মা

মা (মে ২০১৯)

রুহুল আমীন রাজু
  • ৯৪
মুঠোফোনের রিংটোনটি মাঝে মাঝে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয় সপ্তর্ষিকে। কোনটা কোকিল আর কোনটা রিংটোন, বুঝা বেশ মুশকিল। ঢাকা শহরে কোকিলতো দূরের কথা কাকও এখন বিলুপ্তির পথে। যখন সে ঢাকাতে ছাত্রী নিবাসে অবস্থান করে থাকে, তখন বেশ কিছু সময় পর মনে হয় রিংটোন। গ্রামের বাড়িতে থাকাকালীন রিংটোন ও প্রকৃত কোকিলের ডাকে ফোনটা’ই অনেক সময় ধরা হয়ে উঠে না তার।
কোকিল ডাকছে মুঠোফোনে...
: হু বলো।
: হ্যালো সপ্তর্ষি, খুব মনোযোগ দিয়ে কথাটি শোনো...
: বলো শুনছি...তুমি আমাকে হত্যা করতে বলছো !!
: এটাকে তুমি হত্যা বলছ কেন ?
: তাহলে কি বলবো, খুন ? মার্ডার ?
: আহা, এটা হত্যা-খুন... এ জাতীয় কিছুই নয়।
: আচ্ছা, তুমি কি সেকেলেই থেকে যাবে... নাকি আধুনিকতায় প্রবেশ করবে ?
: হত্যা করলে আধুনিক হওয়া যায়, বাহ আকাশ বাহ-চমৎকার বলেছো!
: দেখো সপ্তর্ষি, বৃহত্তর স্বার্থে কঠিন কিছু করতে হয়। যেমন ক্রসফায়ার।
: তুমি ক্রসফায়ার সমর্থন করো ?
: অফকোর্স, সন্ত্রাসীদের এভাবেই দমন করা উচিত।
: অফকোর্স নট। বিচার বহির্ভূত ভাবে শুধু মানুষ কেনো, কোন পশু- জানোয়ারকেও হত্যা করা উচিত নয়। তবে কি তোমার অনাগত সন্তান -অপরাধী ? যে তাকে র‌্যাবের হাতে তুলে দিতে হবে !
: হাউ ষ্ট্র্যাঞ্জ আর ইউ ! এটাকে এভাবে দেখছো কেন ? এটাতো চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটা অংশ-গর্ভপাত। ভ্রূণটাকে ধ্বংস করে দেওয়া। এখন খুব সহজ পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। তুমি একটুকুও ব্যথা পাবে না। সামান্য পিঁপড়ার কামড়। আমি মালিবাগে একটা ক্লিনিকে কথা বলে সব ঠিক করে রেখেছি। আগামী কালই চলো ওখানে।
: আকাশ, দেহে হয়তো আমি ব্যথা পাব না, কিন্তু মানসিকভাবে ভীষণ কষ্ট পাব। আমি সহ্য করতে পারব না। না আকাশ , আমি এই কাজ করতে পারব না, কিছুতেই না।
: প্লিজ সপ্তর্ষি, পাগলামো করো না।
: আমি একটুও পাগলামো করছি না। ও এখন আর ভ্রূণ নেই। পাঁচ মাস হয়ে গেছে। গত পরশু আল্ট্রাসনোগ্রাফ করিয়েছি। ছেলে হয়েছে। জানো, দেখতে কি যে সুন্দর হয়েছে ! থ্রি-ডি আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে রঙ্গিন ছবি তোলা হয়েছে। ওর নাক-মুখ পেয়েছে সব তোমার। চোখ দুটো মনে হয় আমার মতো হবে। কি যে এক অদ্ভুত আনন্দের ঝরণা ধারা বইছে আমার ভেতর, তা তোমাকে ফোনে বলে বুঝাতে পারবো না। ছবিটা তুমি দেখবে না ? সপ্তর্ষির দু'চোখ দিয়ে বৃষ্টির মতো পানি ঝরছে।

: তুমি বুঝতে পারছোনা যে, আমাদের বিয়েটা সমাজ বহিভর্’ত। যা কেউ জানে না। কাজেই এ সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া মানে একটা লংকা কান্ড ঘটে যাওয়া। আমার চাকরিটা স্থায়ী হোক। তোমার লেখা-পড়াটাও শেষ হোক। তারপর ঘটা করে আমাদের বিয়ে হবে।
: এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, তা আমি তোমাকে বহুবার বলেছিলাম। তুমি শুননি।
: দেখো, ভুল তো মানুষের’ই হয়।
: হ্যাঁ হয়। ভুল আবার মানুষ সংশোধনও করে। চলো আমরা সংশোধন করি।
: আর সংশোধনের এই পথইতো উত্তম।
: না, অধম এবং নির্মম-ঘৃণ্য!!!
: এ অবস্থায় পৃথিবীর সবাই তা করছে।
: হ্যাঁ করছে, আমি করবো না।
: তুমি কি পৃথিবী থেকে আলাদা ?
: আলাদা’ই। তোমার চোখে আমাকে সেরকমই তো আবিষ্কার করেছিলে।
: আমি ভুল করেছিলাম। আজ বুঝতে পারছি তুমি বাস্তবতাহীন একটা মেয়ে।
: কোনটা বাস্তব আর অবাস্তব- এটুকু বোঝার ক্ষমতা আমার রয়েছে। ভুল তুমি করনি। ভুল করেছি আমি। তোমার মতো মানুষকে ভালবেসেছিলাম। আমার হাসি পায়, তুমি মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থায় কাজ কর। ও হ্যাঁ, তুমি না আমেরিকা যাচ্ছো- এবিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী আনতে? আফসোস হয়, নিজের অনাগত সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখতে দিচ্ছো না। তাকে হত্যা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছো। শুধু কি তাই... ? তুমি যে এখন আমার হৃদয়কেও হত্যা করতে চায়ছো। তোমার নাম আকাশ বলে আমার নাম পাল্টে রেখেছিলে 'সপ্তর্ষি'। তোমার আকাশ থেকে সেই সপ্তর্ষিসহ নতুন আরেকটি গ্রহ ঝরে যাচ্ছে। যাচ্ছে নয়, ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছো। দাও। আকাশ, তুমিও মনোযোগ দিয়ে শোনো, আমি এ সন্তানের 'মা' হবো। হবো’ই।

মেঘলা আকাশ। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। রাজধানীর একটি ছাত্রী নিবাসে তিন তলায় একাকী সপ্তর্ষি। সহপাঠিরা সবাই ইউনিভার্সিটিতে। ও ইদানীং প্রায়’ই ক্লাস ফাঁকি দেয়। আসলে সে নিজেকে’ই ফাঁকি দিচ্ছে। আর ফাঁকি নয়, এবার সে ঘুরে দাঁড়াবে। যে যা’ই বলুক, সমাজ যেভাবেই তাকে আখ্যায়িত করুক- সে প্রাণ হত্যা করতে পারবে না। জীবনতো একটা’ই।
সপ্তর্ষির দু’চোখও আকাশের মতো। বৃষ্টি ঝরছে না কোন আকাশ থেকে’ই। কিন্ত সপ্তর্ষি চায়ছে, অঝোরে বৃষ্টি নামুক দুই আকাশ থেকে। মধ্য দুপুরে বৃষ্টির প্রতিযোগিতা। দু’আকাশে অঝোর ধারায় ঝরছে বৃষ্টি ...। এক সময় আকাশের বৃষ্টি থেমে গিয়ে হঠাৎ আলোর ঝিলিক। কিন্ত সপ্তর্ষির বৃষ্টি থেমে নেই। আকাশের চেয়ে কি মানুষের চোখে জল বেশি ?

আজ সপ্তর্ষির মন এবং শরীরের অবস্থা কোনোটা’ই ভালো নেই। দেহের ভিতর আরেকটি দেহের বসতি আর মনের উপর বজ্রপাত! তা বহনের ক্ষমতা সে কিভাবে বইবে ভেবে পাচ্ছে না। ওর হঠাৎ চোখ পড়লো মহাসড়কের দিকে। পা হারানো এক বয়স্ক বৃদ্ধ রিক্সার প্যাডেলে লাঠি বেঁধে হাতে প্যাডেল ঘুড়াচ্ছে। দু’জন যাত্রী নিয়ে প্যাডেল চাপানো কি পরিমাণ কষ্ট যে হচ্ছে- তা তার শীর্ণ দেহের ঘাম’ই বলে দিচ্ছে। ক্ষত বিক্ষত ছেঁড়া গেঞ্জির ফাঁকে ফাঁকে দেহের লবনাক্ত জল গড়িয়ে পরছে। তবুও লোকটি থেমে নেই, রিক্সার তিনটি চাকা ঘুড়ছে ...
দৃশ্যটি সপ্তর্ষিকে দারুণভাবে আন্দোলিত করলো। ক্লাস থেকে সহপাঠিরা ফেরার আগে’ই একটা ব্যাগে কিছু কাপড় বই ভরে ওর গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের দিকে রওয়ানা দিলো বাসে। মা- বাবা তার পরম বন্ধু। প্রাইমারিতে পড়–য়া ছোট ভাইটিও। অন্তত মায়ের কাছে বিষয়টি নিয়ে কথা বলার সময় হয়েছে। সময় হয়েছে একটি দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শেরও।
বাসটি বেশ হাঁপাতে হাঁপাতে কটিয়াদী বাসস্ট্যান্ডে এসে থামলো। রাত তখন এগারটার কাঁটা ছুঁই ছুঁই। একটি বেটারি চালিত অটোরিক্সায় চড়ে রওয়ানা দেয় দশপাখি গ্রামে। নয় জনের মতো যাত্রী, তাকে নিয়ে দশ পূর্ন হলো।
রাস্তার পাশে’ই ওদের বাড়ি। সুনসান নীরবতা। সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মাঝে মধ্যে কিছু ঝিঁ ঝিঁ পোকা আর ব্যাঙের ডাক শোনা যাচ্ছে। নয়তো নিঃশ্বাসের শব্দও শুনা যেতো।
সপ্তর্ষি নিঃশব্দ পা’য় বাড়ির উঠোনে এগোয়। দরজার কড়া নাড়ানোর আগে’ই ওর মায়ের ফিস ফিস কথার আওয়াজ পেলো। দরজায় আর কড়া নাড়ানোর সাহস পেলো না সে। মা তাকে নিয়েই কথা বলছে তার বাবার সাথে। বিষয়টি জেনে গেছেন তারা। আক্ষেপে কষ্টে লজ্জায় দিশেহারা ওরা। মা বলছে, ‘ নগানী মাগী বাইত আইওক, তাইরে দাউ দিয়া কাইট্টা গাংগো ভাসাইয়া দিয়াম।’ বাবা নিন্ম মধ্যবিত্ত কৃষক ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন আর হাত দিয়ে বুকে আঘাত করছেন বার বার। ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁকে সব দেখছে সপ্তর্ষি। ছোট ভাইটা ঘুমের ভান ধরে ওপাশ ফিরে শুয়ে আছে। ওর দু’চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। কিন্ত কোনো শব্দ করতে পারছে না। পল্লী বিদ্যুতের কল্যানে বাড়িতে আলোর কারনে সব দৃশ্য’ই অবলোকন করতে পারলো সপ্তর্ষি।
উঠোনে হাটু গেড়ে বসে আকাশের দিকে তাকায় সপ্তর্ষি। মেঘাচ্ছন্ন আবছা চাঁদের আলোয় সপ্তর্ষিকে খুব খুঁজতে লাগলো মাটির সপ্তর্ষি। না, কিছুতেই দেখা গেলো না তাকে। ও উপরের সপ্তর্ষিকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘ আজ মেঘলা বলে তোমাকে খুঁজে পেলাম না, তো একদিনতো পাবো- যেদিন আকাশে চাঁদ উঠবে। সপ্তর্ষি তুমি জেনে রাখো, মাটির এই সপ্তর্ষিকে আজ থেকে আর কখনো কেউ খুঁজে পাবে না।’

মুঠোফোনের সিম খুলে বাড়ির পুকুরে ফেলে দিয়ে এক গন্তব্যহীন গন্তব্যে পা বাড়ালো সপ্তর্ষি। মেঘাচ্ছন্ন অন্ধকার রাতে হাঁটতে তার বিন্দুমাত্র ভয় হচ্ছে না। অথচ চারদিকে ধর্ষণ... অত:পর আগুনে পুড়িয়ে হত্যা। তিন বছর বয়সের শিশুকেও ধর্ষণ, অত:পর মাটিতে পুতে ফেলা অথবা শ^াসরুদ্ধ করে হত্যা ...। এমন ভয়ংকর এক সময়ে সে ঘর ছাড়লো। ওর দুরন্ত শক্তি বোধহয়- তার অনাগত সন্তান। যে সন্তান একদিন ভ’মিষ্ট হয়ে পৃথিবী কাঁপিয়ে চিৎকার করে সপ্তর্ষিকে বলে উঠবে, ‘মা’.......
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ মোখলেছুর রহমান দেরিতে হলেও পড়ার ভাগ্য হল, ভাল লাগল।
শ্রাবনী রাজু অসাধারণ, অনবদ্য রচনা।
Ahad Adnan চমৎকার গল্প। শুভকামনা।
রণতূর্য ২ আপনার গল্পটি এই সমাজেরই প্রতিচ্ছবি।ভ্রুন হত্যা ও মানুষ হত্যায় বস্তুত কোন তফাৎ নেই।শুভকামনা নিরন্তর।আমার কবিতায় আমন্ত্রণ রইল।মতামত দিয়ে অনুপ্রাণিত করবেন আশা করি।
ম নি র মো হা ম্ম দ অনবদ্য।।ভোট রেখে গেলাম।
m sattar 'মা ' নিয়ে বিকল্প ধাঁচের একটি গল্প পরলাম। মানবকুলের সবার উপরে মা ...।। গল্পকার সেই মমতাময়ী মায়ের চ্যালেঞ্জিং চরিত্রের দৃশ্য আঁকলেন । সত্যিই অসাধারণ । তবে এই চ্যালেঞ্জিং মায়ের পরবর্তী ঘটনা জানার আগ্রহ ব্যাকুল হয়ে উঠলো । মা নিয়ে একটি উপন্যাস লিখার প্রস্তাব রইল লেখকের প্রতি। অনেক শুভ কামনা।
মুহম্মদ মাসুদ ভালোবাসার বেদনার গল্প। বেশ ভালো লাগলো। আমার পাতায় আমন্ত্রণ রইলো।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

'মা' দ্বিতীয় ঈশ্বর । এর আর কোন ব্যাখ্যা চলে না । কষ্ট ব্যাথা যন্ত্রণা এমন কি গ্লানি নিয়েও একজন মা তার সন্তানকে লালন পালন করেন । তেমনি গ্লানিকর প্রেক্ষাপটে অন্য এক মায়ের গল্প তুলে ধরার চেষ্টা করেছি । মা বিষয়ের সাথে গল্পটির সমঞ্জস্যতা রয়েছে।

০৬ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“মে ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ মে, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী