ঝমঝম ঝকঝক কান ধরে যাওয়ার অবস্থা কারো কথা কেউ খুব একটা বুঝতে পারছি না, আব্দুর রহিম বলে 'মুড়ির টিন' চলেতো চলেনা। এদিকে সবাই গাড়ীর প্রতি মহা বিরক্ত, মন চলে গেছে চট্টগ্রাম তাই ততটা বিরক্ত প্রকাশ পাচ্ছেনা। লোক সংখ্যা দ্বিগুণ আমরা চার জন কেবিনের বাহিরে চাদর বিছিয়ে বসে কথা বলছি, একটু পর পর গার্ড এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে এসে বলছে আপনারা আস্তে কথা বলেন কেবিনের লোকজন ঘুমাতে পারছে না সকাল হলেই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে। সুমন ভাই বলল সকালে অভিযোগ করবে এখনো করে নাই আচ্ছা তখন আমার কথা বল। গার্ড বলে আপনাকে পাবে কোথায় আমি চাকরি করি সমস্যা হবে আমার। আবারও একটু পড়ে এসে একই বক বক শুরু করল সুমন ভাই বলে, তোমার চাকরি চলে গেলে আমার কাছে এস আমি বুঝব তুমি একটু আগে যার সাথে কথা বলেছ সে আমার বড় ভাই এই দেখ তার নাম্বার, যে তোমার চাকরি খাবে তার চাকরিই থাকবেনা। এর মাঝখানে আমারা যে কেবিনের পাশে বসে আছি সে কেবিনের দু' তিন জন লোক ঘুম ঘুম চোখে এসে ঘুরে গেল তারাতো কিছুই বলল না এখানে কথা বললে আপনার কি সমস্যা ? আমার এ কথার দিকে গার্ডের কোন খেয়াল নেই, তার অন্তর জ্বলছে নাপাওয়ার ব্যর্থতায়। প্রতিবাদের মুখে নাম্বার নিয়ে চলে গেল। লোক সংখ্যা বেশী তাই টাকা চেয়ে না পেয়ে তার মাথা গরম আগে একবার এক ষ্টেশনে নেমেছিলাম পানির জন্য সেখানেও দেখিয়ে ছিল চোর ডাকাতের ভয় তার উপর চলছে রেলওয়ে নিরাপত্তা সপ্তাহ সৎ যুক্তি, কিন্তু তার পকেট যে আজ ফাকা তাই মাথা গরম হওয়ারই কথা। ঝকঝক খটখট শব্দের মধ্যে গাড়ীর গতিতে চলছে আমাদের আলাপ আর হেলে দুলে চলছে গাড়ী ।
চট্টগ্রামের বন্ধুদের আমন্ত্রণে যাচ্ছি চট্টগ্রাম। কমলাপুর থেকে উঠেছিল বিষন্ন সুমন, আব্দুর রহিম স্ব-স্ব পরিবার, সুমন্নাহার সুমি তার ছোট ভাই, এবং এয়ার পোর্ট থেকে মোস্তাফিজুর রহমান, রওশন জাহান এবং আমি দ্বিতীয় গ্রুপে। সারা রাত বসে গল্পে গল্পেই কাটালাম ভোরে ভাবলাম এসে পড়েছি একজন বলল না মাত্র কুমিল্লা, কুমিল্লা ? এবার আমাদের মাথা গরম হল সারা রাতে আসলাম কুমিল্লা চট্টগ্রাম যাব কি বিকালে? গাড়ী চলছে ঝকঝক ঝমঝম কোন ষ্টেশন আর বাদ যায় না সব যাত্রী এই গাড়ীকেই নিতে হবে। পাহাড়তলী আউটার ষ্টেশনে গাড়ী থামল অনেক ক্ষণ পর একটি গাড়ী ৭০ হাজার একর জমি কাপিয়ে চলে এলো ঢাকার দিকে এ রকম সারা রাত শুধু সাইট দিতে দিতেই এ পর্যন্ত এলাম মনে হয় এই গাড়ীটির জন্ম হয়েছে সব গাড়ীকে সাইড দেওয়ার জন্যই। সুমি ম্যাডাম নাকি চট্টগ্রামের ভাষা জানেন যা জানেন তা দিয়েই শুরু করলেন গাড়ীর দু'পাশে হেটে যাওয়া পথ চারিদের সাথে, বাচ্চারা হেসে হেসে কথা বলছে এক চাচা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে বললাম চাচা ম্যাডামের বাড়ি চট্টগ্রাম টাউনে। অনেক ক্ষণ পর শুনলাম গাড়ীর ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে গেছে, কেবিন থেকে এক ভদ্রলোক এসে বলছে কি হল এত ক্ষণ দেরী করছে কেন? স্থানীয় দু'জন মহিলা যাত্রী ছিল গেটে দাঁড়ানো তাদের টিকেট লাগে না, এক ষ্টেশন থেকে উঠে আরেক ষ্টেশনে চুপ করে নেমে যায়। তারা বলাবলি করছিল পাহাড়তলীতে একটি ইঞ্জিন আছে এটি লাগালেই হয়ে যাবে বেশী ক্ষণ লাগবে না। আমার যে আর দেরী সইছে না মন গত কালকেই পৌঁছে গেছে সার্কিট হাউসে বন্ধুদের কাছে আর দেহটা পাহাড়তলী ষ্টেশনের বাইরে দাঁড়ানো গাড়ীর দরজার রড ধরে ঝুলছে। দীর্ঘ ক্ষণ পর এক ধাক্কা খেয়ে এত বড় গাড়ীটা যেন কয়েক ফুট পিছনে সরে গেল তার পর আস্তে আস্তে আরো দু''তিনটি ধাক্কা ভাবলাম ইঞ্জিন বুঝি এলো। তার পর আবার ঝমঝম ঝকঝক।
এক গ্রুপ আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত আমরাও সেখানে শরিক হলাম। ভোর রাতে জোড়ে সোরেই বৃষ্টি শুরু হয়ে ছিল তা এখনো গুড়ি গুড়ি চলছে। সার্কিট হাউসে গিয়েই শুনে ছিলাম নীরব আর আযহা সুলতান ভাইয়ের সম্বন্ধে, ১ম গ্রুপ আহমাদ মুকুল ভাই, সাইফুল ইসলাম, রনীল, ইফতেখারুল ইসলাম, পন্ডিত মাহী কে বরণ করে নেয়ার অসাধারণ কথা, শুনে মন ভরে গিয়ে ছিল আজ তা স্বচক্ষে দেখলাম। আযহা সুলতান ভাইয়ের সাথে এসেছে তার ছোট্ট মেয়ে শিরোপা। সবার সাথেই সাক্ষাত হল মহা আনন্দের জোয়ার বইছে ফুলের বাগানে পরিবেষ্টিত সুন্দর পরিপাটি সার্কিট হাউসে । সার্কিট হাউস থেকে দেখা যায় এম এ আজিজ স্টেডিয়াম এর ফ্লাশ লাইট গুলো, ডান পাশেই আছে পুরনো সার্কিট হাউস যেখানে শহীদ হয়ে ছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।
দুপুরে চট্টগ্রাম রেল ষ্টেশনে বসল কবি মেলা। ইতিমধ্যে তৃতীয় গ্রুপে আক্তারুজ্জামান ভাই এবং তার বন্ধু, চতুর্থ গ্রুপে চাঁদপুর থেকে স্ব-পরিবারে মোঃ মিজানুর রহমান রানা ভাই এসে যোগ দিয়েছেন। মজার ব্যাপার হল আমার আর আক্তারুজ্জামান ভাইয়ের দূরত্ব হল মাত্র তিন মাইল অথচ গল্পকবিতা.কম এর মাধ্যমে আমাদের পরিচয় হল চট্টগ্রাম বন্ধুমেলায়, প্রায় তিন'শ কিঃমিঃ দূরে। স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আসল চট্টগ্রামের জয়েল দেব, সাজিদ খান, মহসিন, মোরশেদুল কবির, শরীফ, জনী চৌধুরী সহ সকল স্থানীয় বন্ধুরা। এইতো তারা যাদের সাথে কাটিয়েছি কয়েকটি মাস অথচ এটিই তাদের সাথে প্রথম সাক্ষাত। অন্তরঙ্গ মুহূর্ত অভূতপূর্ব দৃশ্য, ঠিক এ ভাবে এত দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসা এমন সার্থক আয়োজন বাংলাদেশে হয়তো এটি প্রথম ঘটনা। আমি মুগ্ধ হয়েছি স্মরণীয় হয়ে থাকবে আমৃত্যু। পরিচয় পর্ব ছিল খুব মজার, সবাই সবার নাম জানে কিন্তু কেউ কেউ নাম এর সাথে চেহারার মিল খুঁজে পাচ্ছিল না সে কি হাসাহাসি, অনেক হাসি আনন্দে পরিচয় পর্ব সম্পন্ন হল। রস, রঙ্গ, আলোচনা, বই উপহার প্রদান হল। সেখানেও পথ শিশুদের দৌড়া দৌড়ি। আযহা সুলতান ভাই কর্তিক প্রদত্ত তার লেখা বইয়ের সাথে পেয়ে ছিলাম একটি লাল গোলাপ শিশুরা বার বার ফুলটি চেয়ে মহা বিরক্ত করছিল কিন্তু ফুলটি যে আমার প্রিয় বন্ধুর উপহার সে যে মহা মূল্যবান তা দেই কি করে অগত্যা দশ টাকা দিয়ে বিদাই করে ফুলটি রেখে দিলাম সযত্নে পরম আনন্দে। আসল খাবার প্যাকেট, চলছে রস আলাপ মেলা শুরু থেকেই শুরু হয়েছে ফটো সেশন এখনো চলছে তা যেন থামতেই চায় না। রনীল আর পন্ডিত মাহীর আপ্পায়নে সবাই মুগ্ধ। ঢাকা সহ অনেক জেলার অনেক বন্ধুরা এই অনুষ্ঠানে আসতে পারেনি তারা এবং বাংলাদেশের বাহিরে অবস্থানরত বন্ধুরাও শরিক হয়েছে নেটে। খোঁজ খবর নিচ্ছে সব সময়, যেন আমরা সবাই আজ চট্টগ্রাম বন্ধু মেলায় একি সুরে একি সূত্রে গাঁথা। আমি মুগ্ধ হয়েছি স্মরণীয় হয়ে থাকবে আমৃত্যু।
ঐদিকে গাড়ী রেডি পতেঙ্গা পতেঙ্গা রব উঠেছে, পতেঙ্গা সৈকতের আনন্দের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে হৃদয়ে। সবাই সিটে বসে মনের সুখে চারপাশ দেখছে, সাইফুল আর আমি উঠলাম খোলা জীপে এ যেন পর্যটকদের খোলা জীপ। ছুটল গাড়ী, চট্টগ্রামে প্রথম হিসাবে এটা কি ওটা কি কোন দিকে যাচ্ছি কতক্ষণ লাগবে বিভিন্ন প্রশ্ন করছিলাম সাইফুলকে। হাতে আছে উপহার দুটি বইয়ের প্যাকেট একটি লাল গোলাপ আর খাদ্যের প্যাকেট। চমৎকার সুন্দর লাগছে চারপাশ দুচোখ মেলে দেখছি, রাস্তায় যথা রীতি গাড়ী চলছে। বিশ্বকাপ ক্রিকেট চট্টগ্রাম ভ্যানু সেই সুবাদে কংক্রিটের তৈরি সুন্দর বনের বিশ্ব খ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার যেন ছুটছে আমাদের সাথে, কিছুক্ষণ দৌড়ে গাড়ীর গতির কাছে হার মেনে পিছনে পরে রইল আর আমরা ছুটে চললাম সামনে সৈকত পানে। একটু পরেই দৌড়ে ছুটে এলো রাস্তার দুপাশে ঝাউ বীথি আমাদেরকে বরণ করে নিল, কিন্তু আমরা তাদেরকে পিছনে ফেলে ছুটে চললাম আরো সামনে, একটু পরেই ডান দিকে মোড় নিয়েই পৌছেঁ গেলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত সমুদ্র সৈকতে। গাড়ী পার্ক করে দু কদম হেটেই চোখ জুড়িয়ে গেল, এখন জোয়ারের সময় তাই প্রচন্ড রকম ঢেউ আছড়ে পড়ছে কংক্রিটে দাড়ানো আমাদের উপর, প্রতিটি ঢেউয়ের নরম কোমল জিহ্বা আমাদের ছুঁয়ে দিয়ে হাস্য মুখে স্ববেগে চলে যাচ্ছে পিছনে সারা বিশ্বকে সংবাদ জানাতে ''বিভিন্ন বয়সী এক ঝাক সমমনা প্রাণ উৎফুল্ল কবি বন্ধু দেখে এসেছি বাংলাদেশের পতেঙ্গা সৈকতে'' এ যেন কম্পিউটার যুগে পানি বাহী সংবাদ।
খাওয়ার পর্ব এখানেই সারতে হবে কংক্রিটে আছড়ে পড়া বড় বড় ঢেউয়ের মাঝে সে কি আনন্দ ঢেউ এলে সবাই খাবার প্যাকেট হাতে নিয়ে উঠে দাড়িয়ে যাচ্ছে ঢেউকে স্বাগত জানাতে, ঢেউ চলে গেলে আবার সবাই বসে পরছে এভাবেই খাওয়ার পর্ব চলছে, চলছে ফটো সেশন। পথ শিশুদের দেন স্যার দেন ভাই শুনে শুনে বিরক্তও হচ্ছিলাম তখন মনে পড়ল গল্পকবিতা .কম এর বর্তমান সংখ্যা 'ক্ষুধা' নিয়ে কিছু ক্ষুধার্ত মানুষের টাকার ক্ষুধা আর পথ শিশুদের পেটের ক্ষুধার যন্ত্রণা নিয়ে লেখা গল্পকবিতার কথা, আহা কি কাতরানো সুর খুব কষ্ট হচ্ছিল তাদের দেখে বন্ধুরা তাদের নিরাশ করেনি। আকাশের যেন দয়া হল বৃষ্টি বন্ধ রইল এভাবেই শেষ হল খাওয়া পর্ব। কেউ কেউ কেনাকাটা করল, সমুদ্র আর দূরের শিপ দেখে এবার ফিরার পালা, আহমাদ মুকুল ভাই বললেন তোমরা যে যে গাড়ীতে এসেছ ঠিক সেই সেই ভাবে গিয়ে বস এখন যাব মেরিন ড্রাইভে। গিয়ে বসেও পরলাম কিন্তু অন্য একটি মাইক্রো বাঁধ সাধল, সে বৃষ্টির জলে কাঁদায় আটকে গেছে কিছুতেই উঠতে চাইছে না। অনেক ক্ষণ ধাক্কা ধাক্কি চলছে গাড়ীর যেন রাগ থামছে না তার পর আবার শুরু হল ফোটা ফোটা বৃষ্টি, আহমাদ মুকুল আযহা সুলতান নীরব ভাই সহ অনেকেই ভিজে একাকার, অবশেষে বন্ধুদের একাত্মতার কাছে হারমেনে গাড়ীটি উঠে এলো, কিন্তু ততক্ষণে সন্ধ্যা আর যাওয়া হলনা মেরিন ড্রাইভে তাই রুমে ফিরতে হল।
রাত সাড়ে দশটায় ফিরতি ট্রেন কিন্তু মন ফিরতে চাইছে না। একটি দিন যেন কয়েক সেকেন্ডে কেটে গেলো কিছু বুঝার আগেই সবাইকে বিদাই জানাতে হল। ট্রেনে উঠেও শান্তি পাচ্ছিলাম না মন শুধু বলছে আর একটি দিন যদি বন্ধুদের সাথে এভাবে কাটাতে পারতাম। কিন্তু এই একটি দিনে বন্ধুদের নিকট থেকে যে ভালবাসা পেয়েছি এই অনুষ্ঠানে যে সুখ পেয়েছি তার রেশ এখনো বইছে মনে। পৃথিবীর সমস্ত ভাল লাগার সুখ মনেহয় ঠিক এভাবেই হাতছানি দিয়ে পিছনে ডাকে আর জীবনের সম্মুখ কঠিন পথ চলতে সহজ ও সুখময় করে তোলে।
বয়সের ভারে নুয়ে পড়েনি কেউ বাইশ বছরের তাগড়া যুবকের মতই ছুটে এসে ছিল অনেক দূরদূরান্ত থেকে। অসাধারণ তাদের চিন্তা চেতনা ভালবাসা। ফুটন্ত গোলাপের মত হাসি সব সময় লেগেছিল তাদের ঠোঁটে, দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়। অনেক বন্ধুরা এই অনুষ্ঠানে আসতে পারেনি তারা এবং বাংলাদেশের বাহিরে অবস্থানরত বন্ধুরাও আমাদের সাথে শরিক হয়েছিল নেটে, এই একটি দিনের প্রতিটি সুখ আমরা সব বন্ধুরা ভাগাভাগী করে নিয়েছি। এই হাসি মাখা আনন্দঘণ পরিবেশ জীবনের শেষ দিন অবধী আমাদের কারো ভুলার নয়।
আজ থেকে বহুদিন পরেও জীবনের কোন এক সময় কোন বন্ধুর সৃতির পাতায় ভেসে উঠবে এই স্থান, এই আনন্দময় পরিবেশ, অনুষ্ঠান এই বন্ধুদের নাম। হয়তো কেউ কেউ হবে বাংলাদেশের প্রধান লেখক/কবি, হয়তো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে কারো নাম। সৃতি হয়ে থাকবে আজকের তোলা ছবি গুলো, তখন হয়তো আমরা থাকব না আর এই পৃথিবীতে, তখনো থাকবে বন্ধুত্ব।
এত ভালো মনের অধিকারী, এমন ভালো ভালো লেখকদেরকে বন্ধু হিসেবে পেয়েছি, আমার এই বন্ধুদেরকে নিয়ে আমি গর্বিত।