শ্রাবণীর বাবার প্রচুর টাকা। সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। বিশেষ কোন প্রয়োজন না থাকলে ড্রাইভারকেও গাড়ীতে নেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। এত টাকা পয়সা বাড়ি গাড়ী একদিন তারই হবে সেদিকে কোন চিন্তা নেই। বাড়িতে চুপচাপ থাকা, দুহাতে টাকা খরচ করাই তার দৈনিক রুটিন। কয়েক মাস আগেও তার এমন স্বভাব ছিল না। এখন এগুলো থেকেও অনেক দূরে থাকতে চায়।
কলেজের নবীন বরণ অনুষ্ঠানে পলাশের সাথে প্রথম দেখা। ছেলেটা খুব ভালো। যেমন চেহারা তেমন কথা বার্তা আচার ব্যবহার। ছাত্র হিসাবেও বেশ সুনাম। তার মুখে অভাবী ও ভাল মানুষের ছাপ স্পষ্ট। পলাশকে ঘিরে একটা জটলা সব সময়ই থাকে। কেউ কিছু খেলে কোথাও গেলে তাকে ডাকে। সবাই তার সাথে বন্ধুত্ব করতে চায়। তাতে শ্রাবণীর একটু হিংসা জাগে। অথচ তারও ছেলেটাকে ভাল লাগে। নিজের মতো করে ভাবতে চায়। হঠাৎ করে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় সুযোগ মতো পেয়ে দুএকটা কথা বলে। সে থেকে নিয়মিত।
কলেজের গেইটে পা দিয়ে টুলটুলে চোখ দুটো পলাশকে খোঁজে। পলাশের কণ্ঠ শুনলে চঞ্চলা হরিণীর মতো এদিক ওদিক তাকায়। কল্পনায় নীল আকাশে ভেসে বেড়ায় দুজনে। মাঝে মাঝে তারা এদিক সেদিক ঘুরতে যায়। সকালে বিকালে টিউশনী ঘরে অসুস্থ বাবা তাকেও পলাশ সময় দেয়, তাই প্রতি দিন ঘুরার সময় হয়ে উঠে না। কিন্তু তাকে কাছে পেতে খুব মন চায় শ্রাবনীর। বাড়িতে প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে কথা বলে না। মন মরা হয়ে চুপ চাপ থাকে। কিছু দিন যাবৎ পলাশকে পেয়ে অনেক কথা বলে। হাসে, আনন্দ করে। মনের চাপা কষ্ট গুলো ভুলে থাকে। পলাশের সব কিছুই তার ভাল লাগে। ভাল লাগা গুলো আস্তে আস্তে তার মনের ভিতরে ভালবাসায় পারিণত হয়। মনের খুশিতে উড়তে থাকে প্রজাপতির মতো। ভালবাসার কথা খুব গুছিয়ে শ্রাবণী বলতে পারে না। পলাশের কথায়, ব্যবহারে শুধু ভাললাগা আর ভদ্রতাই প্রকাশ পায়। ভালবাসার কথা একবারও প্রকাশ করেনি। তাই ভাল বন্ধুত্ব হয়েছে বলা যায়। বাড়িতে একঘেয়ে জীবনে নিজের মধ্যে একটা কষ্ট ভরা জগৎ তৈরী হয়েছে শ্রাবণীর। সে জগতে সেই একমাত্র বাসিন্দা, তার কোন সঙ্গী নেই। পলাশকে নিয়ে সব ভুলে থাকতে চায়।
একদিন শ্রাবণী পলাশকে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। বাড়িতে কয়েক জন কাজের লোক ছাড়া কেউ নেই। তারা যার যার কাজে ব্যস্ত। কলেজ থেকে একটি ছেলে এসেছে, করিমের মার কাছ থেকে শুনতে পেয়ে পলাশকে তার রুমে ডেকে নিয়ে অনেক কথা বলেন শ্রাবণীর বাবা। বাবা শ্রাবণীকে কাছে ডাকেন কিন্তু সে আসতে চায় না, ঘৃণা ভরে মুখ ফিরিয়ে রাখে। না বলা একটা যন্ত্রণার কষ্ট বয়ে বেড়ায়। তার বাবা বলেন মা তুমি এবার একটু সংযত হও। নিজেকে বুঝতে শিখ, বাস্তবতা বুঝতে শেখ। ভবিষ্যতের চিন্তা কর। আমি যে সম্পদ গড়েছি তা একমাত্র তোমার জন্যই। টাকা পয়সার অভাব তোমার কখনো হবে না। যখন যা চাইছ, যত টাকা চাইছ সবই তোমাকে দিচ্ছি। তোমার কোন অভাব আমি রাখছি না। তুমি শুধু নিজেকে, জীবনকে বুঝতে শেখ। শ্রাবণী বাবার সাথে কোন কথাই বলে না। বলার প্রয়োজন ও যেন নেই। শুধু টাকার প্রয়োজন হলে বাবার কাছে যায়। সে কারো হুকুম পালন করতে বাধ্য নয়।
করিমের মার প্রতি তার একটা গোপন ঘৃণা কাজ করে। আজ সকালে হঠাৎ করে চটে গিয়ে না না প্রকার গালী দিয়ে মনের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। নাস্তা না খেয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে হয়ে যায় ও । কয়েকজন বান্ধবীর সাথে তার খুব ভাল সম্পর্ক। রুমার সাথে অন্যরকম অন্তরঙ্গ ভাব। মনের কথা গুলো সব সময় তার সাথে ভাগাভাগী করে। এমনকি তার পারিবারিক সমস্যা গুলোও। পলাশকে ভালো লাগার কথা তাকে জানায়। তাকে যে করেই হোক তার জীবন সঙ্গী করতে চায়। কথায় কথায় সুন্দরী করিমের মার চরিত্র নিয়ে কথা বলে। তখন রুমা তাকে কিছু যুক্তি দেখায়। যুক্তি গুলো তার কাছে খুব একটা ভালো লাগে না, তার বাবা সম্পর্কে সন্দেহ কিছুতেই কাটতে চায় না।
সন্ধায় বাড়ি ফিরে আবার একা হয়ে যায় শ্রাবণী। টিভি দেখে কম্পিউটারে গেম খেলেও সময় যেন কাটছে না। মধ্যরাত তবু চোখে ঘুম নেই । রুমের লাইট এখনো নিভেনি। দরজা খুলে বাইরে আসে দক্ষিণের বাড়ান্দায় পায়চারী করতে থাকে। রুমার যুক্তি গুলো মনে পড়ে, সেকথা ভাবতে থাকে, কিন্তু কিছুতেই তার মনকে বুঝাতে পারে না। ঘৃণা গুলো জমাট বেঁধেই থাকে। দোতলায় যে রুমে শ্রাবণী থাকে তার পাশের রুমেই থাকে করিমের মা। আর সামনের রুম তার বাবার। করিমের মা’র আর তার বাবার রুমের লাইট জ্বলতে দেখে তার রাগ আরো বেড়ে যায়। প্রচন্ড ঘৃণায় রাগে তার শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। তার পরও অনিচ্ছায় চুপি চুপি গিয়ে তার বাবার দরজার পাশে দাঁড়ায়। দুজনের কথাও শুনতে পায় শ্রাবণী। এখনো কি বিশ্বাস করতে হবে এই খারাপ লোক দুটিকে। কানে ভেসে আসে আরো কথা।
ভাইজান নিজের মেয়ে হলে কারো কাছে কৈফিয়ত দিতে হয় না। আপনার মেয়েকে যত্ন করে দেখা শোনা করতে গিয়ে প্রতি মুহূর্তে ভয়ে থাকি কখন আপনার কাছে কৈফিয়ত দিতে হয়। আমার কখন ভুল হয় কি না। কোন অযত্ন হয় কি না। শ্রাবণী মার জন্য যা করেছি আমার ছেলের জন্যও তা করিনি। ভাইজান আপনার সেই প্রথম দিনের একটি কথাই শুধু বার বার আমার মনে পরে। আপনি বলেছিলেন মা’মরা আমার একমাত্র মেয়ে। বোন তোমার হাতে দিলাম তুমি ওকে দেখে রেখ। মায়ের আদর দিয়ে ওর মায়ের অভাব দূর করো। আমি বাবা হয়ে মায়ের অভাব পূরণ করতে পারব না। সত্যি ভাইজান আপনিই একজন দায়িত্ববান বাবা। সেই যৌবনে স্ত্রী হারিয়েছেন, কিছুর অভাব ছিলনা আপনার, তবু শুধু শ্রাবণী শ্রাবনী করেই আর সংসারী হলেন না। একথা চিন্তা করলে আমার ভয় আরো বেড়ে যেত। যে লোক সৎ মায়ের ঘরে তার মেয়ের কষ্ট হবে বলে আর বিয়ে করলেন না তার মেয়েকে পালা যে কত কষ্টের সেটা আমি হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছি। আপনার মেয়ে এখন বড় হয়েছে। কলেজে পড়ছে।
ভাইজান আমি একটি কথা বলতে চাই। কি তোমার বেতন বাড়াতে হবে? না ভাইজান টাকার কথা নয়। বেশ কয়েক দিন যাবত লক্ষ করছি মামণি আমাকে সহ্য করতে পারছে না। কি হয়েছে তা আমাকে বলেও না। সকালে আমাকে অনেক গালাগালী করে নাস্তা না খেয়েই বেরিয়ে যায়। সন্ধায় এসে রুমে ঢুকে। কিন্তু এখনো ঘুমোয় নি। রুমের লাইট জ্বলছে। কি হয়েছে তা আমি জানি না। আপনার মেয়েকে আপনিই জিজ্ঞেস করে দেখেন। আমি সাহস পাচ্ছি না। আর আমাকে এবার বিদায় দিন, আমি আর থাকব না। দেখ বোন ছ’মাস বয়স থেকে তুমি ওকে বড় করে তুলেছ। আমি বাবা হয়ে যা পারিনি তা তুমি পেরেছ। আমার কাছে ও যা বলতে পারবে না তা তোমার কাছে ঠিকই বলবে। তুমি যদি চলে যাও তাহলে আমার মেয়েকে কে দেখবে? তার কথায় তুমি কষ্ট নিও না। ও যদি কোন অন্যায় করে থাকে আমি তোমার কাছে মাফ চাইছি। না না ভাইজান একি বলছেন।
গোপনে বাবা আর করিমের মায়ের কথাগুলো শুনে শ্রাবণীর প্রচন্ড রকম ধাক্কা লাগে। চোখ বেয়ে জল আসে। বুকের মধ্যে চাপা কষ্টগুলো প্রচন্ড ঝড়ের সময় গাছের ডালপালার মতো তার বুকের ভিতরে সবেগে আঘাত করতে থাকে। এত দিনের জমানো কষ্টগুলো বহু গুণ বেড়ে তার নিজের উপর লাগতে থাকে। নিজের কছে নিজেকে অপমানে ছোট মনে হতে থাকে। এক দৌড়ে রুমে ঢুকে লাইট অফ করে কাঁদতে থাকে।
একজন বাবা পুরোপুরি বাবার দায়িত্ব পালন করলেও মায়ের দায়িত্ব পালন করতে পারে না। তার অবুঝ থাকা অবস্থায় মা মারা গেলেও তার বাবা শুধু তার সুখের চিন্তা করে দ্বিতীয় বিয়ে করেনি। বাবা হয়েও মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি। লেখাপড়ার দিকেও তার প্রচন্ড খেয়াল, সারা বৎসর মহিলা টিচার দিয়ে প্রাইভেট পড়া। একটু ঠান্ডা কাশি হলে ডাঃ দেখানো, জামা কাপড় আরাম আয়েশ সব দিকেই নজর। করিমের মাকে দিয়েই তার মায়ের অভাব পূরণ করেছে। তার বাবার ধৈর্য্য আর এক মাত্র মেয়ের প্রতি খেয়াল রাখাই তার প্রমাণ। তাদের দুজনে এমন কোন কিছু তার চোখে পরেনি যে তাদের কে খারাপ বলবে। শুধু সন্ধেহ থেকেই দিনের পর দিন তার মনে একটি ঘৃণা জন্মেছে।
সে বুঝতে পারে তার এত দিনের ধারণা সম্পূর্ন ভুল। সে বুঝতে পারে তার বাবা আর করিমের মার কোন দোষ নেই। এমন অনেক অভাবী মানুষই কাজ করে সবার চরিত্রই খারাপ হয় না। তার প্রতি একটু বেশী টান একটু বেশী আদরই তার প্রতি সন্ধেহটা বেশী জেকে বসে। অভাবের জন্যই করিমের মা তাদের বাড়িতে কাজ করে। স্বামী পরিত্যক্তা বলে থাকার কোন স্থান নেই। দিন রাত এখানেই থেকে ভালো ভাবে মেয়ের দেখাশোনা করতে পারবে এই ভেবেই বাবা তাকে বাড়িতে এনেছিল। শ্রাবণী বুঝতে পারে আজ তার ঘুম হয়নি। করিমের মা সে সংবাদ তার বাবাকে দিয়েছে। তার বাবা প্রতিদিন এ ভাবেই মেয়ের খোঁজ নেন। শুধু তার জন্যই করিমের মাকে রেখেছে। তার পছন্দ মতো রান্না করা কাপড় ধোয়া ঘর মোছা সহ সব কাজ এখনো আগের মতোই করে যাচ্ছে। বাড়ির অন্য কোন কাজ বাবা তাকে দিয়ে করান না। দিন রাত যে বাবা আমার খোঁজ খবর নেন যে বাবা আমাকে মায়ের অভাব বুঝতে দেন নি। এমন বাবা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি হতে পারে না। আমার বাবাই পৃথিবীর শ্রেষ্ট বাবা। এই বাবাকে আমি ভুল বুঝেছি। বাবা তুমি আমাকে ক্ষমা করো না, বাবা তুমি আমাকে শাস্তি দাও। কাঁদতে কাঁদতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালে করিমের মার ডাকে ঘুম ভাঙ্গে। আজ লজ্জা আর নিজের প্রতি ঘৃণায় নাস্তা না খেয়ে বের হয়। আর বাড়িতে ফিরতে চায় না। মনে মনে সিন্ধান্ত নেয় পলাশের কাছেই চলে যাবে আর কোন দিন বাড়িতে ফিরবে না। এই মুখ আর তার বাবাকে দেখাবে না। সরাসরি পলাশের হাত ধরে বলে, তুমি আজ থেকে আমাকে তোমার কাছে রাখার ব্যবস্থা করো। আমার বাকী জীবন তোমার কাছেই থাকতে চাই। তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিও না। পলাশ তার মনোভাব বুঝতে পারে না। বড় লোকের মেয়ের খেয়াল বলেই ধরে নেয়। তাই তার বাস্তবতা দেখাতে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। দোচালা একটি ঘরে একজন বৃদ্ধ শুয়ে আছে পলাশ তার শরীরে, মাথায় পায়ে হাত বুলায়। এখন কেমন লাগছে জানতে চায়। আরো জানতে চায় তার কি খেতে মন চায়। শ্রাবণী দারজায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখে। কোন কথা বলে না। একটি কুঁড়ে ঘরে শত অভাবের মধ্যেও পিতা সন্তানের এত ভালবাসা, এত মধুর সম্পর্ক। অথচ আমার বাবা আমাকে ডাকলেও তার কাছে যাই না। তার সাথে কথা বলি না। তার কোন কিছুই আমি খেয়াল করি না। এই ছেলেটি টিউশনী করে তার বৃদ্ধ বাবার ঔষদ পত্র সহ সংসার চালায়। তারা অনেক সুখি।
ঘর থেকে বের হয়ে পলাশ শ্রাবনীকে বলে ইনিই আমার বাবা। পনের বৎসর যাবত প্যারালাইডস। বাবা হচ্ছে আমার প্রথম দায়িত্ব। আমার এমন একজন সঙ্গিনী দরকার যে আমার বাবাকে দেখে রাখতে পারবে তার সেবা করতে পারবে। তুমি কি এটা মেনে নিতে পারবে। পারবে কি আমার বাবাকে দেখে রাখতে। শ্রাবণী মাথা নীচু করে এক পা দু’ পা করে হাটতে থাকে, কোন কথা বলে না। মনে মনে শুধু বলে আমাকে অনেক প্রায়শ্চিত্ব করতে হবে।
২২ জানুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৪৩ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪