পটলের বাবা হওয়ার পর অনেকদিন ওকে দেখিনি ।পটলদের পটলখেতের পটল খেতে হাতি ঢুকেছিল, সেই হাতিদের সাথে হাতাহাতি করতে সেই যে রাণীর পিঠে চেপে রাজা,পটল ও পটলের মা চলে গেল তারপর চার চারটি বছর কেটে গেছে ( পটল কাহিনী পুরো জানতে হলে পড়তে হবে গল্পকবিতার বিশেষ সংখ্যা বাবা দিবস-এর গল্প ‘বাবা হওয়া’ )। হঠাৎ সেদিন চৌরাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানে পটলের সাথে দেখা । ‘ আরে পটল যে, কেমন আছিস, কবে এলি, মা বাবা. রাণী কেমন আছে ?’ এক সাথে এতগুলো প্রশ্ন মুখের ভেতর থেকে ছিটকে বেরোয়।পটল নির্বিকার ভাবে বলে ওঠে, ‘সব বলছি, আগে তো চা খাওয়া যাক।‘ কিন্তু আমি তো চা খাইনা, আমার উত্তর । ‘চা খাও আর না খাও আমাকে তো চাখাও’ ,পটলার চটপট জ্ববাব ।পটলাকে চায়ের সাথে টা চাখাতে শ’খানেক খসলো ।জানা গেল হাতি তাড়াতে গিয়ে গর্তে পড়ে আহত হয়ে রাণী পটল তোলায় রাজা (পটলের বাবা ) রাণীর শোকে দুঃখে পাগল হয়ে পটল গাছের মূল ( যা নাকি খুব বিষাক্ত ) খেয়ে পটল তুলেছে ।
এখন রাজা রাণী পটল তোলায় পটল সাম্র্রাজ্য্ তথা পটল খেতের ভার এসে পড়েছে আমাদের পটলের উপড়ে ।এতে পটল পড়েছে ঝামেলায় । পটল খেতে ও ভালবাসে । পটল ভাজার চেয়েও পটল চিংড়ি, পটলের দোলমা, দই পটল বেশি ভাল লাগে পটলের। তাই বলে পটল তোলা ? তাও একটা দুটো নয় কুইন্টাল কুইন্টাল পটল তোলা ? অসম্ভব ! তার চেয়ে ও একবার একটি মাত্র পটল তুলে ইহ জগৎ থেকে বিদায় নিতে চায় ।
পটলের ঝামেলাটা বুঝে আমি বললাম, রাণী তো নেই, তাহলে আর চিন্তা কি, হাতিরাই সব পটল সাবার করবে, এমনকি মূল সহ পটল গাছ হাতিরা খেয়ে ফেলবে কিন্তু পটল তুলবেনা, পটলের বিষাক্ত মূলে মানুষ পটল তুলতে পারে কিন্তু মানুষের চেয়ে ১০০ গূণ শক্তিশালী হাতির কিছুই হবেনা ।আর মূল খেয়ে ফেলায় পটল গাছ আর হবেনা, ফলে পটলও ফলবে না । পটলকেও আর পটল তুলতে হবেনা । নিজের বুদ্ধিতে নিজেই চমৎকৃত হয়ে গেলাম । এতদিনে আমার নামের প্রতি সুবিচার করতে পারলাম । ধীমান শব্দের অর্থ বুদ্ধিমান ।আহা কি বুদ্ধি আমার ! আমি অবাক হয়ে গেলাম । কিন্তু অবাক হওয়ার অনেক বাকি ছিল । আমার কথা শুনে পটলা বলে উঠলো, ‘ আমি যাই বঙ্গে, কপাল যায় সঙ্গে ‘। মানে ! বলে উঠি আমি । শোন তবে । নুতন পটল কাহিনী শুরু হয়, আমি শুনতে থাকি ।
রানীর মৃত্যুর পরে একদিন পটলখেতের পাশে পাঁকুর গাছ তলায় ঢেঁকুর তুলে বিশ্রাম নিচ্ছি, পাশেই পোষা মোষ দুটো ঘাস খাচ্ছে ।অবলা প্রাণী দুটি ঠিক মত খেতেও পায়না । সারাদিন গাড়ী টানে. কঠোর পরিশ্রম করে । তবুও ওরা যে মনিবকে মানে আমাকে এত ভালবাসে জানতাম না । যদি এই ঘটনা না ঘটতো তবে জানতেও পারতাম না ।চোখদুটো একটু মুদে এসেছিল ।হাতিরাও টের পেয়ে গিয়েছিল রাণী আর নেই ।ব্যস সদলবলে প্রিয় পটল খেতে পটলখেতে হাজির । নেতা দাঁতালটা তার পা দুটো তুলেছে আমাকে পদদলিত করে পিষে মারার জন্য । আমি শব্দ শুনে চোখ খুলে ঐরাবতের সংহার মূর্তি দেখে ভয়ে অজ্ঞান । এমন সময় মোষ দুটো ছুটে এসে দাঁতালটাকে সজোরে গোত্তা মারলো । গোত্তা খেয়ে দাঁতালটা কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল ।ওটা ভাবতেও পারেণি এমনটাও ঘটতে পারে । ঘোড়ার পরে গৃহপালিত মোষ ! বোধহয় লজ্জ্বায় দুঃখে অপমানে হাতি জীবন অবসানের জন্য সে চোঁ চাঁ দৌড় লাগালো , বাকি হাতিরাও বৃংহত রবে তাকে অনুসরণ করলো । আর কোনদিন তারা গ্রামে ফিরে আসেনি ।মোষ দুটোও আশেপাশের সাত গাঁয়ে বিখ্যাত হয়ে গেল । ওদের ছবিসহ খবর বাংলাভাষায় সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক ‘ আনন্দবাজার পত্রিকা’-য় বেড়িয়েছিল ।
আমাবও মনে পড়লো আনন্দবাজারে পড়েছিলাম খবরটা । সত্যি আনন্দবাজার পড়তে হয় নইলে পিছিয়ে পড়তে হয় । সেখানে হাতিশাল গ্রামের নামটাও ছিল ।আশ্চর্য তবুও পটলের কথা মনে পড়লো না ! লোকে ঠিকই বলে চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল !
‘এখন পটলের সিজন, তাই পটল তোলার ঝামেলা থেকে বাঁচতে তোমার কঠিন অসুখ বলে, তোমাকে দেখার নাম করে চলে এসেছি,’ পটল আরো বলে , ‘জানতো মা তোমাকে নিজের ভাইয়ের মতো ভালবাসে তাই কোন আপত্তি করেণি’। তা এখন কি করতে চাস ? আমি বলি । “ বড়ঞা গ্রামে যাব তোমায় নিয়ে, সেখানে রম্যকথার আসর বসবে আগামীকাল থেকে ।“ রম্যকথার আসর ! সে আবার কিরে ? আমি আশ্চর্য হই । ‘ তোমাকে নিয়ে আর পারিনা, কিসের লেখক তুমি, মানে চুটকির তথা রসকথার আসর. সেখানে অংশগ্রহন করবো আমি ।‘পটলের উত্তর ‘। আমি হতবাক, বলে কি পটল ! চুটকি তো বেশীরভাগই আদিরসাত্মক ! সেদিনের ছোকরা পটলা ! হায় এ দেশের কি হবে ! পটল আরো বললো, আমাকেই বললো,” তুমি কথা নিয়ে এত কারিকুরি কর কেন, এ কেমন বদ অভ্যাস তোমার ?” একে বলে পান করা, বলি আমি, পটলকেই বলি । “ পান করা ! মদ-ই তো লোকে পান করে, কথা আবার পান করা যায় নাকি. কি ছাইপাশ বল তুমি ।“ পটলকে জ্ঞান দেওয়ার সুযোগ পেয়ে প্রাঞ্জল করি আমি, বলি এপান সে পান নয় । এই পান-এর মানে হলো কথা নিয়ে কথকতা করা । ভাষার উপড় ভাল দখল না থাকলে এটা কেউ করতে পারবে না । বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুরণো বই ( প্রায় বিয়াল্লিশ বছর আগের ) হাতে এসেছিল সেদিন । তাতেও দেখলাম পানের ব্যবহার । “ হাসা বলে হাসি, হাসি বলে হাসা, এই নিয়ে হাসা, হাসি করে হাসাহাসি ।“ ইংরেজী সাহিত্যে পান-এর ভুরিভুরি উদাহরণ আছে ।
জ্ঞানদান পর্বের পর বড়ঞার দিকে রওনা দিলাম । সেখানে গিয়ে উঠলাম বড়মিঞার বাড়ীতে ।সন্ধ্যায় শুরু হ’ল চুটকির আসর । প্রথম তিন ঘন্টা ( রাত দশটা পর্যন্ত ) নিরীহ সব চুটকি । যেদিন বড় গল্প লিখবো সেদিন ওগুলো পুরো লেখা যাবে । পটলের বিজয় কাহিনী দিয়েই আজ শেষ করবো । পটলের ঐ চুটকি শুনে বহুদিন পর্যন্ত বড়ঞার লোকজন হাসাহাসি করতো । ছেলে ছোকরারা একজন আরেকজনের সাথে দেখা হলেই পটল বলে হেসে গড়িয়ে পড়তো।
পটলের কথা আমি নিজের ভাষায় একেবারে নিজস্ব করে লিখছি : পটলের স্যার পটলকে বলেছিলেন, পটলের বুদ্ধি পরীক্ষা করার জন্যই বলেছিলেন আরকি, ‘ আচ্ছা পটলা বলতো আমাদের বাড়ীতে চারজন লোক, আমার বাবা, মা আর আমার বোন , আরেকজন কে ?’ পটল বলতে পারলো না । তখন স্যার বলেছিলেন, দুর বোকা, “আরেকজন হ’লাম আমি ।“
তো পটল মঞ্চে উঠে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো, “ বলুনতো আমাদের বাড়ীতে চারজন লোক, আমার বাবা, মা আর আমার বোন ।আরেকজন কে ?” সবাই তারস্বরে উত্তর দিল আরেকজন তুমি । পটল হেসে বললো, “জানতাম পারবেন না । আরেকজন হলো “আমার স্যার “ ।।