বিয়ে বাড়ির বিরাট আয়োজন। ঘরে বাইরে অসংখ্য লোকের ভীড়। ছোট্ট ছেলেটা খাটের উপর ওর মায়ের কোলে বসেছিল। চোখ পিট পিট করে চারিদিকের লোক দেখতে দেখতে হঠাৎ ওর চোখ পড়ে টেবিলের উপর। সেখানে পাত্রে রাখা লাল লাল আপেল দেখে সে মাকে জীজ্ঞাসা করে,
*মা ওই গুলো কি?
মা তার জানে যে এখন তিনি যদি বলেন ঐগুলো খাওয়ার জিনিস তাহলে ছেলেটা খেতে চাইবে। আর তিনি যখন ছেলেটাকে দিতে পারবেন না তখন নিশ্চয় ছেলেটা কান্নাকাটি শুরু করবে। এত লোকের মধ্যে বিষয়টা লজ্জ্বাজনক হয়ে দাড়াবে চিন্তা করেই তিনি মিথ্যা বললেন ছেলের সাথে,
*বাবা, ওগুলো খেলনা।
অবুঝ শিশুটি মায়ের কথাকে বিশ্বাস করে যে ওগুলো খেলনা। কিন্তু সে এতটুকু বুঝতে পারে এগুলো খাওয়ারই কিছু। তাইতো সে বাইনা ধরে,
*আমি খেলনা খাব, মা আমি খেলনা খাব।
*শুধু খাব খাব, চুপ। খেলনা কি খাওয়া যায়? মা ছেলেকে তাড়া দেয়।
মায়ের তাড়া খেয়ে ছেলেটি চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। মায়ের ধারনাই সত্যি হয়। কি কান্নাই না কাঁদছে ছেলেটা। এত লোকের মধ্যে ছেলেটাকে কোন ভাবেই থামাতে পারছেন না তিনি। অবশেষে ছেলেটার মামা এসে একটা আপেল তুলে দেয় ছেলেটির হাতে। পাশে ছিল ছেলেটার মামী।
*কি করছ তুমি, কি করছ কি। আপেল গুলো নষ্ট করোনা।
* একটা আপেলের জন্য খুব বেশি সমস্যা হবেনা। একথা বলে ছেলেটার মামা চলে যায়।
ছেলেটার মামী মনে মনে অসন্তোষ হয়। কোথা থেকে যে এসব উটকো ঝামেলা জোটে। যাহোক নিজের মেয়ের বিয়ে। এসব নিয়ে চিন্তা করার এখন সময় না। তিনি চলে যান কাজে। এদিকে ছোট্ট ছেলেটি টুক টুক করে আপেলটি খেতে লাগে। কি নিষ্পাপ অবুঝ একটা ছেলে। কে কি বলছে তাতে তার কান নাই, বোঝেও না কিছুই। আপেলটা পেয়ে সে ভীষন খুশী। টুক টুক করে খেয়েই চলেছে। ছেলেটার মা ওকে খাটের উপর বসিয়ে বাইরে যায়। এমন সময় একজন বয়স্ক মহিলা বলে ওঠেন,
*দেখেছ যে দিপ্তীর এক সময় কত দেমাগ ছিল। এখন তার কি অবস্থা।
*আসলে ওর বাবাই ওর কপাল পুড়িয়েছে। পাশের থেকে আর একজন মহিলা বলে ওঠেন।
কিছু সময় পরই দিপ্তী ফিরে আসে। তাকিয়ে দেখেন তার ছেলেটা এখনও চুপটি করে বসে আপেলটা খেয়ে চলেছে। খাটের উপর উঠে তিনি ছেলেকে কোলে তুলে নেন। মায়ের কোলে বসেই ছেলেটা এবার আপেল খেতে লাগে।
ধুম ধামের সাথে ছেলেটার মামার মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পরের দিন ছেলেটাকে নিয়ে ওর মা বাড়িতে ফেরার জন্য গুছিয়ে নিচ্ছে সকাল সকাল। শহর থেকে ওদের বাড়ি অনেক দূর। অজ পাড়া গা। যাওয়ার জন্য ভাল সুব্যবস্থা নেই। যেতে যেতে প্রায় স্বন্ধ্যা হয়ে যাবে। একারনেই তিনি সকাল সকাল গুছিয়ে নিচ্ছেন। এমন সময় ছেলেটার মামী ওর মাকে ডাক দেয়।
*দিপ্তী, এদিকে একটু শোন তো।
বৌদির ডাকে ছেলেটির মা এগিয়ে গেলে ওর মামী তিন চারটি পুরান শাড়ি ওর মায়ের হাতে দিয়ে বলেন
*এগুলো আমি বেশিদিন পরিনি। প্রায় নতুনই আছে। তুমি এগুলো নিয়ে যাও। অনেক দিন পরতে পারবা।
*আচ্ছা বৌদি।
দিপ্তী শাড়িগুলো ব্যাগে ভরে রওনা হয়। চোখ তার জলে ছল ছল। কত শ খানেক নতুন শাড়ি পেয়েছে ওরা বিয়েতে। তার থেকে কি একটা শাড়িই দেওয়া গেল না।
দিপ্তী বাড়িতে এসে শাড়ি গুলো বের করে অনেক অনেক কাঁদেন। তার স্বামী সবকিছু শুনে তো রেগে অগ্নীশর্মা। দিপ্তীর উপর রেগে গিয়ে তিনি বকা ঝকা শুরু করেন।
*কেন এ শাড়িগুলো এনেছ। মুখের উপর ছুড়ে মারতে পারনি।
বোবা মুখে যেন কথা ফোটে দিপ্তীর। তুমি কোন কথা বলবা না। একটা নতুন শাড়ি কিনে দেবার যার মুরোদ নেই। সে আবার লম্বা কথা বলে কিভাবে। স্ত্রীর মুখে এমন কথা শুনে যেন অপমান বোধ করলেন তার স্বামী। আর কোন কথা না বলে ঘরের বাইরে চলে এলেন তিনি। তারপর হন হন করে চলে গেলেন রাস্তার দিকে। দিপ্তী কাঁদতে থাকেন। ছোট ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদেন তিনি। ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, বাবা তোকে বড় হতে হবে, অনেক বড়। যেদিন তুই আমাকে নতুন শাড়ি কিনে দিতে পারবি। আর আমি ওদের মুখের উপর আমার পুরান শাড়িগুলো ছুড়ে মারতে পারব। ছোট্ট ছেলেটা ওর মায়ের মুখের দিকে তাকায়। মায়ের কাঁন্না দেখে সেও কেঁদে ওঠে।
এই যে ছোট্ট ছেলেটার কথা বললাম। সে ছেলেটা এখন অনেক বড় হয়েছে। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির গন্ডি পেরিয়ে এখন আমি একটি সরকারী ব্যাংকের জুনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মরত। আমার নাম স্মরন মিত্র। শহরে একটি ভাড়া বাসায় থাকি। আমার চাকরির বয়স খুব বেশি না। ভার্সিটি থেকে পাশ করার পর পরই ভাগ্য ভাল চাকরিটা পেয়ে যাই। প্রায় আট নয় মাস হল আমি চাকরিটা করছি। মন থেকে যদিও ভাল লাগে না। কিন্তু বিসিএস বা অন্য কোন ভাল চাকরি না পওয়া পর্যন্ত এটাই আমাকে করতে হবে।
অনেকদিনই বাড়িতে যাইনি। বাড়িতে যেতে ইচ্ছা করে না। বাবা, মা যদিও ফোন করে মাঝে মাঝে বাড়িতে যেতে বলে। কিন্তু আমি বলি যে আমার সময় নেই। কেননা বাড়ি আমার একদম ভাল লাগেনা। সেই ছোটবেলা থেকেই অভাব অনটনের মধ্যে বড় হয়েছি। দারিদ্রতা কি সেটা আমি অনেক ভাল করেই জানি। তাই সব সময় দারিদ্রতা বা অভাব অনটন থেকে নিজেকে দুরে সরিয়ে রাখতে চাই। কিন্তু বাড়িতে গেলেই যেন মনে হয় দারিদ্রতা আমাকে জাপটে ধরেছে। তাছাড়া বাবার নামে মায়ের অভিযোগ আর মায়ের নামে বাবার অভিযোগ একদম অসহ্য লাগে। মনে হয় যেন নরকে এসেছি।
মা বাবার উপর আমার মনে মনে একটু বিশেষ রাগও আছে। কেননা আমার মা বাবা দুজনেই শিক্ষিত। সেই অনেক আগের বিএ পাশ দুজনেই। কিন্তু এই শিক্ষার উপযুক্ত ব্যবহার তারা করেননি। যার কারনে দারিদ্রতা কখনো আমাদের পিছু ছাড়েনি। আসলে আমার বাবাটা ছিলেন খুবই অলস প্রকৃতির। শুধুমাত্র ভাল শিক্ষিত এবং সুদর্শন হওয়ায় আমার মায়ের বাবা মাকে বাবার সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। আমার দাদু জানতেন যে বাবার নিজেস্ব কোন সম্পত্তি বা টাকা পয়সা কিছুই নাই। কিন্তু তিনি বাবার সাথে মাকে বিয়ে দিয়েছিলেন এই ভেবে যে, যেহেতু আমার বাবা একজন শিক্ষিত ছেলে। নিশ্চয় ভাল কিছু করতে পারবেন। কিন্তু বাবার অলসতা বাবাকে কিছুই করতে দেয়নি কোনদিন। প্রথম জীবনে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় ঢুকলেও বেতন বেশি নয় এই অজুহাতে ছেড়ে দেন তিনি। আসলে ঘুম ভেঙে ঠিক টাইমে স্কুলে যাওয়াটাকে সমস্যা মনে করেই চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। এদিকে আমার মা প্রাইমারী স্কুলে চাকরি পেলেও বাবা তাকে চাকরিটা করতে দিয়েছিলেন না। ঘরের বউকে বাইরে গিয়ে চাকরি করার কোন দরকার নেই এমনই যুক্তি ছিল তার। পরবর্তীতে ব্যবসা করার জন্য বাবা শহরে যান। সেখানে পাটের ব্যবসায় অনেক টাকা লোকসান করে ঋনগ্রস্ত হয়ে বাড়িতে চলে আসেন। তারপর থেকে আমাদের পরিবারে দারিদ্রতার সূত্রপাত।
আমি দেখেছি মা অনেক বড় ঘরের সন্তান হওয়া স্বত্তেও পরবর্তীতে কি ধরনের জীবন অতিবাহিত করতেন। পুরো সংসারের দায়িত্ব যেন তার উপর ছিল। গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে যে কয়টা টাকা পেতেন তার সবটাই ঢালতেন সংসারের পিছনে। বাবা ছোট্ট একটা বইয়ের দোকান যদিও বাজারে দিয়েছিলেন কিন্তু সে দোকানে যে তিনি কতটুকু সময় বসতেন তা হয়তো নিজেও সঠিক করে জানতেন না। অধিকাংশ সময়ই হয়তো রাজনীতি করে, নয়তো ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতেন তিনি।
আমি মা বাবাকে খুব বেশি পছন্দ করিনা। বিশেষত এই কারনে যে কলেজ লাইফ শেষ করে যখন আমি শহরে ভার্সিটি লাইফে আসি। তখন তারা বলেছিলেন, তোমাকে মানুষ করার মত যতটুকু সামর্থ্য ছিল ততটুকু করেছি। এখন নিজে চলার মত হয়েছো। সুতরাং নিজে চরে খাও। আমিতো অবাক হয়েছিলাম। তারপরও প্রথম প্রথম যখন টাকা দরকার হত ছুটে যেতাম বাড়িতে। টাকাতো জুটতই না। উল্টো বকা ঝকা খেয়ে চলে আসতে হত। এরপর থেকে বাধ্য হয়ে টিউশনি শুরু করি। টিউশনির পেছনে ছুটতে গিয়ে কখনো ভাল রেজাল্ট করতে পারেনি ভার্সিটি লাইফে। আমি দেখেছি আমার থেকে খারাপ হওয়া স্বত্তেও কত ছেলেমেয়েরা রেজাল্টে আমার উপরে উঠে গিয়েছে। আর আমি সহেছি নীরবে।
এখন আমি বিয়ে করেছি। চাকরি পাওয়ার পর পরই বিয়েটা যদিও করেছি কিন্তু মা বাবাকে এখনও বলা হয়নি। নিজে বিয়ে করাই বউ এবং নিজের পেছনেই চাকরির বেতনটা খরচ হয়ে যায়। বাসায় পাঠাতে পারিনা কিছুই। মা বাবা যদিও ফোন করে এত কথা বলে আমার সাথে কিন্তু চাকরির বেতন সম্পর্কে কখনো কিছুই বলেন না। আমিও জানি অন্ত:ত এইটুকু গুন আমার বাবার মধ্যে আছে। নিজে না খেয়ে মরে গেলেও করো কাছে কখনো হাত পাতেন না তিনি। তা সে হোক না তার ছেলে।
আমি্ও কি যে করব। যা বেতন পাই মাস শেষে থাকে না তার কানা কড়িও। শ্রেয়াকে বিয়ের পর থেকেই এই সমস্যাটা বেড়েছে। আমার ইচ্ছা ছিল না এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করার। কিন্তু ওর সমস্যার জন্যই তো ওকে বিয়ে করতে হল। আসলে শ্রেয়া ছিল আমার স্টুডেন্ট। আমি যখন ভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ারে প্রথম ভর্তি হই ও তখন নবম শ্রেণীতে পড়ত। সেই সময় থেকেই আমি ওকে পড়াতাম। মেয়েটার চেহারা আমার কাছে ভা্লই লাগত। কিন্তু কোনদিন আবেগের দৃষ্টিতে তাকাতাম না আমি ওর দিকে। দীর্ঘ দুই বছর পড়ানোর পর ওর যখন এস এস সি পরীক্ষা হয়ে গেল। তখন চলে আসার সময় আমার কেমন যেন খারাপ লাগছিল্। বুকের মধ্যে কিসের জন্য শূন্যতা কাজ করছিল তখন।
তবে আমার সেই দিনটার কথা ভুলবার নয়। সেদিন অনেক খুশী হয়েছিলাম। কেন হয়েছিলাম জানিনা। কিসের টানে হয়েছিলাম সেটাও জানিনা। যেদিন শ্রেয়ার বাবা আমাকে ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে শ্রেয়াকে আবার পড়ানোর জন্য ডেকেছিল। তখন প্রায় স্বন্ধ্যার শেষ হবে। আমি টুপটাপ বৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে শ্রেয়াদের বাসায় গেলাম। আন্টি আঙ্কেলের সাথে কথা বলে চেয়ারে বসে আছি। হঠাৎ আমার চোখ আটকে যায় সো কেজটার আয়নার দিকে। পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার কাছে দাড়িয়ে আছে শ্রেয়া। কাল একটা পোশাক পরে আছে। সাদা বরফের মত ত্বকের উপর কাল পোশাকটা চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছিল ওর। আমি অবাক ভাবে তাকিয়ে ছিলাম। কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। কি অপরূপ দেখতে হয়েছে মেয়েটা এ কদিনেই। ভরাট ঠোটে মিষ্টি হেসে আড় চোখে তাকিয়ে ছিল ও। সত্যিই যেন পরীর মত লাগছিল ওকে।
শ্র্রেয়ার সাথে আমার সম্পর্কটা হয়ে যায় খুব দ্রুতই সবার চক্ষুর অন্তরালে। শ্রেয়া যখন ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ারে তখন এক সময় বিষয়টা জানতে পারে ওর মা বাবা। আমার মত একটা ছেলের সাথে তারা তাদের একমাত্র মেয়েকে কোন ভাবেই বিয়ে দিতে রাজি নন। অবশেষে তারা মেয়ের জন্য পাত্র ঠিক করে বিয়ের ব্যাবস্থা করে। কিন্তু শ্রেয়া বাসা থেকে পালিয়ে চলে আসে আমার কাছে। শেষমেষ কোন উপায় না দেখে শ্রেয়াকে বিয়ে করতে বাধ্য হই আমি।
অনেক বড় ঘরের সন্তান শ্রেয়া। ওর দামী সব ব্যবহার সামগ্রী আর আমাদের ছোট্ট এই নব পরিবাবটিকে মেইনটেইন করতে গিয়েই বেতনের টাকা ফুরিয়ে আসে আমার। তারপরও আমি শ্রেয়ার সব চাওয়া পাওয়া পূরনের চেষ্টা করি। কেননা মনে পড়ে আমার বাবা আর মায়ের কথা। বাবা বড় ঘরের সন্তানকে বিয়ে করেছিলেন আমার মতই। কিন্তু তার যথাযথ সম্মান তিনি কখনো দেননি মাকে।
সামনে বড় পূজা। বোনাস পেয়েছি আমি। শ্রেয়াকে নিয়ে বড় পূজা উপলক্ষ্যে মার্কেটে যাই। এক শ্রেয়ার পোশাক বা অন্য জিনিস কিনতেই প্রায় অর্ধেক টাকা ফুরিয়ে আসে আমার। কিন্তু তারপরও মায়ের জন্য ভাল দেখে খুব দামী একটি শাড়ি কিনি। শাড়িটি হাতে নিয়ে মনে পড়ে যায় পুরান স্মৃতি। শেষবার বাড়ি থেকে আসার সময় মাকে যখন প্রনাম করতে গিয়েছিলাম। তখন চোখ দুটি আটকে গিয়েছিল মায়ের হাটুর নিচে। কত ছেড়াই না শাড়িটা। মাকে বলে এসেছিলাম এবার বাড়িতে আসার সময় তার জন্য ভাল দেখে শাড়ি কিনে নিয়ে আসব। কিন্তু তারপর থেকে কতদিন কেটে গেল আর বাড়িতে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। বাবার জন্যও পূজার পোশাক কিনে চলে আসি আমরা।
রুমে বসে আছি। চিন্তা করছি আগামীকাল বাড়িতে যাব। তবে শ্রেয়াকে না নিয়ে একা একাই যাব। বাড়িতে গিয়ে প্রথমে শাড়িটা মাকে দেব। মা নিশ্চয় খুশী হবেন। আর যখনই খুশী হবেন তখন মাকে ডেকে আস্তে করে মায়ের পায়ে হাত রেখে বলব, মা তুমি তোমার দুষ্টু ছেলেকে ক্ষমা করে দাও। আমি তোমাদের না জানিয়েই বিয়ে করে ফেলেছি। মা আমার কথা শুনে নিশ্চয় প্রথমে অভিমান করবেন। তবে পরে ঠিকই বুকে টেনে নেবেন। নানা কথা চিন্তা করি। আরও ভাবি এবার যেহেতু বোনাস পেয়েছি। কিছু টাকা বাড়িতে বাবাকে দিয়ে আসব। বাবা অবশ্যই খুশী হবেন।
পরের দিন সকাল সাড়ে সাতটা হবে এমন সময় বাবা ফোন দিলেন। সাধারনত এমন সময় কেউ ফোন দিলে আমি ধরিনা। কিন্তু যখন দেখলাম বাবা সাথে সাথেই রিসিভ করলাম।
*হ্যালো বাবা, ভাল আছ।
*হ্যা, তুই একটু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আয় তো।
*কেন, কি হয়েছে বাবা!
*তোর মায়ের স্ট্রোক করেছে। অ্যাম্বুলেন্সে করে আমরা হাসপাতালে আনছি। তুই হাসপাতালের গেটের সামনে গিয়ে অপেক্ষা কর।
ফোনটা কেটে গেল। মুহূর্তে যেন আমার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে এল। বিশ্বাসই হলনা আমার মায়ের স্ট্রোক করেছে। ধড়ফড় করে খাটের উপর উঠে বসি। অবাক হয়ে শ্রেয়া আমার দিকে তাকায়। আমি ওর জীজ্ঞাসু চোখের কোন উত্তর না দিয়ে তড়িঘড়ি জামাপ্যান্ট পরে চলে আসি বাইরে।
হাসপাতালের গেটের সামনে এসে দাড়াই। কিছুসময় পরই অ্যাম্বুলেন্স চলে আসে। আমি অ্যাম্বুলেন্সের দরজা খুলে মায়ের দিকে তাকাই। দেখি মাকে শোয়ান অবস্থায় রাখা হয়েছে। মায়ের চোখের দৃষ্টিটা আমার দিকে। যেন কিছু বলতে চায়। আমি অ্যাম্বুলেন্সের ভিতরে এসে মায়ের মুখের কাছে মুখ নিয়ে মা মা বলে ডাকি। মায়ের অশ্রুসজল চোখ। কথা বলতে পারে না। শুধু বা হাত দিয়ে নিজের মুখটা বার বার চাপতে থাকেন। আমি খেয়াল করি মায়ের মুখটা যেন একটু বেকে বেকে যাচ্ছে। কথা বলতে পারছেন না। ডান হাত ডান পা সম্পূর্ন অবশ। এমন অবস্থা দেখে খুবই কান্না পায় আমার। আমি ডুকরে কেদে উঠি। আমাকে দুই তিন জন ধরে টেনে বের করে নিয়ে এসে বাইরে বসিয়ে দেয়।
রাত দুইটা দশ মিনিটে মা আমাকে ছেড়ে চলে যায়। যে শাড়িটা আমি মায়ের জন্য কিনেছিলাম সেটা তার গায়ে জড়িয়েই শ্মশান ঘাটে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমি আমার মাকে আর দেখিনি। সবাই বলে চিতার কালো ধোয়া যখন কুন্ডলী পাকিয়ে উড়ে যায়। সেই ধোয়ার মধ্যে রথে বসে নাকি মৃত ব্যক্তি স্বর্গে চলে যায়। আমি খুজেছি সেই ধোয়ার কুন্ডলীর মাঝে আমার মাকে। কিন্তু পায়নি। কোথাও পায়নি আমার মাকে। মা তুমি যেখানেই থাক, ভাল থেক।
০৩ মার্চ - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১৪ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪