নাজনীনের সাথে আমার বিয়েটা রাজকন্যার সাথে রাজ্য পাওয়ার মতোই একটা ঘটনা ছিলো! আমার মতো একজন নগণ্য ছেলের পক্ষে এরকমটা কীভাবে সম্ভব হলো এই ভাবনা আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের বিস্ময়ের মাত্রাকে চরমে পৌঁছে দিয়েছিল।
তারা এতটাই চমৎকৃত হয়ে পড়েছিলেন যে বিহবলতা কাটিয়ে রহস্যটা কী তা আর আমার কাছে জানতে চাওয়ার সাহসও দেখাননি। তবে রহস্যটা সবাই জেনে গিয়েছিলেন! একমুখ থেকে আরেক মুখে তা রটে গিয়েছিলো! ওই আমার সভ্যতার কাহিনী! আমি যে একজন সভ্যবভ্য মানুষ সেকথা! যা দিয়ে আমি অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলাম।
আমি যে সভ্যভব্য বলেই স্রষ্টা আমাকে পুরস্কৃত করেছেন এবং তা করারই ছিলো তা আমার বিয়ের দাওয়াতে আসা আমাদের চেয়ারম্যান সাহেব এমন উচছ¦সিতভাবে বলছিলেন যেন সবসময় পাশে থেকে উনি আমার প্রত্যেকটা পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করে তা আগে থেকেই নিশ্চিত ছিলেন!
আমার বড় তিনভাই, দু’বোন আছে। তাঁদের সবারই বিয়ে হয়ে গেছে। সবাই যার যার সংসার করছে। তাঁদের কারো বিয়েতেই আমার বাবা সাকূল্যে একশ’ জন মানুষকে আপ্যায়ন করতে পারেননি।
কিন্তু আমার বিয়েতে হাজার পাঁচেক মানুষকে উন্নত সব খাবারদাবার দিয়ে আপ্যায়ন করেছি। নাজনীনের বাবা মানে আমার শ্বশুর খুব নামকরা সফল ব্যবসায়ী! উনি আমাকে ডেকে নিয়ে আগেই বলে দিয়েছিলেন- তোমার সম্মানের সাথে আমার সম্মান জড়িত। কাজেই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় কোনভাবেই যেন কোন কিছুতে কোন ঘাটতি বা খুত না থাকে!
আমাদেরকে টাকার কথা ভাবতে হয়নি। তিনরাত আমার বিয়ের আলোকসজ্জায় গ্রামের একটা অংশ আলোকিত করে রেখেছি। গ্রামের অনেক অনেক মানুষ ভিড় করে বিয়েবাড়ির নানা আনুষ্ঠানিকতা দেখেছেন। একে অন্যের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস্ফিস্ করে কথা বলেছেন! তারা কী কথা বলেছেন তা আমি তাঁদের চোখমুখ দেখেই বুঝতে পেরেছি- ওই আমার সভ্যতার কাহিনী! আমি যে একজন সভ্যবভ্য মানুষ সেকথা!
ব্যাপারটা খুলেই বলছি! আমি তখন শহরে থেকে ইংরেজীতে মাষ্টার্স পড়ছি। আমাদের সংসারে খুব অভাবঅনটন। ভাইয়েরা বিয়েথা করে যার যার মতো আলাদা সংসার সামলাতে ব্যস্ত। আমি সবার ছোট। আমি বাবামায়ের সাথে।
বাড়ি থেকে আমার টাকা পাওয়ার কোন উপায়ই ছিলো না। আমি টিউশনি করে নিজের খরচ জোগাতাম। বাবামাকেও যৎসামান্য দেয়ার চেষ্টা করতাম। কোন কোন সময় তা সম্ভব হতো না।
একদিন শহরের অভিজাত বানিজ্যিক এলাকার ফুটপাত থেকে একটা শার্ট কিনে বাসার দিকে ফিরবো তখনই আমি নাজনীনকে দেখলাম। প্রথম দেখা! সে আমার বিপরীত দিক থেকে আসছিলো।
রীতিমতো মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মতো রূপ নাজনীনের। মেদহীন লতানো শরীর। তীক্ষè নাক, মুখ, চোখ। পিঠেজুড়ে থাকা রাশি রাশি চুল। তার মেপে মেপে পা ফেলানোতেও সৌন্দর্য্য যেন উপচে পড়ছিলো। ¯্রষ্টা আসলেই যদি নিজ হাতে দু’একজনকে গড়ে থাকেন তবে নাজনীন তাদের একজন এতে কোন সন্দেহ নেই- এমনটাই ভাবছিলাম আর তাকে দেখছিলাম।
আমরা দু’জন পরষ্পরের কাছাকাছি চলে এসেছি দেখলাম নাজনীন দাঁড়িয়ে পড়লো। আমার হাত তিনেক আগে একটা লিক্পিকে ছেলে হাটছিলো। নাজনীন তার সামনেই দাঁড়ালো। দেখলাম তার চোখ থেকে যেন আগুন ঠিক্ড়ে বেরুচ্ছে। সে ফণা তোলা সাপের মতো হিসহিস করে আমার সামনে থাকা ছেলেটাকে বললো- সভ্যতা ভব্যতা বলে কিছু আছে তা জানো? একটা মেয়েমানুষের দিকে এভাবে তাকাতে লজ্জা করে না?
আমার যেন সম্বিৎ ফিরে এলো। আমি সতর্ক হয়ে গেলাম। দেখলাম ছেলেটা একটা বোকামি করে বসেছে! সে নাজনীনের দিকে তাকায়নি দাবী করে ওর সাথে মিথ্যা তর্ক জুড়ে দিলো।
দেখলাম ছেলেটার মিথ্যা বলাটা নাজনীনের রাগের মাত্রাকে আকাশচুম্বী করে তুলেছে। সে রাগে ক্ষোভে লাল হয়ে কাঁপতে শুরু করেছে।
ইতর!- আমি ছেলেটাকে মনে মনে গাল দিলাম। বলদটা কেন যে মিথ্যা বলতে গেলো! আসলে নাজনীনের যা রূপ তাতে করে কোন পুরুষই তার দিকে না তাকিয়ে পারে না! তার রূপের আগুন যে কোন বুড়োকেও যৌবন বিগত হওয়ার আফসোস ভুলিয়ে দিবে!
ছেলেটার উচিৎ ছিলো নাজনীনের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে সেখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কেটে পড়া। কিন্তু বলদটা মিথ্যা বলে পরিস্থিতিটা খুব জটিল করে দিলো। আমি এগিয়ে গেলাম। অন্যকোন ঘটনা হলে আমি যতদ্রæত সম্ভব পাশ কাটিয়ে চলে যেতাম।
আসলে নাজনীনের মতো একটা সুন্দরীর সামনে একটু সময় হলেও থাকতে পারার সুযোগটা আমি হাত ছাড়া করতে চাইনি। আমি ছেলেটার পাশে গিয়ে বললাম- দেখো, একজন ভদ্রমেয়ের সাথে তোমার ওরকমটা করা উচিৎ হয়নি! তুমি তাকে সরি বলো!
মনে হলো ছেলেটা খুব গোঁড়া প্রকৃতির সে আমার কথায় অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলো। আমি খুব শান্তভাবে তার সাথে কথা বলছিলাম। ততক্ষণে চারপাশে অনেক লোক জমে গেছে। নাজনীন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে! আমার কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে সেও ছেলেটির সাথে কথা বলছিলো।
ছেলেটা হার না মেনে ফুসছিলো আর ফুসছিলো! আর আমি বারবার তাকে ভদ্রভাবে কথা বলার জন্য বলছিলাম! আমি জানি আমার জয় নিশ্চিত! তাই একটু একটু করে রশি কষাতে শুরু করলাম। আমি ছেলেটার উপর চাপ সৃষ্টি করতে লাগলাম নাজনীনের সামনে তাকে ’সরি’ বলতেই হবে! কারণ সে যা করেছে তা কোনভাবেই ভদ্রতার মাঝে পড়ে না!
গোঁড়া বলদটা রাগে ফুসতে ফুসতে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেললো। সে আমাকে ধাক্কা মেরে বসলো। আমি বুঝতে পারিনি সে এতটা আক্রমণাত্মক হবে। ধাক্কা খেয়ে আমি ফুটপাতে একটা দোকানের স্তুপ করে রাখা ফলের কাঠের কার্টুনের উপর পড়ে গেলাম। অমসৃণ কাঠের টুকরার খোঁচা লেগে আমার ডান কুনুইয়ে একটু কেটে গেলো।
একটু কাটলো কিন্তু অনেকটুকু রক্তই ঝরলো। আমার সাদা শার্টের বেশ খানিকটা লাল হয়ে গেলো। এবার উৎসুক লোকজন যারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘটনাটা দেখছিলো তাদের কয়েকজন এসে ছেলেটাকে ধরে ফেললো। দু’একজন দু’একটা চড় থাপ্পড়ও দিলো। দেখলাম শোরগোলের মধ্যে টহল পুলিশের একটা গাড়ি এগিয়ে এসেছে! নাজনীন আমার চোট লাগা হাতটা চেপে ধরে রীতিমতো ভয়ে কাঁপছে!
পরের দিন খুবই জনপ্রিয় একটা জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকীয়তে ওই ঘটনাটাকে ভিত্তি করে লেখা বের হলো। ক্রমশ:ই নৈতিকতা হারানোর মধ্য দিয়ে আমাদের সমাজচিত্র কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠছে তার ব্যাখা ছিলো লেখাটায়। পরিণতিও উল্লেখ করা হয়েছিলো। ধ্বংসের হাতে থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে দেশের যুবসমাজকে আমার মতো ভদ্র হওয়ার পরামর্শও দেয়া হয়েছিলো!
বিকেল নাগাদ অপরিচিত নাম্বার থেকে আমার মোবাইল ফোনে একটা কল্ এলো। আামি রিসিভ করলাম। একজন বয়স্কা ভদ্রমহিলা কথা বললেন। পরিচয় দিলেন উনি নাজনীনের মা। আগের দিনের ঘটনায় তাঁর মেয়েকে সাহায্য করার জন্য উনি বারবার আমাকে ধন্যবাদ দিলেন। আজকাল অভদ্রদের ভিড়ে ভদ্রদের চলাফেরা করাই যে দায় হয়ে গেছে তাও কয়েকবার স্মরণ করিয়ে দিলেন। খুব তাড়াতাড়ি উনি আমাকে দেখতে চান বলে জানালেন!
আমি নাজনীনদের বাড়ীতে গেলাম। ওনারা নিজের সন্তানের মতোই আদর ভালোবাসা দিলেন। ওনারা আরো চাইলেন অভদ্রদের ভিড়ে চলাফেরা দায় হয়ে যাওয়ায় নাজনীনকে যেন আমি একটু সঙ্গ দেই, একটু দেখভাল করি!
বেশ রাত করে আমি যখন নাজনীনদের বিশাল বাড়ি থেকে রাস্তায় নেমে এলাম তখন পথঘাট বেশ ফাঁকা হয়ে গেছে। হঠাৎ করে আমার ওই ইতরটার কথা মনে পড়লো। ওই যে ছেলেটা- যে কিনা খুব অভদ্রভাবে নাজনীনকে দেখছিলো।
অনেকক্ষণ ইতরটার কথা মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না! মনে হচ্ছিলো আমি আর ও একই মানুষ! একই চোখে নাজনীনকে দেখছিলাম। ওই বলদটা ধরা পড়ে গেছে! আমি ধরা পড়িনি! আমার লোভ লালসার আঁধারটুকু নাজনীনদের কারোরই চোখে পড়েনি!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী
ভাই পড়ার তৃষ্ণা কিন্তু শেষ করতে পারিনি, বেশ দারুণ গল্প। ১০নং প্যারার- স্রষ্টা আসলেই যদি নিজ হাতে দু'একজনকে গড়ে থাকেন তবে নাজনী তাদের একজন এতে কোনো সন্দেহ নেই; আচ্ছা স্রষ্টা কি কাউকে আলাদা ভাবে গড়ে থাকেন? নাকি সবাইকে সমান ভাবে সৃষ্টি করে থাকেন? তবে জানিনে ভাই... ভালো থাকুন, শুভকামনা রইল......
Salma Siddika
ছোট হলেও দারুন ভাবে দেখালেন আঁধারকে। আমরা মুখোশ পড়ে অন্ধকারকে লুকিয়ে রাখি। আপনি দরুন লেখেন, আশা করছি অলসতা কাটিয়ে আরো সুন্দর সুন্দর লেখা উপহার দেবেন। ভুল বানানগুলো খুব কষ্ট দিলো। গল্পটা আরাম করে পড়ছিলাম হটাৎ দুম করে শেষ হয়ে গেলো।
মনজুরুল ইসলাম
ওই বলদটা ধরা পড়ে গেছে! আমি ধরা পড়িনি! আমার লোভ লালসার আঁধারটুকু নাজনীনদের কারোরই চোখে পড়েনি!-In the beginning i thought that the story is very common. and did not get any inspiration to continue. but as the story is story i have continued. the lines i hv quoted, totally create a dimension in this story. thank you and thank you to expose a real truth. good luck.
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।