কথা বলা পুতুল

বর্ষা (আগষ্ট ২০১১)

রুহুল আমীন রাজু
  • ২০
  • 0
  • ৬১
লোহাজুরী ইউনিয়ন পরিষদ মাঠে লোকে লোকারন্য। আজ রইব্যা চোরের শক্ত বিচার করা হবে। কুদ্দুছ মন্ডলের গাছ থেকে গত রাতে রইব্যা কাঁঠাল চুরির সময় হাতে নাতে ধরা পড়েছে। গত পরশুও হাছেন বেপারীর বাড়িতে মুরগী চুরি হয়েছে। প্রতি রাতেই কোন না কোন বাড়ীতে এটা সেটা চুরি হচ্ছেই। ইতিপূর্বে রইব্যা চোর বহুবার ধরা পড়েছে। গ্রাম্য সালিশে তাকে পিটুনিসহ কানে ধরে উঠ-বোস ও নাকে খঁত দেওয়ানো হয়েছে। তবুও তার স্বভাব পরিবর্তন হচ্ছে না। তার অত্যাচারে গ্রামের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। কাজেই আজ তাকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে। লোকজন অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় বসে আছে চেয়ারম্যান সাহেবের জন্য। চেয়ারম্যান এলেই বিচার কাজ শুরু হবে।

মাঠে সবার মাঝখানে রইব্যা চোরকে একটা খুঁটিতে বেঁধে রাখা হয়েছে। রইব্যা মাটিতে চুপ করে বসে আছে। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে সে কখনো চোখ ঘুরিয়ে মানুষ দেখছে; আবার উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকছে। চুরি জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় রইব্যার কাছে বষর্াকালে চুরি করা নিরাপদ একটি সময়। এ সময় মানুষজন সহজে বাড়ীর বাইরে বের হয় না। কিন্তু আজ ঘটলো এর ব্যতিক্রম। আসলে 'চোরের দশদিন-গেরস্থের একদিন' প্রবাদটির সত্যতা যথার্থই। সে বুঝতে পারছেনা, আজ তাকে কি এমন কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে।
আছরের নামাজ পড়ে চেয়ারম্যান সাখাওয়াত হোসেন সালিশে উপস্থিত হলেন। চেয়ারম্যানকে দেখে লোকজন সবাই উঠে দাঁড়িয়ে ছালাম জানালো। চেয়ারম্যান লক্ষ্য করলেন, রইব্যা তাকে দেখে দাঁড়ায়নি এবং ছালামও দেয়নি।
ঃ কিরে রইব্যা, বেহায়া দাগী চোরতো অইলে অই, আবার তো দ্যাহি বেয়াদ্দপও অইয়া গেছস। সবাই আমারে দেইখ্খা খাড়াইলো আর তুইতো দ্যাহি বইয়া রইছস।
রইব্যা চোর নিরুত্তর।
চেয়ারম্যান এবার হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন, অই কুত্তার বাচ্চা, কতা কসনা কেরে?
রইব্যা চোর কেঁপে উঠলো। চেয়ারম্যান সাব...।
এ সময় সিরাজ মেম্বার চেঁচিয়ে উঠে বললো, এ্যাই হারামজাদা, ছার ক ছার।
ঃ ছার, খুডির লগে আমার হাতও বান্দা, পাউও বান্দা, উইটটা কেমনে খাড়ইবাম।
চেয়ারম্যান হু বলে চেয়ারে বসলেন। নতুন প্যাকেট খুলে একটা বেনসন সিগারেট ধরালেন। আয়েশ করে কিছুক্ষন ধুঁয়া টেনে সিগারেটের অবশিষ্ট অংশটি রইব্যা চোরের উপর ছুঁড়ে মারলেন। রইব্যা সঙ্গে সঙ্গে ওহ্ আহ্ করে চিৎকার শুরু করলো। এ দৃশ্যে চেয়ারম্যানসহ সবাই হা-হা-হা শব্দ করে হেসে উঠলো। একটু পর পাবলিকের কাছ থেকেও পাঁচ-সাতটা বিড়ির অবশিষ্ট অংশ এসে পড়লো রইব্যা চোরের উপর। রইব্যা এবার হাউমাউ করে চিৎকার শুরু করলো।
চেয়ারম্যান সাহেব পাবলিকের উদ্দেশ্যে কড়া একটা ধমক দিলেন।
ঃ কি করতাছেন আপনারা! মানবাধিকার লংঘন কইরেন না। আপনেরা আমারে ভোট দিয়া চেয়ারম্যান বানাইয়াছেন। আমি এই গেরামের বিচারক। যা করনের আমি করবাম।
চেয়ারম্যান সাহেব রইব্যা চোর সম্পর্কে গ্রামবাসীর অভিযোগ মনযোগ দিয়ে শুনলেন। গত রাতে কুদ্দুছ মন্ডলের গাছে কাঁঠাল চুরির সময় হাতে-নাতে ধরার কাহিনীও শুনলেন।
চেয়ারম্যান আরেকটা সিগারেট ধরালেন। কয়েকটা টান দিয়ে তা রইব্যা চোরের উপর ফের ছুঁড়ে মারলেন। রইব্যা এখন আর ওহ্ও করলো না আহ্ও করলো না। মনে হয় এটা তার সয়ে গেছে।
চেয়ারম্যান বিচারের রায় ঘোষনা করলেন :
'রইব্যার মাথা কামিয়ে গলায় জুতার মালা পড়িয়ে তাকে বাজারে ঘুরানো হোক। অত:পর তার দুই হাতের দুই আঙ্গুলে দুইটা দশ নম্বর সুঁই ঢুকিয়ে দেওয়া হোক।'
রায় ঘোষনার পর শাস্তির প্রথম পর্বটি উৎসব আমেজে সমাধা করলো লোকজন। এখন শাস্তি প্রদানের দ্বিতীয় পর্ব।
রাত দশটা বাজে। হ্যাজাক বাতি জ্বালানো হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ মাঠে এখন মানুষের উপস্থিতি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। দশ নম্বর সুঁই আনা হয়েছে। কিন্তু সুঁই ঢুকানোর জন্য সাহসী একজন লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। লোক খোঁজা হচ্ছে। রইব্যা চোর মনে মনে আল্লাহকে ডাকছে আর বলছে, 'মাবুদগো, আজগা যদি আমারে এই সুঁইয়ের আজাব থাইক্কা রক্ষা কর, তাইলে আমি আর কোনদিন চুরি করতাম না। মাবুদগো, সুঁই ঢুকাইবার লাইগ্গা এই রহম আজরাইল মানুষ যাতে খুঁইজ্জা না পায়।

রইব্যা চোরের প্রার্থনা আল্লাহ শুনেননি। লোক খুঁজে পাওয়া গেছে। পূর্ব পাড়ার দবির উদ্দিন চকিদারের পুত্র খবির উদ্দিন ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসেছে। খবির উদ্দিন পুলিশের নামকরা দারোগা। বিশ বছরের চাকরি জীবনে বহু চোর-ডাকাতকে পিটিয়েছেন তিনি। তিন ডাকাতকে হাজতখানায় পিটিয়ে হত্যা করার অভিজ্ঞতাও তার রয়েছে। পত্রিকায় নেতা পেটানোর ছবি বেশ ক'বার প্রকাশ হয়েছে। খবির দারোগা ঘটনাস্থলে এসে চেয়ারম্যানকে বললেন, এতো দূর্বল মন লইয়া চেয়ারম্যানগিরি কেমনে করবেন? দেন সুঁই দেন।
খবির দারোগা রইব্যা চোরের আঙ্গুলে সুঁই ঢুকানোয় বেশ দক্ষতার পরিচয় দিলেন। রইব্যা 'ওরে মায়াগো ওরে বাবাগো' বলে আকাশ কাঁপানো শব্দে চিৎকার করে উঠলো। তার এই গগনবিদারী চিৎকার শতাধিক মানুষের আনন্দ উল্লাস আর চেঁচামেচিতে হারিয়ে গেল। ইউনিয়ন পরিষদ মাঠে শতবষর্ী বটবৃক্ষ লক্ষ্য করল, রইব্যা চোরের বুকফাটা চিৎকারের চেয়ে নির্দয় মানুষগুলোর উল্লাসের চিৎকারটিই প্রাধান্য পেল বেশি।
লোকজন আস্তে আস্তে করে যার যার বাড়ি ফিরতে লাগলো। কিছুক্ষন পর ইউনিয়ন পরিষদ মাঠ ফাকা হয়ে গেল। হ্যাজাক বাতি আর নেই।
অন্ধকারে পড়ে আছে রইব্যা চোর। রইব্যা নিজেই দাঁত দিয়ে কামড়ে সুঁই দুইটা উঠালো। আঙ্গুল দিয়ে তীরের গতিতে রক্ত ছুটছে। দূর্বা ঘাস চিবিয়ে আঙ্গুলে চেপে ধরার পর রক্ত পড়া কিছুটা বন্ধ হলো। ব্যাথাটা কমছে না। ক্ষুধাও লেগেছে প্রচন্ড। কঠিন এক যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে সে। গভীর ভয়ার্ত এই রাতে কেউ নেই তার পাশে। তবে ব্যাথা ও ক্ষুধা রইব্যাকে পাহারা দিয়ে রেখেছে। নতুবা নিস্তেজ হয়ে গেলে এতোক্ষনে তাকে শিয়াল-কুকুরে খেয়ে সর্বশেষ শাস্তির ব্যবস্থাটাও করে দিতো। 'ক্ষুধা মানুষকে যেমন মৃতু্যর দিকে ধাবিত করে-তেমনি কখনো কখনো বাঁচিয়েও রাখে।'
কাঁঠাল চুরির অপরাধে নির্মম শাস্তির শিকার আজকের রইব্যা কিছুদিন আগেও ছিল মোঃ রবি মিয়া। তার ঘরে গোলা ভরা ধান আর গোয়াল ভরা ছিল গরু। ছিল পুকুর ভরা মাছ। নদী ভাঙ্গন এবং মিথ্যা মামলার কবলে পড়ে নিঃস্ব হয়ে যায় সে। অবশেষে নিরুপায় হয়ে চুরি পেশায় নামতে বাধ্য হয়। এরপর থেকেই তার নাম রবি মিয়া পাল্টে হয়ে যায়-রইব্যা। রইব্যা চোর।
রইব্যা উঠে দাঁড়ালো। শরীরটা থর থর করে কাঁপছে। পা টেনে টেনে বহু কষ্টে বাড়ি পৌছলো সে। বাড়ি এসে বউকে ডাকার সাহস পেলো না। চুপ করে বারান্দার এক কোনে বসে রইলো। আঙ্গুলের ব্যাথায় গোঙানীর একটা শব্দ হতে চায়ছে। কিন্তু তার স্ত্রীর বকাবকির ভয় থেকে বাঁচতে শব্দটা সে অতি কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। রইব্যা ভাবছে, কি ঘৃনীত তার এই চুরি পেশাটা। ঘরের বউও তাকে পছন্দ করে না। আবার সে একটা জিনিস ভেবে পায় না যে, সাখাওয়াত চেয়ারম্যানকে গত বছর পুলিশ রিলিফের এক ট্রাক গম চুরির অপরাধে থানায় ধরে নিয়ে গেল। অথচ একটু পরেই তাকে ছেড়ে দিলো। চেয়ারম্যানের আঙ্গুলে সুঁই ঢুকানো তো দূরের কথা, একদিনের জেলও তার হয়নি। তবে কি বড় চোরের বিচার নাই!
রইব্যা লক্ষ্য করলো, তার ছোট মেয়েটা এখনো ঘুমায়নি।
ঃ মায়া- মায়া, ও মায়া, বাজান অহনো আইয়ে না কেরে?
ঃ তর বাজানের আওনের টাইম অহনো অইছে না।
ঃ কোন সময় অইবো গো মায়া?
ঃ ফজরক্ত, ঘুমা হারামজাদী।
ঃ আমার লাইগগা আজগা যদি পুতুল না আনে বাজানের লগে আর কতা কইতাম না।
ঃ ও জাউরীর ঘরের জাউরী, চুপ করবি না চুল ধইরা দিতাম টান! ভাত খাওয়ানের মরদ নাই, হেয় আইন্না দিব তরে পুতলা? বেটারির পুতলা! চাবি দিলে কতা কয়-নাচে! অই হারামজাদী, জানছ এই পুতলার দাম কত?
ঃ কত ট্যাহা মায়া?
ঃ তরে বেচলেও এ্যাই ট্যাহা অইতো না।
ঃ তয় বাজানদি কইছে পুতুল আইজগা আইন্না দিব অই।
ঃ তর বাজান ত কত কতা অই ক। আমারে দুইডা লুপার চুড়ি বানাইয়া দিব কইছে হেই কবে.... অহনো দে অই। চোরের ঘরের চোর। রাইত পোআইলে ঈদ, চোরটার খবর নাই। মুখে দুহাত চেপে ধরে কাঁদতে লাগলো রইব্যার স্ত্রী মদিনা। মেয়েটা অন্ধকারেই ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে পথের দিকে-কখন তার বাবা আসবে। নিয়ে আসবে পুতুল। এবারের ঈদে তাকে একটা বেটারির পুতুল কিনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তার বাবা।
পুতুল, রুপার চুড়ি, ঈদ-ঈদের বাজার, পুতুল.... শব্দগুলো রইব্যার বুকে বার বার ধাক্কা দিচ্ছে। ধাক্কার চোঁটে রইব্যা উঠে দাঁড়ালো। শরীরটা ঝাড়া দিয়ে আকাশের দিকে তাকালো সে। রাত পোহাতে আরো বেশ কিছু সময় এখনো বাকী আছে। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়া শুরু হয়ে গেছে। গরুশূণ্য গোয়াল ঘরে লুকিয়ে রাখা ছোঁরা বের করে আনলো রইব্যা। চুরি জীবনে আজ এই প্রথম ছোঁরা কমরে গুঁজে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো সে......
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
কৃষ্ণ কুমার গুপ্ত গভীর ভয়ার্ত এই রাতে কেউ নেই তার পাশে। তবে ব্যাথা ও ক্ষুধা রইব্যাকে পাহারা দিয়ে রেখেছে। নতুবা নিস্তেজ হয়ে গেলে এতোক্ষনে তাকে শিয়াল-কুকুরে খেয়ে সর্বশেষ শাস্তির ব্যবস্থাটাও করে দিতো। 'ক্ষুধা মানুষকে যেমন মৃতু্যর দিকে ধাবিত করে-তেমনি কখনো কখনো বাঁচিয়েও রাখে।' এই লাইনটা অসাধারন লিখেছেন। খুব সুন্দর উপলব্ধি। খুব সুন্দর গল্প। অনেক ভাল লাগা রইলো। অসাধারণে ভোট দিলাম।
মিজানুর রহমান রানা গল্পটি ভালোই লেগেছে। ধন্যবাদ পাবার যোগ্য।
সূর্য *****এই হৃদয়ছোয়া গল্পের আরো পাঠক পাওয়ার অধিকার রয়েছে।*****
সূর্য ভাষাটা ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, এবং ময়মনসিংহের ভাষার সাথে মেলে। গল্প হিসাবে বেশ স্বার্থক বলা যায়।
নিরব নিশাচর .................. ফারদিন ফারহানের " একটি অন্য রকম মায়ের গল্প" (মা সংখ্যা) এর পর আজকে আপনি আরেকবার আমার কন্ঠনালীটা শুকিয়ে দিলেন... পছন্দের তালিকায় তো নিলামই সেই সাথে ৫/৫...
Akther Hossain (আকাশ) ভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখা ভালো লাগলো !
আহমাদ মুকুল ভাষাটা বৃহত্তর ময়মনসিংহের সাথে মেলে।

০৬ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী