বর্ষা যায় যায়। শুকিয়েও শুকায় না কাদা মাটি। টান টান কাদায় ভরা মৃত জলা থেকে এক খাবলা কাদা তুলে এনে উঠোনে বসে পড়ল রানু আর অন্তু। অতি প্রিয় কাদা খেলায় মেতে উঠল দুজন। প্রথমে কাদা দুই ভাগ করা হল। এক ভাগ রানুর, আরেক ভাগ অন্তুর। এবার শুরু হল ছোট ছোট থালা বানানো। অন্তু তার থালা বানিয়ে উপুড় করে ছুঁড়ে মারল রানুর সামনে। বাজি ফুটার মত তীক্ষ্ণ শব্দ বের হল থালার তলায় তৈরি হওয়া ফুটো দিয়ে। দু’জনেই হেসে উঠল তারা। খেলার নিয়ম অনুযায়ী রানু তার ভাগের কাদা থেকে কিছু কাদা দিয়ে ভরে দিল থালার ফুটো। এতে কাদার পরিমাণ বাড়ল অন্তুর। এবার রানুর পালা। সে তার কাদার থালা আরো জোরে ছুঁড়লো অন্তুর সামনে। বাজির শব্দ হল বিকট; সাথে থালার ফুটোও। তীক্ষ্ণ শব্দে চমকে উঠল কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মুরগীর বাচ্চারা। তা দেখে খিলখিলয়ে হেসে উঠল দু’জন। গর্বে টান টান হয়ে গেল রানুর বুক। আর চুপ থাকতে না পেরে বলেই ফেলল - ‘দেখছ ভাইজান, তোমারটার চাইতে অনেক বেশি শব্দ হইছে আমারটায়। আর দেখ কতো বড় ফুটা হইছে! অনেক বেশি কাদা লাগবো এইটা ভরতে; তুমি কিন্তু কম দিতে পারবা না।’ ‘এই ল, ভইরা দিলাম’ - ফুটোটা কাদায় ভরে দিয়ে বলল অন্তু। খেলার মাঝপথে ডাক পড়ল মায়ের - ‘অন্তু-রানু, খেলা বন্ধ কর। দাদীর লগে গোসল করতে যাও তাড়াতাড়ি।’ একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলো দু’জন - ‘যাইতাছি মা!’
আজ বৃহস্পতিবার। স্কুল তাই আধবেলায় ছুটি হয়েছে। আগামীকাল শুক্রবার। ছুটির দিন। মানে অন্তু-রানুর ঈদ। আর ঈদের খুশি শুরু আজ থেকেই। তারা দু’জন নীল কমল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। অন্তু পঞ্চম আর রানু চতুর্থ শ্রেণীতে। রানু ভাল ছাত্রী। ক্লাসে শান্তা আপু আর মৃন্ময় স্যার তাকে ‘লক্ষ্মী’ বলে ডাকে। রানু স্কুল কামাই করে না কখনও। এদিকে অন্তু সম্পূর্ণ উল্টো। পাড়ায় ডানপিটে হিসেবে তার খ্যাতি (কুখ্যাতি) আছে। ক্লাসে প্রতিদিন কান ধরে উঠাবসা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। স্কুল ফাঁকি দিয়ে প্রায়ই সে চলে যায় নদীর পাড়ে। জটাধারী বুড়ো এক বট গাছ দাঁড়িয়ে সেই নদীর পাড়ে। জোয়ারের পানি ছুঁয়ে দেয় বটের শিকড়। মাটি সরে গিয়ে আলগা হয়ে আছে শিকড়গুলো। সেই শিকড়গুলোয় ডিঙি বেঁধে রাখে মাঝিরা। দুপুর বেলা স্কুল পালিয়ে এখানে চলে আসে অন্তু। দড়ি খুলে ডিঙি নিয়ে একা বেড়িয়ে পড়ে সে। নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় সারা খাল-বিল।
অন্তু-রানু দু’জনই সাঁতার জানে। পুকুর ঘাটে কাপড়গুলো রেখে পাড় থেকে পানিতে লাফিয়ে পড়ল অন্তু। দাদী প্রতিদিন বারণ করেন এভাবে লাফ দিতে। পানির নিচে ডুবে থাকা বাঁশের খোঁচায় বড় রকমের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু, কে শোনে কার কথা। লক্ষ্মী রানু ধরে ধরে পুকুরে নামায় দাদীকে। রানুর গায়ে সাবান মেখে দেন দাদী। ডাকেন অন্তুকে - ‘এদিক আয় অন্তু। গায়ে সাবান মাইখা দেই।’ সাঁতরে ঘাটে আসে অন্তু। দাদী সাবান মাখতে মাখতে বলেন - ‘কেমন ময়লা হইছে দেখছ? তোর কেম্নে মনে কয় সারাদিন আলায়-পালায় দৌঁড়াইতে?’ দাদীর কথা অন্তুর কানে যায়নি। সে তাকিয়ে আছে এক জোড়া রাজহাঁসের দিকে। কি সুন্দর করে সাঁতার কাটছে ওরা। সাবান গায়ে পিছলে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে। হাঁস ধরবে। রানুকেও ডাকে - ‘আয় রানু, হাঁসগুলারে ধরুম।’ দেরি না করে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে রানুও। দু’জন দু’দিক থেকে তাড়া করে হাঁসগুলোকে। কিন্তু, এত সোজা না। তাদের আগে সাঁতরে পাড়ে উঠে যায় রাজহাঁস দুটো। হতাশ হয়ে ঘাটে ফিরে আসে দু’জন। তবে হাল ছাড়ে না অন্তু - ‘কাইল ধরুমই ধরুম।’
শুক্রবার। অন্তু-রানুর ঈদ আজ। অন্য দিনের তুলনায় শুক্রবারের খুব ভোরেই ঘুম ভাঙ্গে তাদের। ঈদ বলে কথা! আজও ব্যতিক্রম হল না। শালিক, টুনটুনিসহ অন্য পাখিরা চেঁচিয়ে ডেকে তুলল তাদের। পাখিদেরও বুঝি ছুটির দিন আজ। দাঁত মেজে, হাত-মুখ ধুয়ে চুলোর কাছে গেল দু’জন। মা অনেক আগেই উঠেছেন। দাদীও আছেন। সামনে পানের বাটা। চিতই পিঠা বানাচ্ছেন মা। দুধের সিরায় ভিজিয়ে খাওয়া হবে। ভেজা ভেজা রসা পিঠার কথা ভাবতেই জিভে জল এসে যায় অন্তুর!
অন্তু-রানুর বাবা শহরে চাকরি করেন। তিনি পোস্টমাস্টার। সেখানেই থাকেন। ছুটি পেলে গ্রামে আসেন। আজ আসবেন বাবা। অন্তু-রানুর ঈদকে পরিপূর্ণ করতেই যেন! রানুর জন্যে লাল ফিতে, ফ্রক আর অন্তুর জন্যে সাদা জুতো নিয়ে বাড়ি এলেন বাবা। দুজনকে কোলে নিয়ে অনেক আদর করলেন। পড়াশোনার খোঁজ খবর নিলেন। অন্তুকে একটু শাসনও করে দিলেন - ‘তোমার নামে কিন্তু অনেকেই নালিশ করে। স্কুলের আপারাও। দুষ্টামি না কইরা ভালোভাবে লেখা পড়া করবা। ঠিক আছে?’ শান্ত ছেলের মত উত্তর দেয় অন্তু - ‘জ্বি, বাবা।’
পরদিন ভোর রাতে শহরে চলে যান বাবা। ঘর থেকে বের হওয়ার আগে চুমু দিয়ে যান ঘুমন্ত অন্তু-রানুর কপালে। ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে বাবাকে না দেখে অন্তু-রানুর মন খারাপ হয়ে যায়। তবে একটু পরই অন্তুর চোখে মুখে স্বস্তি দেখা যায় এই ভেবে যে, এখন অন্তত বাবার বকা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে! ভাইবোন একসাথে স্কুলের পথে রওনা হল। খোলা বিলের বুকের উপর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে সরু মেঠো পথ। এই পথ ধরে অন্তুর-রানুর স্কুলে যেতে হয়। দুজন দুজনের হাত ধরে হাঁটে দুই ভাইবোন। স্কুলে পৌঁছে যে যার ক্লাসে চলে যায়। আজও স্কুল পালায় অন্তু। বই খাতা ক্লাসে রেখে চলে যায় নদীর পাড়ে। বাঁধন খুলে একটা ডিঙি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে প্রতিদিনকার মত। চারপাশ দেখতে দেখতে নৌকা বেয়ে উত্তরে চলে যায় সে। ফেরার কথা ভুলে যায়। প্রকৃতির মায়া সামনে টেনে নিয়ে যায় তাকে। যে মায়ায় জড়িয়ে গেলে আর বাড়ি ফেরা হবে না তার!
স্কুল ছুটি হয়ে গেল। ভাইজানের জন্য অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল রানু। শেষে অন্তুর এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে, অন্তু বই খাতা রেখে স্কুল পালিয়েছে। রানু ভাইজানের বই খাতা নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। এখনও অন্তু ফেরেনি দেখে মাকে সব বলল সে। মা একটু রেগে গিয়ে বললেন - ‘আইজ আসুক, তার পিঠের চামড়া তুইলা নিমু আমি।’ দাদী উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন - ‘কে জানে কই গেল পোলাডা।’ সন্ধ্যা হয়ে এলো প্রায়। এখনও ফেরেনি অন্তু। এতক্ষণে ভয় ফুটলো মায়ের মুখে। পাড়ার কয়েকজন বড় ছেলেকে বললেন অন্তুর খোঁজ করতে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হল। খুঁজে পাওয়া গেল না অন্তুকে। মা আর দাদী কাঁদতে লাগলেন। রানুও ফুঁপিয়ে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে রাত পার হল। অন্তু ফিরল না। শহরে খবর পাঠানো হল অন্তুর বাবার কাছে। খবর পেয়ে ছুটে এলেন তিনি। অনেক লোক লাগালেন ছেলেকে খুঁজতে। পাওয়া গেল না। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে অন্তুর জন্য সারাদিন কাঁদেন মা; দাদীও। মন খারাপ করে বসে থাকেন বাবা। একা একা স্কুলে যায় রানু।
এভাবে সপ্তাহ, মাস, বছর পেরুলো। আরেক বর্ষা এলো; চলেও গেল। টান টান কাদা জমলো মরা জলায়। কাদা এনে উঠোনে বসলো রানু। তার খেলার সাথী নেই। ভাইজানের জন্য হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল সে - ‘সব কাদা তোমারে দিব, ভাইজান! তুমি তাড়িতাড়ি ফিরা আস! ফিরা আস ভাইজান!’
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।