রাত তখন দশটার কাঁটা অতিক্রম করে চলেছে। কোনো ট্রেন’ই আসার নামগন্ধ নেই। ও যেখানে যাত্রা করবে যে কোনো একটা ট্রেন আসলেই হবে। টিপ টিপ বৃষ্টিতে ছাতা মাথায় মানিকখালী রেল ষ্টেশনের অদুরে নির্জন এক জায়গায় বসে আছে ত্রিশ বছর বয়সের টগবগে যুবক কাইয়্যুম হাসান মিয়া। ও আজ মৃতে্যুর ষ্টেশনে যাত্রা করবে, কাজেই যে কোনো একটা ট্রেন আসলেই হয় । আল্লাহ রসুলের নাম নিয়ে দিবে ঝাঁপ... জীবনের সব কষ্ট জ্বালা-যন্ত্রণা নিমিষেই শেষ ! এমনি এক সিদ্ধান্ত নিয়ে আত্বহত্যার ঘৃণ্য পথ বেছে নিয়েছে সে। এ ঘৃণ্যতার পেছনে তার অবশ্য যুক্তিও আছে।
হতদরিদ্র কৃষক পিতার অভাব দূর করতে হালের গরু মায়ের হাতের বালা ও ভিটে বাড়ী বিক্রি করে পাড়ি দিতে চেয়েছিলো,স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায়। মানব পাচারকারী ভূয়া দালাল চক্রের খপ্পড়ে পড়ে যায় সে । ট্রলারে করে শতাধিক মানুষের সাথে সাগর পথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। সাগরের বিশাল ঢেউ যেমন মৃত্যুর হাতছানি দেয় ; তেমনি আবার সুন্দর স্বপ্নও দেখায় । মৃত্যুর মিছিলে সুন্দর স্বপ্ন হঠাৎ দুঃস্বপ্নে পরিণত হয় । ট্রলার ডুবে মারা যায় বহু মানুষ। কিছু বেঁচে যায় আলৌকিক ভাবে। এর’ই মাঝে কাইয়্যুম হাসান একজন। তবে এ বেঁেচ যাওয়ায় নিজেকে সুভাগ্যবান মনে করতে পারছে না সে। টেলিভিশনে সাগরে ট্রলার ডুবির খবর দেখে তার পরিবারের আর্তি ছিলো, সরকার যেনো ওর লাশটা খোঁজে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। কাইয়্যুম হাসান যখন লাশ নয় ; প্রাণ নিয়েই বাড়ি ফিরে আসে তখন সবার কাছে সে যেনো পূর্নিমার চাঁদ ছিলো। চাঁদের আলোয় তো আর ধান শুকানো যায় না ! ভয়াবহ অভাবে কিছুদিন পর এই পরিবার থেকেই পাথর কঠিন উচ্চারণ- তুই সাগর থাইক্কা ভাইস্সা আইলি কেরে..ডুইব্বা মরতে পারলি না ...!
এমন মমতাহীন পরিবারে বেঁচে থাকার কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছে না সে। এই ব্যর্থ জীবনের প্রায়শ্চিত্ত করার উচিৎ মাধ্যম একমাত্র আত্বহত্যা। কিন্ত ট্রেন এখনো আসছে না কেন ? এতো বড় একটা বিপদেও কেউ কোনো সাহায্য-সহযোগিতা করলো না তাকে। আবার মরবে- তাতেও রেল কর্তৃপক্ষের গাফিলতি। রাত গভীর হতে চলেছে। বৃষ্টির ফোটা আরো বড় হচ্ছে। পাশাপাশি দমকা হাওয়া শুরু হয়েছে। চারদিকে রাতের গভীরতার মতো অন্ধকার নেমে এসেছে। ছাতাটি আর বৃষ্টির বেগ সহ্য করতে পারছে না। আকাশে বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় কিছু দুরে স্যালো মেশিনের একটা ছাপড়া ঘর চোখে পড়লো কাইয়্যুম হাসানের । ঘরটিতে আশ্রয় নেওয়ার জন্যে এগিয়ে যায় সে। ঘরটির কাছাকাছি যাওয়ার পর বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে চোখ পড়লো এক যুবতী মেয়ের। কাঠের মাচায় হেলান দিয়ে বসে আছে মেয়েটি। ও কি মানুষ না জ্বিন-ভূত...? এই নির্জন বোরো জমির মাঠে এরকম একটা মেয়ে একা কেনো ? কালো রং , কিন্ত চোখ দু’টিতে কি মায়া ! মেয়েটি গুনগুন করে রবি ঠাকুরের ’যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে....’ গানটা আপন মনে গেয়ে চলেছে। কাইয়্যুম হাসান ঘরটিতে যাবে কি যাবে না, বেশ দন্ধে পড়ে গেলো। বাইরে টিকটিকির মতো দাঁড়িয়ে রইলো ও ।
এতোক্ষন বিদ্যুৎ চমকানোর আলো তার কাছে অসহ্য লাগছিলো। মৃত্যুর দিনে আবার আলো কেন ? মৃত্যু যেমন অন্ধকার পৃথিবীও থাকুক অন্ধকার। এখন হঠাৎ এই আলো কেমন যেনো ভালো লাগতে শুরু করেছে ওর। আই,এ ফেল করা কাইয়্যুম হাসান রবীন্দ্র সংগীত তেমন একটা না বুঝলেও এই গানটি সে অনেক শুনেছে। কিন্ত গানটির অর্থ হয়তো সে বুঝতে সক্ষম হয়নি। আজ এই মেয়েটির কাছে গানটির অর্থ বোঝা দরকার। তবে মেয়েটি মানুষ না ভূত ! বিদ্যুৎটা আবার চমকালে বিষয়টি আঁচ করা সহজ হতো। ও বৃষ্টি ভেজা হিমশীতল শরীরে অপেক্ষায় আছে ফের বিদ্যুৎ চমকানোর.........
বিদ্যুৎ চমকানোর আগে হঠাৎ চমকে উঠলো দূর থেকে একটি টর্চ লাইট। মেয়েটি মাচা থেকে লাফ দিয়ে নেমে নীচে লুকিয়ে রইলো। কাইয়্যুম এখন বুঝতে পারলো- মেয়েটি ভূত টুত কেউ না , মানুষ’ই। টর্চের আলো থেকে নিজেকে আড়াল করতে সেও ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লো। কিছুক্ষন পর টর্চের আলো থেমে যায়। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে.. মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছে না। অবাক কান্ড , মেয়েটি কি তার উপস্থিতি টের পায়নি ! দুরের অজ্ঞাত এক টর্চ লাইটের আলোর ভয়ে লুকিয়ে পড়লো- আর তার আগমনে কোনো টু শব্দ করছে না মেয়েটি..! বৃষ্টি এখন মূষলধারে পড়তে শুরু করেছে। বলতে গেলে ঝুম বৃষ্টি ।
ক্ষীণ কন্ঠে হাসান বললো, ক্যাডা ক্যাডা আপনি ? কোনো উত্তর আসছে না । এবার সে কিছুটা উচ্চস্বরে বললো, মাচার নিচে ক্যাডা.. কতা কইতাছুইন্না কেরে ?
মেয়েটি দৌড়ে পালাবার চিন্তা করছে। বিষয়টি কিছুটা বুঝতে পারলো হাসান মিয়া। মেয়েটি মাচার ভেতর থেকে একটু পর পর মাথা বের করছে, বিদ্যুৎ চমকানোর পর আবার মাথা ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। এদিকে টর্চের আলোও কাউকে যেনো খুঁজে বেরাচ্ছে ।
মেয়েটি এবার নিজ থেকেই মুখ খুললো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো, আফনে ক্যাডা ?
ঃ আমি কাইয়্যুম হাসান মিয়া। গেরাম লোয়াজুরি । আফনের পরিচয় কি ?
গ্রামের নামটা শুনে আঁৎকে উঠলো মেয়েটি। এ গ্রামেই তার বাপের বাড়ি। একদা ঠিকানা ছিলো-এখন শুধুই স্মৃতি। কেউ নেই তার। মানিকখালীতে মামার বাড়িতে অত্যাচার নির্যাতন আর চরম অবহেলায় দিন কাটছিলো তার। এ অবস্থাতেও এ বছর জিপিএ গোল্ডেন পেয়ে আইএ পাশ করে গ্রামের সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয় সে । কিন্ত তাক লাগাতে পারেনি মামা মামীদের। মামা মামীর এক কথা- আর কুনু লেহাপড়ার দরকার নাই, বিয়ার লাইগগা রেডি হ হারামজাদী। বর হচ্ছে-তাদের’ই গন্ড মূর্খ বখাটে ছেলে।
উনিশ বছর বয়সের মেয়েটি নতুন জীবনের সন্ধানে আজ সেও ট্রেনের অপেক্ষায় আছে । তবে কাইয়্যুŴমř মতো আত্বহত্যা করতে নয়; জীবনটাকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়ে বাঁচার অদম্য স্বপ্নে ট্রেন যাত্রার।
কাইয়্যুম বললো, কই আফনের পরিচয়তো দিলাইন না..
মেয়েটি নিজ গ্রামের মানুষ পেয়ে যেটুকু ভয় ছিলো, অনেকটাই কেটে গেছে । ও মাচার ভেতর থেকেই উত্তর দিলো, আমার নাম শাপলা । গেরাম আফনেরার গেরামঅই।
ঃ আরে কি কইন..? কোন ইষা.. বাপের নাম কি ..?
ঃ দশপাখি। বাপের নাম শুক্কুর আলী।
ঃ কোন শুক্কুর আলী ? ঘুমের মধ্যে ঘরের ভিতর নসিমন ঢুইক্কা পইড়া পরিবারের সবাই যে মরছিন !
ঃ হ।
ঃ আমি তহন কেলাস ফাইভ’এ পড়তাম। ইসকুল ফাহি দিয়া গিয়া দেখছিলাম । হেইদিন আফনে কই আছলাইন ?
ঃ এইখানে, মামুর বাড়ীত আম-কাঠল খাইতে আইছলাম।
ঃ ইস্ মামুর বাইত আওনে জানডা বাঁইচ্চা গেলো আফনের।
ঃ হ, মামুর বাইত আইয়া যিমুন জান বাঁচ্চে, তিমুন আবার জান শেষও হওনের সময় অইছে।
ঃ মাচার ভিতর থাইক্কা বাইরুইন। ডরের কিছু নাই। আপনে ত আমার দেশী মানুষই।
শাপলা উপরে উঠে এলো। মাচার এক কোনে বসলো। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর অন্ধকার নির্জন এই স্থানে এক অচেনা যুবকের পাশে থাকা সত্তেও ওর মনের ভেতর তেমন কোনো ভয় কাজ করছে না। আসলে ও যে পথে পা ফেলেছে- সেখানে ভয় পেলেতো আর হবে না।
হাসান মিয়া বললো, আফনে অত রাইতে এইহানো কেরে আইছুইন..?
ঃ আমিতো আমার বর্তমান বাড়ীর কাছেঅই আছি। আগে কইন আফনে লোয়াজুরী থাইক্কা এইহানো কেরে..?
দু’জনে যার যার গল্প গুলো বললো। শাপলার গল্প শুনে হাসান মিয়া দারুনভাবে অনুপ্রাণীত হয়। নিজেকে সে নির্বোধ চরম বোকা হিসাবে আখ্যায়িত করে। যথাসময়ে ট্রেন না আসা আর এই মেয়েটির সাথে দেখা না হলে, সে যে কি বড় একটা ভূল’ই না করে বসতো !! যে ভূলের মাশুল দিতে হতো ক্ষতবিক্ষত তার পরিবারের সবাইকে। কাইয়্যুম শাপলার পা ছোঁয়ার চেষ্টা করলো। শাপলা বিষয়টি নিয়ে বিব্রত হয়ে বললো, থুবাস থুবাস এইডা আপনে কি করতাছুইন..! বয়সে আফনে আমার কত বড়..আফনে এইডা কি পাগলামী শুরু করলাইন !
কাইয়্যুম গভীর ক›েঠ বললো, এই আন্ধার রাইতে তুমি আমার জীবনে আশির্বাদ হইয়া আইছো- সূর্যের আলো হইয়া আইছো । কিছু মনে কইরো না। আমি তোমারে তুমি কইরা কইলাম।
ঃ না, কি কইন- আমি কিছু মনে করি নাই। অহন কইন আত্বহত্যার ভূত মাথাত থাইক্কা নামছে কি না ?
ঃ হ , নামছে। আমারে তোমার লগে নিবা ?
ঃ কই যে যাইবাম.. আমার অই নাই কোনো ঠিক ঠিকানা.. এ ছাড়া..
ঃ ঝুঝ্ঝি, তুমি আমারে বিশ্বাস করতা পারতাছ না।
ঃ আসলে আমি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কতা কইতাছি না। আপনের আর আমার পরিচয় কি অইবো ?
ঃ হেইডা আল্লাপাক বুঝব। তোমার আমার পরিচয় যহন উনার ইশারায়’ই অইছে- কাজেই উনি’ই বুঝব সব।
কাইয়্যুŴমř কথা শুনে ডুকরে কেঁদে উঠলো শাপলা। ‘পৃথিবীতে ভালো মানুষের সংখ্যা’ই বেশী’ উপন্যাসিক হুমায়ুন আহমেদ ঠিক’ই কইছে।
কথা ও গল্পে গল্পে কখন যে ভোরের পাখি ডাকতে শুরু করেছে টের পায়নি কেউ’ই। ট্রেনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। শাপলা কোমল সুরে বললো, লইন ইষ্টিশনের দিকে যাই ।
ওরা ষ্টেশনে যাওয়ার পর জানতে পারলো- ট্রেনের দেরি হওয়ার কারনটি। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো রেলপথ অবরোধ করেছিলো। বিভিন্ন যাত্রীবাহি গাড়িতে পেট্রোল বোমায় প্রতিদিন মানুষ পুড়িয়ে মারছে তারা । এই নির্মম রাজনীতির আন্দোলনে চলছে আরেক ঘৃণ্য রাজনীতি !! বিরোধী দলগুলো বলছে, আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে নস্যাত করার জন্য সরকার সুপরিকল্পিতভাবে এসব নাশকতা চালাচ্ছে। অপরদিকে সরকার বলছে, তারা ক্ষমতায় যেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ওরা মানুষ পুড়িয়ে বর্বর মধ্যযুগীয় আন্দোলন শুরু করেছে । সাধারন মানুষ কোন পক্ষের কথা বিশ্বাস করবে ...?
ময়নসিংহের দিকে ট্রেন ছুটে চলেছে.. ঝিক ঝিক শব্দে। জানালার পাশে ওদের সিট। ভোরের নরম আলোয় ওদের চোখে মুখে নতুন স্বপ্নের সূর্য জ্বলজ্বল করছে। ওরা অবাক হয়ে দেখছে পরস্পরকে - আবার কখনো দুর মাঠ..। কি মায়াময় সবুজের মাঠ... মনে হচ্ছে, বিশাল সবুজের মিছিল রেলগাড়ীর পিছু নিয়েছে। কি অপরুপ সুন্দর মমতাময়ী এই দেশ ! ট্রেন এখন একটি বিল অতিক্রম করে চলেছে। বিলে লাল ও সাদা রংয়ের বহু শাপলা ফুল ফুটে আছে। দেখতে অসাধারন দৃষ্টি নন্দন লাগছে। দৃশ্যটি প্রথমে চোখ পড়লো কাইয়্যুম হাসান মিয়ার। শাপলাকে তা দেখিয়ে ও বললো, ঐযে দেহো তুমি...। শাপলা এতে এতো আনন্দ পায়, যা জীবনের সেরা আনন্দের একটি ! আনন্দে চোখে পানি এসে যায় তার। চোখের জলে সূর্যের আলো এসে পড়লো- অদ্ভূত সে দৃশ্য ! শাপলার চোখে পানি দেখে কাইয়্যুŴমর খুব ইচ্ছে হলো তা মুছিয়ে দিতে। কিন্তু পারেনি। আনন্দাশ্রুতে মানুষকে অন্যরকম সুন্দর দেখায়- হয়তো এ জন্য এই জল কেউ মুছতে পারে না।
০৬ এপ্রিল - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৩৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪