কোকিল বাসা বানাতে জানে না। সে কাকের বাসায় ডিম পাড়ে। একদিন এক বসন্তের সকালে এক কাকের বাসায় ডিম পেড়ে চলে গেল এক কোকিল- মা। কাক-মা যতেœর নিজের ডিমের সঙ্গে ওই ডিমেও তা দিয়ে ফুটিয়ে তুললো বাচ্চা। খাইয়ে-দাইয়ে বুকের ওমে বড় করে তুললো বাচ্চাটাকে। কিন্তু হা-কপাল! এই বচ্চাটা কার ? এ- যে পরের ছা। এতো যতœ করে সে বড় করেছে কোকিলের বাচ্চা। কষ্টে ভরে গেল কাক-মায়ের মন। কোকিল মায়ের ওপর খুব রাগ হলো। কোকিল- মা, কাক-মায়ের ডিম ফেলে দিয়ে নিজে ডিম পেড়ে চলে গেছে। রাগে ক্ষোভে এতোদিনের আদরে পালিত কোকিল-মেয়েকে ঠুকরিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলো। জিদ হলো কোকিল-মেয়ের ওপর নয়, কোকিল-মায়ের ওপর। সেই রাগ-ক্ষোভ মিটালো সে কোকিল-মেয়ের ওপর।
উড়ে গেল কোকিল-ছা। উড়ে গেল মায়ের কাছে। কোকিল-মা, কোকিল মেয়ে। মায়ের সঙ্গে বাঁধনের ভিত মজবুত হলেও সুক্ষè চুলের মতো একটা ফাটল আছে মা-মেয়ের সম্পর্কে। মাঝেমধ্যে কোকিল মেয়ের যেতে ইচ্ছা করে কাক-বাবার কাছে। কাক-বাবাই তাকে মুখে তুলে খাইয়েছে, পিঠে করে উড়ে উড়ে চিনিয়েছে গাছ-লতা-পাতা-ঘাস। চিনিয়েছে নদ-নদী, প্রজাপতি ফড়িং। কাক-মা রেগে গিয়েছে তবুও কাক-বাবা ছাড়েনি, ছাড়তে চায়নি তার এতোদিনের যতেœ আদরে লালিত কোকিল-মেয়েকে। হোক কোকিল-মেয়ে, পালন করেছে তো নিজে। শুধু কি জন্ম দিলে পিতা, মাতা হয় ! না, তা হয় না ! যে লালন-পালন করে সেই আসল পিতা বা আসল মা। কোকিল-মেয়ে, কাক-বাবার প্রাণ! ও যেন কাক-বাবার হৃদপিন্ড। যতোদিন উড়তে শিখেনি ততোদিন কাক-বাবা, কাক-মায়ের কাছ থেকে আগলে রেখেছে কোকিল-মেয়েকে। কাক-মাকে অনেক বুঝালো কাক-বাবা, কিন্তু কাক-মায়ের রাগ যায় না। বুকের ভেতরের কষ্টের আগুনে-আঁচ বাড়তে বাড়তে লেলিহান শিখায় দাউ-দাউ জ্বলে এখন। কাক-বাবার জন্য কিছু বলতে পারে না। শুধু আগুন-চোখে তাকিয়ে থাকে।
একদিন কাক-বাবা বাসায় নেই, দূর বনে গেছে খাবার সংগ্রহের জন্য, ঠিক সেই মুহূর্তে কাক-মা তাড়িয়ে দিলো ওকে। কোকিল-মেয়ে প্রথমে উড়ে উড়ে খোঁজ করলো কাক-বাবার, অপেক্ষা করলো। কাক-বাবা আসতে দেরী করেছে, এই ফাঁকে কাক-মা ঠুকরিয়ে বনের বাইরে দিয়ে এলো ওকে। কোকিল-মেয়ে মনের দুঃখে ফিরে এলো তার মায়ের কাছে। এই কোকিল-মা শুধু ডিম পাড়তে পারে, তাও অন্যের বাসায়। নিজে বাসা বানাতে জানে না, জানে না কীভাবে বাচ্চা বড় করতে হয়। বাচ্চাকে আদর করতে জানে না, জানে না কোলে পিঠে নিতে।
কোকিল-মা জানে না কী ভাবে মেয়েকে পিঠে নিয়ে উড়বে বন থেকে বনে, গাছ থেকে গাছে। শুধু মাঝে মাঝে একসঙ্গে বসে থাকে, কোথায় কী হলো এসব কথা বলে। কখনও একসঙ্গে খাবার সংগ্রহের জন্য যায়। কোকিল-মা ভালোবাসে কিন্তু তার প্রকাশ নেই। কোকিল-মেয়ের মন চায় একটু আদর, একটু ভালোবাসার কথা শুনতে। মা যেন ওকে বলে, ও আমার সোনা মা ! আমার কলিজা। নাহ ! এসব কিছুই শুনতে পায় না কোকিল- মেয়ে। কাক-বাবার কথা খুব মনে পড়ে কোকিল- মেয়ের। মনে কষ্ট নিয়ে খুঁজতে থাকে কাক-বাবাকে। উড়ে উড়ে খোঁজ করে কাক-বাবাকে। সবুজ বন, সাদা কাশবন পেরিয়ে যায়। পেরিয়ে যায় সোনালি ধানক্ষেত। হলুদ সরষে ফুলের সৌন্দর্য দেখে আর ভাবে, ইস, কাক-বাবা যদি থাকতো এখন খুব মজা হতো। কতো কথা বলতো, গল্প করতো। সরষে ফুল তুলে এনে দিতো। চোখ দিয়ে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে কোকিল-মেয়ের। ওখান থেকে উড়ে গিয়ে বসে ঘন সবুজ পাতাওয়ালা একটা গাছে।
এমন সময় পরিচিত একটা আওয়াজ শুনতে পায়। কোকিল-মেয়ে তাকিয়ে দেখে অবাক! ওমা! এ-যে কাক-বাবা। কোকিল-মেয়ে উড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাক-বাবার বুকে। কেঁদে ভাসিয়ে দেয় বাবার বুকের নরম পালক। বাবাও আদরে আদরে ভরিয়ে দিলো ওকে। তারপর বসিয়ে দিলো সামনের ডালে। কথা বললো দুজনে। প্রাণভরে, মন খুলে কথা বললো। দুজনের কথা যেন ফুরায় না। কাক-বাবা গাছ থেকে ফল পেড়ে মুখে তুলে খাওয়ালো ছোটবেলার মতো। দুজনের কথা একসময় শেষ হলো।
কোকিল-মেয়ে বলে, বাবা, তোমার জন্য মন কেমন করে। অনেক খুঁজেছি তোমাকে। বাবা চলো যাই আমার মায়ের কাছে। আমার মা, একা থাকে। আমি ছাড়া তো মায়ের কেউ নেই। কাক-বাবাও রাজী। কোকিল- মেয়ে চলে আসার পর বাসায় মন টেকেনি কাক-বাবার, সেও চলে এসেছে। ওই বাসা, বউ, ছেলেমেয়ে কোন কিছুতেই মন বসেনি তার। ঘুরে ঘুরে শুধু কোকিল মেয়েকে খুঁজে বেরিয়েছে। কোকিল-মেয়েকে পেয়ে কাক-বাবার চোখও শুকনো থাকে না। মেয়েকে পিঠে নিয়ে উড়ে যায় বাবা। নদী পেরিয়ে, সরষে ক্ষেত পেরিয়ে ওরা পৌঁছালো কোকিল- মায়ের কাছে। কোকিল-মায়ের তো বাসা নেই। মা-মেয়ে থাকে গাছের ডালে পাতার ফাঁকে। মা আর মেয়ের জন্য একটা সুন্দর বাসা বানালো কাক-বাবা। কোকিল-মা, কোকিল-মেয়ে আর কাক-বাবা, ওরা থাকে এক বাসায়। কোকিল মাকে-ও ভালো লেগে গেছে কাক-বাবার। কোকিল-মাকে অনেক আগেই ছেড়ে চলে গেছে কোকিল-বাবা। কোকিল-মায়ের মন খারাপ লাগে, কষ্ট হয় কোকিল-বাবার জন্য। কিন্তু সে দুঃখ-কষ্ট একটু একটু করে ভুলিয়ে দিতে থাকে কাক-বাবা। কাক-বাবাকে ছাড়তে চায় না কোকিল-মা। তা-ছাড়া কাক-বাবাকে ছাড়লে তার মেয়েকেও ছেড়ে দিতে হবে। মেয়ে তো তার কলিজার টুকরা এখন। তার হৃদয়ের একমাত্র প্রদীপ। কিন্তু মেয়ে তো কাক-বাবা ছাড়া থাকবে না, থাকতে চায় না।
কাক-বাবাও তো ওদের ছাড়া থাকতে পারে না। পারবেও না। কোকিল-মা আর কোকিল-মেয়ের জন্য নিজের জীবন দিতে পারে কাক-বাবা। কাক-বাবার নিজের জন্য চিন্তা নেই। কেবলই চিন্তা কী ভাবে ওদের ভালো হবে। ভালো রাখবে ওদের। কোকিল-মা-ও তো পছন্দ করে কাক-বাবাকে। তবুও মনে কষ্টের উথাল-পাথাল। কাক-বাবা বাসায় থাকার আগে তার মেয়ের যতোটা লাগোয়া ছিল তার সঙ্গে, এখন আর ততোটা লাগোয়া নাই। কোকিল-মা কিছু বলে না, বলতে পারে না। কাক-বাবাকে পছন্দ করে সেও। এখন একটু একটু ভালোবাসতেও শুরু করেছে। তা ছাড়াও তার মেয়েকে আদর করে কাক-বাবা। যতœ করে খাওয়ায়, বেড়াতে নিয়ে যায়, অচেনা জিনিস চিনিয়ে দেয়, বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করে। কোকিল-মা-কে কিছুই করতে হয় না। করতে গিয়েও পারে না কারণ সন্তান লালন-পালন করতে জানে না সে। আদর করতে লজ্জা লাগে, মনে হয় আদর তো মনে মনেই করা যায়, এর জন্য কী দেখা-দেখি করার প্রয়োজন আছে? কিন্তু সবাই মনে হয় দেখানোটাই পছন্দ করে। কারণ আড়াল থেকে শুনেছে কোকিল-মেয়ের কাছে ওর বান্ধবী- দোয়েল, শ্যামা, ফিঙে, বউ কথা কও-মেয়েরা বলছে, তোর মা তো তোকে আদর করে না, মুখে তুলে খাইয়ে দেয় না, পিঠে করে ওড়ে না। কেমন মা! কোকিল মা দেখেছে মেয়ের করুণ মুখ, বেদনার্ত অশ্রæসজল চোখ। কাক-বাবা যখন আদর করে যখন দুচোখ ভরে দেখে। কাক-বাবার মতো আদর করতে চায় কিন্তু কেমন যেন বাধো বাধো লাগে। আদর করতে পারে না। কিছু বলতেও পারে না। তার মনে জল জমে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে জল বাড়ে। সে জল বাড়তে বাড়তে নদী হয়, তারপর সাগর, মহাসাগর হয়। সেই মহাসাগর উত্তাল ভাসিয়ে নিয়ে যায় ওর জীবন, হৃদয়, মন। কোকিল-মায়ের কিছু ভালো লাগে না এখন।
দিন-রাত প্রার্থনা করে ঈশ্বরের কাছে। হা, ঈশ্বর, তুমি কেন আমাকে মা হতে দিলে, কেন আমার মনে মায়ের মমতা দিলে, কেন কেন দিলে? যদি সন্তানের লালন-পালন করার শক্তি, সামর্থ, নাই-ই দিবে, তবে কেন মা হতে দিলে, মায়ের মমতা কেন দিলে বুকের ভেতর? সারাক্ষণ কাঁদে কোকিল-মা, উত্তর খুঁজে কেন এমন হলো, কেন এমন হয়! কিন্তু কোন উত্তর পায় না।