দীপাদের বাতিঘর

বাংলাদেশ (ডিসেম্বর ২০১৯)

Gazi Saiful Islam
  • 0
  • ৩৩
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই দীপার সঙ্গে পরিচয় হয় রাজের। দীপাই প্রথম প্রশ্ন করে,
কোন দল করেন?
উত্তরে রাজ বলল, কোনো দল করি না।
-কেন করেন না?
-কারণ, বিদ্যমান দলগুলোর কোনোটির উদ্দেশ্য ও আদর্শই আমার ভালো লাগে না। তাছাড়া আমার কল্পনায় যে দলের অস্তিত্ব আমি অনুভব করি সে দলের আজও জন্মই হয় নি। আর যদি হয়েও থাকে-তবে তার নেতা ও কর্মি আমি একাই।
-একা? ভারি অদ্ভুত কথা তো। একা আপনি কী করবেন? একা লড়ে তো আপনি জাতীয় পরিবর্তনের কথা ভাবতে পারেন না।
-‘আজ আমি একা, কিন্তু চিরদিন একা থাকব না। কৌত‚হলি ও সাহসী মানুষেরা একদিন তাদের প্রয়োজনেই আসবে আমার সঙ্গে মিল দিতে। আপনি হয়ত জানেন না, একা লড়ে আর কিছু না হোক একটা আদর্শের কথা মানুষের কাছে ঘোষণা করা যায়। পৃথিবীর বড় বড় রাজনীতিবিদদের অনেকে প্রথমেই দল নিয়ে কাজ শুরু করেন নি। শুরু করেছেনে একা, পরে গঠিত হয়েছে দল।’
এরপর রাজ ও দীপা আরও অনেক কথা বলল। রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য, দর্শন, ধর্ম ইত্যাদি সব বিষয়ে। শেষে দীপা প্রস্তাব করল, আমাদের দলে যোগ দিন, একসঙ্গে কাজ করা যাবে। আপনার চিন্তাগুলো ভালো-আমাদেরও কাজে লাগতে পারে।
রাজ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ‘না’ বোধক মাথা নাড়ল। সব কথা শুনেও আপনি আমাকে ডাকছেন?
-হ্যাঁ ডাকছি। ডাকাই যে আমাদের কাজ। তাছাড়া, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে এতদিন আপনাকেই আমি খুঁজছিলাম।
-তাই? আজ কী মনে হচ্ছে যাকে খুঁজছেন -পেলেন?
-‘হ্যাঁ, মনে তো হচ্ছে পেয়েছি। কিন্তু বড় দুঃখের সে পাওয়া। দু’জনের মাঝে দূরত্ব অনেক। এ দূরত্বটা কমাতে হবে। চলুন আরেকদিন বসি। আপনার কথা আমি শুনব, আমার কথা আপনি। যদি আমার যুক্তির কাছে আপনি হারেন আসবেন আমার দলে, আমি হারলে যাব আপনার দলে।
-রাজ বলব, ‘‘আমি রাজী। আমার দলটি দাঁড় করানোর জন্যও আপনার মতো মেয়ে প্রয়োজন। আসবেন আমার দলে?
-আসব, যদি আসবার মতো যুক্তি পারেন দেখাতে। আজ চলি, পাঁচটার ট্রেনে নেত্রকোণা যেতে হবে।

\ দুই \

পরে একদিন একটি নির্দিষ্ট তারিখে তারা আবার মিলিত হলো দীর্ঘ আলোচনায়। আসলে আলোচনার নামে ওটা ছিল তাদের পারস্পরিক জানা-বোঝার একটা যৌক্তিক আনুষ্ঠানিকতা। তারা মুখোমুখি বসে খুবই আত্মবিশ্বাসীর মতো নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরল একে অপরের সামনে। নিজেদের যুক্তি রাখল স্ব স্ব মতামত ও বিশ্বাসের পক্ষে। তাদের আলোচনাটা সবসময়ই নদীর শান্ত বুকের মতো থাকে নি, কখনো তাতে ঢেউ উঠেছে, কখনো ঝড় উঠেছে। আবার শান্ত ও স্বাভাবিক হয়ে তাদের আলোচনা একাকাকর হয়ে মিশে গেছে প্রকৃতির সাধারণ শব্দাবলীল সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত কেউ-ই তারা হারেনি কারও যুক্তির কাছে, কাজেই দল পরিবর্তনেরও প্রয়োজন হয় নি। তবে সেদিন উভয়ের মধ্যে তাদের নিজেদেরে সম্পর্কে এমন কিছু ধারণার জন্ম হলো যেগুলো খুবই মহান ধারণার মতো তাদের আত্মশক্তি বহুগুণে বাড়িয়ে দিলো। তারা প্রতিজ্ঞা করল, ভালোবাসবে পরস্পরকে আর মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করবে। তাদের কারও জয় কারও জন্য পরাজয় নয়, বরং সে জয়টাকে তারা মেনে নেবে পরস্পরের বিজয় বলে। তাদের গভীর জানাশোনা গভীর ভালোবাসায় পরিণত হলো। কিন্তু দেশের রাজনীতির পরিস্থিতি তখন সম্পূর্ণ বৈরি। এসে গেল, ১৯৮৭ সালের নভেম্বর মাস। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে একটার পর একটা কর্মসূচি ঘোষণা করছে। দিনের পর দিন চলছে হরতাল, লক আউট, জরুরি আইন প্রয়োগ। পুলিশের গুলিতে রাজপথে প্রাণ দিচেছ ছাত্রজনতা। অনেক ক্ষেত্রে বিরোধীদলগুলো সন্ত্রাসের পথ বেছে নিচ্ছে। তারা রিকশা ভাঙছে, বাসে-ট্রাকে আগুন দিচেছ, রেল লাইন ওপড়ে ফেলছে। কক্টেল, হাতবোমা ছুঁড়ে মারছে পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে। পুলিশ নেতাদের দলে দলে গ্রেফতার করে নিক্ষেপ করছে অন্ধকার কারাকক্ষে।
দেশের এ পরিস্থিতি দীপা আর রাজকে তাদের ভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য পরস্পরের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। বলা যায়, আন্দোলনের কেন্দ্র বিন্দু হয়েও তাদের অবস্থান দু’টি ভিন্ন মেরুতে। আর ১০ নভেম্বর ঢাকা অবরোধ দিবসটি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তাদের শেষ কামড়। এর ক’দিন আগে একদিন রাজা দীপাকে বলেছিল, দেখলে তো, প্রত্যেকটি সরকারই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দোহাই দিয়ে ক্ষমতায় এসে গণতন্ত্রের গলাটিপে ধরে। মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয় অসহনীয় অগণতান্ত্রিক নীতিমালা।
বেশ কিছুদিন ধরে দীপার সঙ্গে দেখা হচ্ছে না রাজের। রাজের বুকটা ভীষণ রকম হাহাকার করছে। দীপাকে নিয়েই এখন তার সবচেয়ে বেশি ভাবনা। এদেশের পরিচিত রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। নেতারা সুবিধাবাদী, তারা দলের কিংবা দেশের স্বার্থে চেয়ে নিজেদের স্বার্থকে বড় করে দেখে। প্রধান সবগুলো দল ক্ষমতায় যাওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। অধিকাংশ দলই তো ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। যে দলের নিজস্ব কোনো নীতি নেই, সে দলের অস্বিত্ব তো ভবিষ্যতে বিপন্ন হবেই। এ সমস্ত দলের পেছনে দলবেধে নেতাদের কিছু সুবিধা আদায়ের পথ সুগম করে দিয়ে কী লাভ? রাজ ভাবছে, ‘দেশের অবস্থা যত খারাপ হচ্ছে দীপাও তত জড়িয়ে পড়েছে রাজনীতির সঙ্গে। নির্ঘাৎ একদিন পুলিশের গুলিতে মারা পড়বে। দীপাকে ফেরাতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে, নতুন কোনো শক্তিশালী নেতৃত্ব গড়ে তোলা ছাড়া এদেশের পরিবর্তন আসতে পারে না’
ওইদিন বিকালে রাজ দীপাদের বাসায় গেল তার সঙ্গে দেখা করতে। ওদের বাসায় যেতে তার খুব খারাপ লাগে। দীপার বাবা দীর্ঘদিন ধরে জেলে। মা-ও অসুস্থ্য। মনে হয় যেন গুমোট বাঁধা কান্না বাসাটার বুক চেপে আছে।
বাসায় দীপাকে দেখে ম্লান আর অসুখী মনে হচ্ছিল। রাজ তাকে বোটানিক্যাল গার্ডেনে নিয়ে গেল। এবং ওখানে ওই ব্রহ্মপুত্রের তীরে বসে অনেক কথার পর আসল কথাটি বলল, “দীপা তুমি ও দলটি ছেড়ে দাও। ও দল তোমাকে কিংবা দেশকে কিছুই দেবে না। মাঝখান থেকে শুধু কষ্ট পাবে তুমি আর তোমার বাবা। ভেবে দেখ, তোমার বাবার মুক্তির জন্য তোমাদের দল কি জোরালো একটা মিছির পর্যন্ত করেছে? করে নি। চল, আমরা দু’জনে মিলে এমন একটি দলের ভিত রচনা করি যার নিজস্ব একটি আদর্শ থাকবে, যে আদর্শ হবে এদেশের মাটি আর মানুষের কাছাকাছি, যা হবে না অন্য কোনো দেশ থেকে ধার করা। তাছাড়া, তোমাকে হারাবার ভয়ও এখন বাড়ছে আমার।
উত্তরে দীপা বলল, দেশের এ পরিস্থিতিতে আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। আমার জীবনের লক্ষ্য থেকে যে কোনো কিছুর বিনিময়ে আমি সরে যেতে পারব না। সংগ্রামের শেষ প্রান্তে পৌঁছতে না পারি, মরে যাব, তবু দলের সঙ্গে বেঈমানী করব না।
আমার জন্যও কি তুমি তা পার না?
-না, পারি না। আপনার সঙ্গেই না একদিন আমার কথা হয়েছিল, আমরা যখন যেভাবেই থাকি, পরস্পরকে ভালোবাসব। আর দেশের মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করে যাব। হোক না আমাদের মত ও পথ ভিন্ন। সে আরও বলল, আমি আপনাকে যেমন ভালোবাসি তেমনই ভালোবাসি এদেশের মানুষকে। আজ আমার নিজের সুবিধার জন্য মুক্তিকামী একটি জাতির মানুষকে ত্যাগ করতে পারি না। আর আপনার দলের কথা বলছেন? ওটার তো কোনো অস্তিত্বই নেই। আমাদেরটির অস্তিত্ব আছে আমরা মানুষের কাছে যেতে পারছি।
-তাহলে আমাদের ভালোবাসা? শুধু কি দু’টি বিপরীত স্রোতের মুখে স্বপ্নের সেতু রচনা করে চলবে? আমরা কি পারব না দু’টি হাত আমাদের একই ফুলদানীতে সাজিয়ে রাখতে?
জানি না। শুধু এতটুকু জানি, যে আদর্শের জন্য আমার বাবা তার জীবনের বেশিরভাগটা সময় কাটিয়েছেন অন্ধকার জেলে, মা একাকী গুনেছেন অজস্র বিনিদ্র রাতের প্রহর আজ আমি আমার প্রেমের জন্য-তাদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বসঘাতকতা করতে পারি না। সমস্ত জীবন যদি আমাদের মিলনের সম্ভবনা না থাকে-আমি আপনার ভালোবাসাকেই জানব আমার প্রেরণা শক্তি হিসেবে। আমি জানি, আপনি কেন আমাকে রাজনীতি ছাড়তে বলছেন। মরে যেতে পারি এই ভয়ে। আমার প্রতি এটা আপনার অন্ধ দুর্বলতা। আমি রাজনীতি ছেড়ে দিলেই কি ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হয়ে যাবে? হবে না। বরং সুবিধাবাদীরা সে স্থান দখল করে নেবে। দোহাই তোমার, আমাকে আমার ইচ্ছে থেকে সরিয়ে নিতে চেয়ো না।
রাজ লক্ষ্য করছে দীপা এই প্রথম তাকে তুমি বলল। সে দীপার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, তাহলে তোমার গ্রেফতার হওয়ার আগেই এ শহর ছেড়ে আমি দূরে কোথাও চলে যাব। আমাকেও তো গ্রেফতার করতে পারে। শুধু শুধু কেন আমি পুলিশের নির্যাতন সইতে যাব? তুমি জানো না, ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ যাকে ইচ্ছে তাকে গ্রেফতার করছে। ছাত্র নেতাদের ধরার জন্য তারা মরিয়া হয়ে ওঠেছে। লক্ষ্য রাখছে সবার প্রতিটি গতিবিধির ওপর।
-জানি, প্রতি মুহুর্তে টের পাচ্ছি।
-আচ্ছা, তুমি একবার আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখ না ওরা কী চায়?
-“ক্ষমা করো, তোমার চোখের দিকে আমি তাকাতে পারব না। দুর্বল হয়ে যাব। আচ্ছা তুমিই বল, কোনো বোন কি পারে তার অসুস্থ ভাইকে রেখে অভিসারে যেতে? মা কি র তার অসুস্থ সন্তানকে রেখে যেতে? আমার দেশ, আমার বাবা, আমার অসুস্থ মা... আমি কীভাবে যাব?
রাজ কাঁপছে। তবু নিজেকে সে শক্ত রাখল। আবেগের কাছে হারল না। উঠে দাঁড়িয়ে ব্রহ্মপুত্রের অপর পাড়ের ফুলে ফুলে ছাওয়া শন গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চল ঘরে ফেরা যাক।’

\ তিন \

কাজের মেয়েটা খাবারের জন্য পীড়াপীড়ি করে গেল।
‘খাবো না, বিরক্ত করিস না’। বলে দীপা বিদায় করেছে তাকে। কাজের মেয়েটাকেও সে খুব ভালোবাসে। সকালে বিকালে সে তাকে একটু একটু পড়ায়। ও খুব ভালো পড়তে পারে। অথচ স্কুলে পড়ার সুযোগ নেই। এসেছে অন্যের বাসায় কাজ করতে। ‘‘হায়, এসব মানুষদের মুক্তির জন্যই তো আমার সংগ্রাম। এবং অসহায় মানুষদের মুখের দিকে তাকিয়েই তো আমি আমার জীবনের চরম সিদ্ধান্তটা নিয়েছি। তাইতো রাজ যে জীবন দিতে চেয়েছিল আমি তা গ্রহণ করিনি।’’
পরদিন একটু রাত থেকেই ঘুম ভাঙল দীপার। তবু সে বিছানায় শুয়ে রইল। সে ভাবছে, ‘রাতে রাজের চলে যাবার কথা। হয়তো গেছেও। কোথায় যাবে আমি তার কিছুই জানিা না। রাজটা সত্যি আশ্চর্ষ একটা মানুষ, নিষ্ঠুরের মতো চলে গেছে।’ দীপা বিড়-বিড় করে বলছে। জানালা দিয়ে ভোরের আলোর সঙ্গে বকুলের মিষ্টি গ›ধ ভেসে আসছে। আর সে গন্ধে সে আরও বেশি আনমনা হয়ে পড়েছে। বিছানায় শুয়ে থাকতেই তার ভালো লাগছে। কী যেন একটা কষ্ট তার সমস্ত উদ্দীপনা বিনাশ করে দিয়েছে। এ সময় ঘরে এলেন মা, তিনি তার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়েই বললেন, ‘কিরে রাতে কেঁদেছিলি নাকি? চোখের কোণে পানির দাগ লেগে আছে যে।’ দীপা উঠে বসতে বসতে বলল, ‘নাতো মা।’
কপালে হাত দিয়ে তাপটা পরীক্ষা করে জানতে চাইলেন তিনি, ‘তোর বাবার খবর কিছু জানিস?
‘না মা, সেই যে রাজ আর আমি গিয়েছিলাম। তারপর আর জানি না। ’
রাজ থাকত তার এক বন্ধুর বাসায়। দীপা ফোন করে জানতে চাইল রাজ আছে কি-না? উত্তরে বন্ধুর বোন জানাল, রাজ ভাইয়া তো গত রাতেই চলে গেছে।’
‘কোথায় গেছে?’
বলে যায় নি। শুধু বলেছে, ‘ফিরতে দেরি হবে। হয়তো পালিয়েছে, হি-হি-হি।’
হাসছ যে। না এমনেই, রাজ ভাইয়টা যা ভীতু কিনা।
ও! আচ্ছা রাখি।
‘তাহলে সত্যিই সে চলে গেছে? এখন আমি কী করব? আবার বলেছে ফিরতে তার দেরি হবে।’ ফোনটা রেখে ভাবছে সে। ‘রাজকে খুঁজব না পার্টির কাজে আরও বেশি করে জড়িয়ে পড়ব? আগুন জ্বেলে দেব স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের বুকে?’

\ চার \

ওদিকে রাজ পরদিন সকালে রাঙামাটির এক স্টেশনে বাস থেকে নেমে কর্ণফুলি নদের তীর ধরে হাঁটছে। মাইল দেড়েক দূরে এক বাংলোতে তার এক বোন থাকে। আপাতত সে ওখানেই ওঠবে। তার কাছে নতুন এই রাঙামাটির পথ। সে হাঁটছে অন্যমনস্কভাবে। দূরে উঁচু টিলার ওপর উপজাতি মহিলারা পিঠে সন্তান ঝুলিয়ে গাছ-গাছালির আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে। রাজ ভাবছে, এখানেই কোথায় বসে রবী ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘‘গ্রাম ছাড়া এই রাঙা মাটির পথ আমার মন ভোলায় রে...।’’
রাজ দীপার কথা মোটেই মনে করতে চাচ্ছে না। তবু দীপা তার চিন্তা জুড়ে এসে যাচ্ছে। দীপার মতো এত বড় মাপের একজন নারীর সঙ্গে কেন যে তার পরিচয় হয়েছিল? সে স্বার্থপর, নিজের সুবিধার জন্য, প্রেমের জন্য দীপাকে তার আদর্শ থেকে সরিয়ে আনতে চেয়েছিল। ভাগ্যিস দীপা আসে নি। এই রাঙামাটির পাহাড়ি পথে দীপাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে রাজ হয়তো সুখীই হতে পারত Ñ কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের কথা বলত কে? অসহায়, অসুস্থ মা- বোনদের হয়ে সংগ্রাম করত কে? দীপার মতো বড় মানুষদের তো ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু থাকতে নেই। তাদের যে কারও একার হতে নেই। এত বড় সত্যটা সে আগে উপলব্ধি করে পারেনি। কেন সে তাকে কষ্ট দিয়ে এলো? কেন সে তাকে তার চলার পথে আরও উৎসাহিত করে এলো না?
একদিনের কথা মনে পড়ে রাজের। ওরা বনভোজনে গিয়েছিল। ওরা দু’জন অন্যসব ছাত্র-ছাত্রী থেকে অনেক দূর পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে একটি ছোট লেকের ধারে বসেছিল। তাদের মধ্যে সেদিন কত কথা বলেছিল। কিছু কিছু কথা রাজ এখনও মনে করতে পারে। দীপা জানতে চেয়েছিল, আচ্ছা রাজ, আমরা আমাদের সংগ্রামটাকে জোরদার করতে পারছি না কেন? কেন রাজনীতির নামে অসংখ্য দল সৃষ্টি করে আমরা বোকা বানিয়ে ফেলছি গোটা দেশের মানুষকে? কেন বায়ান্ন কিংবা একাত্তরের মতো আমরা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধেও একতাবদ্ধ হতে পারছি না? একদিন তো এদেশের মানুষ ভাষার দাবীতে পুলিশের গুলিতে লাল কৃষ্ণচূড়ার মতো রাজপথে ঝরে পড়েছিল, এখন কেন পারে না? তার মনে পড়ে, দীপা একদিন জানতে চেয়েছিল, ‘এই পথে চলতে চলতে আমরা কৃষ্ণচূড়া, সূর্যমুখীর মতো কত ফুলকেই না ফুটে থাকতে দেখি গোলাপ-চামেলি আর জবার পাশাপাশি। কিন্তু আমাদের ছলিম উদ্দিন, কলিম শেখ, যদু পোদ্দারের মধ্যে কেন কোনো বড় মানুষ জন্ম গ্রহণ করে না?
রাজ উত্তরে বলেছিল,‘ বড় মানুষেরা জন্মগ্রহণ করে সময়ের দাবী মিটাতে Ñ তেমন সময় আসুক দেখবে তারা জন্মগ্রহণ করেছে।’’

\ পাঁচ \

শেষমেষ নূর হোসেন স্কেয়ারের কাছে একটি বাসে আগুন দিতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে দীপা। পেট্টোলে ভেজা তার শরীর স্থানে স্থানে পুড়ে গিয়েছিল। পুলিশ যখন তাকে থানা হাজতে ফেলে রেখে গেল তখন সে শরীরে পোড়া যন্ত্রণা অনুভব করল। তবে সে ভয় পেল না কিংবা কাঁদল না। যদিও পুলিশের আচরণ দেখে সে বুঝতে পারছিল কী ধরনের আচরণ তারা তার সঙ্গে করবে। পরদিন সমগ্র শহরে দীপার গ্রেফতারের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে স্থানে স্থানে জনতা বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে লাগল দীপার মুক্তির দাবীতে।
দীপাকে সন্ধ্যে নাগাদ অপেক্ষা করতে হলো পুলিশের মুখোমুখি হতে। সন্ধ্যার পর পুলিশ দীপাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল। ঠাণ্ডা মাথায়, ধীরে-সুস্থ্যে প্রশ্ন করছে পুলিশের প্রধান কর্মকর্তা। ‘‘ বলো, কার নির্দেশে বাসে আগুন দিচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে কে কে ছিল?’’
দীপা উত্তরে বলছে, ‘‘ আমি জানি না। কিছু জানি না।’’
জল�াদের মতো একটা সেপাই এগিয়ে এসে একটি মুষ্ঠি চুল টেনে ধরল তার। অকথ্য গালি-গালাজ তার মুখে। দীপার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। তবু সেপাইটি তার চুল ছাড়ছে না। আরেকজন পুলিশ তার দেহে পোড়া সিগারেট চেপে ধরে বলল,‘‘পুলিশকে তোরা গালি দিস, আজ দেখিয়ে ছাড়ব পুলিশ কী জিনিসি।’’
আরেকজন পুলিশ বেত দিয়ে পেটাতে লাগল। বাড়ির চোটে শরীর ফেঁটে রক্ত বেরুতে লাগল। প্যান্ট-শার্ট ভিজে গেল। তবু তার সঙ্গে কে কে ছিল সে তাদের একজনের নামও বলল না। শুধু বলল, ‘আপনারা এদেশের সন্তান হয়েও কেন অমন নির্মম আচরণ করছেন? আপনাদের আচরণ পথের কুকুরের সঙ্গে পোষা কুকুরের আচরণের চেয়েও নিকৃষ্ট? আসলে আপনারা বুঝতে পারছেন না আমাদের অবস্থান, যারা যেখানেই আছি আমরা আসলে সকলেই কুকুর।’ এ কথার বলার পরই সে অজ্ঞান হয়ে যায়।
দ্বিতীয় দিনেও তার ওপর অত্যাচার চলল বিভিন্ন কায়দায়। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সময় কাটল রাতে। এক সময় দীপা তার শারীরিক মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। সে নিজের অজান্তেই বলে ফেলে যে, সে নিজেই ওই বাসে আগুন দিতে গিয়েছিল।
‘কেনো?’ এর উত্তরে সে বলেছে,‘ স্বৈরাচার নিপাত যাক’।
তৃতীয় রাতেও কথা আদায় করতে চেষ্টা করেছে পুলিশ কিন্তু ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ এর বেশি কিছু আদায় করতে পারে নি।
সপ্তম দিনে অসুস্থ আর মৃত্যু পথযাত্রি দীপাকে পুলিশ জেলখানা থেকে হাসপাতালে পাঠায়। ডাক্তার তাকে প্রথমে গ্রহণ করতে না চাইলেও পরে ভালো করে তোলার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। কিন্তু পারেন নি।
মধ্যরাতে হঠাৎ গোঙানির শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে যায় নার্সের। ছুটে এসে দাঁড়ায় দীপার শিয়রে। বারো ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরেছে দীপার। নার্সের মুখে হাসি ফুটে।
দীপা তাকে কাছে ডাকল। এবং তার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, রাজ এসেছিল?
-‘না, কেউ আসে নি। পুলিশ আপনার সঙ্গে কাউকে দেখা করতে দিচ্ছে না।’
-‘ অ আচ্ছা।’
এরপর সে বলল, ‘সিস্টার, স্বৈরাচারের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য আমি জীবন দিয়ে গেলাম। আমার খুব ভালো লাগছে। আপনি আমার একটা উপকার করবেন, বলুন করবেন?’
নার্স ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘আপনার কথা বলা নিষেধ। আপনার শরীর খুব দুর্বল।’
মৃদু হাসল দীপা। বলল, ‘আমাকে তো অনেক আগে ওরা মেরে ফেলেছে। যাক, আপনি দু’টুকরা কাগজে আমার কিছু কথা লিখে নিন। আর কথা দিন এ চিঠি দু’টো ঠিকানা মতো পৌঁছে দেবেন?’
নার্স বলল, ‘আমি চেষ্টা করব।’
দীপা বলল, নার্স লিখল। প্রথম চিঠিটি তার বাবার কাছে জেলখানায়। ‘বাবা, আমি অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মরব। আমার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে তুমি কষ্ট পেয়ো না। আমি তোমার মুক্তির জন্য আর স্বৈরাচারের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য জান বাজি রেখেছিলাম। আমাকে ভুল বোঝ না। খুব সম্ভব তাড়াতাড়ি তুমি মুক্তি পাবে। কারণ আমার মৃত্যুর পর বাইরের বিশ্ব থেকে চাপ আসবে তোমাকে ছাড়ার জন্য। তোমাকে না ছেড়ে স্বৈরাচারের উপায় থাকবে না। মাকে আমার এ চিঠির কথা বলো।’’
আরেকটি চিঠিতে সে বলল,‘ রাজ, তোমার কথাই সত্য হলো। আমি খুব অল্প বয়সেই মারা গেলাম। তুমি তো বলেছিলে, দেশের জন্য কিছু করবে। এখন শুরু করো। তোমাদের চলার পথে আমি আর নূর হোসেন না হয় বাতিঘর হয়েই থাকব।’
এ চিঠি দু’টি নার্স খুব গোপনে রক্ষা করেছিল। পুলিশ বার বার জানতে চেয়েছে দীপা মৃত্যুর আগে কিছু বলে গেছে কি-না। প্রথম চিঠিটি সে দীপার বাবার কাছে জেলখানায় নিজে গিয়ে দিয়ে এসেছিল। আর দ্বিতীয় চিঠিটি পৌঁছাতে পারেনি তার প্রাপকের কাছে। কারণ, রাজের কোনো ঠিকানা তার কাছে ছিল না।
রাজ তিনদিন পর দীপার মৃত্যু সংবাদ পায় একটি দেয়াল লিখন থেকে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সুপ্রিয় ঘোষাল ভোট দিলাম। কিন্তু গল্পটা narrative গোছের ছোটগল্পের turn, twist, conflict এবং resolution এইসব শর্ত যে মানা হয়েছে এমন নয়। তা সত্ত্বেও ভোট দিলাম। আশা করি পরবর্তীতে বিষয়ের নতুনত্ব পাব। শুভ কামনা রইল।
সুপ্রিয় ঘোষাল ধন্যবাদ আপনার ভোটের জন্য। পরামর্শের জন্য। আমার একটা কবিতাও আছে যদি দেখেন খুশি হব।
ভালো লাগেনি ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৯
দেখেছি। ঐ ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই।
ভালো লাগেনি ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৯
MD. MOHIDUR RAHMAN লেখা চালিয়ে যাবেন আশাকরি.
কেতকী দীপাকে যেন দেখতে পেলাম। আমার গল্পটাও ব্রহ্মপুত্র সম্পৃক্ত। শুভেচ্ছা সহ ভোট রইলো।
Gazi Saiful Islam আশা একটি ভোটি দিতে পারতেন
রঙ পেন্সিল দীপার জন্য খুব কষ্ট হলো। লেখার ধরন চমৎকার। অনেক অনেক শুভকামনা!

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

[দীপাদের বাতিঘর 1987 সালের 10 নভেম্বর স্বৈরাচারি এরশাদ সরকারের পতনের আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত এক অসাধারণ গল্প। সেদিন ছিল ঢাকা অবরোধ দিবস। সে দিন হরতাল, গাড়িতে অগ্নি সংযোগ ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে গ্রেফতার, নিপীড়নসহ নানাবিধ দুর্ঘটনা ঘটে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। নূর হোসেনের গুলিবিদ্ধ হওয়া ও মৃত্যুসহ রাজনৈতিক পরিবর্তনের পটভূমি তৈরি হয় এবং যেহেতু তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেহেতু এ গল্প তুলে ধরে সেহেতু এটি ’বাংলাদেশ‘ নামের প্রতিনিধিত্ব করে। ধন্যবাদ-গাজী সাইফুল ইসলাম]

২৪ মার্চ - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪