‘এই মিয়া, ফাল দিয়া গাড়িত উডলেই যাওন যায় না। কই যাইবেন আগে কইয়া লইতে হয়।’
গাড়ির হেল্পারের এমন উক্তিতে আমার মেজাজটা চড়া হয়ে গেল। হালার দুই টাকার হেল্পার আমাকে জ্ঞান দেয়? বড়জোর বলতে পারত- ভাই কোথায় যাবেন? তখন না হয় ভালোভাবে উত্তর দিতাম। আমিও একটু রুক্ষ মেজাজে বললাম, ‘তর জ্ঞান দেয়া লাগবে না। আমিই জানি, কোথায় যাব আর কীভাবে যাব।’
‘না ভাই। এমনে কইলে পরের গাড়িতে যান, এহন নামেন।’
এ কথায় অন্য এক ভদ্রলোক ক্ষেপে উঠলেন। চোখজোড়া লাল করে হেল্পারকে বললেন, ‘তুইতো বড় বেয়াদব। তোরে এমনে কথা বলা কেডা শিখাইছে? এই হালার-প-হালা মারুম এক চর।’
আমি আর কিছু বললাম না। চুপটি মেরে গাড়িতে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পরই বুঝতে পারলাম ভদ্রলোক গাড়ির মালিক। ধমক খেয়ে হেল্পারও নীরব হয়ে গেল। তারপর গাড়ি থেকে নেমে সে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। তাকে আর দেখতে পেলাম না। খানিক পরে ড্রাইভার বারকয়েক হর্ণ বাজানোর সাথে সাথে অন্য এক হেল্পার দৌঁড়ে এসে গাড়িতে উঠল। এবার ড্রাইভার একটু নরম সুরে আমাকে বলল, ‘বাই কই যাইবেন? গন্তব্যস্থল না জাইনা গাড়িতে যাত্রী উডাইলে সমস্যা অয়।’
ব্যাপারটা আমার বোধগম্য হলো না। বছর কয়েক পূর্বে একবার এ কোম্পানীর গাড়িতে চড়েই বন্ধুর সাথে তার বাড়িতে গিয়েছিলাম। সুতরাং এখন যে এ গাড়িতেই যেতে হবে, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু হেল্পারের কারণে মেজাজটা চড়া থাকায় ড্রাইভারকেও সঠিক কথাটা বলতে ইচ্ছে হলো না। গন্তব্যস্থলের কথাটা সরাসরি না বলে একটু ঘুরিয়ে বললাম, ‘চিন্তার কিছু নেই ভাই। জায়গামতোই যাব।’
ড্রাইভার আমার গন্তব্যস্থল কিছু একটা আন্দাজ করে নিল। কী আন্দাজ করে নিল আল্লাহ মালুম। তারপর চলতে লাগল তার আপন গতিতে। আমিও বাসের সিটে হেলান দিয়ে বাইরের দৃশ্যগুলো মনভরে দেখতে লাগলাম।
যা হোক, এবার মূল কথা বলি। যে জায়গাটি থেকে আমি গাড়িতে উঠলাম, তা মাদারীপুর জেলার টেকেরহাট ষ্টেশন। যে কাজে এখানে আসা, তা হলো এক অসুস্থ বন্ধুর সাথে দেখা করা। অবশ্য বন্ধুর বাড়ি এখানে নয়। বরিশাল জেলার গৌরনদী থানাধীন ঘোষেরহাট এলাকায়। এখন আমি সেদিকেই যাচ্ছি।
যে বন্ধুর সাথে আমি দেখা করতে যাচ্ছি, তার নাম টুটুল। বছর দুয়েক পূর্বে যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ বর্ষ পরীক্ষা দিয়েছিলাম, তখনই বন্ধু টুলুলের সাথে আমার শেষ দেখা হয়। ফোনে মাস কয়েক তার সাথে যোগাযোগ ছিল। পরে উচ্চ শিক্ষার জন্যে আমি বিদেশে পাড়ি জমালে কেমন করে যেন তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ফোনে বহুবার কল দেয়ার চেষ্টাও করেছিলাম। ফোন বন্ধ থাকায় ব্যর্থতা বরণ করে নিয়েছিলাম বারবার। তাই মনের মাঝে বন্ধুর প্রতি খুব ঘৃণা জন্মেছিল। কারণ; সে হলো আমার জীবনের ডায়রীতে শ্রেষ্ঠ বন্ধুর তালিকায় এক নম্বর আসনে। ভার্সিটি ছাড়ার পর যখন একদিন তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়- তারপর থেকে পুরোনো স্মৃতি চোখের সামনে ভাসিয়ে কত দিবস-রজনী যে তার জন্যে অশ্রুবিসর্জন দিয়েছি, তারও হিসাব নেই।
অনেক দিন পর গতকাল যখন একবার বন্ধুর সেই নম্বরে কল দিয়েছিলাম, তখন মাথায় হঠাৎ আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল। বন্ধুর ফোনে মেয়েলি কণ্ঠ পেয়ে লাইনটা কেটে দিয়েছিলাম। মনে খুব কষ্টও লেগেছিল। বন্ধু কেমন স্বার্থপর? কবে কবে বিয়েও করে ফেলেছে! অথচ আমাকে একটিবার ফোন করার প্রয়োজন বোধ করেনি। এমনটি ভেবে বন্ধুর সাথে আর কথা বলতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু লাইন কেটে দেয়ার পর আমার ফোনে একের পর এক তার কল আসছিল। অবশেষে সইতে না পেরে কল রিসিভ করেছিলাম। ইচ্ছে ছিল খোঁচা মেরে তাকে কয়েকটা কথা বলার। অথচ ঘটনা ঘটেছিল ব্যতিক্রম। রিসিভ করে পুনরায় মেয়েলি কণ্ঠ পাবার পর পরিচয় জিজ্ঞাসিলে বলেছিল, ‘আমি টুটুলের ছোট বোন মালা। আপনি কে বলছেন?’
বুঝে নিলাম মালা আমাকে চিনে নিতে পারেনি। কিন্তু তাকে আমি চিনে নিয়েছিলাম। বলেছিলাম, ‘আমি যেই হই না কেন, তুমি বল টুটুল কোথায়।’
মৃদু কণ্ঠের উত্তর, ‘ভাইয়া ঘুমিয়ে আছে।’
‘তাহলে জাগিয়ে দাও না। বল মতিভাই ফোন করেছে।’
‘আপনি তাহলে সেই মতি ভাই? যার জন্যে এখনো ঘুমের ঘরে ভাইয়ার কান্নার শব্দ শুনতে পাই।’
‘দেখ প্যাচানো কথা না বলে সহজ করে বল।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে, ‘আসলে আমার ভাইয়া এখন অন্য দুনিয়ার বাসিন্দা। যতই ডাকি সাড়া দেয় না। মুখ খুলে কথাও বলে না।’
টুটুলের বোনের মুখে গতকাল শেষবার এ কথাটাই শুনেছিলাম। তারপর কান্নার শব্দ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাইনি। কী একটা মনে করে যেন ভয়ে আমার বুক কেঁপে উঠেছিল। আবার ভেবেছিলাম, হয়তো কোনো দুর্ঘটনা কিংবা দুরারোগ্য ব্যাঁধি। তাই কাল রাতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যেভাবে হোক বন্ধুর সাথে দেখা করতে হবে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজ সকালেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম।
প্রথমত- চাঁদপুর লঞ্চঘাট থেকে শরীয়তপুর ফেরিঘাট; দ্বিতীয়ত- ফেরিঘাট থেকে মনরা তিন রাস্তার মোড়; তৃতীয়ত- মনরা থেকে মাদারীপুর টেকেরহাট ষ্টেশন পর্যন্ত খুব ভালোভাবেই চলে এলাম। এখানে এসেই নির্বোধ হেল্পারের কথায় সামান্য একটু হোচট খেলাম। মনে চিন্তাও কাজ করতে লাগল। বাস যে কোন রাস্তা দিয়ে কোন দিকে যাচ্ছে, তা বুঝে উঠতে পারলাম না। বড় বড় বাঁশবাগানের মাঝখান দিয়ে সরু রাস্তা। বাসও চলছে দ্রুত গতিতে। পেছনের খানিকটা পথ পরিচিত ছিল। এখন বাস সামনে যতই এগিয়ে যাচ্ছে, ততই অচেনা পথ আর অচেনা ফসলের মাঠ নজরে পড়তে লাগল। আচমকা মনে প্রশ্ন এল- জায়গামতো যাব কথাটা বলেই কী মুশকিলে পড়লাম? তাৎক্ষণিকভাবে পাশের সিটের এক ভদ্রলোককে বললাম, ‘আঙ্কেল বাসটা কোন দিকে যাচ্ছে বুঝতে পারছি না।’
ভদ্রলোক বললেন, ‘ডামুড্ডার দিকে।’
‘হায় আল্লাহ্ সর্বনাশ! ড্রাইভার গাড়ি ব্রেক করেন।’
ড্রাইভার গাড়ি হার্ড ব্রেক করল। বলল, ‘কী অইছে বাই?’
‘গাড়ি নাকি ডামুড্ডা যাবে? তাহলে অন্য রাস্তা দিয়ে ঢুকেছিলেন কেন?’
‘বাই ঐ রাস্তার প্রথম দিকে একটা বিরিজ বাঙ্গা, তাই ঘুইরা এই রাস্তায় ডুকছি। আপনি যাইবেন কই?’
‘মাদারীপুর।’
‘অসুবিদা নাই বসেন। আরেকটু সামনে গিয়া নাইমেন। একটা গাড়িত উডায়া দিলে যাইতে পারবেন।’
আমি আর কিছু বললাম না। পন্ডিতির সাজা যে পেয়ে গেছি, তা বুঝতে আর বাকী নেই। ভাগ্যকে ধিক্কার দিয়ে গাড়িতে চুপটি মেরে বসে রইলাম। জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখতে পেলাম এর মধ্যে ক্ষতি হয়ে গেল প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার পথ।
পেছনের যাত্রাগুলোতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেও আমার মনে এক বিন্দু বিরক্তি আসেনি। অথচ এ এক ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে গিয়ে ঘড়ির কাটা যেন থেমে গেছে। তার উপর এখন ড্রাইভার-হেল্পারের হাসাহাসি আর সহযাত্রীদের জায়গামতো যাব কথাটা নিয়ে কানাখুশা চলছে বাড়াবাড়ি রকমে। একপর্যায়ে পাখির কলকাকলির মতো পাবলিকের হাসাহাসির রবও উঠল। আমি লজ্জায় লাল মুখখানা ঢেকে রাখার কোনো উপায় খুঁজে পেলাম না। তারপর ছটফট করতে করতে আরো কিছুটা পথ এগিয়ে যাবার পর ড্রাইভার একটি বাস থামিয়ে তাতে আমাকে উঠিয়ে দিল। আমি লজ্জার অনুভূতিটা ঐ গাড়ির দিকে ছুড়ে নতুন গাড়িতে উঠলাম। জানালার পাশের সিটে হেলান দিয়ে বসে রইলাম। পরক্ষণে হেল্পার বলল, ‘ভাইজান কই যাইবেন?’
‘যাব মাদারীপুর, সেখান থেকে গৌরনদীর ঘোষেরহাট।’
‘তাইলে এই দিকে আইলেন কেমনে, ভুল কইরা?’
‘ভুল করে না ভাই, পন্ডিতি করে। ঐ গাড়িতে যখন জিজ্ঞেস করেছিল কোথায় যাবেন? তখন বলেছিলাম- জায়গামতো যাব। তারপর এই দশা।’
কথাটা বলার পরই হাসাহাসির রব উঠল। তবে এখানে লজ্জার ভাবটা আর এল না। লোকজনকে হাসাতে পেরে একটু অন্যরকম ভালোই লাগল। এর মধ্যে এক ভদ্রলোক বললেন, ‘এটাই আপনার জন্যে ভালো হয়েছে। পন্ডিতির ফলে কমপে দুই ঘণ্টা আগে আপনি জায়গামতো পৌঁছতে পারবেন।’
ভাবলাম শিক্ষিত বুড়ো ভদ্রলোক আমার সাথে মজা করছে। তাই চুপটি মেরে বসে রইলাম। ভদ্রলোক আমার চুপ থাকা দেখে বললেন, ‘ঠাট্টা করে বলিনি বাবা, ঐ পথে ঘোষেরহাট যেতে আপনার অনেক সময় লাগত। আগে মাদারীপুর গিয়ে তারপর যেতে হতো। কিন্তু এখান থেকে সরাসরি ঘোষেরহাটেই যেতে পারবেন। অপেক্ষা করুন, আর মাত্র পঁচিশ থেকে ত্রিশ মিনিট লাগবে আপনার জায়গামতো পৌঁছতে।’
মনে কিছুটা শান্তি পেলাম। পন্ডিতি করে অন্তত ধরা খাইনি। গোপনে নিজেকে নিয়ে গর্বিতও হলাম। বুঝে নিলাম- যদি আগের বাসের ঐ ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস না করতাম, তাহলে হয়তো ডামুড্ডাই চলে যেতে হতো। আর সেখানে গেলে সারা দিনই আজ পথে পথে কাটাতে হতো।
যা হোক, দেখতে দেখতে আরো অনেকটা পথ পেছনে ফেলে দিলাম। অচিনপুরের আঁকাবাঁকা পথ ধরে বাস দ্রুত গতিতে চলতে লাগল। চলতে চলতে যখন মোস্তফাপুর ষ্টেশনে পৌঁছল, তখন কলিজাটা অনেক বড় হয়ে গেল। কারণ; আর মাত্র কয়েকটা ষ্টেশন পার হলেই আমার গন্তব্যস্থল চোখে পড়বে। তাই পেছন থেকে উঠে সামনের একটি খালি সিটে গিয়ে বসলাম। ড্রাইভার একটুখানি ঠাট্টার সুরে বলল, ‘চিন্তা কইরেন না ভাই, জায়গামতোই নামায়া দিমু।’
আমি কিছু বললাম না। মনে মনে কিছুক্ষণ হেসে নিলাম। তারপর ভাবলাম, ষ্টেশন পৌঁছার পূর্বে টুটুলের নম্বরে একটা কল দিলে হয়তো সে আমাকে এগিয়ে নিতে আসবে। অবশেষে কল দিলাম। দু’তিনটা রিং বাজার পর ওপার থেকে আওয়াজ শুনতে পেলাম, ‘হ্যালো আস্সালামু আলাইকুম। কে বলছেন?’
ওমা। এ আবার কেমন কথা? কাল রাতে একবার মালার সাথে কথা হয়েছিল। তবে কি আমাকে সে চিনে নিতে পারেনি? মনে খুব কষ্ট লাগল আমার। বন্ধুর অসুস্থতার কথা মনে পড়তে কষ্টটা আবার মিলিয়েও গেল। ভাবলাম, বন্ধু হয়তো মুমূর্ষ রোগীর মতো বিছানায় পড়ে আছে। তা না হলে আমার কল পেয়ে সেতো লাফিয়ে ওঠার কথা। অবশেষে বললাম, ‘হ্যালো মালা, আমি মতি। কেমন আছ তুমি?’
‘হ্যা ভাইয়া ভালো। আপনি কেমন আছেন?’
‘ভালো। আমি কিন্তু টুটুলকে দেখতে আসছি। ও কোথায়, বাড়িতে না হাসপাতালে?’
মালার আর কোনো আওয়াজ এল না। ব্যাপারটা বোধগম্য হলো না। মনের অজান্তে ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এল- টুটুলের কিছু হয়নি তো? তারপর হঠাৎ বুকের ভেতরটায় চিনচিনিয়ে ব্যথা শুরু হলো। লাইনটা কেটে দিয়ে বসে রইলাম। এর মধ্যে হেল্পার বলে উঠল, ‘এই যে বাই ঘোষেরহাট নামেন।’
আমি ত্বরিত বাস থেকে নেমে পড়লাম। টুটুলের জন্যে কিছু ফল-পাকড়া কিনে একটা রিক্সায় চড়ে বসলাম। তারপর চলতে চলতে রিক্সা যখন টুটুলের বাড়ির সীমানায় থামল, তখন নজর পড়ল টুটুলের ঘরের দরজায়। দেখতে পেলাম তার মা-বাবা নির্বাক তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি কাছে গিয়ে ছালাম দিলে তারা আমাকে ঘরে নিয়ে গেলেন। বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন এলাকা হওয়ায় কিছুটা সময় অন্ধকারেই বসে থাকতে হলো। খানিক পরে টুটুলের মা একটি পিদিম হাতে নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘কেমন আছ বাপ।’
‘জি খালাম্মা ভালো আছি। টুটুল কোথায়?’
খালাম্মা চোখের জল ছেড়ে বললেন, ‘আছে, কাল সকালে তোমাকে নিয়ে যাব। এখন তুমি বস, আমি একটু কাজ সেরে আসি।’
আমি বসে থাকতে পারলাম না। ঘর থেকে বের হয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। মনে কৌতুহলের কোনো শেষ নেই। মালা যে বলেছিল- ভাইয়া এখন অন্য দুনিয়ার বাসিন্দা। ডাকলেও সাড়া দেয় না, আর মুখ খুলে কথাও বলে না। সেই কথাটা বারবার মাথায় ঘুরতে লাগল। তাই বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারলাম না। এদিক ওদিক ঘুরে টুটুলকে খুঁজতে লাগলাম। অবশেষে তার পড়ার টেবিলের কাছে গিয়েই থমকে গেলাম। বড় করে ফ্রেমে তার ছবিটা বাঁধা আছে। সেই হাসিটাই ছবিটাতে আটকে আছে, ভার্সিটি থেকে বিদায় নেয়ার দিন যেই হাসিটুকু তার মায়াবী মুখটা উজ্জল করে রেখেছিল। ছবিটা দেখে আমি চোখের জল ধরে রাখতে পারলাম না। ফুলের মালা দিয়ে ছবিটাকে যেভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে, তাতে আমার কিছুই বুঝতে বাকি রইল না। ফুলগুলো সব শুকিয়ে আছে। মনে হলো বহুকাল পূর্বেই বন্ধু দুনিয়া থেকে চিরনিদ্রার দেশে চলে গেছে। তবু মনকে বুঝাতে পারলাম না। বন্ধুর ছবিটা হাতে নিয়ে চুপটি মেরে বসে রইলাম। অপেক্ষা করতে লাগলাম খালাম্মা কখন আমাকে টুটুলের কাছে নিয়ে যাবেন। খানিক পরে সেই অপেক্ষার মাঝে খালাম্মা এসে হাজির হলেন। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। বললাম, ‘প্লিজ খালাম্মা, আমাকে কষ্ট দিবেন না। টুটুলের জন্যে বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছে। আমাকে তার কাছে নিয়ে চলুন।’
খালাম্মা কিছু না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। এর মধ্যে ঠান্ডা পানির শরবত, চা-বিস্কুট ইত্যাদি নিয়ে মালা এসে হাজির হলো। খালাম্মার কথা না পেয়ে অবশেষে মালাকে বললাম, ‘মালা আমি ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলেছি। প্লিজ টুটুলের কাছে নিয়ে চল। সকাল পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করতে পারব না।’
‘আরে ভাইয়া বসেন। এতটা অস্থির হচ্ছেন কেন? আগে চা-নাস্তা খেয়ে নিন। তারপর নিয়ে যাব।’
এ কথা শুনে আমি দেরি করলাম না। ত্বরিত কয়েকটি আইটেম এক এক করে খেয়ে নিলাম। তারপর বললাম, ‘কী হলো, নিয়ে যাবে না?’
মৃদু কণ্ঠে মালা বলল, ‘হ্যা চলেন।’
মালা পিদিম হাতে নিয়ে হাটা শুরু করল। আমিও পিছু পিছু চলতে লাগলাম। মালার বৃদ্ধ মা-বাবাও কিছুটা পথ আমাদের সাথে এসে দুরে দাঁড়িয়ে গেলেন। বাড়ির শেষ সীমানায় মসজিদের পাশে স্বল্প উচ্চতা বিশিষ্ট বাউন্ডারী দেয়ালের গেট খুঁলে মালা আমাকে নিয়ে অকপটে ভেতরে চলে গেল। তারপর ঘাস-লতা-পাতায় ঢেকে থাকা জরাজীর্ণ অল্প আয়তনের একটি নির্দিষ্ট জায়গা দেখাল। চিৎকার করে বলল, ‘এই দেখেন, এখানেই আমার ভাইয়া ঘুমিয়ে আছে। ডাকেন, কোনো সাড়া পাবেন না। আপনি হাজার কথা বললেও, ভাইয়ার মুখ খুলবে না।’
কথাটা বলা শেষে মালা অস্বাভাবিকভাবে কাঁদতে আরম্ভ করল। আমি নির্বাক হয়ে গেলাম। চোখে জল এলেও আমার কাঁদতে ইচ্ছে হলো না। আমি কাঁদলে মালাকে থামাবে কে? মনে মনে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো। কোথা থেকে হঠাৎ এসে টুটুলের প্রাণপ্রিয় বোন আর বাবা-মা’র কাটা ঘাঁয়ে নুনের ছিটা দিলাম। মনে মনে বন্ধুর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলাম। মালাকে বললাম, ‘সরি মালা। হঠাৎ এসে তোমাদের কষ্ট দিলাম।’
মালা চোখের জল মুছতে মুছতে কাঁপা কণ্ঠে বলল, ‘চলেন বাড়িতে চলেন।’
তারপর মালার সাথে ঘরে ফিরে গেলাম। বড় একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বন্ধুর ছবিটার দিকে অপলক তাকিয়ে রইলাম। বিনা কান্নায় অশ্রু ঝরতে লাগল বিরামহীনভাবে। বন্ধুর বাবা এসে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘যে নেই তাকে নিয়ে কেঁদে কী লাভ বাবা? এই যে দেখ, আমারাতো কাঁদছি না।’
আমার বুঝতে বাকি রইল না কাঁদতে কাঁদতে যে তাদের আঁখিজল ফুরিয়ে গেছে। তাই আমার চোখের জল মুছে নিলাম। কী ছিল কারণ, তা আজ আর জানতে ইচ্ছে হলো না। শুনতে চাইলে হয়তোবা আবারও কান্নার বীন বেজে উঠবে। এমনটি ভেবে নীরবে বসে রইলাম। খানিক পরে গুনগুন আওয়াজ শুনে মাথা উঁচিয়ে ডানে-বায়ে তাকিয়ে দেখলাম- টুটুলের বন্ধুকে দেখতে দর্শকের মতো বহু নর-নারি দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে মাঝ বয়সের একজন এসে বললেন, ‘আপনের দেশ কই?’
চাঁদপুর বলে আমি জবাব দিলাম। তারপর লোকটি আর কোনো কথা বলার সুযোগ পেল না। মালা এসে সকলের উদ্দেশে বলল, ‘আপনারা এখন যান। উনি খুব ক্লান্ত।’
আমি অবাক হয়ে বসে রইলাম। সত্যিই আমি খুব ক্লান্ত। তার চেয়ে বেশি ক্লান্ত আমার বুকের ভেতরটা। ভাবতে লাগলাম, ভার্সিটিতে যেই বন্ধু আমাকে ছাড়া একটি প্রহরও কাটাতে পারত না, আজ সেই বন্ধুর বাড়িতে এসে বন্ধুকে ছাড়াই কাটাতে হচ্ছে। কাজের কাজ কিছুই হলো না। সময়-অর্থ দু'টোই গোল্লায় গেল। আমার এ ভাবনা শেষ না হতেই মালা রাতের খাবার নিয়ে এল। বলল, ‘ভাইয়া সারাদিন জার্নিতে ছিলেন। খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েন। না হয় অসুস্থ হয়ে পড়বেন।’
আমি কথা না বাড়িয়ে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। তারপর বিছানায় শুয়ে মনে মনে বললাম, কাল খুব ভোরেই রওয়ানা দিব আপন ঠিকানায়। তারপর হারানো দিনের কিছু স্মৃতি নিয়ে ভাবনার আধারে লুকিয়ে চোখ দু'টো বন্ধ করে দিলাম।
বছর কয়েক পূর্বে যখন এসেছিলাম, তখন বন্ধুর সাথে এ কক্ষেই ঘুমিয়েছিলাম। মালা তখন ছিল ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী। আমাদের দুজনের সাথে সেও ঘুমিয়েছিল। সারা রাত আমার আর টুটুলের বুকের ওপর গড়াগড়া দিয়ে ঘুমিয়েছিল সে। আমিও তাকে ছোট বোনের মতো খুব আদর-স্নেহ করেছিলাম। ভাবনার মাঝে এ স্মৃতিগুলো চোখের সামনে যেন হঠাৎ বাস্তবরূপে উকি দিল। সেই বাস্তবতা স্বপ্নের জগতে মিশে গেলে কোন সময় যে ঘুমের দেবতা আমার চোখ দু'টো বন্ধ করে দিল, কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না।
পরদিন ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেল। চোখ খুলেই মাথার পাশে দেখতে পেলাম টুটুলের মাকে। উঠে সোজা হয়ে বসতে চাইলাম, কিন্তু উনি বাঁধা দিলেন। বললেন, ‘না বাবা শুয়ে থাক। তুমি এখনো পুরোপুরি সুস্থ হওনি।’
আমি চমকে উঠে বললাম, ‘না খালাম্মা আমি ঠিক আছি। আমার কিচ্ছু হয়নি।’
‘কী হয়েছে সেটাতো তুমি টের পাওনি বাবা। কাল মধ্য রাতে হঠাৎ শুনি তুমি কাতরাচ্ছ। এসে দেখি জ্বরে গাঁ পুড়ে যাচ্ছে। পরে মাথায় একটানা পানি ঢেলে তোমার জ্বর কন্ট্রোল করলাম।’
ভয়ে আমার বুক কেঁপে উঠল। শরীরে হাত দিয়ে দেখলাম তাপমাত্রা স্বাভাবিকই আছে। সোজা হয়ে বসে বললাম, ‘এখন ঠিক আছি খালাম্মা।’
এ কথা বলে বিছানা থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে এলেই দেখতে পেলাম মালা নাস্তা নিয়ে রেডি। তার দিকে দৃষ্টি ফেলতেই সে হেসে উঠল। কিন্তু আমার হাসি এল না। মনে বিরক্তির ছোঁয়া লাগল। বন্ধুর অনুপস্থিতি আমাকে মুহূর্তে মুহূর্তে কাটার আঘাত দিচ্ছে, আর সে কিনা কোন খেয়ালে হাসছে? তার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। তারপর নাস্তার টেবিলে বসে খেতে শুরু করলাম। খানিক পরে খালাম্মা এসে পাশে বসলেন। নাস্তা খাওয়া শেষে খালাম্মার কাছে জানতে চাইলাম বন্ধুর পরিণতির কথা। কিন্তু তিনি কিছু বলতে চাইলেন না। বললেন, ‘মালার কাছে সব শুন।’
তারপর মালাকেই জিজ্ঞেস করলাম। জানতে পারলাম সুইসাইড। ভালো রেজাল্ট করেও টাকা ছাড়া উপযুক্ত চাকরী না পাওয়া আর পারিবারিক অর্থসঙ্কটই এর কারণ ছিল। ভেবে কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না। এতগুলো বছর পরিশ্রম আর শত চেষ্টা সাধনার পরও বন্ধুর ফলাফল শূণ্য হলো কেন? এর জন্যে দায়ী কে? রাষ্ট্রীয় ব্যাবস্থা, নাকি বন্ধুর অভিমান? হতে পারে দু'টোই। তবে যাই হোক- বন্ধুর বিদায়ে দেশ যেমন হারিয়েছে একখানা মেধাবি মুখ, তেমনি তার পরিবারও হারিয়েছে জীবনের সুখ। বন্ধুর সাথে সাথে পরিবারের সুখও যে চিরতরে হারিয়ে গেছে, তা বুঝতে পারলাম মালার মায়াবী মুখখানার দিকে দৃষ্টিপাত করে। কিছুক্ষণ পূর্বে যে মুখে হাসির ফুল ফুটেছিল, সে মুখ এখন বিরহের আবরণে ঢাকা। দুই বছর পূর্বে ছবিতে যে মালার রূপ দেখেছিলাম একটি সদ্য ফোটা গোলাপের মতো, তা এখন যেন ঝরে পড়া মুহূর্তের মুখ থুবড়ে থাকা গোলাপের মতো। তাই নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। টুটুলের কথা বাদ দিয়ে বললাম, ‘মালা, তোমার পড়ালেখার কী খবর?’
‘ভাইয়া যতদিন ছিল, পড়ালেখাও ততদিন ছিল। ভাইয়া চলে গেলে উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর আর কলেজে ভর্তি হতে পারিনি।’
বলার মতো কিছু আর আমি খুঁজে পেলাম না। চুপটি মেরে বসে রইলাম। মালাও নির্বাক তাকিয়ে রইল আমার দিকে। হঠাৎ কী মনে করে সে যেন নিঃশব্দে হেসে উঠল। এ হাসিতে আমি বিব্রত বোধ করলাম। বুঝে নিলাম- বোকা বানিয়ে আমাকে এতদুর নিয়ে আসতে পারার আনন্দে হয়তো হাসছে। একটু বিরক্তির সুরে বললাম, ‘এখানে হাসির কী হলো?’
মালার মুখখানা আবার গোমরা হয়ে গেল। চুপটি মেরে বসে রইল। একবার মাথা তুলে আমার দিকে তাকিয়ে, আবার মাথা নিচু করে বসে রইল। আমি বললাম, ‘তুমি ফোনে আমাকে সবকিছু বলনি কেন?’
‘ভাইয়ার নিষেধ ছিল।’
‘তার মানে?’
মাথা তুলে মালা বলল, ‘হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ছাড়ার পূর্বে ভাইয়া আমাকে বলেছিল, সবার কাছে বললেও তার মৃত্যুর খবর যেন আপনার কাছে না বলি।’
‘কেন?’
মালা আর কিছু বলল না। বসা থেকে উঠে চলে গেল অন্য দিকে। আমি তাকে ডাক দিতে গিয়েও দিলাম না। তারপর পাশের কক্ষে গিয়ে টুটুলের পড়ার টেবিলে বসলাম। তার ছবিটা হাতে নিয়ে বারকয়েক নাড়াচাড়া করার পর নজর পড়ল মালার ড্রেসিং টেবিলের উপর। দেখতে পেলাম একটি পরিচিত মুখ। তাও সাধারণভাবে রাখা নয়, ফুলের মালা দিয়ে সাজানো। মুহূর্তের মধ্যে চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে গেল। দুর থেকে ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না ছবিটা কার। কাছে গিয়ে দেখলাম অন্য কারো নয়, ছবিটা আমারই। এটা এখানে কেন? মনে প্রশ্ন জাগলে খালাম্মার কাছে জানতে চাইলাম। খালাম্মা বললেন, ‘এটা টুটুলের পড়ার টেবিলেই ছিল। সে খুব যত্নে রাখত। মালাকে দিয়ে প্রতিদিন ছবিতে একটি করে তাজা ফুলের মালা দিত। যখন যে ফুলের সময় আসতো, সেই ফুলের মালা দিতে বলত।’
আমার প্রতি বন্ধু টুটুলের অকৃত্রিম ভালোবাসার বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারলাম। কিন্তু ভাবলাম, এখনতো সে নেই। তবে এখনো তাজা ফুলের মালা কেন? ভাবনার মাঝে আমার এ প্রশ্নের উত্তর পেতে দিশাহারা হয়ে গেলাম। খুঁজতে লাগলাম মালাকে। বাইরে নেমে পুকুর পাড়ে গেলেই দেখতে পেলাম সে বসে আছে। আমি নিঃশব্দে তার পিছনে দাঁড়িয়ে রইলাম। কী করছে দেখতে লাগলাম। কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। তাকিয়ে আছে দুর অজানার দিকে। কিছুক্ষণ পর ধৈর্য্যহারা হয়ে বললাম, ‘কী ব্যাপার মালা? একা একা বসে আছ কেন?’
মালা হঠাৎ থমকে উঠল। কাঁপতে লাগল বাড়াবাড়ি রকমে। কিছু না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি বললাম, ‘একটা প্রশ্নে উত্তর দিবে?’
চোখের জল মুছে মাথা তুলে আমার দিকে তাকিয়ে কাঁপা সুরে বলল, ‘কীসের প্রশ্ন?’
‘আমার ছবিটাতে ফুলের মালা দেয়ার অর্থ কী?’
‘ভাইয়া বলেছিল আপনি যতদিন পর্যন্ত আমাদের বাড়িতে না আসবেন, ততদিন একটি করে মালা বানিয়ে আপনার ছবিটাতে দিতে। কেন বলেছিল, তা জানি না।’
‘তাহলেতো গতকালই মালা দেয়া শেষ হবার কথা ছিল। আজ দিলে কেন?’
‘আজ দিয়েছি অন্য হিসেবে। তাছাড়া দিতে দিতে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল যে।’
কথাটা থেকে কিছু একটা বুঝে নিলাম। এটা নিশ্চয়ই টুটুলের চালাকি। সে তার বোনের প্রতি আমাকে আকৃষ্ট করার লক্ষেই এমন নাটক সাজিয়ে গেছে। এখানে আর এক মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে হলো না। বললাম, ‘মালা ছবিটা আমাকে ফেরত দিতে হবে। আমি এখনই নিজ গ্রামে রওয়ানা হবো।’
‘নিজ গ্রামে যান আর যেখানেই যান। আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু ছবি ফেরত চাইলে দিব না।’
ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেল। না জানি কোন বিপদের মধ্যে পা দিলাম। মনে মনে উপরওয়ালাকে ডাকতে লাগলাম। মনে পড়ল বন্ধুর কথাটাও। সে একবার বলেছিল- জোর করে একজনের ঘাড়ে মেয়ে একটা চাপিয়ে দিতে তার এলাকার মানুষ পটু। তাই ভয়ের কোনো অন্ত নেই। তবু ভাবলাম- বন্ধুর পরিবার আলাদা। তারা এমনটি করবে না।
তারপর মিতালীর জন্যে মনটা হঠাৎ কেঁদে উঠল। সে আমার প্রিয়জন। যদিও তাকে এখনো চোখে দেখিনি। এমনকি তার ঠিকানাও সে বলেনি কোনো দিন। প্রায় বছর হয়ে এলো, তার সাথে যে ফোনে আমার কথা চলছে। এতদিনে তাকে আমি অনেকটা ভালোবেসেও ফেলেছি। যদিও মনে আছে- তাকে দেখার পর মনে ধরলেই মন-প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসব। অবশ্য খুব শিঘ্রই সে আমার সামনে আসার কথাও দিয়েছে। কাল সকালেও বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তার সাথে কথা বলেছিলাম। সেও জানে আমি যে বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। এ বিপদের মুহূর্তে তার সাথে একবার কথা বলার প্রয়োজন বোধ করলাম। মালার সামনেই তাকে কল দিলাম। কিন্তু কাজ হলো না। মোবাইলটা বন্ধ পেলাম। সে কি আমার সাথে রাগ করেই মোবাইলটা বন্ধ রেখেছে? বড্ড চিন্তা কাজ করতে লাগল। আমার চিন্তিত ভাব দেখে মালা কিছু না বলে চলে গেল।
আমি দিশাহারা মনে বন্ধুর ঘরে চলে গেলাম। গিয়ে তার পড়ার টেবিলের উপর বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর বন্ধুর মা-বাবা আমার পাশে এসে বসলেন। বন্ধুর বাবা বললেন, ‘তোমার কি কষ্ট হচ্ছে বাবা?’
কষ্ট হলেও মিথ্যা বললাম, ‘না না। কষ্ট হবে কেন? খুব ভালোই লাগছে।’
কথাটা বলে নীরব হয়ে গেলাম। বন্ধুর বাবা-মাও কিছু না বলে বসে রইলেন। আমি আড়চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে বুঝে নিলাম কিছু একটা বলতেই তারা আমার সামনে উপস্থিত হয়েছেন। কী বলবেন তাও আন্দাজ করে নিলাম। হয়তো মালার কথা। তাই গোপনে আমি মিতালীর সাক্ষাৎ কামনা করতে লাগলাম। ভাবলাম, মালার বাবা-মা’র সামনে যদি মিতালীর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারতাম, তাহলে হয়তো মুখের কথাটা তারা বলতে সাহস পাবেন না। এ ভাবনাটা শেষ হতেই হঠাৎ মিতালীর মিস্ড কল পেলাম। ত্বরিত কল দিলাম মিতালীকে। বললাম, ‘হ্যালো মিতালী? কেমন আছো?’
‘হ্যা ভালো? আপনি কেমন আছেন?’
আমি বোবা হয়ে গেলাম। একি হলো? মিতালী প্রথম থেকেই আমাকে তুমি সম্বোধন করে কথা বলেছিল। গতকালও তাই। এখন হঠাৎ করে তুমি থেকে তার আপনি করে বলাটা আমার বুকে ভূমিকম্পের মতো আঘাত হানল। তাছাড়া কণ্ঠেরও অমিল। ভাবলাম, নাকি অন্য কেউ? হতে পারে মিতালী আমাকে দুরে ঠেলে দিচ্ছে। আমার নীরবতা পেয়ে সে বলল, ‘কী হলো কথা বলছেন না যে?’
অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও বললাম, ‘বলার ভাষা যে আমার হারিয়ে গেছে।’
হাসতে হাসতে বলল, ‘কেন কেন?’
মৃদু কণ্ঠে বললাম, ‘কেমন যেন মনে হচ্ছে তুমি মিতালী নও। সত্যি করে বল, তুমি মিতালী, না অন্য কেউ?’
‘হ্যা আমি মিতালীই। আমার কণ্ঠ হঠাৎ করে চেঞ্জ হয়ে গেছে। অবশ্য ধরে নিতে পারেন এটাই আমার অরিজিনাল কণ্ঠ। এতদিন আপনার সাথে ডুপ্লিকেট কণ্ঠে কথা বলেছিলাম। এখন ইচ্ছে করেও ডুপ্লিকেট কণ্ঠটা বের করতে পারছি না।’
‘তার মানে?’
‘আর কিছু বলব না। বললে ভয় পাবেন। তা এখনো কি আপনার বন্ধুর বাড়িতেই আছেন?’
‘হ্যা। তবে একটু পরেই রওয়ানা হবো।’
‘এত তাড়াতাড়ি কেন? বন্ধুর বাড়িতে গেলেন, কটাদিন থাকতে মন চায় না?’
‘নাহ্, একটু সমস্যা আছে। আচ্ছা তোমাকে একটু পরে আবার ফোন দিচ্ছি। তুমি মোবাইল খোলা রেখ, এখন রাখি।’
‘আরে আরে শুনেন, আসল কথাটাই বলা হলো না। আপনার সাথে কিন্তু আজই আমার দেখা হবে।’
আমি চমকে উঠলাম। মনের আনন্দ ধরে রাখতে পারলাম না। একদিকে আনন্দ, অন্যদিকে ভয়ও। বসা থেকে উঠে পাশের কক্ষে চলে গেলাম। এক বছরের মিতালী, আর আজকের এক দিনের মিতালীর কণ্ঠে কোনো মিল খুঁজে পেলাম না। তাই ভাবলাম, কথায়ও যদি আবার অমিল হয়? অবশেষে বললাম, ‘দেখ, তুমি কিন্তু আমাকে অনেক ঘুরিয়েছ। প্লিজ আর সাজা দিও না। সত্যি করে বল তুমি কে, আর কোথায় তোমার বাড়ি?’
‘আমিতো আগেও বলেছি- আপনি যেমন আমাকে চিনেন, তেমনি আমিও আপনাকে খুব চিনি।’
‘তাহলে বল আমাকে কোথায় আসতে হবে?’
‘এখন বলব না, আমি রেডি হয়ে নিই। কিছুক্ষণ আমার কলের অপেক্ষায় থাকেন। এখন রাখি।’
মিতালী লাইনটা কেটে দিল। আমি চেয়ারে বসে রইলাম। ঘামে আমার সমস্ত দেহ ভিজে গেল। মিতালী যেভাবে বলল, মনে হলো অচিরেই তার সাথে দেখা হতে যাচ্ছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস হতে চাইল না। তবে কে হতে পারে মিতালী? হাজারটা ভেবেও হিসাব মিলাতে পারলাম না। চিন্তায় গলাটা শুকিয়ে গেল। বন্ধুর মাকে ডেকে বললাম, ‘খালাম্মা এক গ্লাস পানি।’
উনি বসা থেকে না উঠে মালাকে ডাকতে লাগলেন। বারকয়েক ডাকার পর মালা হাঁফাতে হাঁফাতে এসে হাজির হলো। বলল, ‘আম্মু কী?’
‘মতিকে এক গ্লাস পানি এনে দাও।’
মালা এক গ্লাস পানি নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। আমার নজর পড়ল তার কপাল আর নাকের ডগার ওপর। যেখানে কতগুলো জলকণা জমে আছে। তারপর তার সম্পূর্ণ মুখটাও দেখে নিলাম। অবাক হয়ে গেলাম পুরোদমে। তাকে কাল রাতে দেখলাম এক রকম, আজ সকালে আরেক। এখন দেখছি অন্যরকম এক তরুণী। তার ভাবটাও খুশিখুশি। বিষয়টি নিয়ে ভাবনায় পড়ে গেলাম। পরক্ষণেই সে উচ্চ শব্দে হা হা করে হেসে আমার ভাবনায় ফাটল ধরাল। তার হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে আমি চেয়ারে বসে পড়লাম। হাসতে হাসতে সে চলে গেল।
মালা চলে গেলে একটানে গ্লাসের পানিটুকু পান করে গলাটা ভিজিয়ে নিলাম। ঘড়িতে নজর দিয়ে দেখতে পেলাম এর মধ্যে সময় অনেকটা চলে গেছে। তারপর মিতালীর জন্যে অপেক্ষার প্রহর গুণতে লাগলাম। সময় যেন কাটতে চাইল না। কিছুটা সময় অপেক্ষার পর ধৈর্য্যহারা হয়ে মিতালীকে কল দিলাম। কিন্তু বহুবার রিং বাজার পরও সে কল রিসিভ করল না। অবশেষে বন্ধুর পড়ার টেবিলে চলে গেলাম। একটি ডায়রী খুলে দেখতে লাগলাম। দেখতে দেখতে এক পর্যায় ডায়রীর পাতা থেকে দু’চোখে সুর্যোদয়ের মতো উকি দিল মিতালীর ফোন নম্বর। তবে কোনো নাম ঠিকানা লেখা নেই। আমার চোখ কপালে উঠে গেল। একি? বন্ধুর ডায়রীতে মিতালীর ফোন নম্বর এল কীভাবে? ডায়রীটা হাতে নিয়ে মালাকে খুঁজতে লাগলাম। অমনি আমার মোবাইলটা বেজে উঠল। দেখতে পেলাম মিতালীর কল? তারপর রিসিভ করে বললাম, ‘হ্যালো মিতালী?’
‘হ্যালো, আমি রেডি। আপনি আসবেনতো?’
‘আসবো মানে? বলো কোথায় আসতে হবে।’
‘আপনার বন্ধু টুটুলের সমাধি বরাবর পশ্চিমে নজর দিবেন। দেখবেন বিলের মাঝখানে একটি উঁচু জায়গায় কতগুলো বৃক্ষ আছে। সেই বৃক্ষগুলোর নিচেই আমি দাঁড়িয়ে আছি।’
হৃদয়কুটিরে হঠাৎ কীসের একটা অনুভূতি যেন জেগে উঠল। লাইনটা কাটতে গিয়ে মোবাইলটা হাত থেকে পড়ে গেল। বুঝতে পারলাম মিতালী বন্ধু টুটুলেরই পরিচিত কেউ। মালার সাহায্যে বোকা বানিয়ে হয়তো সেই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। ভাবলাম, মালাকে নিয়ে তার কাছে গেলেই ভালো হবে। অবশেষে মোবাইলটা তুলে খুঁজতে লাগলাম মালাকে। কিন্তু খুঁজে পেলাম না। তাই একাকী চলতে লাগলাম। টুটুলের সমাধিপাশে দাঁড়িয়ে নজর দিলাম দুর পশ্চিমে বিলের মাঝখানটায়। দেখতে পেলাম লাল শাড়ি পরিহিত একজন পশ্চিম অভিমুখে বৃক্ষতলে দাঁড়িয়ে আছে। দক্ষিণের মৃদু বাদাশে তার আচল দুলছে। তারপর স্লথ গতিতে এক এক করে পা ফেলে চলতে লাগলাম। চলতে চলতে তার নিকটে পৌঁছেই কাঁপা কণ্ঠে ডাক দিলাম, ‘মিতালী।’
মিতালী পিছনে ফিরল না। আমি খানিকটা বিব্রত বোধ করলাম। আশে-পাশে দৃষ্টি সঞ্চালন করে কোনো জনমানবের চিহ্নও পেলাম না। পুনরায় আওয়াজ দিলাম, ‘মিতালী আমি এসে গেছি। এদিকে ফিরে দেখ।’
তবু মিতালী ফিরল না। অবশেষে পেছন থেকে তার ডান হাত ধরে টান দিলাম। অমনি আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। নিজের চোখকে বিশ্বাসই করতে পারলাম না। এত রূপবতী নারী জীবনে প্রথম দেখলাম মনে হলো। বুঝে নিলাম আমার এতদিনের ভালোবাসা যে বিফলে যায়নি। কিন্তু এসবের রহস্য কী? এক জনকে আমি চারবার চার রূপে দেখলাম। মনে প্রশ্ন জাগলে বললাম, ‘তোমার কি আর কোনো রূপ আছে?’
‘নাহ্, এটাই আমার সর্বশেষ রূপ।’
কথাটা বলে মালা চোখের জল ছেড়ে দিল। আমার মন মানল না। তার চোখে আর একবিন্দু অশ্রুও সহ্য হলো না আমার। হাতের রুমাল দিয়ে চোখ দু’টো মুছে দিলাম। বললাম, ‘খবরদার, আর একবিন্দু জলও যেন তোমার চোখে না আসে।’
এ কথার পর মালার মুখে মৃদু হাসির ফুল ফুটল। তাতে তার রূপ যেন আরো কয়েকশ গুণ বেড়ে গেল। আমি নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলাম না। এক বছরের মিতালীকে স্বপ্নের ঘরেও দেখিনি কোনো দিন। তাই মনে কোনো আবেগ ছিল না। কিন্তু এখন আর আবেগকে ধরে রাখতে পারলাম না। বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘এতদিন আমাকে অনেক ঠকিয়েছিলে মালা?’
‘জিনা, আমি মালা নই, মিতালী। আর আমি ঠকাইনি, আপনার বাবা-মা-ই আপনাকে ঠকিয়েছে।’
‘এ আবার কেমন কথা?’
‘যেমন কথাই হোক। ঘরে চলেন। গেলেই সবকিছু টের পাবেন।’
মনে আবার নতুন এক কৌতুহলের জন্ম হলো। কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। জানতেও চাইলাম না তার কাছে। বুঝলাম, মালা মানেই কৌতুহলের দুনিয়া। প্রথম থেকে এ পর্যন্ত যার প্রত্যেকটি কথা-ই এক একটি নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে। তাই কিছু না বলে তার হাতে হাত রেখে নতুন অধ্যায় আবিস্কার করতে ধীরে ধীরে হেটে চললাম বাড়ির দিকে। ঘরের দরজায় পা রাখতেই ভয়ে মুর্ছা যাবার উপক্রম হলো। দেখলাম আমার বাবা-মা আর জনকয়েক নিকটাত্মীয় তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। তখনও আমার হাতটি ছিল মালার হাতেই। তাৎক্ষণিকভাবে হাতটি ছেড়ে দিলাম। চেচিয়ে উঠে বললাম, ‘একি? বাবা তুমি এখানে কেন? আ....আ....আমি চোখে ঠিক দেখছিতো মা?’
‘জি আব্বাজান, আপনার চোখ ঠিকই আছে। আর আমাদের এখানে আসাও সঠিক। তা আম্মাজানের হাত ছাড়লেন কেন?’
বাবা এ কথা বলে মালার হাত দু’টি আমার হাতে তুলে দিলেন। আমি অন্যরকম এক অনুভূতি খুঁজে পেলাম। তারপর বাবা সবকিছু খুলে বললেন। শুনলাম- বছর পূর্বে আমি যখন বিলেতে অবস্থানরত ছিলাম, তখন টুটুল আমাকে সারপ্রাইজ দিতে না বলে মালাকে নিয়ে আমার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল। কিন্তু গিয়ে আমাকে পায়নি। বাবা-মাও বিষয়টি আমাকে