ছবিয়ালা

সবুজ (জুলাই ২০১২)

মোঃ আক্তারুজ্জামান
  • ৪৩
  • ৩০
চাচা, ক্যামুন আছ?- আমার পাশের চেয়ারটায় বসেই ইস্রাফিল তার হাটু দোলাতে থাকে। আমার ইদানীং ওকে একেবারে অসহ্য লাগে। মনে মনে নিজেকেই গালাগাল করি। কেন যে আমি এই সব বাচ্চা ছেলেপেলেগুলোকে আস্কারা দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছিলাম! ওর এই হাটু দোলানোটা পেন্ডুলাম ঘড়ি হয়ে আমার হৃদপিন্ডে অস্বস্তির ঘন্টা বাঁজায়।

ম্যালা দিনতো চাচা ডাকলিরে! অহন আর ভাল্লাগে না!- আমিও মোটেও ছাড়ার পাত্র নয় একেবারে উল্টা নখে ইস্রাফিলের গতর চুলকে দেই। ইস্রাফিল ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার খুব ভাল লাগে। আমি আগুনটাকে আরও উস্কে দিতে চাই।

-অহন কিছুদিন আববা কইয়া ডাক। দেহি, ক্যামুন লাগে! মজা টজা পাই কিনা!- আমি আবার বলি।

ইস্রাফিল কিছুক্ষণ বজ্রাহতের মত চুপ করে ওর ট্যারা চোখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপরই আবার দ্বিগুণ গতিতে হাটু দোলাতে থাকে। ওর মুখেও কেমন একটা খুশির ঝিলিক ফুটে উঠে। আমি ওর মতলবটা বুঝতে না পেরে ভিতরে ভিতরে ভয় পেয়ে যাই।

- হ তোমারে যে বদলাইয়া যাওয়ার নেশায় পাইছে হেইডা কিন্তু টের পাইছি, চাচা! এইডা ওইডা বদলাইতে বদলাইতে একদিন চাচীরেও যে বদলাইবা তা কিন্তু আমি ভালই বুঝতাছি! ইস্রাফিলের বত্রিশ পাটি বের করা হাসি আমার চোখের সামনে একশ ওয়াটের বাতির মত জ্বলে উঠে।

হালার পোলায় কত্ত বড় খবিশ!- আমি মনে মনে ইস্রাফিলকে গালাগাল করতে থাকি। ও এমন একটা মোক্ষম প্রতিশোধ নিবে আমি কল্পনাও করতে পারিনি।

দিন কয়েক ধরেই খেয়াল করেছি মৌ আমার ষ্টুডিওতে ঢুকলেই ও ষ্টুডিওর সামনে দিয়ে এপাশ ওপাশ হেটে যায়। গুন গুন করে গান গাওয়ার ভান করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু আমি বেশ বুঝতে পারি ও আমার আর মৌয়ের কথা শোনার চেষ্টা করে। তক্কে তক্কে থেকে ও যে আমাদের দুজনকে চোখে চোখে রাখে তা না বোঝার মত কঁচি খোকা তো আমি নই।

চাচা, হুন তোমার বয়স অইছে। কতাডা ভুইলা গেলে চলবো না। পোলা মাইয়া ডাঙ্গর অইছে। এই বয়সে তোমারে এগুলি মানায় না!- আমার নীরবতার সুযোগ নিয়ে ইস্রাফিল আমাকে উপদেশ শোনায়। রাগে আমার শরীর জ্বলে যায়। ওর দিকে কটমট করে তাকাই। মনে মনে নিজের চুল নিজে টেনে ছিঁড়তে থাকি। আফসোস করি কী ভূলটাই না করেছি ওকে প্রশ্রয় দিয়ে, গরীব মানুষ কিছু করে খাবে বলে নিজের ষ্টুডিওর এক পাশে বসতে দিয়ে। ফল বেচে বেচে ও এখন আমার উপরই মাতাববরি ফলাতে শুরু করেছে!

চাচা তুমি পিরোজপুরের মাইয়াগুলিরে তো চিন না। ওরা এক একটা বজ্জাতের হাড্ডি! ওদের চরিত্র বলতে কিচ্ছু নাই, ডাহা শহরে যত বাজে মাগী মানুষ দেখবা এগুলান সব পিরোজপুরের!- ইস্রাফিলের গলার আওয়াজ ক্রমেই চড়তে চড়তে যেন কামারের দোকানের হাতুড়ির মত আমার কানের পর্দা ভেদ করতে চায়। আমার চোখের সামনে মৌয়ের চেহারাটা ভেসে উঠে।

ঐ ব্যাডা উড, আগে উইডা খাড়- ইস্! আবার চেয়ারে বইসা রইছে। হালার পোলা, মমিসিংগা দেড় ব্যাটারী! লাত্তি মাইরা তোর কোমরের কডি আলগা কইরা ফালামু! বাকী জিন্দেগী দোকানদারি করা তো দূরের কথা টয়লেটেও যাইতে পারবি না- আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারি না। একেবারে পাগলা কুকুরের মত খেঁকিয়ে উঠি। ইস্রাফিল মুখ কাঁচুমাচু করে উঠে দাঁড়ায়।

ঐ ব্যাডা, পিরোজপুরের মাইয়ারা খারাপ, না? আর যত ভালার গোডাউন পইড়া রইছে সব মমিসিং! হালার পুত তোর ভাগ্নিডা দুধের বাচ্চা ধুইয়া ভ্যানগাড়ী ওলার লগে যহন ভাইগা গেল তহন কেউ কি তরে কইছিল মমিসিংগা মাইয়াগুলান সব খারাপ?- ইস্রাফিল আর দেরী করে না। মাথা নীচু করে আমার সামনে থেকে চলে যায়। ওকে উচিৎ শিক্ষা দিতে পেরে আমার বেশ ভাল লাগে।

মাস কয়েক হয়েছে মৌয়ের সাথে আমার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ও একদিন আমার ষ্টুডিওতে এল। উনিশ, কুড়ি বছর বয়সের মৌ দেখতে একটু কালো হলেও শরীরের গড়ন নজরকাড়া। বাধ ভাঙ্গা যৌবন যেন ওর শরীরের ভাজে ভাজে ঢেউ খেলে। ড্রেসিং টেবিলটার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সামান্য গুছিয়ে নিয়ে, নীল পর্দার সামনের টুলটায় বসতে বসতে সেদিন ও আমাকে ডেকেছিল- আসেন। ছবি কিন্তু সুন্দর হওন লাগব! দরকার পড়লে আপনি আমারে ঠিকঠাক কইরা লইয়েন।

আমার ষ্টুডিওর প্রায় সব কাষ্টমারই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীর শ্রমিক শ্রেণীর মানুষ। রূপ সচেতনতা, স্মার্টনেস বলতে এদের বেশীর ভাগেরই কোন ধারণা নেই। বরং এমনিতে যেই লোকটা স্বাভাবিক আচরণ করে ক্যামেরার সামনে বসলেই দেখা যায় তার কাহিল অবস্থা! অপ্রস্ত্তত, অস্বাভাবিক চোখে বাকা ট্যারা হয়ে বসে থাকে। ফলাফলে ছবিটা যতটুকু সুন্দর হওয়ার কথা ঠিক ততটুকু সুন্দর হয় না।

একবার এক পাতি নেতা টাইপের ছেলে এসে আমাকে আগেই সাবধান করল ছবি ভাল না হলে সে একটা টাকাও দিবে না। ছেলেটার চেহারা সুরত দেখে আমি ওকে আশ্বস্ত করলাম- ছবি ভাল হবে। কিন্তু ছবি তুলতে গিয়ে চরম বিপদ টের পেলাম। ছেলেটার কোমড়, মেরুদন্ড, ঘাড় যেন একে অপরের ঘোর শত্রু! যার দরুন ও সোজা হয়ে বসতেই পারে না। আমার ধৈর্য্য শক্তিটা বরাবরই কম এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বলেই বসলাম- অই ব্যাডা, টয়লেটের পুরান প্লাষ্টিকের বদনার মত না, কাঁচের জগের মত সোজা অইয়া ব!

আমার ছবি কোনদিনই ভাল হয় না- বলে ছেলেটা মুখ কাঁচুমাচু করে ওর বান্দরবানের নকশার মত ছবিগুলি নিয়ে গেল। অবশ্য আমার একটা টাকাও সে কম দিল না।

মেয়েগুলি নিয়ে তো আরও বিপদ! বেশির ভাগই লজ্জায় যেন কুঁকড়ে থাকে। ছেলেগুলিকে যাও ধাক্কা গুঁতা দিয়ে একটু সোজা করার চেষ্টা করা যায়। মেয়েদের বেলায় স্বাভাবিক ভাবেই তা অসম্ভব। সোজা বসেন, মুখটা একটু উচু করেন, হাসি মুখে থাকেন- এই জাতীয় কথা বলে দুরে দাঁড়িয়ে ইশারা ইঙ্গিতে কষ্টে সৃষ্টেই মেয়েদের ছবি তুলতে হয়।

আপনি আমারে ঠিকঠাক কইরা লইয়েন- মৌয়ের কথাটা আমার কাছে একেবারে অভূতপূর্ব, অপ্রত্যাশিত, অকল্পনীয়ই ছিল। যা আমার সাথে আগে কোনদিনই হয়নি বা ঘটেনি। ওর এই আহবান আমার মনের কোন্ দরজায় গিয়ে জানি টোকা দিয়ে বসল। আমি কাঁপা হাতে ওকে ‘ঠিকঠাক’ করে প্রয়োজনের চেয়ে বেশী সময় নিয়ে বেশ কয়েকটা ছবি তুললাম।


ছবিগুলি ওকে দিয়ে দিলাম কিন্তু কোন দাম নিলাম না। দুরু দুরু বুকে আরও একটা কাজ করলাম। আমার মোবাইল নাম্বারটা একটা কাগজে লিখে ওর হাতে গুঁজে দিয়ে কোন মতে বললাম- আবার এস। আর কোন প্রয়োজন পড়লে ফোন দিও!

বেশ কয়েকদিন মৌয়ের আর দেখা পেলাম না। আমি মনে মনে ধরেই নিলাম ও আর হয়ত কোন দিন আসবে না। কিন্তু আমি জানি কেন ওকে ভূলতেও পারলাম না। দিনে দু একবার ওর সুশ্রী মুখটা আমার মনে পড়তে লাগল। আমার ধারণা অমূলক প্রমাণ করে ও একদিন হাসি মুখে এসে হাজির হল। খুশিতে আমার মনটাও ভরে গেল। আমি জিজ্ঞ্যেস করলাম- ছবি তুলবে বুঝি?

-না! মৌ লাজুক মুখে বলল।

ওকে আমার কেমন জানি অস্থির, চঞ্চল মনে হল- আমাকে যেন কিছু একটা বলতে চাইছে কিন্তু বলতে পারছে না। আমার অনেক পীড়াপীড়ির পর ও মাথা নীচু করে বলল- আমার পাঁচশ ট্যাকার খুব দরকার!

আমি পকেট থেকে সাথে সাথে পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করে ওর হাতে দিলাম। বেশ ডাট নিয়ে বললাম- আরে এইডা কোন ব্যাপার অইলনি। তুমি ফোন দিয়াও তো আমারে জানাইতে পারতা। নাকি আমার ফোন নাম্বারটা তুমি ফালাইয়া দিছ?

ইস্! মাইনষেরে আপনি এত্ত যা-তা ভাইবেন না ত!- অভিমানীর মত গাল ফুলিয়ে কথাগুলি বলেই মৌ ওর মোবাইলের কন্টাক্ট লিষ্টটা ওপেন করে সেটটা আমার হাতে গুঁজে দিল। আমি বোতাম টিপে টিপে মোবাইলের সেভ করা নামগুলি পড়তে লাগলাম। কিন্তু আমার বা আমার ষ্টুডিওর নামটা কোথাও খুঁজে পেলাম না।

এমুন কানা মানুষত আমি জীবনেও দেহি নাই- বলেই মৌ ওর সেটটা আমার হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। মুহুর্তেই একটা সেভ করে রাখা নাম্বার আমার চোখের সামনে তুলে ধরল। আমি নিজের নাম্বারটা দেখে সহজেই চিনতে পারলাম। নাম্বারের ওপরে ছোট্ট একটা নাম দেখে আমি খুব রোমাঞ্চিত হয়ে পড়লাম- জান!

আমিও ওকে চমকে দেয়ার মত একটা কাজ করে রেখেছিলাম। প্রথম দিন যখন ওর ছবি তুলেছিলাম সেই ছবি থেকে ওর মুখটুকু কপি করে নিয়ে হিন্দি ছবির নায়িকা রানী মুখার্জীর মুখের উপর লাগিয়ে একটা চার বাই ছয় ইঞ্চি মাপের ছবি বানিয়ে রেখেছিলাম। সুসজ্জিত বাসর ঘরের খাটের ওপর ও নতুন বৌয়ের সাজে বসে আছে। ফটোশপ প্রোগ্রামের ফেদার, কনট্রাষ্ট, কালার ব্যালেন্স ইত্যাদি সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা থাকলেই এসব কাজ যে কেউই করতে পারে।


ছবিটা ও হাতে নিয়ে খুশীতে ডগমগিয়ে উঠল। তারপরই আবার লজ্জায় লাল হয়ে আমার মুখের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বলল- ছি: মানুষটা এত্ত খারাপ আমিত আগে জানতাম না!

এইডা আবার কী কইলা?- আমি বেশ অবাক এবং ঘাবড়ে গিয়ে ওর মুখের দিকে তাকালাম।

-আপনে এত বেশরম! আমার কাপড়গুলি খুইলা এই নতুন কাপড়গুলি পড়াইতে আপনার একটুও শরম লাগল না!

আমি ওর নির্বুদ্ধিতায় অবাক হলাম। ও যা ভেবেছে তা আসলে মোটেও সত্য না। পৃথিবীর এমন কোন প্রযুক্তিই নাই যা দিয়ে একটা ছবিতে থাকা কোন মানুষের কাপড়চোপড় খোলা যায়। যাইহোক আমি ওর বোকামী দেখে অবাক হওয়ার চেয়ে বেশি আনন্দিতই হলাম। একটা সুড়সুড়ি আমার কামনা বাসনাকে চরম ভাবে উস্কে দিল। এক লহমায় আমি অনেক কিছুই কল্পনা করে ফেললাম।

মৌ খুব খুশি হয়ে অনেকক্ষণ ধরে ছবিটা নেড়ে চেড়ে দেখতে থাকল আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম ওর খুব পছন্দ হয়েছে। আমার মোবাইল ফোনের সেটটা একরকম কেড়ে নিয়ে তাতে ওর মোবাইল ফোন নাম্বারটা তুলে দিয়ে বারবার বলল যখন মন চায় তখনই যেন ওকে ফোন দেই। যাওয়ার আগে আমার দুগালে চট করে দুটো চুমোও এঁকে দিয়ে গেল।

আমি সারাদিনই কিছুক্ষণ পর পর আমার গালে মৌয়ের চুমো খাওয়া জায়গায় হাত বুলিয়ে ওর ঠোটের উষ্ণতা অনুভব করে করে শিহরিত হতে থাকলাম। বয়সের সাথে মানুষের চিন্তা ভাবনাগুলিও রঙ বদলায়। বিবর্ণ হয়ে যাওয়া আমার মনের ভাবনাগুলি হঠাৎ করেই কঁচি ডগার মত লতিয়ে উঠতে লাগল।

রাতে আমার মৌয়ের সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছা করল। আমার পাশেই শুয়ে থাকা বৌয়ের জন্য ফোন করতে পারছিলাম না। নাক ডাকার অজুহাত দেখিয়ে বউকে গভীর ঘুম থেকে ঠেলে ঠুলে জাগিয়ে তুললাম।

কী অইছে? এ্যামুন ডাহাইতের লাহাইন করতাছেন ক্যান?- বউ চোখ কচলাতে কচলাতে অপ্রস্ত্ততভাবে আমার দিকে তাঁকিয়ে রইল।

বিলাইর গুষ্টি, নাক ডাকলেই মনে করছস সিংহ অইয়া যাবি, না? তোর লাইগা আমি সারা রাইত জাইগা থাকমু?- আমার মিথ্যাচারের মাথা মুন্ডু ঠাহর করতে না পেরে ও পাশের ঘরে আমার এক দঙ্গল ছেলে মেয়ের সাথে শুয়ে পড়ে।

বউকে তাড়াতে পেরে আমার খুব ভাল লাগে। রাত জাগা আমার ধাতে নেই। সেই আমি অনায়াসে প্রায় সারারাত জেগে মোবাইল ফোনে মৌয়ের সাথে রঙ তামাশার আলাপে মেতে থাকি।

জানেন? আমি না, সারা রাইত ঘুমাইতে পারি নাই!- আমাকে নাস্তা দিয়ে বউ আমার দিকে তাকিয়ে বলল। বেশ বেলা হয়ে গেছে দেরীতে জাগায় ষ্টুডিওটা খোলা হয়নি। ওর কথায় আমার মেজাজটা বেশ বিগড়ে যায়।

ঘুমাস নাই ক্যান? রাইত জাইগা কী আত্তি গোড়া মারছস্ যে ঘুমাইতে পারস নাই- আমি সকাল বেলাই খেঁকিয়ে উঠি।

- আপনি ত আমারে নাক ডাকার কতা কইয়া ঘর থাইকা বাইর কইরা দিলেন। হারা রাইত একটা ভূত ঘরের কোন কোণায় বইসা বইসা জানি গোঙাইছে! ডরে আমি আপনেরেও ডাকতে পারি নাই। আইজকাই, মসজিদের হুজুরের কাছ থেইকা একটা বাড়ী বন্ধের কবচ আইনেন।

চুপ কর্! এই শহরে ভূত আইব কই থাইকা। পেঁচা টেছায় ডাকছে হয়ত!- আমি আসল ঘটনা আড়াল করতে বউকে ধমক দিয়ে ঠান্ডা করে ফেলি।

মনে মনে বেশ ঘাবড়ে যাই। আর একটু হলে তো ধরাই পড়ে গিয়েছিলাম! মনে মনে হায় হায় করে উঠি! এত গরমের মাঝে মোটা কাঁথার নীচে লেপ্টে থেকেও কোন লাভ হল না। আমার আর বুঝার বাকী রইল না যে কাঁথাটা ‘সাউন্ড লীক’ করেছে।

আমার ষ্টুডিওতে মৌয়ের আনাগোনা বেড়ে যায়। আমাদের দুজনের অন্তরঙ্গতাও বাতাসের মত হুঁ হুঁ করে বেড়ে যায়। মৌকে ছাড়া আমার আর কিছুই ভাল লাগে না। ওকে একদিন না দেখলে নিজেকে হাজার বছরের উপবাসী মনে হয়।

শুধু ইস্রাফিল না আমি বেশ বুঝতে পারি আশে পাশের অন্য দোকানদারেরাও ব্যাপারটা নিয়ে গুজুর গুজুর করে। আমাকে অন্য ভাবে দেখে। আমি কোন কিছু গায়ে মাখি না।

মৌয়ের পিছনে সময় দিয়ে, টাকা খরচ করে আমার ব্যবসাটাও আগের মত চাঙ্গা থাকে না। আমি খুব ভাবনায় পড়ে যাই। এ নিয়ে খুব ভাবি। অনেক অনেক ভাবনা চিন্তা করে আমি বুঝতে পারি মৌ আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। ওকে বাদ দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

একদিন আমার ষ্টুডিওতে ও আসার পর আমিই গুরুত্বের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলি। সব কিছু বুঝিয়ে বলার পর আমি ওকে বলি- আমাদের বিয়ে করে ফেলা উচিত!


প্রথমে রাজ্যের বিস্ময় মাখা বিস্ফারিত চোখে ও আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তারপর খুশিতে প্রায় নেচে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমোয় চুমোয় এক রকম ত্যক্ত উত্যক্ত করে তুলল।

কাউকে কিছু না জানিয়ে আমি মৌকে বিয়ে করার জন্য গোপনে প্রস্ত্ততি নিতে থাকলাম। বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে রীতিমত ধার দেনা করে আমি হাজার ত্রিশেক টাকা ওর হাতে তুলে দিয়ে বললাম- তোমার যা যা লাগে কিনে নিও। তবে বিয়ের শাড়ীটা তোমাকে কিনতে হবে না। ওটা আমি আমার পছন্দ মত তোমাকে কিনে দিব!

আমার কথায় মৌ খুব খুশি হল। আমরা দুজনে একটা তারিখও ঠিক করে ফেললাম। কোথায়, কখন, কীভাবে বিয়েটা হবে তারও একটা পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেললাম।

নির্ধারিত দিন আমি বেশ সকাল সকাল দোকান খুলে বসলাম। আমার মনের আকাশে নানা রঙের মেঘও উড়ে বেড়াচ্ছে। বসে বসে কী হবে কী না হবে তার একটা হিসেব নিকেশ করছিলাম। ঠিক তখনি ইস্রাফিল একটা চেয়ার টেনে চুপচাপ আমার পাশে এসে বসল।

অনেকদিন পর ও আবার আমার দোকানে এসেছে। আমি ওকে কিছু বললাম না। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে ও আমাকে বলল- চাচা, একটা খবন হুনছনি?

আমি কিছু না বলে ওর দিকে চোখ তুলে তাকালাম। ও ট্যারা চোখে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল- ঐ যে তোমার দোকানে মাইয়াডা আইয়ে না? ঐ মাইয়াডা নাকি কাইল রাইতে পলাইছে! অনেকের নাকি ম্যালা ট্যাকা পয়সা মাইরা ভাইগা গেছে! কই আছে কই গেছে কেউ কিছুই কইতে পারে না। নাম ঠিকানা সবই নাকি ভূয়া!

আমি ইস্রাফিলকে কিছু বললাম না। ও কিছুক্ষণ বসে থেকে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। তারপর গুনগুনিয়ে একটা গান গাইতে গাইতে বড় বিশ্রীভাবে ওর পাছাটা চুলকাতে চুলকাতে চলে গেল। অন্য সময় হলে আমি কি করতাম জানি না। কিন্তু তখন ভাল মন্দ কোন কিছুই আমার উপলব্দিতে আসছিল না। আমি আমার ষ্টুডিওর সাটার নামিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।







- বাঃ শাড়িডা ত অনেক সুন্দর! অনেক দাম নিছে না? হাছাই শাড়িডা আপনি আমার লাইগাই আনছেন? আমার বউ বাচ্চা কাচ্চা পরিবেষ্টিত হয়ে বসে মুগ্ধ ভাবে শাড়িটা দেখতে দেখতে আমাকে বলে।
-ফাজিল মাগী মানুষ তোর লাইগা না ত কি আমার আরও দুই চাইরডা নডীর লগে পীড়িত আছে ল যে আমি তাগোর লাইগা শাড়ী কিনছি! কথাগুলি আমার কন্ঠনালীতে হোঁচট খেয়ে সাবলীলতা হারিয়ে বের হয়ে আসে।

গালি বা তিরস্কার আমার বউকে একটুও স্পর্শ করতে পারে না। ওর যত্ন বিহীন খসখসে মুখেও মুগ্ধতার আলো ছড়িয়ে পড়ে। অনেক পুরান একটা ছবি আমার মনে পড়ে যায়। বিশ পঁচিশ বছর আগে তারও কমনীয় মোহনীয় গাল, মুখ, ঠোট, চোখ ছিল। ওসবে আমি মুগ্ধও ছিলাম।

শুধু বয়সের জন্য নয় আমার ভোগ উপভোগে, আমার সংসারের হাজারটা চিন্তায়, আমার সংসারের হাজারটা নির্যাতনে ওর শরীরটা আজ বিবর্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু আমার প্রতি ওর বিশ্বাস, ভক্তি, সম্মান, নির্ভরতা এখনও অটুট, অবিচল, নির্মল- সবুজ!

আমি একজন ছবিয়ালা হিসেবে হাজারটা ছবির ভিড়ে কিছু কিছু ছবির কথা ভূলে যেতেই পারি। কিন্তু একজন স্বামী হিসেবে হাজারটা নারীর ভিড়ে নিজের স্ত্রীকে ভূলে যাওয়াটা আমার খুব অন্যায়, বড় পাপ হয়েছে। নিজের উপর আমার খুব ঘৃণা হয়- সত্যি আমার নিজের চেহারাটা যতটা না কুৎসিত, তার চেয়ে মনটা আরও অনেক বেশি নোংরা, কদাকার!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ সাইফুল্লাহ ভাল একটা গল্প। মন ভরে গেল।
সিয়াম সোহানূর অনন্য গল্পকথন। ভাব, ভাষা ও গাঁথুনি প্রাঞ্জল। বিমোহিত হলাম।
তানি হক এক কথায় দারুন একটি গল্প পড়লাম ..ঠিকই আছে ছবি ওয়ালার ঠিক শাস্তি হয়েছে ..সবচেয়ে ভালো লাগলো শেষের উপলব্ধি ..যাইহোক পিরোজপুরের মেয়েদের সম্পর্কে মন্তব্য শুনে ব্যাটা ইস্রাফিলের উপর আমি কিন্তু মারাত্মক খেপেছি ..পিরোজপুরের মেয়ে হয়ে কথা গুলো আমার পক্ষে নিরবে সয়ে যাওয়া কঠিনই বলে ...হা হা ..ভাইয়াকে সুভেচ্ছা আর ধন্যবাদ জানাই...
আবু ওয়াফা মোঃ মুফতি বহুত বালা লাগল, বেবুজ নারীর সবুজ ভালবাসা|
সেলিনা ইসলাম অসাধারণ থিম এবং গল্পের উপাস্থাপন খুব ভাল লাগল ।শুভকামনা
মৌ রানী মনমুগ্ধকর গল্প। অসাধারণ।
নিলাঞ্জনা নীল !!!!!!!!!!!!!!!!!!!! কি আর বলব!!!
মিলন বনিক কিন্তু আমার প্রতি ওর বিশ্বাস, ভক্তি, সম্মান, নির্ভরতা এখনও অটুট, অবিচল, নির্মল- সবুজ! অসাধারণ বন্ধু...একজন জাত গল্পকারই এভাবে ভাবতে পারে আর কথামালাগুলোকে মানুষের কাছে ছবির মত তুলে ধরতে পারে...অনেক শুভ কামনা...
বশির আহমেদ আমি বেশ বুঝতে পারি আশেপাশের অন্য দোকানদারেরাও ব্যাপারটা নিয়ে গুজুর গুজুর করে । আমাকে অন্য ভাবে দেখে । আমি কোন কিছু গায়ে মাখি না । আক্তার ভাই ভাবী যদি গল্পটা পড়ে তাইলে কিন্তু খবর আছে ? গায়ে মাখায়ে ছাড়বে । সবুজের রূপটা যে এত বিচিত্র হয় আপনার গল্প পড়ার আগে আমার ধারনাই ছিল না । বৃহত্তর ঢাকার আঞ্চলিক ভাষার উত্তম ব্যবহারে গল্পটা আরও বেশী প্রানবন্ত হয়ে উঠেছে ।

২২ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪