নিরাপদ আঁচল চাই।

মা (মে ২০১১)

লুৎফুর রহমান পাশা
  • ৩৭
  • 0
  • ৩৭
মায়ের ইচ্ছা ছিল আমি যেন অনেক বড় হই। বড় বলতে আমার অনেক সুনাম হবে। দেশ জোড়া খ্যাতি হবে। খ্যাতিমানের মা হবার বাসনাটাও তার মনে ছিল প্রবল। এর একটা কারণও আছে। আমার মা বেশ আগের দিনের মানুষ। সেই সময়ে পড়া শোনার তেমন কোন প্রচলন ছিলনা। আর মেয়েদের বেলায় তো নয়ই। সে সময় এলাকায় নতুন হাই স্কুল হলো। না জনের নানা কথাকে উপেক্ষা করে সেখানে পড়তে গেলেন। শুধু গেলেনই না। ছেলে মেয়েদের মধ্যে আমার মা ই প্রথম যিনি ঐ স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেছিলেন। কলকাতা থেকে মন্ত্রী এসেছিলেন মাকে শুভেচ্ছা জানাতে। সেই বছরই স্কুলটা সরকারী হয়ে যায়। এটা মায়ের প্রচণ্ড গর্বের বিষয়। বিয়ের পর সংসার সন্ততি নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও মায়ের ইচ্ছাটার মৃত্যু ঘটেনি। তার ছেলে মেয়েদেরকও তিনি উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। আমরা পাঁচটি ভাই বোন বিশ্ব বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়েছি এটা যতনা আমাদের চেষ্টায় তার চেয়ে বেশী ছিল মায়ের আকাঙ্ক্ষা। মায়ের প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষার কাছে পরাজিত হয়েছে সব।

আমি তখন ছোট। দুরন্ত কৈশোরের গতিময় ঘোড়া আমার নাগালে। বেশ দুষ্ট আর ডান পিটে ছিলাম। মায়ের ইচ্ছার কথা বুঝতাম না। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মানে বুঝার বয়স হয়নি তখনও। কিন্তু মা ঠিকই বুঝতেন এখনই গড়ে উঠার সময়। তাই তিনি সচেষ্ট থাকতেন। আর আমার তখন সময় স্বাধীনতার। সারাদিন টই টই করে ঘুরে বেড়ানো। গাছে চড়া, ভর দুপুরে পুকুরে সাতার কাটা, পাখির বাসা চুড়ি, রাতের বেলায় মায়ের চোখ ফাকি দিয়ে অন্যের গাছের ফল চুড়ি করা এইসব আমার স্বাধীনতার আরাধ্য হলেও মায়ের চোখে ছিল চরম অপরাধ। তাই মাঝে মাঝে বকুনি তো মামুলি ব্যপার পিটুনি খেয়েছি কত তার কোন ইয়ত্তা নেই। তাই বলে আজও থামেনি আমার বোহেমিয়ান গতি আর দুরন্তপনা।

সেই জন্য মায়ের সাথে আমার সারাজীবনের শত্রুতা। তবে মায়ের চেয়ে আপন যে কেহ নাই সেটাও বুঝতাম মাঝে মাঝে। আর এখনতো হারে হারে টের পাই। রাতের বেলার মায়ের পাশ ছাড়া আমার ঘুম হতোনা। লেপ কিংবা কম্বল আমার শীত নিবারণ করতে পারতো না, যদি না মায়ের আচলটা আমার গায়ে না পড়ত। সেই দিন আর কোন দিন আসবেনা জানি তবুও ভুলতে পারিনা এক মুহূর্তের জন্য।

আমাকে নিয়া মায়ের ভাবনাটা একটু বেশী তা আগেই বুঝতে পারতাম। ছোট সন্তান বলে হয়তোবা যদিও মায়ের সব সন্তানই হয়তো মায়ের কাছে সমান। আবার আমার ধারনা ভুলও হতে পারে। তবে মনে হতো এই জন্যই মা আমাকে শাসনটা বেশীই করতেন। তবে পড়াশোনার জন্য যতনা যাতনা পেয়েছি তার চেয়ে অনেক বেশী পেয়েছি দুষ্টুমির জন্য। মা আমার মধ্যে সম্ভাবনা দেখতেন হয়তো। ছোট বেলায় সবাই যখন কাদামাটি দিয়ে পুতুল বানাতো আমি তখন গাড়ি কিংবা ঘর বানাতাম। স্কুলের বন্ধুরা যখন বই কিংবা খাতায় পড়াশোনার বাইরে বারতি একটা দাগও কাটতনা বই নোংরা হয়ে যাওয়া কিংবা কলমের কালি ফুরাবার অযুহাতে তখন আমি বিভিন্ন কবিতা বা গল্পের অনুকরন লিখতাম। স্কুলের স্যারের বকুনি থেয়েছি। খেয়েছি বাবার হাতে শাসনও কিন্তু মাকে কোনদিন বকতে শুনিনি। মায়েদের দৃষ্টি অনেক দুরবর্তী তা বুজতে পেরেছি অনেক পরে।

মায়ের ইচ্ছা আমি পুরন করতে পারিনি। কাদামাটির যন্ত্র বানানো সেই ছেলেটি আজ প্রকৌশলী হয়েছি। কাজের ফাকে দুচার কলম লিখি। পত্রিকায় ছাপা হয়। বই মেলাও আমার অংশগ্রহন থাকে। দু চারজন আমাকে চিনে কিনা আমি জানি না। নিজের ছাপানো লেখা দেখতে কতই না ভাললাগে আমার। আমার মাও খুশি হতেন। তবে মায়ের সেই ইচ্ছা পুরন হয়নি। কারন তার আগেই মা আমাকে ছেড়ে অজানার পথে চলে গেছেন। আর আমিও তেমন কেউ হতে পারিনি যে মায়ের কবরের কাছে গিয়ে অন্তত বলতে পারবো যে মা আমি তোমার কথা রেখেছি। আমি তোমার তেমন একজন সন্তান হতে পেরেছি। তুমি চেয়েছিলে তোমার সন্তানের নাম দুরের মানুষেরা নাম শুনবে। তোমার সন্তানকে অচেনারা চিনবে। তোমাকে দেখে বলবে ওই যে মহিলা যাচ্ছে তিনি অমুক বিখ্যাত লোকের মা। আমি আজ বলতে গেলে পুরোটাই ব্যর্থ।

আমি কোন দিন আকাশের তারা গুনে দেখিনি। তবে আমার মা মারা যাবার পর আমি প্রতিদিন তারা গুনি। আমি গুনে দেখেছি, প্রতিবার একটি করে তারা বেশী হয়। অনেকেই বলে মানুষ মরে গেলে আকাশের তারা হয়। তবে কি আমার মা আকাশের তারা হয়ে আমাকে দেখছেন? আমি বিশ্বাস করিনা তবে অবিশ্বাস করতেও আমার ভীষন কষ্ট হয়।

মায়েরা সন্তানের গৌরবে গর্বিত হয়, যেই সন্তানকে তিনি গর্ভে ধারন করেছেন। যদি সন্তানের মৃত্যুও হয় তবুও মা তাকে নিয়ে গর্ব করেন। বড় সন্তান মারা গেলে ছোটটার প্রতি যত্নশীল হন। মায়েরা এমনই হয়। গর্ভে ধরেন বলেই গর্ভধারিনি। মরে গিয়ে সন্তানকে বাচাতে চান বলেই তিনি মা। আমি সেই মাকে নিয়ে গর্ব করি। যদিও আমি বা আমরা মায়ের তেমন কোন ইচ্ছাই পুরন করতে পারিনা।

আমি আমার গর্ভধারিনি মায়ের জন্ম দেখিনি। তবে মায়ের জন্ম আমি দেখেছি। যেদিন গর্ভধারিনি প্রসব করেন সেদিন শুধূ এক সন্তানেরই জন্ম হয়না জন্ম হয় একজন মায়েরও। এমন মাকে আমি জন্মাতে দেখেছি। এমনও মাকে দেখেছি যারা সন্তানের মৃত্যুতে বিলাপ করে কাদেন। এমন মাকে দেখেছি যে কিনা নিজেকে বাচাতে, নিজের জন্ম দিতে গিয়ে অনেক সন্তানের মৃত্যু ঘটিয়েছেন। তিনি এমন সব সাহসী সন্তানের জন্ম দিয়েছেন যারা মাকে বাচাতে জীবন দিয়েছে কেউবা জীবন বাজি রেখে মাকে বাচানোর প্রানপন চেস্টায় রত হয়েছে।

আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে অনেক গুলি সন্তানের জীবনের বিনিময়ে জন্ম হয়েছিল একজন মায়ের। সেই মায়ের নাম বাংলাদেশ। এই মায়ের যেদিন জন্ম হয় সেদিন মারা যায় তার লাখ সন্তান। ইজ্জত হারায় তার সহস্র সন্তান। এখনও বাস্তবতার কঠিন আবরনে পড়ে আছে তার অসংখ্য সন্তান যারা মাকে জন্মাতে গিয়ে জীবন বাজি রেখেছিলেন।

আমার এই মায়েরও অনেক ইচ্ছা ছিল। ইচ্ছা ছিল এদেশের প্রতিটি সন্তান বিশ্বের দরবারে মাথা উচু করে দাড়াবে। তারা মানুষের মত মানুষ হবে। এই দেশকে সারা বিশ্ব এক নামে চিনবে। পৃথিবীর অপর প্রান্তে কোন শিশুর পাঠ্যবইয়ের পড়া হবে এরকম যে,” প্রথিবীর বুকে এক দেশ আছে তার নাম বাংলাদেশ। যে দেশকে তার সন্তানেরা মরে গিয়ে জন্ম দিয়েছে। যার জন্য সেই দেশের হাজারো সন্তানেরা মুহুর্তের মধ্যে বুকে ডিনামাইট বেধে ঝাপিয়ে পড়তে পারে।“

আজ পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। সবাই জানে এই দেশের মানুষ সাহসী। বীরের জাতি। জীবন বাজি রেখে প্রান পন লড়ে যাওয়া জাতি। তারা জীবন দিতে পারে দেশের জন্য, জীবন দিতে পারে কথার জন্য। এরপরও কথা থেকে যায়।

মা তোমার সব ইচ্ছা কি পুরন হয়েছে? তুমি যে জন্য তোমার বীর সন্তানদের বলি দিয়েছ, তুমি নিজে বাচার জন্য তোমার সন্তানদের তুলে দিয়েছো নরপিশাচদের হাতে। আজ কি তোমার জন্ম সার্থক হয়েছে মা? বলতে পারো মা তুমি আজ কি পুরো পুরি স্বাধীন? তোমার বেচে থাকা সন্তানরা কি তোমার সব ইচ্ছাকে পুরন করেছে? তারা নিরাপদ করেছে তোমার অনিরাপদ বুকের জমিন? তুমি কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে মা তোমার আচল আমাকে আজও শীত থেকে বাচাবে?

যদি তাই হয় তাহলে সেই কুলাঙ্গাররা কিভাবে তোমার বুকের উপর নির্বিঘ্নে বিচরন করে ? কেন আজ তোমার কোন সন্তানেরা তাদের খোজ রাখেনা যারা ক্ষুধায় যাতনায় ফুটপাতে কুকুরের সাথে কেদে উঠতে উঠতে মরে যায়। তোমার বেচে থাকা সন্তানেরা সেই বিভেদ আজো ঘুচাতে পারেনি কেন মা? আজ তারা কোন মুখে স্বাধীনতার স্তবক পড়ে তোমাকে অনিরাপদ রেখে। আজ কিভাবে মিশে যায় তেলে আর জলে। যাকে আলাদা করা জন্যই তুমি তোমার সন্তানদের মৃত্যু মুখে ঠেলে দিয়েছিলে।

আমি প্রশ্ন করতে চাইনি মা। আমি ক্ষমা চাইতেও আসিনি। আমি জানাতে এসেছি। আমিওযে সেই অপরাধীদের একজন। আমি বিভেদের দেয়াল ভাঙ্গতে পারিনি মা। আমি পারিনি দ্রেশদ্রোহীদের টুটি চেপে ধরে বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করতে। কারন আমি আজ বড়অসহায় মা। তোমার বুকে আমি নিরাপত্তা পাইনা। তোমার আচল আমাকে শীত থেকে বাচাতে পারেনা।

মাগো তুমি কি ঘুমিয়ে গেছো? তোমার সকল শক্তি কি আজ নিঃস্ব হয়ে গেছে? তোমার সেই সন্তানেরা কোথায়? মাগো একবার তুমি তাদের জাগাও। যারা আবারো গর্জ উঠবে। আবার জীবন দেবে। তোমার বুকের উপর প্রলয় নৃত্যকারী নরপিশাচদের আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করবে। আমি আছি সেই দলে, আমি অপেক্ষায় আছি সেই হুন্কারের। কারন আমি যে আবার তোমার সেই নিরাপদ আচল ফিরে পেতে চাই।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সাদিক আহমেদ ভালো লেগেছে, সামনে আপনার আরো ভালো লেখার আশায় রইলাম l
খন্দকার নাহিদ হোসেন ভালোবাসার গল্প সবসময়-ই ভালো লাগে।
লুৎফুর রহমান পাশা আপনার গঠন মুলক মন্তব্যের জণ্য শুকরিয়া সাবের ভাই
আহমেদ সাবের এ লেখায় দুটো বিষয় চলে এসেছে। প্রথম ভাগ স্মৃতিচারন; আর দ্বিতীয় ভাগে দেশ মাতার জন্য আক্ষেপ। একটা লেখা একটা থীম নিয়ে এগুলেই ভাল হতো। আপনার গদ্যের হাত বেশ ভাল।
লুৎফুর রহমান পাশা @ ফজলুল হাসান ভাই। শুকরিয়া জানাচ্ছি
এস, এম, ফজলুল হাসান আপনার অসাধারণ গল্পটা পড়ে খুব ভালো লাগলো , ধন্যবাদ একটি ভালো গল্প লিখার জন্য , আপনি এখনো ন্যায় ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করলে একদিন বিখ্যাত হতে পারবেন , আপনি-ই হয়ত ভবিষৎ এ, আর , খান , ধন্যবাদ
লুৎফুর রহমান পাশা @ শাহনাজ আক্তার। খুব খুশি হলাম। আপনাকে শুভেচ্ছা

২৩ মার্চ - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪