বিলের ধান কাটা শুরু হবে।
রহমতের আনন্দের শেষ নেই। কদিন ধরে রহমত স্ত্রী গুল মেহেরের সাথে খুব ভালো ব্যবহার করছে। স্ত্রীর সাথে সাত কথা পাঁচ কথা বলছে। আজও বারান্দায় বসে স্ত্রীকে ডেকে বলছে, এবার ফসলটা ভালা হইছে বউ। ক’দিন পরেই ধান কাটা শুরু হইবো। ধান কাটা হইয়া গেলে তোমার লাইগা একখান টেলিভিশান কিনুম। তয় কালার না, সাদা কালা। তুমি মাঝে মইধ্যে সিনামা দেখতে পারবা। বাজারের টেলিভিশনে সিনেমার নায়িকাগো নাচ দেখলে মাথা আউলা হইয়া যায়। মাথায় খালি চক্কর মারে।
সাত বছরের মেয়ে তুলি। ওকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে। নিজের হাতে মুখ ধুইঁয়ে দিয়েছে। কোলে বসিয়ে মেয়েকে আদর করে বলছে, আইজ আমার তুলি মায়েরে ক্ষেতে নিয়া যামু। আমার তুলি মা হইলো সাইক্ষ্যাত লক্ষী। কী সোন্দর ধান হইছে! আমার লক্ষী মাইয়াডা একবার চক্কর দিয়া আইলেই জমির ধানে গোলা ভইরা যাইবো।
রহমতের চোখে স্বপ্ন। দিন দিন ধানগুলোর রং পাল্টে যাচ্ছে। এই সেদিনও সবুজ মাঠ ছিল। এখন হালকা সোনালী রং হয়েছে। এবার তেমন একটা মড়ক পড়েনি। সকালে তুলিকে নিয়ে জমির আইল ধরে হাটছিল। কুয়াশায় পা ভিজে যাচ্ছে। রহমতের লুঙ্গিটা কোঁচা করে বাঁধা। খালি পায়ে বাবার হাত ধরে হাটছে তুলি। আলের কোন এক জায়গায় এখনও ভেজা কাঁদা মাটি রয়ে গেছে। রহমত মেয়েকে কোলে করে কাঁদাজল মাড়িয়ে পাড় করে দিয়েছে।
- বুঝলি মা, আর কয়দিন প’র পৌষ মেলা। ত’রে এবার মেলায় লইয়া যামু। তুই যা ক’বি তাই লইয়া দিমু।
- কী লইয়া দিবা বা’জান?
- কইলাম তো, তুই যা ক’বি তাই। ক’ তুই কী ল’বি।
- আমারে তুমি আলতা, চুড়ি আর লাল ফিতা কিইন্যা দিবা।
- আইচ্ছা তাই কিইন্যা দিমু। একটা লাল জামাও লইয়া দিম্।ু লাল জামার লগে এসব পড়লে আমার তুলি মায়েরে যা সোন্দর লাগবো না!
তুলি খুশি হয়। জমির আলের উপর দু’টো খেজুর গাছ। রহমতের নিজের গাছ। প্রতিদিন বিকালে এসে খেজুর গাছ কেটে মাটির হাঁড়ি বসিয়ে দেয়। রাতে একবার এসে দেখে যায়। যা রস পায় তা একটা বড় হাঁড়িতে ঢেলে বাড়ি নিয়ে আসে। আবার খালি কলসি বসিয়ে দেয়। পাশেই নদীর ধারে আরো কয়েকটা খেজুর গাছ। মেম্বারের গাছ। রহমত ঐ গাছগুলোও বর্গা নিয়েছে। ওগুলো থেকে যা রস হয়, সেগুলো তিন দিন গেরস্থের আর চারদিন রহমতের। তারপরও পাড়ার কিছু দুষ্ট ছেলে রাতে এসে রস খেয়ে যায়। কাঁচা রস খেতে খুব মজা। তাই মাঝে মাঝে পাহাড়া দিতে হয়।
কুয়াশার চাদরে চারপাশ ঝাপসা। রহমত প্রথম গাছে উঠেই রসের হাড়িটা সাবধানে নামিয়ে আনলো। শীতের প্রথম খেজুর রস। হাঁড়িটা মাটিতে রাখার আগেই একটা সাদা কাপড় কলসির মুখে বেঁধে রসটা ছেঁকে নেয়। তুলিকে এক গ্লাস কাঁচা রস দিয়ে বলল-
- ল’ মা, খাইয়া ল। এই শীতের পরথম রস। খালি পেটে খাইলে মেলা শক্তি হয়। শইল ভালা থাকে। এমন খাটি রস আর কই পাবি মা?
তুলি এক চুমক খেয়ে বললÑ
- বা’জান রসটা বড়ই মিষ্টি। তারপর আর এক চুমুকে সব খেয়ে ফেলল।
- ল’ তাইলে আরেক গেলাস খা। অহনও মাটিতে রাখি নাই। তারপর আমিও এক গেলাস খামু।
রহমত মেয়েকে আরেক গ্লাস রস দিয়ে বলল Ñ
- খাইয়া ল।
তারপর নিজেও এক গ্লাস কাঁচা রস ঢকঢক করে গিলে আলহামদুলিল্লাহ বলে তৃপ্তির ঢেকুর তুলল। বড়ই শান্তি পাইলাম। চল এবার অন্য গাছের রস পাইড়া লই। তর মায়েরেও কাঁচা রস খাওয়াইতে হইবো। খাঁটি রস।
দু’টো জমির মাঝখানে পাড়ের মত একটু উঁচু জায়গা। তাতে কয়েকটা আমগাছ। একটি হিজল গাছ ও একটি খেজুর গাছ। মাঝখানে ছোট একটা শ্মশান মন্দির। খেজুর গাছটি রহমতের জমির পাড়ে উঠেছে বলে রহমত সেটা ভোগ করছে। মাঝখানের উঁচু জায়গাটা একটু প্রশস্ত। এক সময় হিন্দুদের শ্মশান ছিল। মরা পোড়ানো হতো।
শ্মশানসহ পুরো জমিটা ছিল খোকাবাবুদের। তখন দেশে যুদ্ধ চলছে। খোকাবাবুর এক ছেলে দুই মেয়ে। ছোট মেয়েটা কলেজে পড়ত। বড় মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে যুদ্ধের আগে। রহমতের তখন বার তের বছর বয়স। রহমতের বাবা মোতালেব মিয়া খোকা বাবুদের জমি-জিরাত দেখাশুনা করত। চাষবাস করত। সাথে রহমত বাবাকে সাহায্য করতো। একদিন রাতে মোতালেবের ডাক পড়ল খোকা বাবুর ঘরে। সাথে রহমতও গেল। মোতালেবের অনেক চিন্তা। এত রাইতে বড় বাবু কেন ডাকল? দ্যাশের অবস্থাও ভালো না। মোতালেব কড়জোড়ে মিনতি করে বলল, বাবু ক্যান ডাকছেন? কোন অসুবিধা হইছে? খোকাবাবু মোতালেবের কাঁধে হাত রেখে ঘরের ভিতর নিয়ে ফিসফিস করে কিছু কথা বলল। খোকাবাবুর চোখে মুখে উদ্বেগ, উৎকন্ঠা। চোখ ঠিকরে বের হচ্ছে ঘৃণার আগুন। পেছনে কড়া নাড়ছে দেশপ্রেম। কিন্তু দেশপ্রেম দিয়ে মেয়ের ইজ্জত রক্ষা হবে কী করে? তারপর হাতে একটা চাবি আর কিছু কাগজ দিয়ে বলল, তুই দেখে শুনে রাখিস। চাষবাস করে নিজে ভালোই চলতে পারবি। আর ছেলেটাকে মানুষ করবি।
রহমত শুনেছে সেদিন সন্ধ্যায় গ্রামের আলী মাতব্বর কয়েকজন সাঙ্গ পাঙ্গ নিয়ে এসেছিল। খোকাবাবুর সাথে বাড়াবাড়ি হয়েছে। যে মাতবর খোকাবাবুর সামনে কখনও চোখ তুলে কথা বলতে সাহস করেনি, সেই মাতবর খোকাবাবুকে শাসিয়ে গেছে, অহন দিন আমাগো। থাকতে হইলে আমাগো কথামত থাকতে হইবো। না হইলে তোমাগো মাসীর দ্যাশে চইলা যাও। নাইলে এমন সোন্দরী মায়া ঘরে রাইখা বেশিদিন থাকতে পারবা না। শেষে মানও যাইবো, ইজ্জতও যাইবো। দিনকাল খুউব খারাপ।
পরদিন সকালে রহমত বাবার সাথে গিয়ে দেখে খোকাবাবুরা কেউ নেই। সদর দরজায় তালা ঝুলছে। এক রাতের মধ্যে বাড়িশুদ্ধ লোক কোথায় গেল কেউ জানতে পারেনি। মোতালেব মিয়া ভাবে, আইজ বুঝি আইলো। খোকাবাবু আসে না। অপেক্ষা দিনগুলো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। একসময় যুদ্ধ থেমে যায়। দলে দলে অনেকে আবার দেশে ফিরে আসছে। খোকাবাবুরা আর ফিরে আসেনি। হয়তো ঘৃণায় কিংবা লজ্জায়। মাতবরের মত লোকের কাছ থেকে লুকিয়ে হয়তো স্বেচ্ছা পরাজয় মেনে নিয়েছে।
সেদিন রহমতরা খোকাবাবুর বাড়ীতে এসে আশ্রয় নিয়েছে। দরজা খুলে পুরো বাড়িটা যতœ করে ঝাড়– দিয়েছে। চৈত্র সংক্রান্তির দিনে খোকাবাবুর বউ নির্মলা দেবী যেভাবে নিজের হাতে সারা বাড়ি পরিষ্কার করতেন, ঠিক সেভাবে। মোতালেব বউকে ডেকে বলছে, ও বউ, তুমি তাড়াতাড়ি গোসল কইরা আসো। তারপর আগে বাবুদের তুলসি গাছের গোড়ায় বেশী কইরা পানি দাও। গাছটা শুকাইয় কাঠ হইয়া আছে। বাবু আইসা যদি এই অবস্থা দ্যাখে কী ভাববো? হাজার হোক বাবুদের খাইয়া পইড়াই তো বাইছা আছি। এই বাড়ি আমাগো কাছে আমানত রাইখা গেছে। আমি জানি না, এই আমানত আমি কীভাবে রক্ষা করুম। হে আল্লাহ, তুমি আমারে সাহায্য কইরো।
রহমতের মা এসে তুলসি তলায় পানি দেয়। বাড়ির সামনে ফুলগাছগুলোতে একর পর এক বালতি বালতি পানি ঢালে রহমত। উঠোন বাড়ি পরিষ্কার করে। অপেক্ষা করতে থাকে, আজ বুঝি খোকাবাবু আসবে। কোনদিকে এতটুকু ময়লা জমতে দেয়নি। বাবু এসে অপরিষ্কার দেখলে মনে কষ্ট পাবে। একসময় তুলসি গাছটা মরে যায়। নতুন করে আর লাগানো হয় না। সেখানে দু’টো লাউ গাছের লতা মাচাং বেয়ে লিক লিক করে ঘরের চাল ছুঁতে চলেছে। বেদীটা খালি পরে আছে। ফুল গাছগুলো মরে যায় একের পর এক। নতুন ফুল গাছ আর লাগানো হয়না। ওখানে ক’টা ধানি মরিচ, ক’টা ঢেড়স, শীতের দিনে কিছু ধনে পাতা ছিটিয়ে দেয়। তাতে নিজেদের প্রয়োজনটা মিটে। গোটা বাড়ির চেহারাটা আস্তে আস্তে বদলে গেলো। এখন সবাই জানে এটা রহমতের বাড়ি।
সারা গ্রাম রটে গেছে খোকাবাবুরা নেই। মান ইজ্জত নিয়ে যুদ্ধের ভয়ে পালিয়েছে। একদিন আলী মাতবরের সাঙ্গ-পাঙ্গরা এসে সব জমি দখল করে নিয়েছে। শুধু বাড়ী-ভিটা আর গড়াই বিলের দুই টুকরা জমি ছাড়া বাকী সবগুলো জমি এখন আলী মাতবরের। ব্যাপারটা এমন যে, দেশের অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। আলী মাতবরকে খুব বিশ্বাস করত খোকাবাবু। দেশের অবস্থা নিয়ে দুজনের মধ্যে আলাপ হতো। সেই বিশ্বাস নিয়ে জমির সমস্ত দলিল পত্র, সোনা দানা মাতবরের জিম্মায় রেখে ছিল খোকাবাবু। নেহায়েত ভালো মানুষ হিসাবে বিশ্বাস করেছিল খোকাবাবু। দেশে যুদ্ধ শুরু হলো। রাতারাতি আলী মাতবরের চেহারাও বদলে গেল।
পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে কিছুদিন আগলেও রেখেছিল। খোকাবাবুও নির্ভয়ে ছিল। যেদিন পাক সেনাদের খুশি করার জন্য খোকাবাবুর সেয়ানা মেয়েটার কথা বলল, তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল খোকাবাবু। তার আমানত ফেরত চাইল। আর তখনই মোক্ষম ছোবলটা মারল আলী মাতবর। খোকাবাবুর বুঝতে কষ্ট হলো না। এখানে আর এক মুহুর্তও নয়। আলমারির কোণায় এই দুটো দলিল পড়েছিল। তাই রহমতের বাবার হাতে দিয়ে বিশ্বাস করতে চেষ্টা করল। এরা হয়তো এটুকু ঠিকই রক্ষা করতে পারবে। মনে মনে ভাবল-আবার যদি কখনও এ দেশে অতিথি হয়ে আসি তাহলে হয়তো শান্তিতে মাথা রেখে দুটো রাত কাটাতে পারব। সেই রাতেই খোকাবাবুরা দরজায় তালা লাগিয়ে দিল।
কিছুদিন পর এক শুক্রবার জুমার নামাজের পর আলী মাতবর কয়েক জন পাকসেনা নিয়ে খোকাবাবুর বাড়ি এসে দেখে কেউ নেয়। মোতালেব মিয়া বাড়ির উঠনে বসে ওজু করছিল। অনেক খোঁজা খুঁজি করে বাড়ি ঘরের জিনিস পত্র তছনছ করল। শুধু তছনছ করে ক্ষান্ত হয়নি। রহমতকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে আগুন লাগিয়ে দিল। দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। গ্রামের কেউ এগিয়ে আসেনি। দূরে দাঁড়িয়ে ঠাঁই দেখছে মোতালেব। এদিকে মাতবর বার বার শাসিয়ে যাচ্ছেÑডান্ডির পুতের সবকিছু জিম্মায় লইছস তুই, না? হেরা কই আছে ক? মোতালেব অনেক কাঁদল। বলল, আমি ক্যামনে জানুম। কাইল রাইতে আমার হাতে চাবিটা দিয়া কইল, তুই একটু দেইখা রাখিস। আমি ক’দিনের জন্য বাইরে গেলাম।
পাকসেনারা কিছুই বিশ্বাস করতে পারছিল না। শেষে মাতবর তাদের কানে কানে কী যেন বলল। সাথে সাথে গর্জে উঠল রাইফেল। লুটিয়ে পড়ল মোতালেব। রহমতের মা বাড়ির পিছনে লুকিয়েছিল। বেগানা পুরুষের সামনে আসতে পারল না মোতালেবের স্ত্রী। পালিয়ে বাঁচল পেছনের দরজা দিয়ে।
শুন্য ভিটায় দাঁড়িয়ে কতদিন কেঁদেছে রহমত। কেমন হাহাকার করত বুকটা। যুদ্ধ শেষ হলো। স্বাধীনতার লাল সূর্যটা যখন দেখল রহমত, তখন ভাবল এবার হয়তো খোকাবাবুরা ফিরে আসবে। যারা পালিয়ে বেচেঁছিল তারা অনেকেই ফিরে আসছে। খোকাবাবুরা আর আসেনি।
গ্রাম ছেড়ে গা ঢাকা দিয়েছে আলী মাতবর। বেশ কিছুদিন শূন্য পড়েছিল ভিটেটা। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আর গ্রাম বাসীদের সহায়তায় দলিল দুটোর সুবাদে রহমতের জায়গা হলো খোকাবাবুর ভিটায়। সে ভোগ দখলে রাখবে খোকাবাবুর সম্পত্তি। রহমতের স্বপ্ন বুনা শুরু হলো। এক তালা ছনের ঘর হলো। মাকে নিয়ে সুখেই চলছিল। বাবার ক্ষতটা আজও ভুলতে পারেনি। বাবাকে কবর দেওয়া হলো খোকাবাবুদের শশ্মানে। এই খেজুর তলায়। ছোট শশ্মান মন্দিরটার পাশে। কেউ কেউ মুসলমানের কবর হিন্দুর শশ্মানে না দেওয়ার পরামর্শ দিল। শেষ পর্যন্ত রহমতের কথায় সবাই রাজি হয়।
খোকাবাবুদের সম্পত্তি কম ছিল না। সেই সম্পত্তির সুবাধে ধীরে ধীরে রহমতের উন্নতি হলো। অল্প কয়েক বছরে মাটির ঘর হলো। একমাত্র মাকে নিয়েই ভালো চলছিল দিনগুলো। মাঝে মাঝে বাবার মৃত্যুটা দগদগে ঘা এর মত যন্ত্রণা দিত। কিছুতেই আলী মাতবরের সেই দৃশ্যটা মন থেকে মুছতে পারছিল না। রাতে ঘুমাতে পারত না। কি এক যন্ত্রনায় ছটফট করত। মা বুঝতে পারে ছেলের কষ্ট। কিন্তু কী করবে? একমাত্র সন্তান রহমতকে নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে মা। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা মিলে মোতালেবের কবরে স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করে। শহীদের মর্যদা পায় মোতালেব। রহমত প্রতি বছর বাবার কবরে গিয়ে প্রতিজ্ঞা করে-যেদিন খোকাবাবুরা ফিরে আসবে সেদিন তাদের আমানত ফেরত দিয়ে মাতবরকে দুনিয়া থেকে শেষ করে দেবে। রহমতের এখন টগবগে যৌবন।
সময়ের সাথে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। পাঁচ ছয় বছর পর ফিরে এল মাতবর। ঠিক আগের দাপটে। আবার বিচার হলো। রহমতকে খোকাবাবুদের সবকিছু ছেড়ে দিতে হবে। শুধু রহমতের হাতে যে দু’টো দলিল আছে তা সে রাখতে পারবে। বাকী সব জমি আলী মাতবরের দখলে চলে গেলো। তার পরের বছর মাতবর গ্রামের মেম্বার হয়ে গেলো।
বাবার কবরের পাশে এই খেজুর গাছটাও ছাড়তে চাইনি মাতবর। ভাগ্যিস গাছটা সামান্য জমির দিকে ঝুঁকে ছিল। আজ এত বছর পর স্যাঁত সকালে তুলিকে নিয়ে খেজুরের রস পারতে গিয়ে রহমতের সব কথা মনে পড়ে যায়। কাঁধের গামছা দিয়ে চোখের জল মুছল। মনের বোঝাটা কিছুটা হালকা হলো। তুলিকে জড়িয়ে ধরে মনটা হু হু করে কেঁদে উঠল। তুলি ছোট মেয়ে। কী বুঝবে? বাবাকে বললÑ
- আব্বা তুমি কান্দো ক্যান?
- কই নাতো আম্মা। চোখে ময়লা পড়ছে। তাই চোখটা মুইছা নিলাম।
মেয়েকে মিথ্যা সাত্ত্বনা দেয় রহমত। তারপর থরথর করে গাছে উঠে গেল। নীচেই ধান ক্ষেত। কী সুন্দর সোনালী ধান। রস নামাতে গিয়ে উপর থেকে বার বার ক্ষেতের উপর চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল রহমত।
আজ নন্দনপুর গ্রামে পৌষ পাবণের মেলা বসেছে। আশে পাশে দশ গ্রামের মানুষের আনন্দ এই মেলাকে ঘিরে। প্রতিটা বাড়িতে নতুন ধানের পিঠা পায়েস। হরেক রকম পিঠা। রহমতেরও আয়োজনের কমতি নেই। আগের দিন রাতে রহমতের বউ রাত জেগে চাল গুড়া করেছে। খুব সকালে উঠে পিঠা বানাতে বসেছে। গরম গরম পিঠা। গরম রসে চুবিয়ে খেতে ভারী মজা। পেট ভরে খেয়েছে রহমত। তুলির বাটিতে আর একটা পিঠা দিয়ে বলল Ñ
Ñ ল’ মা আর একটা ল। তোর মার হাতের যশ আছে। মায়ের হাতের পিঠার মজাটাই আলাদা।
তারপর বউকে বললÑ
- ও তুলির মা, আমারে আরেকটা দাও। তুমিও খাইয়া লও। সকাল সকাল মেলায় যাইতে হইবো।
বউ বাধ সাধলÑ
- আমি যামু না। তুমি তুলিরে লইয়া যাও। ওরে কী কী কিনা দিবা কইছ তা কিইনা দিও। মাইয়াটা খুশি হইবো।
- হ হ সবই কিনা দিমু। তোমার জন্য কি লাগবে কও?
- আমার কিছু লাগবো না। আমার কী আর সাজনের বয়স আছে?
- কী যে কও না তুমি। কী এমুন বয়স হইছে? তোমারে কখনও একখান ভালা কাপড় কিইনা দিবার পারি নাই। তোমার লাইগা একখান লাল বেনারসী লমু। তোমারে যা মানাইবো না!
- পোলা পানের মতো কী সব কও না? বলে রহমতের বউ ঘরের মধ্যে ডুকে গেল। লজ্জা পেয়েছে।
সত্যিই তো। এই ঘরে আসার পর নিজের দিকে কখনও খেয়াল রাখতে পারেনি। চাষা ভুষার সংসার। গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগী, ক্ষেত-খামার এসবের মধ্যে সংসারটা সীমাবদ্ধ। সকালে মিজ্জি আজান আর মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে। তারপর একটানা খাটা খাটুনি। সন্ধ্যার আগে গরু-ছাগলকে খাইয়ে গোয়ালে বেঁধে তারপর রান্না বান্না। হাতে কিছু সময় থাকলে ধান ভানা, চালগুলো চালুনিতে চেলে আলাদা করা। ধানের বীজগুলো যতœ করে রাখা। সংসারের কত কাজ। কখন যে সময় চলে যায় টেরও করতে পারে না। আজ রহমতের মুখে লাল বেনারসীর কথা শুনে মনটা কেমন করে উঠল। লজ্জায় দৌড়ে গিয়ে আলমারির সাথে লাগানো আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখল। চোখের নীচে কালি পড়ে গেছে। মাথার চুলগুলো এলোমেলো। চিরুনি দিয়ে মাথা আঁচড়ে নিল। ছেড়া আধময়লা শাড়িটা মাথার উপর টেনে ধরে বউ সাঁজার ভান করল। ওদিকে রহমত ডাকছেÑ
- ও বউ কই গেলা। বেনারসীর কথা কইছি দেইখা লজ্জা পাইছ না? আরে লজ্জা কর ক্যান? আমাগো একটা মাত্র মায়া। মা’টা বিছানায় পড়া। আমি জানি তোমার খুব কষ্ট হইতাছে। কি করুম কও, গরীবের ঘরে বউ হইয়া আইছ। এটুকুন কষ্ট তো মাইনা লইতে হইবো। লও তুমিও লও। মেলায় গিয়া ঘুইরা আসি। আমার তুলি মায়েরেও সাজাইয়া দাও।
- আমি গেলে ঘরে মা’রে কে দেইখবো।
- হাঁছাই কইছো। আইচ্ছা তোমার লাইগা কী আনুম কও?
- তোমার যা মন চাই তাই আইনো। মাইয়াডারে লইয়া যাও। পারলে একটু নাগরদোলা চড়াইয়ো। মাইয়াডার নাগরদোলা চড়নের খুব সখ।
- আইচ্চা বাবা আইচ্ছা। চড়ামু। তোমার অতো ভাবতে হইবোনা। মাইয়াডা হইলো আমার পরাণ। আমার কইলজার টুকরা।
মেলায় লোকে লোকারণ্য। চারিদিকে দোকানিরা পসরা সাজিয়ে বসেছে। নতুন ধানের খই, চিড়া, মুড়ি, বাতাসা। সারি সারি কত রকমের খেলনার দোকান। মনিহারি দোকান। দূর দুরান্ত থেকে ছেলে-মেয়ে বুড়ো-বুড়িরাও ছুটে এসেছে। এটাই এই অঞ্চলের একমাত্র মেলা। সবার মনেই আনন্দ। একদিকে যাত্রাপালা। একদিকে সার্কাস। অন্যদিকে নাগরদোলা, চড়কি। বাবার সাথে মেলায় এসে খুব আনন্দ পাচ্ছে তুলি। নাগরদোলায় চড়তে গিয়ে কিছুতেই উঠতে চাইছে না। তুলির ভয় করছে। শেষ পর্যন্ত রহমত নিজেও মেয়ের সাথে নাগরদোলায় উঠে বসেছে।
এবার তুলিকে সার্কাস দেখালো। মানুষের কত রকমের কসরত। যাদুর খেলা, সাইকেলের খেলা। মেলা সাতদিন থাকবে। রহমত ভাবছে একদিন বউকে নিয়ে এসে যাত্রাপালা দেখাবে। মেয়ের জন্য চুড়ি, আলতা, রঙিন ফিতা, লাল জামা সবই কিনা হলো। সাথে দুটো পুতুলও কিনেছে তুলি। রহমত না করেনি। এইতো ক’দিন আগে নতুন ধান বিক্রি করে ভালোই দাম পেয়েছে। সারা বছরের খাওয়ার ধানও রেখেছে গোলায়। ঠিক করেছে এ বছর মেয়েটাকে একটা প্রাইভেট মাষ্টার দিয়ে পড়াবে।
এবার শাড়ীর দোকানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছে। বউয়ের জন্য একটা শাড়ী কিনবে। কিছুতেই পছন্দ করতে পারছে না। তুলিই বার বার বলছে, আব্বা এইটা না, ওইটা লও, ওইটা না, এইটা লও। এইটার রং কেমন? মায়ের রংটা তো শ্যামলা। এই শাড়িটা মানাইবো না। চলো অন্য দোকানে ঘুইরা দেহি। রহমত ভাবছে এতটুকু মেয়ে এত কিছু জানে কী করে। সে বউয়ের জন্য যতবার শাড়ি কিনেছে, এভাবে দেখে কিনতে পারেনি। যা কিনেছে তাই পড়েছে গুলমেহের। কখনো বলেনি যে, এটা পছন্দ হয়নি। তাই রহমতও এসব নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি।
ওদিকে রহমতের বউ পশ্চিমের বিল থেকে গরু নিয়ে এসে দেখে কে একজন তুলসী তলায় বেদীর নীচে দাঁড়িয়ে আছে। পোশাক আশাক বেশ পরিপাটি। পরনে সাদা ফতুয়া আর প্যান্ট। চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। তুলসীর বেদীটায় হাত বুলিয়ে দেখছে। গুল মেহের অপরিচিত লোক দেখে শাড়ির আঁচলটা টেনে দিল। ভেতর থেকে রহমতের মা চিৎকার করছে, ও বউ আমারে একটু পানি দিয়া যা। কই গেলি? পোলাটাও নাই। রহমতের বউ কে গরু নিয়ে আসতে দেখে জিজ্ঞাসা করলÑ
- রহমত ঘরে আছে?
- নাই। মাইয়ারে লইয়া মেলায় গ্যাছে। আপনে কেডা?
- আমি নরেন। আমাকে চিনবেন না। রহমত কখন আসবে?
- চইল্যা আইবো। গ্যাছে তো হেই সকালে। এখন বেলা পইড়্যা আইলো।
- ঠিক আছে। আমি ততক্ষণ পুকুর ঘাটে গিয়ে বসি। চাচীর বুঝি খুব অসুখ।
- হ। একবছর ধইরা বিছানায়। উইঠা বসতে পারে না। পেরালাইজ।
- আচ্ছা। ঠিক আছে। রহমত আসলে আমি চাচীকে দেখে যাবো।
রহমতের বউয়ের কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। নরেন রহমতের সমবয়সী। খোকাবাবুর ছেলে। আজ এতদিন পর নিজের জন্মভূমিতে এসে সবকিছুকে কত আপন মনে হচ্ছে। চারিদিকে সব বড় বড় বাড়ি ঘর। নিজেদের পুরানো বাড়িটা নেই। পুকুরের পাকা ঘাটটির পলেস্তারা খসে পড়েছে। অথচ এত দিন পড়েও মায়ার বন্ধন এতটুকু কমেনি। নরেন ইচ্ছে করলে এ জন্মভিটিতে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারে।
রহমতকে পেয়ে নরেন বুকে জড়িয়ে ধরেছে। রহমতও চিনতে পেরেছে। এ যে আমাদের ছোটবাবু। নরেনকে বাড়িতে নিয়ে এলো। নতুন চালের পিঠা খাওয়ালো। রহমতের মনের মধ্যে কোথায় যেন একবিন্দু বৈষয়িক চিন্তা ভর করছে। ছোটবাবু ফিরে এসেছে। তার সবকিছু ফিরিয়ে দিতে হবে। আবার ভাবছে, যাক এবার আমি মুক্ত। সবকিছু নরেনকে বুঝিয়ে দিতে পারলে আমার শহীদ আব্বার আত্মা শান্তি পাবে।
আজ এতদিন পর মুনিব এসেছে। ব্যাস্ত হয়ে পড়লো রহমত। কী খাওয়াবে, কোথায় বসাবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। খেজুর গাছগুলো আর একবার ছেঁচে দিতে হবে। কাল সকালের কাঁচা রসটা ছোটবাবুকে খাওয়াতে হবে। রহমত খেজুর গাছ কাটার দাও’টা হাতে নিল। চিক চিক করছে দা। তীক্ষ ধারালো। হাত দিয়ে ধারটা পরখ করে নিলো। হাতের ইশারায় দা’এর হালকা আঁচড়ে পরতে পরতে উঠে আসে খেজুর গাছের ছালগুলো। একপাশে কোমড়ের সাথে কাঠের আংটা দিয়ে ঝুলিয়ে নিল চারটা মাটির হাড়ি। নরেনকে বলল, ছোটবাবু আপনে একটু বইয়েন। আমি হাড়িগুলান বসাইয়া আসি। কাইল আপনেরে কাঁচা রস খাওয়ামু।
তুমি এত ব্যাস্ত হচ্ছো কেন? আস্তে আস্তে তুমি তোমার কাজ করো। এর মধ্যে আমি বাড়ির চারপাশটা একটু ঘুরে দেখি। সবকিছু কত দ্রুত বদলে গেলো। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আজ রাতটা আমি তোমার বাড়িতে শান্তিতে ঘুমাবো। কাল আমিও তোমার সাথে পৌষ পাবণের মেলা দেখতে যাবো। কতদিন যাওয়া হয়নি।
পড়ন্ত বিকেলের সোনা রোদটা জ্বলজ্বল করছে। পশ্চিমের বিলের পাশ দিয়ে সরু খালের পাশ ধরে শ্মশানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে রহমত। হাতে দা। সোনা রোদে চিক চিক করছে দা’এর ধারালো অংশটা। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে খেজুর গাছের নীচে শুয়ে থাকা শহীদ মোতালেব মিয়ার স্মৃতিসৌধ।
রহমতের ভিতরের মানুষটা আরেকবার জেগে উঠল। মাথায় জ¦লে উঠল প্রতিশোধের আগুন। একবার স্মৃতিসৌধ আর একবার দাওটার দিকে তাকায়। তেমোহনী খালের পশ্চিম দিক থেকে লুঙ্গির এক কাঁচা অনেকটা কোমড়ে তুলে বাঁশের সাঁকো পার হয়ে আসছে আলী মাতবর। পৌষের পড়ন্ত বিকেলের রোদটা হঠাৎ রক্তবর্ণ হয়ে উঠল। রহমত এবার তাকায় আলী মাতবরের দিকে। আরেকবার হাতের দাওটার দিকে। এদিকে ঘরে ছোট বাবু আছে। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। খুব দ্রুত পা ফেলে রহমত। সামনে আলী মাতবর। তাড়া খাওয়া কুকুরের হৃদপিন্ডের মত দ্রুত উঠানামা করতে থাকে মাতবরের বুক। লুঙ্গির কাঁচা ছেড়ে দিয়ে দ্রুত উল্টাদিকে দৌড়াতে থাকে মাতবর। পেছনে রহমত।
দৌড়াচ্ছে তো দৌড়াচ্ছে।