এখান থেকে বের হয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু কোথায় যাবে? সুব্রতর এক দূরসম্পর্কের ভাই আছে টেরিবাজারে। এত রাতে ওখানে যাওয়াটা ঠিক হবে না। কোনোভাবেই সহজভাবে মেনে নেবে না। হিতে বীপরীত হয়ে যেতে পারে। আত্মীয়স্বজন যাওয়াটা পছন্দ করেন না বলে কেউ যায়ও না।
রেহানা এতক্ষন সমশুমিয়ার গা ঘেষে ঘুরঘুর করছিল। পারলে যেন কোলে বসে পরে। চায়ের কাপে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে বললো,
- মনে হয়, শহরের নতুন মাল। কাম করতে সাহস লাগে। দেহস না, বইয়া বইয়া ভিজা কুড়ার মতোন ঝিমাইতাছে।
- ল, অগোরে আমাগো লগে বাসায় লইয়া ঘুম পাড়াইয়া দিই। রঞ্জুর দিকে তাকিয়ে বললো শেফালি।
পিলে চমকে গেলো সুব্রত আর রঞ্জুর। সুব্রতর মনে হলো রঞ্জু এবার ঠিকই ভয় পেয়েছে। সুব্রতর হাতে চিমটি কাটলো রঞ্জু। বিপদ সংকেত। এখন আর বুঝতে বাকি নেই যে, ওদের নিয়েই কথাবার্তা চলছে। এই মুহূর্তে বাইরে বের হওয়া মুশকিল। রাস্তাঘাটে কোনো লোকজন নেই। সমশুমিয়ার সাথে রেহানা শেফালির যে ভালোই জানাশোনা আছে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। রঞ্জুর চেয়ে সুব্রত আরও বেশি ভীতুর ডিম। সমশুমিয়া বুঝতে পেরেছে। ভালো মানুষের মতো বললো,
- বিপদে পইড়া রাইত কাটাইতেছে। ঝামেলা করিস না। ভালা ঘরের পোলা।
- ওই মাগীর পুত, তুই এত দরদ দেখাস ক্যান?
কাছাকাছি কোথায় ওয়াজ মাহফিল হচ্ছে। মাইকে ওয়াজের সুন্দর সুর ভেসে আসছে। খুব কাছে কোথাও হবে। রঞ্জু হঠাৎ ওঠে দাঁড়িয়ে বললো,
- দোস্ত, চল।
- কোথায়? সুব্রত উৎকণ্ঠার সাথে বললো।
রেহানা বিশ্রি হেসে বলে উঠলো,
- আমাগো লগে ল, যাই। সুখ দিমু।
রঞ্জু কোন কথা বললো না। সুব্রতর হাত ধরে টেনে রাস্তায় নামিয়ে বললো,
- চল। ওয়াজ মাহফিল শুনবো।
- মাহফিল কোথায়?
- ঐ তো। মাইকে শোনা যাচ্ছে। খুরশিদ মহলের সামনে।
সুব্রত ভরসা পেলো। ওখানে অনেক লোকজন আছে। কোনো সমস্যা হবে না। পেছনে এক কোণায় বসে থাকা যাবে। রঞ্জুর হাত ধরে রাস্তায় নেমেছে সুব্রত। দ্রুত দৌড়ে পালাতে গিয়েও পা থমকে যাচ্ছে। রেহানা থু করে একগাল টকটকে লাল পানের পিক রঞ্জুর সামনে ফেলে আঙ্গুলের মাথা থেকে চুন মুখে দিয়ে অসভ্যের মতো হাসছে। খুব রাগ হচ্ছে সুব্রতর। এ কেমন নির্লজ্জ বেহায়া মেয়েরে বাবা। পিকের এক ফোটাও যে রঞ্জুর গায়ে পড়েনি তা নয়। প্রতিবাদ করলেই বিপদ। রঞ্জু তা ভালোই জানে।
দু’জন লুঙ্গি পরা লোক এলো। পুরাই মাতাল। গলায় মাফলার। মাথায় উলের টুপি। অবিন্যস্ত্য দাঁড়ি গোফ। পা দুটো টলছে। সমানে পান চিবোচ্ছে আর সিগারেট টানছে। একজন লুঙ্গির কাঁচা উরু পর্যন্ত তুলে হাঁটছে। অন্যজন রেহানার হাত ধরে টেনে বললো-
- ঐ মাগী, চল। দুইশ ট্যঁ’আ দিয়ুম।
ওদের কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। খেঁকিয়ে উঠলো রেহানা,
- পুরান মরদ, বাইক্যা মজা লুটতে আইছস। ছ্যাং কাডি হাতে ধরাই দিলে বুঝবি, মাগী কারে কয়। আগের ট্যাহা দে। এই লাইনে বাকি কাম নাই।
- ল’ চল। আগরগুন’অ দিয়ুম।
- আগে দে। তাইলে ভালা কইরা সোহাগ দিয়া দিমুনে।
অন্যজন পকেট থেকে দুইটা একশো টাকার নোট দেখিয়ে বললো,
- এই চা, একদম পেরেশ নোট। ল’ চল।
- ঐ শেফালি, এই মাদারি দেখি নতুন নাগরের সোহাগ লইতে দিবো না। চল আগে নগদ কিছু কামাইয়া লই। পরে দেহা যাইবো নে।
চোখের সামনেই ওরা ফুটপাত ধরে কিছুদূর গিয়েই অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো। সুব্রত হাঁফ ছেড়ে বললো,
- যাক বাবা, বাঁচা গেলো।
রঞ্জুকে দোষারোপ করে বললো,
- তোর জন্য আজ এই অবস্থা। এত কষ্ট পেতে হচ্ছে।
- আমি কি জানতাম, মুসলিম হলের ভ্যারাইটি শো’টা এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে?
- আমি তো কখনও ভ্যারাইটি শো দেখিনি। আমার জানার কথাও নয়।
- তাতে কী হয়েছে? আজ তো দেখেছিস।
- তা দেখেছি।
- জরিনার নাচটা কেমন লেগেছে বল?
- যেভাবে নাচলো, তাতে তো মনে হয়েছে ষ্টেজ ভেঙ্গে পরবে। ভাগ্যিস পরেনি।
- দেখেছিস তো, জরিনার সাথে কত মানুষ মাতালের মতো নাচলো।
- তা দেখেছি। ওরাও তো মাতাল।
- মাতাল বলেই তো মজা পেয়েছে। আমরা মাতাল হতে পারিনি, তাই মজাও পায়নি।
- মজার দরকার নেই। ভাগ্যিস রেহানা শেফালির পাল্লায় পরিনি, তাহলে মজা কী জিনিস হাঁড়ে হাঁড়ে বুঝিয়ে দিতো।
খুরশিদ মহলের সামনে হকার মার্কেট। মার্কেটের সামনে বিশাল প্যান্ডেল। সামিয়ানা ঠাঙ্গানো। অনেক লোক। সবার মাথায় টুপি। হুজুরদের সাথে সাথে আল্লাহু-আকবর ধ্বনি তুলে ওয়াইজ করছে সকলে। মাঝে মধ্যে আমেন বলে দু’হাত ওপরে তুলে স্রষ্টার কাছে ফরিয়াদ করছে।
রঞ্জু কিংবা সুব্রত এ ধরনের জিকিরে মোটেও অভ্যস্থ নয়। রেহানা, শেফালি কিংবা টং দোকানের মালিক সমশুমিয়ার ভয়ে এখানে পালিয়ে এসেছে। এখানে তেমন পরিচিত কেউ থাকার কথা নয়। কে কাকে চিনবে? কোনোভাবে রাতটা পার করতে পারলেই হলো। সকালের প্রথম বাসে বাড়ির পথ ধরবে। মাথায় রুমাল বেঁধে একেবারে পেছনের সারিতে ওরা দু’জন হাঁটু গেড়ে বসেছে। তাতে একটু আরাম বোধ হচ্ছে। কানের ঠা-াটা কম লাগছে। ভালোই হলো।
পাশে এক ভদ্রলোক মোনাজাত করছেন। বার বার আড়চোখে দেখছেন। বুকটা কেঁপে উঠলো সুব্রতর। তবে কি বুঝে ফেলেছে আমরা বিধর্মী? কীভাবে বোঝাবো? যদি কিছু মনে করে কিংবা আমাদের ভূল বুঝে থাকে। এদিকে রাত তিনটা বাজে। মাহফিল শেষের দিকে। মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে, মোনাজাত শেষে আপনারা সবাই তবরুক নিয়ে যাবেন। সব ভক্তপ্রাণ মুসুল্লিরা যেমন করছেন, রঞ্জু ও সুব্রতও দুইহাত উপরে তুলে একইভাবে মোনাজাত করছে। সুব্রত ভাবলো, সৃষ্টিকর্তা তো এক। আমরা আমাদের মতো ডাকছি। সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয় আমাদের সহায় হবেন। এই বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন।
মোনাজাত শেষ করেই পেছন থেকে একজন জিজ্ঞাসা করলো, তোমাদের নাম কী?
যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়। লোকটি পেছনে থাকায় এতক্ষন সুব্রত কিংবা রঞ্জু কেউই খেয়াল করেনি। লোকটির বিদঘুটে চেহারা। চোখ দুটো লাল। মোটা গোঁফ। কুচকুচে কালো গায়ের রং। রঞ্জু ভালো করে দেখে নিলো। কালো পাঞ্জাবি। অন্ধকারে কেউ হঠাৎ দেখলে ভয় পাবে। রঞ্জু সুব্রতর উরুতে চিমটি কাটলো। সুব্রত বুঝে নিলো এ আরেক বিপদ। যেভাবে হোক সামাল দিতে হবে। রাত আর বেশি নেই।
কোনো জবার না পেয়ে লোকটি চোখ বড় করে তাকালো। গোঁফে বাম হাত বুলিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলো,
- নাম কী?
- আবদুস শুক্কুর। জবাব দিলো রঞ্জু।
- বাড়ি কোথায়?
- নোয়াপাড়া।
মনে হলো ল্যাটা চুকে গেছে। মাহফিল শেষ। যে যার মতো ওঠে তবরুকের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এক এক করে সবাই পলিথিনে করে তবুরুক নিয়ে যে যার মতো ফিরে যাচ্ছে। রঞ্জু আর সুব্রত প্যান্ডেলের একপাশে এসে দাঁড়িয়েছে। একটু সুযোগ পেলেই ফিরে আসবে সমশুমিয়ার দোকানে। এছাড়া আর কোথাও যাবার উপায় নেই। পা বাড়ালো রঞ্জু। পেছন থেকে রঞ্জুর পিঠে হাত রেখে লোকটি বললো-
- মাহফিলে এসেছো। তবুরুক না নিয়ে কোথায় যাচ্ছো? চলো তোমাদেরকে তবুরুক নিয়ে দিচ্ছি।
- গরুর মাংস খাওয়া নিষেধ। আমার এলার্জি আছে। বললো সুব্রত।
- দুজনেরই এলার্জি?
- হুঁম। সায় দিলো রঞ্জু।
এবার আসল কথাটা বলেই ফেললো লোকটি।
- আমি তোমাদের অনেক্ষণ ধরে ফলো করছি। চলো আমার বাসায় চলো। কোনো অসুবিধা হবে না।
লোকটির কথা বলার ধরণ দেখে পিলে চমকে গেলো। শেফালি রেহানার চাইতেও বড় ভয়। লোকটির চেহারা দেখে রঞ্জু ভয় পেয়ে সবকিছু খুলে বললো। লোকটি আর কিছু বলেনি। রঞ্জু আর সুব্রত আবার সমশুমিয়ার দোকানে পা গুটিয়ে বসে দু’কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে ভাবছে, কখন সকাল হবে?