প্রায় ফাঁকা মানিক মিয়া অ্যাভিন্যুর পূর্ব প্রান্তে রিক্সা থেকে নামে সুজন। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে খামার বাড়ির পশ্চিম প্রান্তে বা খেজুর বাগানের দক্ষিণ প্রান্তে অথবা সংসদ ভবনের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে দাঁড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেট থেকে একশলা সিগারেট বের করে ঠোঁটে লাগায়। দেশলাই খুঁজতে গিয়ে ঝামেলা হয়। প্যান্টে গোটা চারেক পকেট থাকলেও কোথায়ও দেশলাই পেল না সে। বুক পকেটে হাত দিতে গিয়ে মনে মনে একচোট হেসে নেয়- গায়ে টি-শার্ট- পকেট থাকবে কি করে! বুঝলো, বেটা দেশলাই কখন হয়তো গলে বেরিয়ে গেছে পকেট থেকে- কোরবানীর এই দিনে সুজনের পকেটে নিঃস্পৃহ হয়ে থাকাটা ওর হয়ত ভাল লাগেনি।
অন্যান্য দিনের মত গলায় গামছা জাতীয় কিছু দিয়ে ঝুলিয়ে ছোকরা টাইপের সিগারেটওয়ালাদেরও দেখা মিলছে না। সুজন বোঝে- সিগারেট বিকিকিনিতে যে লাভ হবে তার থেকে কোরবানীর মাংস কালেকশনে লাভ ঢের বেশী। খানিকটা সময় কেটে গেলেও ওর মুখের সিগারেটে অগ্নিসংযোগ হলো না। অগত্যা কিছুটা এগুতে হলো- অবশেষে মিললো।
সুজনের জীবনটাই এমনি করে কাটছে। সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যায় ঠিক ‘পৌনে বারটা’ বাজার পরে।
জীবন্ত সুজনের মুখাগ্নি ঘটার পর আয়েশ করে টান দিয়ে পাঞ্জাবীদের মত লম্বা নাকের ততধিক সরু নাসিকা ছিদ্র দিয়ে গোয়ালন্দ থেকে খুলনাগামী স্টিমারের চিমনির মত ধোঁয়া ছেড়ে স্বস্তি অনুভব করে সে; যদিবা এ চিমনির রঙ কালো নয়, শ্বেত-শুভ্র।
আনমনে হাটতে তাকে সুজন। সংসদ ভবনের উত্তর-পূর্ব কোনে এসে মন্ত্রীবাহী গাড়ীর বহরের হুইসেল শুনে মেজাজটা খিঁচ্ড়ে যায়। কোরবানীর ঈদে নয় কেবল; বছরে দু’টো ঈদের ছুটিতে ঢাকা যখন একেবারেই ফাঁকা হয়ে যায়, যখন ফাঁকা মহানগরীকে সত্যিকার বসবাসের উপযুক্ত মহানগরী বলে মনে হয়; তেমনি সময়ে ফাঁকা পথে মন্ত্রীবাহী গাড়ীর এই আর্তচিৎকার অসহনীয় লাগে। দাঁড়াতে হয় তাকে; ফুটপাথ ঘেঁষে। সামনে দিয়ে যে গাড়ীটা গেল- পরিস্কার বোঝা গেল, এটা প্রধানমন্ত্রীর গাড়ীর বহন নয়। তবু গাড়ীর বিদঘুটে হর্ন বেজেই চলেছে। সুজনের মনে হচ্ছে জবাইয়ের আগে পশু যেভাবে আর্তনাদ করে; তেমনি শব্দ করে চলে গেল ভিআইপি গাড়ীবহর।
এরপর প্রায় বিনা বাঁধায় সে পথ চলেছে- অবশ্য নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে; রাস্তার বাম দিকের ফুটপাথ ধরে। আইন বলে- রাস্তার ডান দিকে চলবে মানুষ- বায়ে যান্ত্রিক বহর। কথাটা মনে হতেই হাসি পায় তার। সে কি আসলেই মানুষ; না কি যান্ত্রিক কিছু একটা!
যান্ত্রিক কিছু একটা না হলে সে যন্ত্রের মত জীবনের চারটা দশক পার করলো কি করে! বাবা-ঠাকুর দা’র দেয়া সুজন গাঙ্গুলী নামটা বদলে ফেললো কি করে? পাঠক, জেনে নিন- আলোচ্য সুজন এক সময়ে ছিলো- সুজন কে গাঙ্গুলী। বাংলায় লিখতো সুজন কুমার গঙ্গোপাধ্যায়। যখন থেকে সে বুঝতে শিখেছে- মানব ধর্মের চেয়ে বড় কিছু নেই; তখন থেকে সে হয়ে গেছে সুজন; কেবলই সুজন। ইউরোপীয় কায়দায় তার ফার্স্ট নেম আর লাস্ট নেম বলে কিছু থাকলো না। ফলে ইদানিং অনলাইনে কোন তথ্য ফরম পূরণ করতে গেলে; শেষতক তার নাম দাড়ায় সুজন সুজন। ফার্স্ট আর লাস্ট নেম একটাই। মিডেল নেম এর কোন অপশনতো আর ম্যান্ডেটরী নয়। ফলে নেটের বন্ধুরা বেশ আগে থেকেই তাকে সম্বোাধন করে ‘সুজন স্কয়ার’ বলে।
এই সুজন কে গাঙ্গুলী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে ভালবেসে, জাত-পাত খুইয়ে একটি উচ্চ বংশীয় মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করেছিল। জাত-পাত নিয়ে সুজনের কোন দুঃশ্চিন্তা ছিল না বলেই খুব সহজে বাবা-মায়ের অমতে সানজিদা চৌধুরীকে নিয়ে ঘর বেঁধেছিল। বিষয়টা মনে হতেই পাঞ্জাবী নাকের সরু ছিদ্র দু’টো দিয়ে ঠান্ডা বায়ু নির্গত হয়; হৃদপিন্ডের নীচে হালকা একটা চাপ অনুভূত হয় তার।
তালতলার কাছে আসতেই একটু ঝামেলার মত মনে হল। সারিবদ্ধ প্রাইভেট কার দাড়িয়ে- গ্যাস নেয়ার জন্য। ছুটির দিনে, বিশেষ করে ঈদের ছুটিতে ঢাকা যখন একেবারেই ফাঁকা তখন এই সারিবদ্ধ গাড়ী দেখতে খুবই বেমানান লাগছে। ওই জায়গাটুকু অতিক্রম করতে গিয়ে মনে মনে গালি দেয় গাড়ী চালকদের। আজ ওরা যেন সবাই রিক্সা চালক; দু’টো গাড়ীর মাঝখানে যে পরিমান ফাঁকা থাকার দরকার, তা নেই। সুজন ভাবে নিশ্চয়ই এ সব চালক পেশা হিসেবে শুরুতে রি•ক্সা চালনাকেই বেছে নিয়েছিল।
রোকেয়া সরণিতে ব্লু লেগুন বলে একটা নামী রেস্তোরাঁ রয়েছে- আগারগাঁ ও মিরপুরের সঙ্গম স্থলে। বহু বছর আগে ঐ রেস্তোরাঁর ধারে কাছে কোন ভবন ছিল না; এমনকি রেস্তেরাঁটাও ছিল জলাশয়ের ওপরে মোটা মোটা পিলারের ওপরে। ভরা বর্ষায় বেশ ভাল লাগতো সেখানে বসতে। সুজনও দু’একবার সেখানে বসে পর্যটনের স্বাদ নেয়ার চেষ্টা করেছে। অবশ্য সে সময়ে রোকেয়া সরণিতে যানবাহনের চাপ এতটা ছিল না। সেই রেস্তোরাঁর কাছে আসতেই পুরানো দিনের কথা ষষ্ঠ ঈন্দ্রিয়ে ভর করে তার। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পশ্চিমাকাশ দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করে সে। আশ-পাশের উঁচু ভবনগুলো মুখ বাঁকিয়ে ওর দিকে তাকায়; ফলত তার মনে হয় কিছুটা হলেও তার শরীরে ঘাম জমেছে। মনের রঙ সবসময় ছয়টা থাকে না। এক্ষণে ওর মনে হলো পিঠের মধ্যখানে- যেখানে শীর দাড়া রয়েছে- সাধু ভাষায় যাকে বলে মেরুদন্ড; ওখানটায় ঘামের স্রোত বইছে। অভ্যেস বা বদ-অভ্যেস, যা-ই হোক না কেন হাতটা পেছনে নিয়ে টি-শার্টের ভেতরে চালান করে ঘাম মুছে ফেলার চেষ্টা করতেই- খিল্ খিল্ করে কচি নারী কণ্ঠের হাসি কানে ভেসে অসে। তাকিয়ে দেখে, চৌদ্দ-ষোল বছরের দু’টি মেয়ে হাসতে হাসতে তাকে অতিক্রম করে এগিয়ে চলছে এবং একে অপরকে বলছে:
-চুপ, শুনতে পাবে।
চুপ করেনি কেউই; বরং দু’জনে পেছন ফিরে আরেকবার সুজনকে দেখে নিয়ে দ্রুত পথ চলতে তাকে।
চল্লিশোর্ধ সুজনের খোলা পৃষ্ঠদেশ দেখে ওরা যখন হাসে- পুলকিত হয়; তখন কিশোরী বা যুবতীর উন্মুক্ত পৃষ্ঠদেশ এক যুবক বা প্রৌঢ়ের কাছে মহা আনন্দের বিষয় হবে; তাতে দোষের কি! সুজন নিজেও কি দেখেনি বা দেখার চেষ্টা করেনি কখনো?
নারী পুরুষের এই আকর্ষণ চিরন্তন এবং ঈশ্বর প্রদত্ত। এ কারণেই পৃথিবীর অবয়ব না বাড়লেও বেড়ে চলেছে মনুষ্য জনগোষ্ঠীসহ তাবৎ প্রাণীক‚লের পরিধি।
এমনই এক আকর্ষণে সুজন আজও ছুটে চলেছে মিরপুরের কোন এক প্রান্তে এবং পদব্রজে। হঠাৎ করেই তার মনে খটকা লাগলো, কেন সে রিক্সা বা স্কুটার খুঁজলো না! কেনইবা হেঁটে চলেছে এতটা পথ! প্রশ্নের উত্তর জানা নেই সুজনের; পথ চলাও থেমে নেই।
শেওড়াপাড়ার ফুটপাথ সাধারণত সবসময়ে ফল-ফলাদির দোকানে ভরা থাকে। আজ অবশ্য তেমনটি নেই। বরং রাস্তার ধারে সকালে কোরবানী দেয়া গরু ছাগলের রক্ত, কিছুটা গোবর এবং কোরবানীর আগে উৎসর্গীকৃতদের ভোজনের জন্য দেয়া খাবারের কিছু উচ্ছিষ্ট এখনো রয়ে গেছে। তুলনামূলকভাবে ফুটপাথটাই হেঁটে চলার জন্য উত্তম মনে হয় তার কাছে।
এমনিতরো জীবনের স্বর্ণালী দিনগুলোর কোন এক সময়ে সানজিদা চৌধুরীও বোধকরি সুজন কে গাঙ্গুলীর সাথে ঘর বাঁধাটা তুলনামূলকভাবে উত্তম মনে করে ছিল। সুজনও সম্ভবত উত্তম সময় ভেবে তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল। স্বপ্নই বা বলা কেন; বাস্তবে তারা একই নীড়ে নীবিরভাবে বসবাস করেছিল। পঞ্চাশ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে কোন এক মহাকুমা হাকিমের দপ্তরে দু’জন বাঘা উকিল স্বাক্ষী রেখে স্বাক্ষর করে বন্ধু থেকে স্বামী-স্ত্রীতে রূপান্তরিত হয়েছিল তারা। সেখানে অবশ্য ‘কে গাঙ্গুলী’ বাদ দিয়ে কেবলই ‘সুজন’ লেখা হয়েছিল। হাকিম সাহেব বা উকিল- কেউ-ই সুজনের পুরো নাম জানতে চায়নি। সুজনের বাবার নামটা লেখার সময় উকিল কি যেন জানতে চাইলে সানজিদাই উত্তর দিয়েছিল।
বেশ সুখেই দিন কাটছিলো। সানজিদা আর সুজনের ভালবাসার ফসলও এসেছিল বছর দুয়েক বাদে। বড় আদর করে সুজন নাম রেখেছিল সুমনা।
না, সে এখন আর সুমনা নামে পরিচিত নয়। অন্য কোন নাম হয়ে গেছে তার। নামের শেষে চৌধুরীও যোগ হয়েছে। কত বড় হয়েছে মেয়েটি- সুজন জানে না। সানজিদা জানতে দেয় না। সুমনার কি মনে আছে বাবার কথা? স্মৃতিপট থেকে হারিয়ে যাবারই কথা। মাত্র দেড় বছর বয়সে সুমনা হারিয়ে যায় সুজনের জীবন থেকে।
সানজিদার বাবা, সুজনের শ্বশুর; মস্ত ব্যবসায়ী- মেয়ে আর নাতনীকে দূরে পাঠিয়ে দেন। শ্বশুর অবশ্য এ কাজে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিলেন; বলেছিলেন- ওদের আমেরিকা বেড়াতে নিয়ে যাবেন। সুজনকেও প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল; সুজন অবশ্য রাজী হয়নি।
আমেরিকা যাবার সময় সানজিদার অনুনয়-বিনয়ে সুজন চৌধুরী সেজে নীল রঙের একটা কাগজে স্বাক্ষর করেছিল সে- যা কাবিননামা হিসেবে সকলে জানে। সুজন পড়েও দেখেনি কি কি লেখা হয়েছিল ঐ নীল রঙের কাগজটায়। আমেরিকার ভিসা পাবার জন্য ঐ কাগজটা নাকি খুবই দরকারী ছিল।
তিন মাস পরে, সুজনের কাছে আরেকটি নীল রঙের কাগজ এসেছিল রেজিস্টার্ড ডাকে, আগেরটার থেকে খানিকটা ছোট আকারের; যা তালাকনামা হিসেবে সকলে জানে। সুজন সব বুঝলেও তালাকের কারণ হিসেবে কি লেখা ছিল তা কখনো পড়ে দেখেনি।
ভুত দেখার মত সুজন দেখে শেওড়াপাড়া ও কাজীপাড়ার মাঝামাঝি একটা জায়গায় ফুটপাথের ওপর একটি চায়ের স্টল খোলা রয়েছে। অবাক হয় সে- আজ তো চায়ের দোকান খোলা থাকার কতা নয়! দাঁড়ায় সে; চায়ের ফরমায়েস দেয়। আবারো মুখাগ্নি ঘটায় পশ্চাৎদেশে হালকা সোনালী রঙের ফিল্টারসহ সাদা সিগারেট মুখে নিয়ে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে মোবাইলটা হাতে নেয় হিপ পকেট থেকে। সুজন বরাবরই হিপ পকেটে মোবাইল রাখে- এ নিয়ে বন্ধু মহলে কত কথা হয়েছে- ভেঙ্গে যাবে, হারিয়ে যাবে। সুজন শোনেনি- ওর স্বভাবটাই এমন; যদিবা স্কুটারের সিটে হিপ পকেট থেকে পড়ে গিয়ে মোবাইল হারিয়েছে সে একবার।
অপর প্রান্তে দু’টো রিঙ বাজতেই উত্তর পাওয়া গেল
- কোথায়?
- কাজীপাড়া।
- ওখানে কেন?
- তোমাদের দিকে আসছি।
- কতক্ষণ লাগবে?
- চল্লিশ মিনিট বা তারও বেশী।
- এত কেন, রিক্সায়।
- না, এগারো নম্বর বাস।
রোকেয়া সরণি হয়ে এগার নম্বর বাস চলে না, সুষ্মিতা তা ভাল করেই তা জানে; তাই অবাক হয়ে প্রশ্ন করে:
- মানে?
- মানে হেঁটে আসছি।
- কেন? কোত্থেকে হেঁটে আসছো?
মৃদু হেসে সুজন বলে:
- একটা একটা করে প্রশ্ন করো, এক সাথে দু’টো প্রশ্নের জবাব দেব কি করে?
- হেঁটে আসছ কেন?
- মন চাইলো, তাই।
-কোত্থেকে হেঁটে আসছে?
- বাঙালী জাতির ঐতিহাসিক ঐক্যের প্রতীক জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ-পূর্ব কোন থেকে।
- কেন?
- এসে বলবো, কেমন!
- পাগলামী, তাই না! জলদি রিক্সা নাও।
- দেখি।
কথা বাড়ায়নি কেউ-ই। চা পর্ব শেষ করে আবারো পথ চলে সুজন। ওর গন্তব্য মিরপুর।
আকাংখিত মানবী সুষ্মিতা, সুমাইয়া চৌধুরী। চাকুরে বাবার একমাত্র মেয়ে। চৌধুরী পিতৃক‚লের পদবী নয়; স্বামীর বংশ মর্যাদা। ওর বাবা সৈয়দ বংশের। পিতৃভক্ত সুষ্মিতা স্বামীর বংশ মর্যাদা ধারণ করে আছে আজও। সেই সাথে স্বামীর দেয়া অনন্য উপহার মৌমিতা। বয়স বার বছর। ইরেজি মাধ্যমে স্ট্যান্ডার্ড-টু ক্লাসে পড়ছে।
মিরপুর দশ নম্বর গোল চক্করে এসে প্রকৃতার্থে চক্করে পড়ে যায় সুজন। হিপ পকেটে রাখা মোবাইলটা বেজে ওঠে ফোনটা মাধবীর:
- কোথায় আছ?
- মিরপুর।
- ওখানে কেন?
- কাজ আছে।
- ঈদের ছুটিতে কি কাজ ওখানে?
- আমারতো ঈদ নেই, পুজোও নেই।
- রমনায় আসবে?
- রাত হবে।
- কোথায় যাচ্ছ?
- পরে বলবো।
- আমি কি অপেক্ষা করবো?
- না, আজ নয়; কাল দেখা হবে।
কথা প্রলম্বিত হয় না। মাধবী অভিমান করে লাইনটা কেটে দেয়।
মাধবী, মাধবী রানী গুহ। সুজনের কলিগ; একত্রে ওরা কাজ করে একটি দৈনিকে। মাধবী মফষ্মল পাতা দেখে, সুজন বিজ্ঞাপন বিভাগে। তবু কেন যেন মাধবী সুজনকে লাইক করে; হয়ত স্বধর্মী ভেবে। মাধবী সুজন থেকে অন্তত দশ বছরের ছোট হবে বয়সে। তবু ওদের মধ্যে সম্পর্কটা ‘তুমি’ পর্যায়ে। সুজনের ‘আপনি’ সম্বোধনটা একেবারেই অপছন্দ; তবু অপরিচিতজন বা বয়স্কদের আপনি-ই বলতে হয়। কারো সাথে বছরখানেক সম্পর্ক রয়েছে- এমন কাউকে সে আপনি বলছে- এমন মানুষ মেলা দুষ্কর।
চাকুরে বাবার মেয়ে সুষ্মিতা বহুজাতিক কোম্পানির পাবলিক রিলেশনে কাজ করে। চাকুরীর সুবাদেই সুজনের সাথে পরিচয়- বছর দুয়েক হবে। পরিচয়ের ছ’মাসের মধ্যেই সম্বোধনটা তুমিতে চলে এসেছে। এর কারণও অবশ্য রয়েছে। অনেক কারণের একটি হাস্যকর কারণ হলো, ওরা দু’জনেই পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে ভালবাসে। রমনা, সোহরাওয়ার্দী বা চন্দ্রিমা উদ্যানে ওরা নিদেন পক্ষে বারটি পূর্ণিমা উপভোগ করেছে এরি মধ্যে।
দু’একবার চাঁদের উপমায় সুষ্মিতার নাম সুজনের ঠোঁট গলে বেরিয়েছে বটে। সুষ্মিতাও বলেছে:
- তুমি কি মুসলমান হতে পার?
- হয়েছিতো!
- কই! দেখছি না তো।
- সানজিদার নীল কাগজে লেখা আছে।
- ওটাতো ভুয়া, মেকি। আসলে মন থেকে হতে হয়।
- হলে কি হবে?
- তুমি আমি এক হব।
- এমন ভাবছ কেন?
- তোমার মত বন্ধু কি আর পাব?
- চেষ্টা করেছ কখনো?
সুষ্মিতা সরাসরি উত্তর না দিলেও সুজন জেনেছে ওর জীবন কথা। মৌমিতার বাবা চৌধুরী সাহেবের করুন পরিনতি; জেনেছে সুষ্মিতার জীবন সংগ্রামের কথা। বাবা তার জন্য নিশ্চিত আশ্রয় দিয়েছেন বটে, জীবন সংগ্রামে অন্য কোন ভাবে সহায়তা করেন নি। তবু সে বাবার কাছে কৃতজ্ঞ। ঐ ঠাঁইটুকু না পেলে মৌমিতাকে নিয়ে তার দুঃসময় কিভাবে কাটতো- ভেবে পায় না সে।
দশ নম্বর গোল চক্কর থেকে সোজা যাবে না বাম দিকে মোড় নেবে; ভাবতে ভাবতে আরেকটা সিগারেট ধরায় সুজন। কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। এমনি সময়ে সোনালীর ফোন- ছেলে বেলার বন্ধু; থাকে যাত্রাবাড়ী। স্বামী সন্তান নিয়ে সুখেই আছে। ফোনটা রিসিভ করতেই
- কিরে, এলিনা কেন?
- আমি একটু দূরে আছি; আজ আর আসবো না।
- দুপুরে খেয়েছিস?
- হুম।
- কোথায় খেলি? তোর কোন্ বান্ধবী খাওয়ালো রে?
- না রে, আমিই খেয়েছি। ডাল আর ডিম।
- এভাবে কদ্দিন চলবে? পুজার দিনও এলি না; ঈদের দিনও না; কবে আসার সময় হবে তোর?
- বড় দিন তো বাকী আছে। অপেক্ষা কর, আসবো।
- তোর জামাই বাবু বসেছিল তোর জন্য।
- বলে দে, বড় দিনে একসাথে খাব।
সোনানী জানে সুজন এমনি বাউণ্ডুলে। খাবার হিসেব নেই, চলার তো নয়ই। কেবল একটা জায়গায় সে পারফেক্ট- তা হলো কাজ। কাজে তার কোন ফাঁকি নেই কোন দিন। সে জন্য সোনালীর স্বামী সুজনকে নিজের কোম্পানীতে কাজ দিতে আগ্রহ দেখিয়েছিল। সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যেতে পারে আশংকায় সুজন সেই আগ্রহে সাড়া দেয়নি।
অবশেষে ইনডোর স্টেডিয়ামের দিকে এগোতে থাকে সুজন। তার গন্তব্য মিরপুর সাত নম্বর সেকশনের সাত নম্বর রোডের সাত নম্বর বাড়ীর সাত তলার ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাট নম্বরটাও সাতের ঘরে, ইংরেজীতে ‘জি’। সাধারণত কোন উঁচু ভবনের ফ্ল্যাট নম্বর হয় প্রতি তলার ফ্ল্যাট ধরে ধারাবাহিকভাবে। ওদের ফ্ল্যাটটের নম্বরের ধারাবহিকতা হয়েছে নীচ থেকে উপরে; এমনটি করে- নীচ তলার প্রথম ফ্ল্যাটটি ‘এ’; এর পরে দোতলার ঠিক ওপরেরটি ‘বি’- এভাবে। সুজন বাড়ীওয়ালার রুচির তারিফ করে মনে মনে।
কল বেল বাজানোর সাথে সাথেই দরজা খোলে সুষ্মিতা। মনে হলো দরজা খোলার জন্যই হয়তবা সে দাড়িয়েছিল ঠাঁয়। মুখদর্শনে চমকে যায় সুজন।
বসার ঘরে সোফায় আরাম করে বসেই
- এক গ্লাস পানি দেবে?
হাসিমুখে উঠে পানি দিতে দিতে বলে সুষ্মিতা:
- এমন পাগলামী না করলে হতো না?
- তা হলে চলে যাই?
- যাও তো দেখি!
সুষ্মিতা জানে, সুজন এতটা পথ হেঁটে এসে ক্লান্ত; মুখে বললেও সে এখনই উঠবে না। সুজন নিজেও এখনই ওঠার জন্য আসে নি এতটা পথ।
সুষ্মিতা বাঙালী ঢঙ্গে শাড়ী পড়েছে। একেবারেই সাদাসিধা আটপৌঢ়ে শাড়ী। হালকা সবুজ রঙের ব্লাউজের গলাটা একটু বড়। এমন ব্লাউজ পড়ে সে বাড়ীর বাইরে যায় না কখনো- একটু ঢিলে-ঢালা; বেশ লাগছিলো তাকে। প্রকান্ড গলার ব্লাউজের ওপর সাদা এবং তার ওপরে সাদা সুতোর কাজ করা শাড়ীর আঁচল ডান হাতের নীচ থেকে পয়তাল্লিশ ডিগ্রী কোনে বাম কাঁধের ওপর পেচানো। গলায় সরু স্বর্ণের চেইন। বুকের মাঝখানে, যেখানটায় ছোট একটা শীর্ণধারা দৃশ্যমান, লাল পাথর বসানো লকেটটা সেখানে সেঁটে আছে। ওটা সুষ্মিমতার সৌন্দর্য বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে। এক নজরে তাকিয়ে সুজন; যেন গোগ্রাসে গিলছে তার সৌন্দর্য।
দার্জিলিং এর টাইগার হিলে উঠে প্রত্যুষে কাঞ্চজক্সঘা ও হিমালয়, দুটোই দেখেছে সুজন- বহুবার। তুলনামূলকভাবে কাঞ্চজক্সঘাই ভাল লেগেছে তার। তবে প্রকৃতির কাঁচুলী জড়ানো উই ঢিবি দেখতে সব থেকে ভাললাগে তার কাছে- বান্দবানের নীলগিরীতে। সারিবদ্ধ টিলা, সবুজ রঙের কাঁচুলী জড়িয়ে পুরো বান্দরবানের সৌন্দর্যকে সত্যিকার রমনীয় করে রেখেছে। সুষ্মিতার দিকে তাকিয়ে সামনে নীলগিরী থেকে দেখা বান্দরবানকেই দেখছিল সুজন।
সুষ্মিতা জানে সুজনের স্বভাব। তাকিয়ে থেকে দেখায় তার জুড়ি নেই। নীরব দর্শক হিসেবে সুজনের চেয়ে উত্তম কাউকে পাওয়া যাবে না। তাই সেও তাকিয়ে থাকে সুজনের দিকে। কতক্ষণ! এক মিনিট, দুই মিনিট; না কি তারও বেশী! সুজনের মত নীরব দর্শক সে নয়, তাই
- ক্লান্ত শরীরে অমন করে কি দেখছো?
- কাঁচুলী জড়ানো নীলগিরী।
এবারে সুষ্মিতা শাড়ীর আঁচল ঠিক করার চেষ্টা করে, যদিবা ওটা আগে থেকেই সঠিক জায়গাতেই ছিল।
- হাত যখন লাগালেই, আঁচলটা নামাও না!
- ধ্যাত!
- কেন, ভরসা হারিয়ে গেছে?
- চোখে কোন জড়তা নেই তোমার?
- না!
- হেঁটে এলে কেন?
- মন চাইছিল, তাই।
- আমায় ইম্প্রেপ্রস করতে চাও?
- বলতে পারো, আবার নাও বলতে পারো।
- এতটা পথ কোন পাগলেও হাটে না!
- আমি তো পাগল নই।
- তুমি মহাপাগল।
এবারে দু’জনেই হাসে।
উঠে দাড়ায় সুষ্মিতা। চা বানানোর জন্য ছুটি চায়। সুজনও সায় দেয়। সুষ্মিতার প্রস্থান লক্ষ্য করলেও সহসা সোফায় শরীরটা এলিয়ে দেয় সুজন।
গুলশান বনানীর সীমানা নির্ধারণী লেকের ওপরে নতুন তৈরী সেতুর ওপর দাড়িয়ে পূর্ণিমার চাঁদ দেখবে সুষ্মিতা আর সুজন। মেঘলা আকাশ ওদের আনন্দের মাঝে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছে এরি মধ্যে। তবু মাঝে মধ্যে হালকা কালো-সাদা মেঘের ফাঁকে ভরা পূর্ণিমার চাঁদ যখন আকাশে হেসে-খেলে ছুটে চলে অবিরাম, লেকের জলে তা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে হাজারো চন্দ্রকণার কৃত্রিম ও ক্ষণস্থায়ী উপস্থিতি বেশ উপভোগ করে ওরা। শরতের প্রথম পূর্ণিমা; প্রথাগতভাবেই খন্ড খন্ড সাদা আর ছাই রঙের মেঘের ফাঁকে ফাঁকে ভরা যৌবনা নারীর মত প্রস্ফুটিত র্পূণ চাঁদ।
যখন ওরা লেকের ধারে পৌঁছায়, তখনও চাঁদ ছিল মেঘে ঢাকা। সুষ্মিতা মন খারাপ করে বলে
- ভাগ্যদেবতা আমাদের অনুক‚লে নয়, চলো ফিরে যাই।
- এসেছি যখন, একটু বসে যাই।
সেতুর ওপরেই দাড়ায় ওরা। লোক-জনের বেশ আনাগোনা। গল্প করে সময় কাটানোর জন্য দারুন একটা জায়গা। ওদের সময়টা বেশ কাটে! ওরা দু’জনেই পূর্ণ চাঁদ ভালবাসে; জীবনের পূর্ণতা পায়নি বলে হয়তোবা।
সুষ্মিতার মত সংগ্রামী নারীকে শ্রদ্ধা করে সুজন। নিজে কাজ ভালবাসেই বলেই হয়ত। সুষ্মিতাকে সংগ্রামে উৎসাহ দেয়, সাহস জোগায়। বিনিময় একটাই- একত্রে পূর্ণ চাঁদ দেখা।
না, ওদের চাওয়া-পাওয়ার গন্ডি এখনো সীমানা অতিক্রম করেনি।
সীমানা অতিক্রমে সুজনের একটা নিজস্ব মতামত রয়েছে। ছেলে বেলায় এনুয়েল স্পোর্টস্ এ তিন পায়ের দৌড় বলে একটা খেলা হত। দু’জন প্রতিযোগী মিলে তিন পায়ে দৌড়াতে হতো। একজনের ডান পায়ের সাথে অন্যজনের বাম পা বেঁধে দেয়া হত। দু’জনের তখন কর্মক্ষম পা তিনটি। সেই জুটি সবচেয়ে ভাল দৌড়াতে পারতো, যাদের মধ্যে পারষ্পরিক সমঝোতা বা একসাথে দৌড়ানোর ইচ্ছেটা একসাথে হতো; তারাই প্রথম বা দ্বিতীয় স্থান দখল করতো।
নারী পুরুষের সম্পর্কের সীমানা অতিক্রমের ক্ষেত্রেও এমনি ইচ্ছে শক্তি বা একে অপরকে পাওয়ার ইচ্ছেটা জন্ম নিতে হয়; একজন চাইলেই তা পূর্ণ হবার নয়।
রাত বাড়ে; সুষ্মিতা ফেরার তাগিদ দেয়। সুজন অসম্মতি জানিয়ে বলে:
- আমি পূর্ণিমার স্বাদ নেব, ঈশ্বর তা হতে দেবেন না- এমনটি হতে পারে না। আধা ঘন্টা অপেক্ষা করো, মেঘ না কাটলে চলে যাব।
সুজনের অপ্তবাক্যে সুষ্মিতা রাজী হয়। সে বহুবার দেখেছে ধর্মহীন মানুষটার একটা শুভ পরিনতি আছে। ধর্মীয় অনুশাসন না মানলেও তার চলার পথে বক্ররেখার কোন উপস্থিতি নেই। তার চাওয়া-পাওয়ার হিসেবে-মেলে সবসময়ে, তবে ঠিক পৌরে বারটায়।
চা নিয়ে ফিরে এসে সুষ্মিতা দেখে সুজন ঘুমিয়ে গেছে সোফায়। মাথায় হাত রেখে ডাকতে যায় সে- তখনই চোখ মেলে তাকায় সুজন।
- বড্ড ক্লান্ত, তাই না?
- হুম! তবে, সেই রাতে আমরা ঠিক পূর্ণিমার চাঁদ দেখেছিলাম, তাই না?
হেসে ফেলে সুষ্মিতা। কাবাবের প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে বলে:
- তোমার জীবনটাইতো পৌনে বারটায় বাঁধা।
সুজনও হাসে। গরুর মাংসের গরম কাবাব হাতে নিয়ে বলে:
- এত অল্প সময়ে করলে কি করে?
- সবই তৈরী ছিল, কেবলি তেলে ভাজার কাজটা করেছি। নাও, ঠান্ডা হয়ে যাবে।
সুজন এলেই নিজের হাতে বানানো খাবার খাওয়াতে পছন্দ সুষ্মিতার। কারণ হয়তো সুজনের ভাল কাওয়া হয় না বহুদিন ধরে, তাই। সুজনও বিষয়টা বেশ উপভোগ করে। এমনও দিন গেছে, সুজন আসার পর ভাত সাংস রান্না করে খাইয়েছে সে।
সুষ্মিতার সবই পছন্দ সুজনের; কেবল ধর্মবিশ্বাস ছাড়া। সুজনও মানব ধর্মের বাইরে যেতে চায় না। সে কারণেই কাঁচুলী জড়ানো ধরণীর কাছাকাছি যাওয়া হয়ে ওঠেনি সুজনের। সুষ্মিতা বহুবার বলেছে:
- আমার জন্য অন্তত এই টুকু করে দেখাও।
- নিজের সাথে প্রতারণা করতে বলো?
- তা কেন?
তা নয়তো কি? যা আমি বিশ্বাস করিনা, সেইটে করা বা বলাই তো নিজের সাথে প্রতারণার সামিল।
- সানজিদাকে তো এমনি একটা কাগজ দিয়েছিলে তখন!
কথাটা বলেই দাঁতে জিব কাটে সুষ্মিতা। সুজন কিছু বলার আগেই বলে:
- তোমায় কষ্ট দেয়ার জন্য কথাটা বলিনি সুজন।
সাবলিল ঢঙে সুজন উত্তর দেয়:
- ওটা দিয়েছিলাম ওর বিদেশ যাওয়ার সুবিধের জন্য। কাজটা অন্যায় ছিল বলেই হয়ত ওকে আর ফিরে পাইনি।
- এ জন্য কষ্টবোধ আছে তোমার?
- থাকলেই বা করার কি আছে, বল?
কথা বাড়ায়নি সুষ্মিতা; সুজনও না। প্রসঙ্গ বদলে সুজন এমনটি বলে:
- ধরণীর বুকে সমর্পিত না হতে পারলেও দর্শনে কোন দোষ থাকার কথা নয়।
সুষ্মিতা বোঝে- সুজন কি বলতে চাইছে। চোখের ভাষায় সে বলতে চাইছে:
- এমনটি আব্দার করোনা গো!
একই ভাষায় সুজনও বলে:
-তাই হোক। আমরা না হয় রেল লাইনের মত সমান্তরালে চলতে থাকি; সেটাই উত্তম পথ। দেখা হবে, কথা হবে, দূর থেকে দৃশ্যমান হবে- দূরে কোথায়ও আমরা মিলিত হয়েছি; প্রকৃতার্থে তা হবার নয় কোনও দিন!
সাদামাটা “আল্লাহ হাফেজ” শব্দে বিদায় জানায় সুষ্মিতা; সুজন অবশ্য বলে “খোদা হাফেজ”।
রিক্সা ব্লু লেগুর অতিক্রম করছে। হেমন্তের আকাশে একাদমীর চাঁদ মেঘে ডেকে আছে। সুজন জানে খানিক বাদে একাদশীর চাঁদ মেঘমুক্ত হবে। সোডিয়াম বাতির কিম্ভুতকিমাকার রঙে উদ্ভাসিত ঢাকায় ঐ চাদের আলোর বন্যা কোনই আবেদন তৈরী করতে পারবে না। ঢাকাবাসী উপভোগ করতে পারবে না একাদশী চাঁদের অপূর্ব রূপ ও রস।
বাসায় ফিরে নিত্যকার অভ্যেসমত চা তৈরী করে বিছানায় চারটে কুশন দিয়ে কৃত্রিম টেবিল বানিয়ে বই নিয়ে বসে; পাশে কাগজ কলমতো রয়েছেই।
চারিদিকে নীরব- নিত্যকার মত। সুজন বুদ্ধদেব গুহ’র ‘বনজ্যোৎস্নায় সবুজ অন্ধকারে’ নিমগ্ন। বনে-জঙ্গলে গুরতে ঘুরতে হঠাৎ তার চোখের গতি থেমে যায় একটি চরনে, “নারীমাত্রই জলের মত। কোথায় যে তারা কখন গড়িয়ে যায় ¯^ভাবেরই কারণে, তা শুধু ঈশ্বরই জানেন।” তখনি মুঠোফোনে সর্ট মেসেজ, যা এসএমএস নামে সকলে জানেন; প্রাপ্তির ঘোষণা। গত দু’তিন দিন ধরে ঈদের শুভেচ্ছা জ্ঞাপক সর্ট মেসেজ ডিলিট করতে করতে সুজনের বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুল বিরক্ত হয়ে গেছে। ডান হাতে ফোনটা নিয়ে অবাক হয় সে, সুষ্মিতা লিখেছে:
“কিছু কিছু বিদায় সুখের হয় না। আজ ঠিক তাই হল। একটা কি যেন অপূর্ণতা ছিল”।
সর্ট মেসেজ পাঠাতে সুষ্মিতার জুড়ি নেই। কোন কোন দিন ৫টা বা তারও বেশী সর্ট মেসেজ পাঠায় সে। সুজন সেগুলো সুন্দর করে লিখে রাখে ডাইরীর পাতায়। বিষয়টা জেনে সুষ্মিতা বলেছিল:
- এটা পাগলামী ছাড়া কিছু নয়।
সুজন বলেছিল দৃঢ়তার সাথে:
- তোমার সর্ট মেসেজগুলো আগে-পরে সাজিয়ে সুন্দর একটা গল্প হতে পারে। দেখো, এই আমি একদিন এ অসাধ্য সাধন করে ফেলবো।
কথাটা মনে হতে দিন কয়েক আগে সুষ্মিতার পাঠানো আরেকটি মেসেজ আবারো পড়তে মনে চাইলো তার। মেসেজটির কথাগুলো ছিল এমনতরো:
“মনের মাধুরী মিশিয়ে ভাল লাগার মানুষের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছি বহুবার, পারিনি। পুজোর বলির জন্য উৎসর্গীকৃত পশুর মত হাতে-পায়ে শিকল আমার। মনটাতো আর ওরা বেঁধে রাখতে পারেনি। তাই উদ্যামে ছুটে যায় সেটি যখন তখন, সেথা খুশী সেথা। তাইতো মন ভরে কথা বলি, মিষ্টি প্রেমের কথা বলতে চাই। দুনিয়ার তাবৎ জটিলতার কাছে এ জীবন উৎসর্গীকৃত হলেও মনটা ভাললাগা আর ভালবাসার কাছে উৎসর্গীকৃত”।
এ দু’টো সর্ট মেসেজ সুজনকে ভাবতে শেখায়। ভাবতে বাধ্য করে সুষ্মিতার পূর্ণ গগণ নিয়ে। তবে কি সুষ্মিতার পূর্ণ চন্দ্র আলোক বিচ্ছুরণ ঘটাচ্ছে? মনে হয় তাই; তবে আকাশের যেখানটায় পূর্ণ চন্দ্র, তারও অনেক অনেক নীচে কালো মেঘের ঘনঘটা। তাই দৃশ্যমান নয় সেই আলোর ছটা; এ যেন আষাঢের শুক্লপক্ষের ভরা পূর্ণিমার চাঁদ- আলো ছড়াচ্ছে- মনুষ্যক‚ল দেখতে পাচ্ছে না; ধরণী বঞ্চিত হচ্ছে ভরা পূর্ণিমার আলোর বন্যার সৌন্দর্য থেকে।