নির্বাসিতা মা

মা (মে ২০১১)

লাবণ্য কান্তা
  • ১৬
  • ৪৩
একজন সৈনিক নিজের জীবনের চেয়ে, নিজের দেশকে বেশি ভালবাসে। তাই দেশের স্বার্থে যে কোন সময়, যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে বাধ্য থাকে। তেমনই একজন সৈনিক প্রণয় সূত্রে আবদ্ব হবার পর-পরই চলে যায় তার কর্ম ক্ষেএে দূর-বহূদূর। বাড়িতে রেখে গেল তার স্ত্রী আর অনাগত সন্তান। প্রতিদিন তার স্ত্রী পথ চেয়ে থাকে, তার স্বামী ফিরে আসবে বলে। এভাবে অপেক্ষার মাঝেই তার সময় কাটতে থাকে।
দিন মাস পেরিয়ে একদিন তার সন্তানের জন্ম হলো। সে মা হয়েছে। কিন্তু বাবা তার দেশ মাতৃকার স্বার্থে দায়িত্ব পালনে এখনো ব্যস্ত। নবজাতকের মুখ দেখার প্রবল ইচ্ছে হয়তো জেগেছে বারে-বারে কিন্তু সুযোগ হয়ে উঠেনি। বাবার অনুপস্থিতে একজন মা তার সন্তানকে লালন-পালন করতে গিয়ে খুব কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে। ঠিক তেমনই এক কঠিন সময়ে সৈ্নিকের মৃতদেহ এসে পৌঁছলো। নিজের সন্তানের মুখ দেখার সৌভাগ্য হয়নি সেই সৈনিকের। শুরু হল আরো এক যন্ত্রণা পূর্ণ জীবন তার স্ত্রীর।
সৈনিকের জীবনাবসানের সাথে-সাথে তার স্ত্রীর উপর নেমে আসে অমানবিক অত্যাচার।পরিবারের সবাই তাকে যত্র-তত্র খাটিয়ে নিতে পারে। যখন তখন গাল মন্দ করে। কখনো খেতে পায় ,কখনো পায়না। কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা তার জানা নেই। প্রথমে সে তার স্বামীর বিচ্ছেদে পাথর হয়ে গিয়েছিল; তারপর স্বামীর মৃত্যূ এবং তার শবদেহ তাকে আরো পাথর বানিয়ে দিল। মৃত সৈ্নিকের পরিবারের সদস্যদের অত্যাচার সহ্য করে কিছুদিন সে সেখানে থাকতে পেরেছিল; কিন্তু খুব বেশিদিন থাকতে পারেনি। সে তার পুত্র সন্তান কে নিয়ে চলে যায় বাবার বাড়িতে।
বাবার বাড়িতেও ভাল থাকা হলোনা। তার সন্তান আর সে সেখানেও বোঝা হয়ে গেলো। তাই বাবার বাড়ি তাকে ছেড়ে যেতে হলো। একদিন রাতের আঁধারে সে তার ছোট্ট শিশুটিকে নিয়ে কাউকে কিছু না বলে অজানার পথে পা বাড়ায়। সে তার শিশুটির অনাগত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে,দূরে–বহূদূরে চলে যাবে। যেখানে তাকে কেউ চিনবে না; সেখানে সে তার আশ্রয় খুঁজবে। তাই সে স্টেশনের দিকে রওনা হয়; এবং একটি লোকাল ট্রেনে তড়ি-ঘড়ি করে উঠে পড়ে। ট্রেন ছেড়ে দেবার পর সে দু’দিকের দৃশ্যের সাথে কথা বলে আর চোখের জলে ভেসে যেতে থাকে। কখনো কখনো তার নিষ্পাপ সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে-চেয়ে কাঁদে। সে কোথায় যাবে? জানেনা, তবুও যাচ্ছে। তাকে যেতে হবে।
তাকে অবিরাম কাঁদতে দেখে ট্রেনে এক ভদ্রলোক জানতে চাইলেন ,তুমি কাঁদছো কেন?
কোথায় যাবে?
কিন্ত সে কোন উত্তর দিতে পারেনি। কারন সে কোথায় যাবে,তা নিজেও জানেনা; কি উত্তর দেবে!
কিছুক্ষণ পর ভদ্রলোক আবার বললেন,” তুমি কোথায় যাবে?”
আমি তো সামনে নেমে যাব। কিন্তু তোমাকে এভাবে অসহায় অবস্থায় রেখে যেতে পারবো না। তুমি কোথায় যাবে বলো? ভদ্রলোকের অনেক পিড়া-পিড়ীতে সে বলেছে ,”আমি কোথায় যাবো জানিনা। তবে আমার একটা আশ্রয় দরকার। এই ছোট্ট কোলের শিশুটি ছাড়া আর এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই।“
ভদ্রলোক শিক্ষক ছিলেন। তাই তার এরকম অসহায়তার কথা শুনে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবার কথা বললেন। তিনি বললেন,তোমার কোথাও যাবার জায়গা নেই,তাহলে চল আমার বাড়িতে।“
তাঁর কথা শুনে, সে নিজের কোলের শিশুটির মুখের দিকে চেয়ে বললো, যাবো; আমি আপনার বাড়িতেই যাবো। পরের স্টেশনে ভদ্রলোক সেই অসহায়া কে নিয়ে নেমে গেলেন। বাড়িতে গিয়ে তার সব বৃত্তান্ত শুনে ,তার বাড়ির পাশে একটি ছোট্ট ঘর তুলে দিলেন। তার থাকার ব্যবস্থা করে একটি ছোট কাজ যোগাড় করে দিলেন।যাতে সে তার সন্তান কে নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে।
এভাবেই তার অসহায়তার কিছুটা অবসান হলো। অনেক কষ্ট করে সে তার সন্তান কে লালন-পালন করে বড় করে তুলে। শিক্ষক ভদ্রলোকের সহযোগীতায় তার সন্তানের কিছু লেখা-পড়ার ব্যবস্থা হয়েছে। মা নিজে না খেয়ে সন্তানের খাবার ব্যবস্থা করে। সে তার ছেলের নাম রেখেছে কিরণ। কিরণ আস্তে-আস্তে বড় হতে থাকে। মায়ের মনে কিছুটা আশার সঞ্চার হলো। তার সন্তান বড় হয়ে তাকে সুখে-শান্তিতে রাখবে। এরকম আরো অনেক স্বপ্ন দেখতে শুরু করে কিরণের মা।
এক সময় কিরণ যুবক হয়, নিজেকে বুঝতে শিখে। কিরণের আলোতে আলোকিত হতে চায় মায়ের মন। তার মায়ের জীবন জুড়েই আঁধার। আঁধারে পথ চলে-চলেই সে কিরণকে যুবক করে তুলেছে। এখন কিরণ আয়-রোজগার করতে শিখেছে। কিরণের মায়ের শারিরীক অসুস্থতা দেখা দিলে, মা কিরণের বিয়ের তাগিদ করেন। কারণ তার মা আর ঘর- সংসারের কাজ কর্ম করতে পারছেন না। চোখের জ্যোতিও ক্ষীণ হয়ে আসছে। তিনি কিরণের বিয়ে করিয়ে ঘরে বউ আনার ব্যবস্থা করেন।
ঘরে বউ এলো,কিন্তু কিরণের মায়ের জীবনের আঁধার দূর হলোনা। কিরণের স্ত্রী কিরণকে জানিয়েছে,সে তার বৃদ্বা মায়ের সেবা-যত্ন করতে পারবেনা। যদি সে তার মাকে সাথে রাখে,তাহলে তার বউ বাপের বাড়ি চলে যাবে। কিরণ তার স্ত্রীকে বলেছে, মা ব্যতীত এই সংসারে তার আর কেউ নেই। মা কে সে কোথায় রাখবে? মা তার সারা জীবন কষ্ট করেছেন। এখন এই বৃদ্ব বয়সে তাদের মায়ের সেবা করা উচিত। কিন্তু তার স্ত্রী এসব কথা শুনলেই রেগে যায়। এক সময় রাগ করে সে বাপের বাড়ি চলে যায়।
কিরণ ভারি বিপদে পড়ে যায়। না পারছে সে তার মায়ের দুঃখ-কষ্টের অবসান ঘটাতে, না পারছে তার স্ত্রীর মন কে বুঝাতে। এমনই অবস্থায় পড়ে সে তার মা কে বলে-----মা তুমি বলো আমার কি করা উচিত?
আমি কি করবো?
কিরণের মা বললেন,”বাবা তুই না হয় আমাকে অন্য কোথাও রেখে আয়। আমি থাকলে তোর জীবনে শান্তি আসবেনা। তোর সুখের সংসারে আমি অশান্তি হতে চাইনা বাবা।“
কিরণ বলে মা আমি তোমাকে কোথায় রেখে আসবো মা ? মা বলেন,”বাবা,তুই আমাকে বৃদ্বাশ্রমে রেখে আয়। তাহলে আর তোর সংসারে অশান্তি হবেনা।“ মায়ের কথা শুনে কিরণ ঠিক করলো ,মাকে বৃদ্বাশ্রমে রেখে আসলেই ভালো হবে। এতে তার স্ত্রীর আর বাড়তি ঝামেলা পোহাতে হবেনা।
কিরণ মাকে বৃদ্বাশ্রমে রেখে আসে। স্ত্রীকে নিয়ে সুখের সংসারে মগ্ন হয়। মাঝে-মাঝে মন চাইলে মাকে দেখতে যায়, না চাইলে যায়না। মা বৃদ্বাশ্রমে বসে-বসে সদা তার সন্তান কিরণের মঙ্গল কামনা করে যাচ্ছেন। মা প্রতিদিন প্রার্থনা করেন, কিরণের যেন প্রথম সন্তান পুত্র হয়। তার মায়ের এই কামনায় সত্যি-সত্যি একদিন কিরণের ঘরে পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। কিরণ তার মাকে এই সংবাদ দিতে গিয়েও দিতে পারেনি। সংসারের বিভিন্ন কাজের ঝামেলায় পড়ে মায়ের কথা সে ভুলেই গিয়েছিলো। আর যাওয়া হলোনা তার মায়ের কাছে। মা অপেক্ষা করে-করে সময়ের স্রোতে ভেসে যায়-----হয়তো কাল কিরণ আসবে। কিন্তু কিরণের আর সময় হয়নি। কিরণের মায়ের চোখের জ্যোতি ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে, মা তার সন্তানকে দৃষ্টি জুড়ে দেখতে চান।কিন্তু সন্তানের সময় হয়ে উঠেনি।
হঠাৎ একদিন ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়। দু’দিন যাবত ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। কিরণ বাড়ি নেই,বাইরে গেছে। সারাদিনেও বৃষ্টি আর ঝড়ের তান্ডব শেষ হবার নেই। ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে গভীর রাতে কিরণ বাড়ি ফিরে আসে। কিরণ এসে দেখে তার সন্তানের প্রচন্ড জ্বর উঠেছে। তার স্ত্রী তার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কাঁদছে। পরনে তার শাড়িটুকুও নেই। অবিরাম বৃষ্টির কারনে তার সন্তানের কাপড়-চোপড় শুকাতে পারেনি। তাই নিজের শাড়িতে সন্তানকে জড়িয়ে রেখেছে।
এসব দেখে,কিরণের তার মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো। কিরণ ভাবছে,-------আজ তার স্ত্রী যেভাবে নিজের সন্তানকে বুকে জড়িয়ে সারা রাত কাঁদছে, কোন একদিন তার মাও এভাবেই তাকেও নিয়ে বুকে জড়িয়ে কেঁদেছেন,কষ্ট করেছেন কিন্তু সে যে আজ নিজের সুখের জন্য মাকে বৃদ্বাশ্রমে দূরে রেখে এসেছে। মায়ের জন্য তার মন কেঁদে উঠল। সে তখনই ওই গভীর রাতে মাকে নিয়ে আসবে। দরজা খুলে ঘর থেকে বের হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কিরন। বৃষ্টি থামলেই, সে মায়ের কাছে যাবে। এখনি মাকে নিয়ে আসবে।আর মাকে বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে দেবে না। বাড়িতে এনে মায়ের সেবা যত্ন করবে, মায়ের কাছে ক্ষমা চাইবে।
বৃষ্টি থামেনি। সারারাত অপেক্ষা করেছে কিরণ মায়ের কাছে যাবার জন্য। কিন্তু প্রকৃতি তার সাথে বিরূপ আচরণ করেছে। প্রকৃতির জালে জড়িয়ে থেকে সারারাত কেটে গেলো কিরনের। সকালে বৃষ্টি থামার পর কিরণ মায়ের কাছে ছুটে যায়। মা- মা বলে চিৎকার করে যখন মায়ের কাছে গিয়ে পৌঁছলো, তখন মায়ের দেহটি নিথর হয়ে পড়ে আছে। কাল সারারাত কিরণের মা, কিরণকে ডেকে ডেকে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। কিরণের নাম ধরে ডেকেই ডেকেই সেই বৃদ্ধাশ্রমে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Akther Hossain (আকাশ) আপু তোমার আরো লেখা চাই
বিন আরফান. শুরুতে মনে হলো আমার জীবন কাহিনী লিখছেন. তাই মনোযোগ সহকারে পাঠ করলাম. শেষের অনুভূতিটা বুঝানো সম্ভব নয়. মনে রাখা মত একটি গল্প. আমিও সৈনিক দেশ প্রেমিক কি না জানিনা, তবে দেশদ্রোহীদের ঘৃনা করি. আর লেখালেখি সেই ঘৃণার বহির্প্রকাশ. ধীরে ধীরে চিনতে পারবেন আমি কি তথ্যে লিখি. স্বাধীন দেশে পরাধীন নাগরিকের জীবনে যা দেখলাম একদিন প্রকাশের আশা রাখি. অনেক ধন্যবাদ. শুভ কামনা রইল.
শিশির সিক্ত পল্লব আপু...গল্পটার কাহিনী অসাধারণ...আরেকটু গুছিয়ে লিখতে পারতে...তবে যাহোক আমার ভাল লেগেছে...তোমাকে সর্বোচ্চটাই দিব
আবু সাঈদ মোল্লা এদেশের অনেক কুলবধুকে তার স্বামীর পথ চেয়ে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিতে হয় । তাদের কেউ কেউত্যাগ,ধৈর্য, সংযম আর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে নিজেকে সাফল্যের কাতারে দাড় করায় । কেউ আবার পা বাড়ায় নারকীয় অন্ধকারে । আপনার গল্পটি ভালো লাগলো ।
শাহ্‌নাজ আক্তার হায়রে বৃদ্ধাশ্রম, হায়রে মা , হতভাগা সন্তান ................বুকটা আমার ভেঙ্গে যায়
sakil ভালো লেগেছে . আরো ভালো লিখতে হবে .
এস, এম, ফজলুল হাসান একজন সৈনিক নিজের জীবনের চেয়ে, নিজের দেশকে বেশি ভালবাসে, একজন সৈনিকের বউ সংগ্রাম করে তার আত্মমর্যাদা বাচাতে , একজন সৈনিকের ছেলে সংগ্রাম করে মানুষের মত মানুষ হতে ----- গল্পটা ভালো হয়েছে , ধন্যবাদ আপনাকে

০৫ মার্চ - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪