তোর থাইক্কা বেশী কামাই করি এখন আমি। তুই সাব গো বাড়ির কাম ছাইড়া দে।
শবেবরাতের সারা রাত রিকশা চালিয়ে ঘরে ফিরে চোঙা মুখে ‘স্কুলের মাঠে জনসভা, জনসভায় যোগ দিন, যোগ দিন’ জাতীয় চোঙা ফোকার মতো করে কথাগুলো বলে যায় লাল মিয়া।
লাল মিয়া রিকশা চালায়। লালমিয়ার বউ, লালমতি মালিবাগে এক ডাক্তারের বাসায় কাজ করে। তিন বছর ওই এক বাড়িতেই কাজ করছে। ওরা থাকে মালিবাগের এক চারে। চারগুলো তোলা হয় খালের ওপর। সাঁকোর মতো কাঠের পাটাতনের ওপর টিনের বেড়া দিয়ে বানানো এই চারের একটা ঘরে থাকে ওরা। ভাড়া ১২০০ টাকা। এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেটাকে একটা চায়ের দোকানে লাগিয়ে দিয়েছে লালমতি । মেয়েটা ছোট। কাজে যাওয়ার সময়, যাতে মেয়েটা নিচে খালের পানিতে পড়ে না যায় সে জন্য খাটের ওপর বসিয়ে খাটের পায়ার সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে যায় মেয়েটাকে । খাটটা ওদের বিয়ের খাট। সব কিছু গেছে। এটাই এখন আগেকার সব স্মৃতি ধরে রেখেছে।
লালমতি কাজে যাওয়ার আগে ছেলে মেয়েকে খাইয়ে নিজেও একটা পাউরুটির দুইটা টুকরা এক কাপ চা’য়ে চুবিয়ে খেয়ে পা মেলে বসে পান মুখে দিচ্ছিলো। স্বামীর কথা শুনে কিছু না বলে চোখ তুলে তাকায়।
আজ মেলা ট্যাকা কামাই হইছে, এই রকমই কামাই করুম। আর না খাইয়া থাকতে হইবো না। তোরেও আর কাম করতে হইবো না। লাল মিয়া বলে।
কয়দিন করবা এই রকম কাম, দেখা যাইবো নে। এখন গোসল দিয়া ভাত খাও। আমার কামে যাওনের সময় হইছে। যখন ট্যাকা কামাই করবা তখন কাম ছাইড়া দিমু নে। এখন যাও। আমার দেরী হইতাছে।
লাল মিয়া আর লালমতির গ্রামের বাড়ি শেরপুরে। পাশাপাশি বাড়িতে বেড়ে ওঠা ওদের। একসঙ্গে খেলাধূলা করেছে। বছর দুয়েকের ছোট বড়ো দুজনে। লাল মিয়া আর লালমতি দুজনের গায়ের রঙই ফর্সা। ছোটবেলায় ওদের গালে লাল আভা থাকার জন্য ওদের এই নাম রেখেছে ওদের বাবা-মা।
লাল মিয়া গ্রামের বড়ো ঘরের ছেলে। জোতদার না হলেও অভাব ছিলো না লাল মিয়ার বাবার। পরিবারে একটাই ছেলে হওয়ার কারণে ‘আদরে আদরে বাঁদর’ হওয়ায় প্রাইমারী ডিঙানো হয়ে ওঠে নি তার। আর লালমতির তো কথাই নেই। ভাই-বোন মিলে তারা এক ফুটবল টীম। সেখানে সবার ছোট লালমতি। ফুটবল টীমের জন্মদাতা আর জন্মদাত্রীর অজ্ঞানতার ফল ভোগ করতে হচ্ছে লালমতি আর ওর ভাইবোনদের।
লাল মিয়ার বাবা চেয়েছিলো ছেলে লেখাপড়া শিখে জজ-ব্যারিস্টার না হলেও একটা চাকরি করবে। কিন্তু লাল মিয়ার বাবার সে আশা পূরণ হয় নি। লাল মিয়ার পড়ায় মন ছিলো না। স্কুল পালিয়ে, সারাদিন মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়িয়ে, বনে জঙ্গলে পাখি পেড়ে, এর তার বাঁধা গরু ছাগল ছেড়ে দিয়ে কাটিয়েছে তার শিশুকাল। এসব কাজের সঙ্গী লালমতি। ছোট বেলার পুতুল খেলার সময় খেলাঘরের বর লাল মিয়া। খেলাঘরের মিছিমিছি হাট বাজার করতো লাল মিয়া আর রান্নাবান্না করতো লালমতি। গ্রামের লোকের কেউ বলতো ‘বট পাকুরের জুড়ি’ কেউবা বলতো শিব পার্বতী।
সেই লালমতি, ঋতুমতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওদের মেলামশা বন্ধ হয়ে যায়। তখন বহির্মুখী লাল মিয়ার কিছু দোস্ত-বন্ধু জুটে যায়, যারা খারাপ নেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলো । ওদের সঙ্গে মিশে লাল মিয়ারও ধরে যায় জুয়া খেলার মতো খারাপ নেশা। অভ্যাস হয় বিড়ি, সিগারেট খাওয়ার। প্রথম দিকে মার্বেল দিয়ে খেলতো। একটু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাসের আড্ডায় যাওয়া শুরু হয়। ঘরের জিনিষপত্র বিক্রি, মহাজনদের টাকার তাগাদায় অস্থির হয়ে ওঠে লাল মিয়ার বাবা। চিন্তা-ভাবনা করে স্থির করে বিয়ে দেওয়ার। মা বলে, বিয়ে দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। বিয়ে হয়ে যায় লালমতির সঙ্গে।
বিয়ের পর কয়েক বছর ভালোই ছিলো। জুয়া খেললেও লাল মিয়ার ভালোবাসার কোন কমতি ছিলো না। লাল মিয়ার ভালোবাসা এতোই ছিলো যে ১৪ বছরের লালমতির কাছে অসহ্য লাগতো। ওর কাছে মনে হতো মানুষটার ভালোবাসা আদর ঠিক ভালোবাসা বা আদর না, ক্ষুধা পেলে খাবার খাওয়ার মতো। ওর খারাপ লাগলেও বলতো না কিছু। বিয়ের দিন, ওর শাশুড়ি ওকে বলেছিলো,
শোন মা, আমার পোলাডারে ভালো করণের জন্যিই কিন্তু তোমারে এই বাড়িতে আনা। ও যা কয়, তা চোখ বন্ধ কইরা শুনবা।
শাশুড়ির কথামতো চলতে চেষ্টা করেছে। লাল মিয়ার কথার বাইরে যায় নি। মনে ভয় যদি কোন অঘটন ঘটে। সব মিলিয়ে দিন ভালোই যাচ্ছিলো। গোল বাধলো শ্বশুর মারা যাওয়ার পর। শ্বশুর মারা যাওয়ার পর বেড়ে গেলো জুয়ার নেশা। বাড়ি আসাও প্রায় বন্ধ। এক রাত আসে তো তিন রাত আসে না। সব জমি-জমা বিক্রি করে দিয়ে জুয়ায় হেরে শেষে বসত বাড়ি বিক্রি করতে চাইতেই মায়ের সঙ্গে শুরু হলো ঝগড়া, কথা কাটাকাটি। মায়ের হার্ট অ্যাটাক। মারা গেলো মা। মা মারা যেতে হুঁশ হলো ছেলের।
কিন্তু তখন তো তার কাছে কিছুই নেই, না জমি-জিরেত না থাকার ভিটে। অন্যের জমিতে কামলা দেওয়া শুরু করে। তাও একদিন করে তো দুইদিন করে না। ক্ষুধার আগুন জ্বলে জঠরে। সারাক্ষণ খাবার চাই, খাবার চাই। খাওয়ার পেট তো একটা না চারটা। ছোট মেয়েটার বয়স দুই মাস। দুধ চাই। নিজের ক্ষুধা তাও সহ্য করা যায়, কিন্তু চোখের সামনে ক্ষুধায় ছেলে মেয়ের কান্না সহ্য করতে না পেরে লালমতি বলে,
আমি চেয়ারম্যানের বাড়ি কাম করুম।
কথা শুনে লাল মিয়ার মাথায় হাত। নিজের গ্রামে বউরে তো কাম করতে দেওয়া যায় না। একটা ইজ্জত আছে তো তার ! কিন্তু বউ এর সঙ্গে রোজ ঝগড়া, রোজ বউ এর কান্না, রোজকার ঘ্যানঘ্যান ভালো লাগে না লাল মিয়ার। শেষে চলে আসে ঢাকা শহরের এই বস্তিতে।
লালমতির এই মুহূর্তে কাজ বাদ দিতে না চাওয়ায় রাগ করে না লাল মিয়া। আবারও সেই ভাষণ দেওয়ার মতো করেই কথা বলে লাল মিয়া।
না পরে না, আজ থাইক্কাই কাম বাদ দিতে হইবো, কাম বাদ দিবি কি, দিবি না ক’ ?
পান মুখে দিয়ে চিবুচ্ছিলো লালমতি। পানের পিচকি পিচ করে পাটাতনের ফাঁক দিয়ে ফেলে বলে,
ঠিকই আছে, কইতাছ যখন তখন ছাইড়া দিমু। বউরে খাওন-পরন দেওনের দায়িত্ব তো স্বামীর।
হাসে লালমতি। ওর হাসিতে বিরক্ত হয় লাল মিয়া। বলে,
হাসিস না, লালমতি, হাসির কথা কই নাই। তুই কী ভাবছস, আমি তোরে খুশী করার জন্য এই কথা কইতাছি , তা না। তুই কী মনে করছস, ভাত কাপড় দিয়া খুশী রাখতে পারুম না তোরে, পারুম রে, পারুম। ঠিকই পারুম । আমি ঠিক করছি, আর জুয়া খেলুম না। জুয়া খেলা খুব খারাপ কাম।
স্বামী জুয়া খেলবে না শুনে খুব খুশী হয় লালমতি। খুশীতে চিকচিক করে ওর দুটি চোখ। আদর আর আবেগে থরথর কাঁপে লালমতির কণ্ঠ। বলে,
সত্য কইতাছ, আর খেলবা না ! রোজ কাম করবা !
হ, হ, ঠিক কইতাছি। বিশ্বাস রাখ।
লালমতি সমস্ত মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ে।
ঠিক আছে, আমি কাম ছাইড়া দিলাম। এখন থাইক্কা পোলাডারেও আর কাম করতে দিমু না। ওরে ইস্কুলে দিমু। লেখাপড়া করামু। আমরা আবার আগের মতো থাকুম।
ঠিক কইছস বউ। আমি তো লেখাপড়া না কইরা ভাদাইম্মা হইছি, কাসেম রে আর ভাদাইম্মা হইতে দিমু না।
লাল মিয়ার দুই চোখ অপত্য স্নেহে ভিজে ওঠে। ছেলে, মেয়ে, বউ এর জন্য বুকের ভেতর খেলা করে আবেগ মথিত ভালোবাসা।
লালমতি ছেড়ে দেয় কাজ। লাল মিয়া আর খেলে না জুয়া। রোজ রিকশা নিয়ে বের হয়। কাজ শেষে ঘরে ফিরে সময় কাটায় বউ, ছেলে মেয়ের সঙ্গে। কোন কোন দিন রিকশায় ওদের নিয়ে বেড়াতে যায়।
লালমতি রান্না করে, স্বামী, ছেলে মেয়ের যত্ন করে। লাল মিয়ার কিনে দেওয়া শাড়ি, চুড়ি কসমেটিকস দিয়ে সাজুগুজু করে। আনন্দে ওর মনের আকাশে উড়ে বেড়ায় বালিহাঁসের ঝাঁক।
এমন করে হাসি আনন্দে কেটে যায় একটি বছর। লাল মিয়া এখন পাঁচটা রিকশার মালিক। ও নিজে একটা চালায় আর চারটা ভাড়া দেয়। একদিন লাল মিয়া এসে বলে,
ও বউ জিনিষপাতি সব বাইন্ধা নে, আমরা এ ঘর ছাইড়া দিমু। নতুন চারে নতুন ঘরে যামু।
নতুন চার, নতুন ঘর! বিস্মিত লালমতি। কোনখানে ?
ওই তো ওই খানে। সেদিন যে তোরে দেখাইয়া আনলাম। পাঁচটা ঘর লইয়া ওই চারটা কিনছি। অর্ধেক দাম দিছি, আর অর্ধেক ছয় মাস পরে দিলেই হইবো। পাঁচটা ঘরের, দুইটাতে থাকুম আর তিনটা ভাড়া দিমু।
এতো টাকা কই পাইলা? বলে লালমতি। লাল মিয়া বলে,
টাকার চিন্তা তোর না। তুই ওঠ। আরও শুইনা রাখ, পুনর্বাসন প্রকল্পে যে ফ্ল্যাট দিতাছে তাও কিনবার চেষ্টা চালাইতেছি।
ফিলাট কিনবা? অ্যাত্তো ট্যাকা কই পাইবা? আবার কোন কুকাম করতাছ না তো ? লালমতি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে।
ওঠ তো ওঠ। বেলা নাই, ওঠ। লাল মিয়া তাড়া দেয়।
লালমতি ছেলে মেয়েকে কাপড় পরিয়ে নিজেও সাজুগুজু করে তৈরি হয়। রিকশায় ওদের বসিয়ে নতুন চারের পথে রিকশা চালাতে থাকে লাল মিয়া। কথা বলে লালমতির সঙ্গে, ছেলে মেয়ের সঙ্গে। কথায় পেয়ে বসে লাল মিয়াকে।
তোরে নিয়া যে আমার অনেক আহ্লাদ আছে রে বউ, তুই জানোস না। তোরে এখন কেবলই সাজাইয়া রাখুম ঘরে। তুই সাজুগুজু করবি, পান খাবি আর বইয়া থাকবি। কোন কাম করবি না। পোলা-মাইয়া দেখন ছাড়া আর কোন কাম নাই তোর, বুঝলি।
স্বামীর কথায় হাসে লালমতি। বাতাসে ছড়ায় ওর হাসি। বাতাসে ওড়ে ওর লাল শাড়ির আঁচল।
লাল মিয়া গান ধরে- ‘ ঢাকা শহর দেখামু তরে ঘুইরা ঘুইরা’। রিকশার চাকা ঘোরে আর লাল মিয়ার মনের সৈকতে আগামি দিনের ভালবাসার সফেদ ঢেউ ভাঙে। লাল মিয়া ভাবে, আগে যতো কষ্ট লালমতিকে দিয়েছে, সব, সব কষ্ট সুদে-আসলে পুষিয়ে দিবে। অনেক অনেক আদর করবে লালমতিকে। লালমতি কোনদিন, কোন অনুযোগ করতে পারে এমন কোন সুযোগই আর দিবে না ওকে। লালমতিকে নিয়ে ভাবনার সঙ্গে ভালোবাসার সব রঙ নিয়ে এক সুন্দর সুখময় পাখির জন্ম হয় লাল মিয়ার বুকের ভেতর।
রিকশা চলছে। হঠাৎ ধাক্কা, উল্টে যায় রিকশা। রিকশায় পা-দানীতে আটকিয়ে যায় চালকের পা, আর ছিটকে যায় আরোহিরা। রিকশার নিচে চাপা পড়ে চালক। শোঁ শাঁ নাগালের বাইরে চলে যায় বাস। বাস যাওয়ার সঙ্গে বোম ব্লাস্টের মতো আওয়াজ হয়। দেখতে দেখতে মানুষ জমে যায় ওদের চারপাশে। কয়েকজন মিলে রিকশার ভেতর থেকে টেনে বের করে লাল মিয়াকে। লাল মিয়া ছেলে মেয়ের খোঁজ করে, পেয়েও যায়। কিন্তু লালমতি কোথায় ? লাল মিয়া ডাকে,
লালমতি, এই লালমতি, কই তুই? বউ রে, কই তুই ?
কিন্তু কে দিবে লাল মিয়ার ডাকে সাড়া। যে সাড়া দিবে, সে তো বাসের চাকায় পিষ্ট নিথর পড়ে আছে রাস্তায়। মাথা, মুখ থেতলে গিয়েছে। মাথার মগজ ছিটকে পড়েছে কয়েক হাত দূরে। রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে জমাট বাঁধছে লালমতির লাল আঁচলে।
পায়ে পায়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়ায় লাল মিয়া। তারপর বুকভাঙা স্বরে লালমতিরে--- ডেকেই লালমতির বুকের ওপর আছড়ে পড়ে। কয়েকজন মিলে সরিয়ে আনে ওকে। লাল মিয়া উঠতে চায় না। ওর বুকের ভেতর ছটফট করে ভালোবাসার সেই রঙিলা পাখি। লালমতিকে বুকের গভীরে জড়িয়ে ধরতে চায় সেই পাখি। অনেক অনেক আদর দিতে চায় লালমতিকে। কিন্তু কিছুই করতে পারে না, করা হয় না ওর। শুধু স্বপ্নভাঙা এক উদাস শূণ্য বেদনায় ভালোবাসার অমলিন ক্ষুধা তড়পাতে থাকে লাল মিয়ার বুকের ভেতরে। ওর বুকের ভেতরের এই ক্ষুধা, এই ছটফটানি টের পায় না দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো।