আজ বিশেষ কোন দিন না। তারপরও হটাৎ কেন জানি খুব দেখতে ইচ্ছে করছে বাবাকে। ইদানিং একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, আমি বাবাকেই সবচেয়ে বেশি ভালবাসি। তিনি ছাড়া কোন ভাবনা আমার মাথাতেই আসেনা। কেন এমন হয়? একরকম অপরাধবোধ কাজ করে সবসময়। এমনও মনে হয়, যদি নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে সামান্যতম কিছু করতে পারতাম মানুষটির জন্য।
আমার বাবা আট-নয় বছর বয়সেই তাঁর বাবা-মাকে হারান। একমাত্র বড় ভাই যিনি, তিনি সেরকম কোন দায়িত্ব বহন করেননি কখনোই। সে অর্থে আমার বাবা ছিলেন একজন পরিবারহীন মানুষ। শুধু বড় হওয়ার আশায় তিনি ১৯৬৩ সালে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শহরে এসেছিলেন। বেঁচে থাকার তাগিদেই এসেছিলেন। এতিমখানায় বড় হয়েছেন। বাড়ি বাড়ি টিউশনি করে পড়াশুনা করেছেন। কখনো প্লাটফর্মে শুয়ে রাত কাটিয়েছেন। পড়াশুনার পাশাপাশি কখনো দিন মজুরির কাজও করেছেন।
এতো গেল বাবার ছাত্রজীবন। ছোটখাট একটা অফিসে সামান্য বেতনের কাজ করতেন তিনি। সেই অর্থ দিয়ে আমাদের পরিবার কখনো চলতো, কখনো চলতো না। মা প্রায়ই কাঁদতেন। তার একটাই চিন্তা, সংসারটা চলবে কিভাবে? বাবা সকাল থেকে রাত বারোটা, কখনো বা সারারাত কাজ করতেন । তিনিই ছিলেন আমার শিক্ষক। আমাকে পড়া শিখাতেন, লিখাতেন, ঘুরতে বের হতেন। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসে বাবার সাইকেলে চড়ে ঘুরতে বের হতাম, কুচকাওয়াজ দেখতে যেতাম। কখনো যেতাম শহীদ মিনারে। রবীন্দ্রনাথের "দুই বিঘা জমি" সম্পূর্ন মুখস্থ ছিল বাবার। আমি অবাক হয়ে শুনতাম সেই কবিতা । এখনো মনে পড়লে বুকটা ছ্যাৎ করে উঠে। বাবার প্রিয় বই "গল্পগুচ্ছ" ৭১-এ কিভাবে যেন হারিয়ে যায়। ঠিক যেভাবে সেসময় বাবা নিঁখোজ হয়েছিলেন। গ্রামে প্রচার হয়ে গিয়েছিল যে, বাবা মারা গেছেন। আমার একমাত্র চাচা শহরে এসে বাবার কোন খোঁজ পেয়েছিলেন না ।
বাবা প্রায়ই বলতেন, "আমার বাবা-মা, পরিবার, বাড়িঘর ছিলনা।" তুমি পরিবার পেয়েছ, বাবা-মা পেয়েছ, থাকার জন্য শহরের বুকে একটি বাড়ি পেয়েছ। খুব কষ্ট করে এগুলো আমি করেছি। আমার মত অভাগা আর কেউ নেই। তোমার যে কোন সমস্যার জন্য আমি তোমার পাশে আছি। কিন্তু আমার পাশে থাকার মত কোন কালে কেউ ছিলনা।"
আমি তখন কলেজে উঠেছি। সতের বছর বয়সের এক অবাধ্য তরুণ। বিন্দুমাত্র পড়াশুনা না করে বিভিন্ন কারন অকারনে বাবার কষ্টার্জিত অর্থ খরচ করতাম, আড্ডা দিতাম। রাত করে বাসায় ফিরতাম। জেদ করে এখানে ওখানে যেতে চাইতাম। বাবা রাগারাগি করতেন। আমি খারাপ ব্যবহার করতাম। দিনকে দিন কোন অন্ধকারে যে ডুবেছিলাম ভাবলে এখনো কষ্ট হয়। বাবা সারাদিন বাইরে কত কষ্ট করতেন, বাসায় এসেও কষ্ট পেতেন। প্রায়ই আমাকে নিয়ে অশান্তি তৈরী হত।
আমার বাবা বাইরেও যে কত কষ্টে থাকতেন তা নিজের চোখে না দেখলে বুঝতে পারতাম না । একদিন বাবার অফিসে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন কি এক কাজে। অফিসের যিনি বস, একটু অন্যরকম মানুষ, ছোটবেলায় যাকে আমি প্রথম দেখা শয়তান ভাবতাম, বাবাকে চা-সিগারেট আনতে দিয়েছেন অপদস্ত আর অপমান করার জন্য। বাবা বসের আদেশ অনুযায়ী চা- সিগারেট নিয়ে যখন বসের রুমে প্রবেশ করলেন তখন চেয়ারে বসা ভদ্রলোক চেয়ার ছেড়ে হটাৎ উঠে পড়লেন, " স্যার আপনি? কেমন আছেন স্যার ? চিনতে পারছেন আমাকে ?' বাবা অবাক হয়ে যান। সেই কবে ক্লাস ফাইভে না সিঙ্ েপড়িয়েছেন মকবুলকে। আজ সে সরকারী অফিসের বড় কর্মকর্তা। বাবা চিনেও না চেনার ভান করলেন, "সরি স্যার আপনার সম্ভবত কোথাও ভুল হচ্ছে।" বাবা রুম থেকে বেরিয়ে আসেন। পরবতর্ীতে সেই অফিসের চাকরী তিনি ছেড়ে দেন। সৎ ও সম্মানের সাথে কাজ করার উপায় কোথাও নেই। টিকে থাকতে হলে অসৎ হতে হবে, উপর ওয়ালাদের তোষামুদি করতে হবে। আমার কি কপাল সেদিন বাবাকে হাতে ফ্লাঙ্ ভর্তি চা, সিগারেট দেখে চমকে গিয়েছিলাম। বোকা মানুষটাকে যে যেরকম ভাবে পারে কাজ করিয়ে নেয়। এরকম কত ভাবে বাবা অপদস্ত হয়েছে শুধু সৎ মানুষ বলেই। আমি নিজেও খারাপ ব্যবহার করেছি, ভাবলেই কষ্ট পাই, কান্না আসে। পরবর্তীতে নিজের ভুলগুলো বুঝতে পেরেছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে চাকরীর আশায় ঢাকায় আছি অনেক দিন। বেকার জীবন, মন খারাপ হলে ছাদে যায়, আকাশ দেখি। আমার বাবাও আকাশের মত উদার।
ভালবাসা কি, আমি জানিনা। আমার অস্তিত্ত্ব, শূন্যস্থান, স্বপ্ন, সব কিছুর মূলে রয়েছে একজন মানুষ। আমার সব ভাললাগা, ভালবাসা শুধু সে মানুষটির জন্য। তিনি আমার বাবা, আমার আদর্শ।
০৩ এপ্রিল - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৪ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪