গেল সিজনে ক্ষেতে রোয়া লাগানোর সাথে সাথেই বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেল। খড়া। প্রচন্ড খড়ায় মাঠের সব ফসল পুড়ে গেছে। যে সব ক্ষেতে সবুজ সবুজ ধান গাছে সোনালি ফসল ফলত, সে সব ক্ষেত এখন ধুধু মরুভূমি। রৌদ্রে খাঁখাঁ করছে। মরীচিকা জ্বলমল করছে। শীত প্রায় এসে গেল। এখন আর বৃষ্টি হবেনা। গরু মহিষের খাবার নেই। ঘর ছাওয়ার ছন নেই। খড়ের অভাব, খাদ্যের অভাব। গ্রামের চুলায় তিনবার ঠিক মতো রান্না চাপেনা। গৃহস্থরা সব গরু মহিষ, ছাগল, ভেড়া মাঠে ছেড়ে দিয়েছে । ছেলেরা লাঠি নিয়ে তাড়া করছে। হৈত হৈত। ডাইনে বায় বায়, থাম্ থাম্ বলে হাক ছাড়ছে। বাঁশি বাজাচ্ছে, দৌড়াদৌড়ি করছে, ডাংগুলি খেলছে। ছোট ছোট মেয়েরা গরুর পিছনে পিছনে ঘুরঘুর করছে। মাটিতে পড়ার আগেই গোবর দখল নিচ্ছে, ঘুঁটে করার জন্য। কয়েকজন ছেলে বুড়ো বট গাছটার নিচে শুয়ে বসে, ঘুড়ি উড়িয়ে গান গাইছে।
স্কুলে আসাযাওয়ার পথে রুদ্র এমন দৃশ্য কয়েক মাস যাবত দেখছে। কিন্তু আজ একটি খেলা তার মনে ধরে। ঘুড়ি উড়ানো। স্কুল থেকে ফিরে তার মাকে বলে ঘুড়ি বানিয়ে দিতে। তুমিই তো বানাতে পার বাবা। তোমার খাতার একটি তা দিয়ে বানিয়ে নাও। গরম ভাত আছে ভাল আঠা হবে । না মা এই সব ঘুড়ি না। ওইযে বড় ঘুড়িটা উড়ছে। শোনছনা কেমন করে আকাছে ডাকছে। ওই ঘুড়ি বানিয়ে দাও। না বাবা ওটা আমি বানাতে পারিনা। আচ্ছা তোমাকে আমি একটি লেজ ওয়ালা ঘুড়ি বানিয়ে দেই। অনেক লম্বা লেজ। না না এই ঘুড়ি আমি উড়াবনা। আমাকে ওই ঘুড়িটাই বানিয়ে দাও। বাবা ওই ঘুড়ির অনেক বেশি শক্তি হয়। তোমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। ওগুলো বড় মানুষেরা উড়ায়। তুমি পারবানা বাবা। মা’র কথা শুনে রুদ্র মুখ ভার করে থাকে।
রসুল মাষ্টার একতলা বাড়ি করেছে মাস খানেক হয়। গেটের কাছে এসে রুদ্রকে ডাকে, রুদ্র রুদ্র। রুদ্রের কোন জবাব নেই। তার মা বলে, রুদ্র স্কুল থেকে ফিরে ভাত না খেয়েই মাঠে চলে গেছে। ঘুড়ি দেখতে। আমি এত করে বললাম, আমি বানিয়ে দেই। না ও ছোট ঘুড়ি নিবেনা। ডাক ঘুড়ি বানিয়ে দিতে বলে। তাদের একমাত্র সন্তান রুদ্র। রসুল মাষ্টার বিয়ে করেছিল প্রায় আঠার বছর। আট বছর পর ঘরে সন্তান আসে। খুব আদরের একমাত্র সন্তান। তার কোন ইচ্ছাই অপূর্ণ রাখেনা। রসুল মাষ্টার মাঠে গিয়ে কোলে করে নিয়ে আসে। কালকেই ঘুড়ি বানিয়ে দিবে। এমন কথা দিয়ে আদর করে একসাথে বসে ভাত খাওয়ায়।
সন্ধার পর একটি বড় রঙ্গিন কাগজ, ঘাম, মোটা নাইলন সুতা, সুতা প্যাঁচানোর জন্য বড় একটি নাটাই নিয়ে আসে। পরদিন তার এক আত্মীয় আসে। সম্পর্কে ভাই। নাম বছির। তাকে দেখেই বুঝে যায়। মা তার কথাই বলেছিল। ঘুড়ি বানিয়ে দিবে। খুশিতে রুদ্রের পেট ব্যথা শুরু হয়ে যায়। সে নাস্তা খেয়ে, স্কুলে না গিয়ে তার ভাইয়ের সাথে বসে বসে ঘুড়ি বানানো দেখে। তার নিজের ঘুড়ি। হা তার গুড়িই তো বানাচ্ছে। খুশিতে মন লাফাচ্ছে। মাঝে মাঝে এটা ওটা এগিয়ে দিতে পুলকিত বোধ করে। ঘুড়ি বানানো শেষে, বছির ভাই বলে। রুদ্র আসো তোমার সাথে মাপ দেই। বলেই দুজনে হাসাহাসি করে। উরে বাবা, ঘুড়িটা আমার চেয়েও বড়। বুকের ভিতর চিন করে উঠে। মনে ভয় ভয় লাগে। মা বলেছিল এই ঘুড়ির অনেক শক্তি হয়। ঘুড়িটা আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। যদি সত্যি সত্যি আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। এখন আর ঘুড়ির কাছে আসতে চায়না। কেমন যেন নিশ্চল থাকে। ভয় ভয় লাগে রুদ্রর। কিন্তু ঘুড়ির রূপে মুগ্ধ হয়ে যায়। খুব সুন্দর।
মাঠে নিয়ে ঘুড়িটা রুদ্রর হাতে দিয়ে, নাটাই থেকে অনেক সুতা ছেড়ে দেয়। তারপর রুদ্রকে বলে উপর দিকে ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে দিতে। রুদ্র তাই করে। সাথে সাথে ঘুড়িটা আকাশে উড়ে যায়। ঘুড়ির মাথায় পাতলা করে লাগানো, বেতের বেনা থেকে সাথে সাথে প্রচন্ড একটা শব্দ শুরু হয়, ব্যান্ ন্ ন্ ন্ ন্ ন্। শোশো করে উপরে উড়ে যায়। ব্যান্ করে ডাক দেয় বলেই তার নাম ডাক ঘুড়ি। গাছের গোড়ায় বেঁধে রাখে। সুতায় হাত দিয়ে মাঝে মাঝে ঘুড়ির শক্তি দেখে। সুতা অনেক শক্ত। টান টান হয়ে আছে। বেনার প্রচন্ড ডাকে মাঠের সব ছেলে মেয়েরা আকাশের দিকে তাকায়। আশে পাশের লোকেরাও ডাক শুনে আকাশের দিকে তাকায়। ঘুড়ি দেখে মুগ্ধ হয়।
প্রতিদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় ঘুড়িটা একবার ছুঁয়ে যায়। বিকালে স্কুল থেকে ফিরে ঘুড়িটা উড়ায়। সন্ধার সময় কাজের লোক কালু হাত দিয়ে সুতা টেনে টেনে ঘুড়িটা নামায়। একা একা এসব ঘুড়ি নামানো যায়না। এত বড় ঘুড়ি উড়াতে যেমন বেশি বাতাস লাগে, তেমন শক্তিও হয় খুব বেশি। তাই দুজন লাগে। একজন সুতা টেনে টেনে নামায়। আর একজন নাটাইয়ে সুতা প্যাঁচায়। রুদ্র নামাতে পারেনা। সুতা ধরে স্থির হয়ে দাড়িয়ে থাকতে পারেনা। এত শক্তি এখনো তার হয়নি। মা’র কথা মনে পরে। মা সত্যি বলে ছিল। আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। তাই সে নাটাইয়ে সুতা প্যাঁচায়।
স্কুল বন্ধ। সাত দিনের ছুটি। নৌকায় করে নানা বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার সময়, ঘুড়িটা সে সাথে নিয়ে যায়। রুদ্রের মামা ঘুড়িটা উড়ায়। ওই পাড়ার লোকেরা ঘুড়িটা দেখতে আসে। এত বড় ঘুড়ি উড়াতে অনেক বাতাস লাগে। বাতাসের শক্তি দিয়েই ঘুড়িটা এত উঁচুতে উঠে। তাই তার এত শক্তি। একদিন উড়ানোর সময় বাতাস বেশি ছিল না। বাঁশ বাগানের উপরে ঘুড়িটা আছড়ে পড়ে। ঘুড়ির ছাউনি ছিঁড়ে যায়। রুদ্রের কান্না থামেনা। তাই আর বেড়ানো হলনা। পরদিন ফিরে আসে বাড়িতে। বছির ভাইকে এনে সাথে সাথে আবার ঘুড়ি ছেয়ে নেয়।
বাড়ির পিছনে ফাঁকা জায়গা। আজ ছাদের উপর থেকেই ঘুড়ি উড়ায়। ঘুড়িটা আকাশে উড়ে গেলে, কালু নিচে বিল্ডিং’র রডের সাথে বেঁধে, নাটাই ছাদের উপরে ছুঁড়ে দেয়। ছাদের রডের সাথে সুতা বেঁধে তার পর নিচের বাঁধন খুলে দেয়। ছাদের উপর বসে বসে রুদ্র ঘুড়ি উড়ায়।
আজ স্কুল থেকে ফিরেই সে ঘুড়িটি উড়ায়। ঠিক ঐ ভাবে ছাদের উপর নাটাই নিয়ে বসে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘুড়ির অনেক উপর দিয়ে শকুন উড়ে। রুদ্র গুনতে থাকে, একটা দুইটা তিনটা তার পর আরো, আরো অনেক । লাইন ধরে উড়ছে। নাহ্ এত কম সুতায় হবে না। আমার ঘুড়িটা যদি ওই শকুনের উপর দিয়ে উড়ত তাহলে কত মজা হত। আজই বাবাকে বলব আরো সুতা আনতে। একটু পর পর সুতা টেনে ঘুড়ির শক্তি দেখে।
জলবায়ুর কারণে সাধারণত বাতাস দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে বয়ে যায়। তাই ঘুড়িও উত্তর আকাশে থাকে। দক্ষিণ দিকে মুখ করে। রুদ্র উত্তর দিকে মুখ করে বসে থাকে। ঘুড়িটা উত্তর আকাশেই বেশির ভাগ সময় থাকে। মাঝে মাঝে পূর্বদিক থেকে বাতাস বইলে, অথবা বাতাস পাক খেলে পশ্চিমাকাশে চলে যায়। তার পর আবার উত্তর আকাশে চলে আসে।
প্রচন্ড খড়ায় কোথাও গরু মরেছে। শকুনের ঘ্রাণ শক্তি অনেক বেশি। কয়েক শ মাইল দূর থেকেও তারা ঘ্রাণ পায়। ওরা উড়ে যাচ্ছে খাওয়ার জন্য। ঐ শকুনের উপর দিয়ে কেন আমার ঘুড়ি উড়ে না। যদি আমি পাখি হতাম তাহলে আকাশে উড়তাম। ঐ মেঘের ভিতর দিয়ে উড়ে যেতাম। নানুর বাড়ি। মেঘে বসে বসে আমার ঘুড়ি দেখতাম। রুদ্র এক ধ্যানে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে। এখন বাতাস উল্টা-পাল্টা বইছে। ঘুড়ি প্রতিদিনের মতো উত্তর আকাশে এক স্থানে স্থির হয়ে থাকছেনা। একটু আগেও স্থির ছিল। এই ঝড়ো হাওয়ার মতো শোঁ-শোঁ শব্দ করে প্রচন্ড বেগে বইছে। আবার থেমে যাচ্ছে। এই দক্ষিণ দিক থেকে আবার এই পূর্ব দিক থেকে বইছে। একটু পর পর ঘুর্ণি বায়ুর মতো পাক খাচ্ছে। যখন বাতাস থেমে যায়, তখন ঘুড়িটা নিচের দিকে নেমে আসে। মনে হয় মাটিতে পড়ে যাবে। এমন সময় সুতা টেনে টেনে টান্ টান্ করে রাখছে রুদ্র। যাতে সেজা হয়ে উপর দিকে মুখ করে থাকে। তখন ঘুড়িতে বাতাস আটকে উপর দিকে উঠে। এভাবে না উড়ালে ঘুড়ি নিচে পড়ে যায়। রুদ্র আজ বেশ বেগ পাচ্ছে। এই কষ্টের মধ্যেই যেন ঘুড়ি উড়ানোর প্রকৃত সুখ।
হঠাৎ বাতাস কমে গেলে, রুদ্র সুতা টেনে টেনে টান টান করে পিছন দিকে দৌড় দেয়। ছাদের পুর্ব পাশের রেলিং এর উপর দিয়ে নিচে পড়ে যায়। বিল্ডিংএর রড বাঁকা করার জন্য, পূর্ব পাশে মাটিতে পোঁতা একটি যোগান। যোগানের তিন ইঞ্চি পরিমাণ রড দুটি তার পেটের ভিতর ডুকে যায়। রুদ্র নিশ্চুপ হয়ে যায়। ধরাধরি করে মেডিক্যাল নিয়ে যায়। কিন্তু ততক্ষণে সে চলে গেছে দূরে। বহু দুরে। আকাশে উড়ন্ত শকুনের চাইতেও অনেক উঁচুতে। আর কোন দিন ফিরে আসবেনা মাটির পৃথিবীতে।
২২ জানুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৪৩ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪