ক্রিং ক্রিং ক্রিং............। মাথার কাছে টেবিল ঘড়ির অ্যালার্ম বেজেই চলছে । কিন্তু বকুলির ঘুম ভাঙ্গার কোন লক্ষণ নেই । তার সাবকনশাস মাইন্ডে তখন একটাই শব্দ অনবরত বাজছে । তা হল ট্রেনের হুইসেলের । বকুলি ট্রেনের জানালা দিয়ে সম্পূর্ণ মাথাটা বের করে রেখেছে । দুরন্ত বাতাসে মুখে ঝাপটা দিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে । তার কিশোরী মনেও চুলের মত ঝড় বইছে । কখন সে তার প্রিয় নদীটির পাশে যাবে, সেখানকার ছোট ছোট ব্যাঙগুলোকে হাতের মুঠোয় নিবে । তার পাশে বসা বাবাকে সে ধাক্কা দেয়, “বাজান, বাজান” ।
“এই বকুলি, এই বকুলি, ওঠ । সাতটা বাজতে গেল । নাস্তা বানাতে হবে না ?”
বকুলির গায়ে সজোরে ধাক্কা দেয় সামিয়া । বকুলির এই এক সমস্যা । সে কিছুতেই সকালে সময় মত উঠতে চায় না । অথচ, প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে ছটার অ্যালার্ম দিয়ে রাখে ঠিকই ।
ভাঙা স্বপ্ন থেকে বাস্তবে ফিরতেই বকুলি চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসে । প্রতিদিনের মত হারিয়ে যায় সে ট্রেন, হুইসেল আর তার বাবা । বাস্তবতায় দেখা যায় সামনে বিরক্ত সামিয়া দাঁড়িয়ে ।
“বকুলি, তোর কি হয় রে ? প্রতিদিন যদি আমাকেই ডাকতে হয়, তাহলে আর অ্যালার্ম দেবার দরকারটা কোথায় ? যা, আর বসে থাকিস নে, গিয়ে নাস্তা বানা । তোর খালুর অফিসে যেতে দেরি হয়ে যাবে ।”
বকুলি তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে ঢুকে যায় । লেগে পড়ে তার প্রতিদিনকার রুটিন কাজে । অভ্যাসমত রুটি বেলতে থাকে আর সকালের স্বপ্নের কথা ভাবতে থাকে । প্রায় প্রতিদিন সে এই স্বপ্নটাই দেখে । ট্রেনে করে ময়মনসিংহ যাচ্ছে । তার মাথা জানালার বাইরে । ট্রেনের হুইসেল বাজছে ।
বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে তার ।
প্রায় ছয় মাস হল এ বাসায় এসেছে বকুলি । আগে কয়েক বাসায় কাজ করেছে । কিন্তু কোথাও তিন মাসের বেশি থাকতে পারেনি । এসব মানুষের কাছাকাছি থেকে এই বয়সেই বকুলির বেশ অভিজ্ঞতা হয়েছে বেশিরভাগ বাসাতেই মানুষ কাজের লোক দের মানুষ বলে গন্য করে না । সারাদিন একের পর এক কাজ দিয়ে রাখে । খাওয়ার সময় বাসি পচা খাবারগুলো খেতে দেয় । বাসার মালিকের চড় থাপ্পড় তো রয়েছেই । বাচ্চাগুলো আরও বিচ্ছু, কখনো লাঠি দিয়ে বাড়ি দেয়, কখনো চুল ধরে ঝুলে পড়ে । রান্না ঘর আর বারান্দা ছাড়া কোথাও যাবার স্বাধীনতা ছিল না এসব বাসায় । এসমস্ত কারণে কোন বাসাতেই বকুলির মন টিকত না । ফলে কদিন পর পরই বাসা বদল । তবে এখানে এসে বকুলি বুঝেছে যে পৃথিবীর সব মানুষ সমান না ।
সামিয়া একটা সরকারী কলেজের শিক্ষক। সরকারী চাকুরে স্বামী ফরহাদ আর ছেলে বছরের ছেলে রাতুল কে নিয়ে তার সংসার । অত্যন্ত মায়াবতী একজন মানুষ সামিয়া । তার বাসায় কখনো কারো অনাদর ঘটে না । সে কাজের মানুষই হোক না কেন । অন্য বাসায় থাকতে বকুলির যে কষ্ট গুলো ছিল এখানে আসার পর সেটা দূর হয়েছে ।
বকুলির বয়স বার তের বছর হবে । তবে এই বয়সের অন্য মেয়েদের থেকে সে একটু আলাদা । ধীরস্থির কিসের এক ভাবনায় ডুবে থাকে । বাসার সবাই যখন বাইরে চলে যায় তখন কাজ সেরে সে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে দুরের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে । তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক পানি থই থই করা নদী । তার পাশে ছোট একটা গোরস্থান । নদীর পাশে বিশাল বিশাল গাছ । গাছের ছায়ায় সমবয়সী মেয়েদের সাথে দৌড়াদৌড়ি । তারপর ক্লান্ত হয়ে ব্রহ্মপুত্রে ঝাঁপিয়ে পড়া । ভাবতে ভাবতে বকুলির কিশোরী মন উদাস হয়ে পড়ে । ঢাকা শহরে চারদিকে খালি ইট আর ইট । এই ইটের তৈরি ছোট্ট একটা বাসায় বন্দি জীবন কাটায় বকুলি । পাখিরাও বাসা বাঁধে ঘুলঘুলিতে । কিন্তু তারাও তো উড়ে বেড়ায় । বকুলির সে সুযোগ ও নেই ।
বকুলির বাবার কথা মনে হয় । কতদিন বাবার হাত ধরে নদীর সামনে দাঁড়িয়ে কত প্রশ্ন করেছে, “বাজান! ইতা বড় নদী আর দেখছ ? বাজান, আমারে একটু নৌকা চড়াইবা ?”
“ধুর বেডি, এখন গোছল করবার আইছস, গোছল কর ।”
“না বাজান, আমি নৌকায় চড়মুই ।”
“আইচ্চা মা ,চড়িস, কিন্তু অহন না । বিকালে । অহন গোছল কর । নাইলে তোর মা বেজার হইব ।”
বিকালে বকুলি আবার বাবার হাত ধরে নদীর ধারে যায় । নৌকায় চড়ে নদীর ওপার থেকে ঘুরে আসে । বাবার কথা মনে হলেই বকুলির চোখে জল আসে ।
কল বেলের শব্দে বকুলির ভাবনায় ছেদ পড়ে ।
রাতুলকে নিয়ে ঘরে ঢুকেই হাসিমুখে সামিয়া বলে, “বকুলি, তোর বাড়ি যাবি ? ”
“বাড়িত ? অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বকুলি ।”
“হ্যা । শুক্রবার ময়মনসিংহে যাব আপার বাসায় ।”
“ওরে আল্লাহ ! তাই ? যামুনা আবার ! কি যে কন খালাম্মা ? আমি কইলাম সাত দিন থাকমু ।”
“আচ্ছা থাকিস । আমার কলেজেও ছুটি । রাতুলেরও স্কুল বন্ধ । বহুদিন আপার বাসায় যাওয়া হয় না ।”
“খালাম্মা , আপনে কইছিলেন আমাগো বাড়িত যাইবেন । হাছাই যাইবেন ?”
“তুই নিয়ে গেলে তো যাবই । মিটিমিটি হাসে সামিয়া ।”
“এইত্তা কুনো কিছু কইলেন খালাম্মা ? আইন্নে গেলে আমার আম্মায় খুশিতে ফাল পাড়ব । খারান । আমি এখনি আম্মারে কইতাছি ।”
“আরে থাক থাক । পরে বলা যাবে । তুই এখন তাড়াতাড়ি টেবিলে খাবার দে । ”
বকুলির মনে যেন পাখির ডানা ভর করে । কাজের মাঝেই সে খুশিতে আনমনা হয়ে যায় মনের আনন্দে গান করে ।
এই কিশোরীটার উপর সামিয়ার এক ধরণের মায়া তৈরি হয়েছে ।বেশি কথা বলে না যতটুকু বলে তার বেশিরভাগই ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে তার বাড়ি আর তার বাবাকে ঘিরে । তার কথা শুনলে মনে হয় পৃথিবীতে বাবা একমাত্র বকুলির আছে । মাঝে মাঝে সামিয়া ঠাট্টা করে বলে, “কি রে বকুলি, তোর বাবা দেখতে কেমন ?” বকুলির চোখে যেন তারার ঝিলিক দেখা যায় । “খালাম্মা, আপনি যদি আমার বাপজানেরে দেখতাইন, তাইলে বুঝতাইন” ।‘হে ইত্তা হানি লম্বা’ বলে হাত উঁচু করে। “এক্কেরে ফর্সা ফকফকা সাহেবে গো লাহান। ”
সামিয়া বকুলির কথা শুনে হাসে । বকুলি উৎসাহ পেয়ে বাবার নানা গল্প জুড়ে দেয় । কবে তাকে চৈতালি মেলায় নিয়ে ঢোল কিনে দিয়েছে , মুড়ি মুড়কি কিনে দিয়েছে ।
সামিয়া একদিন জানতে চায়, “আচ্ছা, তোর বাবা যে তোকে একদিন ও দেখতে এল না ।” মুহূর্তেই যেন বকুলির মুখে বিষাদের কালো মেঘ ছায়া ফেলে । তার চোখে জল ছল ছল করে । বলে, “কেমনে আইব খালাম্মা ? হ্যা তো থাহে বিদ্যাশে । তয় খালাম্মা, হেইদিন আব্বা আমারে ফুন কইরা কইছে হ্যা তাত্তারি আইয়া পড়ব । আইয়া আমারে বাড়িত
লইয়া যাইব ।”
“কবে ফোন করল রে? ”
“ও, খালাম্মা, আইন্নারে তো কই নাই । দুই তিন দিন আগে আব্বায় ফুন করছিল । আইন্নে তহন কলেজে আছলাইন ।” বকুলির বাড়ি থেকে মাঝে মাঝে ফোন করে, কিন্তু,
সামিয়া বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকে বলে বাসার ল্যান্ডলাইন নাম্বারেই ফোন করে । সামিয়া ভেবে পায়না ওর বাবা বিদেশে থাকে তাহলে ও মানুষের বাসায় কাজ করছে কেন? ওর মায়ের কাছে শুনতে হবে ।
সন্ধ্যা বেলায় সামিয়ার কাছে মুখ কাচুমুচু করে এসে দাঁড়ায় বকুলি ।
“কি, কিছু বলবি ?”
“খালাম্মা একখান কথা কইতাম ।”
“বল,”
“ঈদের সময় যে বকশিশ পাইছিলাম সব টেহা আমার কাছে আছে । সাতশ টেহা । আমার বাজানের লাইগা একটা পাঞ্জাবী কিনা দিবাইন? ”
“ তোর বাজান না বিদেশ থাকে?”
“ তো কি হইছে? আইয়া পিনব ।”
“আচ্ছা দেব ।”
বকুলির চোখের আলোয় সামিয়া বালিকার যে আনন্দ দেখেছে সেটা অনেক দামি । এইটুকু মেয়ে নিজের জন্য কিছু না কিনে বাবার জন্য পাঞ্জাবী নিয়ে যাবে । সামিয়া অবাক হয় । সে বকুলিকে সাথে নিয়ে মার্কেটে যায় । কিন্তু কোন পাঞ্জাবী বকুলির পছন্দ হয় না । শেষমেশ একটা পাঞ্জাবি বকুলির খুব পছন্দ হল যার দাম ছয়শ পঞ্চাশ টাকা । সামিয়া একবার ভাবল টাকাটা সে দিয়ে দেবে কিন্তু বাবাকে দিয়ে যে আনন্দ বকুলি পাবে সেটা আর নষ্ট না করাই ভাল । পাঞ্জাবী টা বাসায় আনার পর বকুলি যে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে
কত বার দেখেছে তার ঠিক নেই । যতবার দেখে ততবার তার মুখ আলোকময় হয়ে উঠে ।
কাল বিকালে ট্রেন ! রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে সামিয়া বকুলির ব্যাগ খুলে । তার খারাপ লাগে কাজটা করতে । সামিয়া জানে বকুলি তেমন মেয়ে নয় তবুও মনে সন্দেহ রাখতে চায় না সে। সামিয়া আগে অনেক মেয়েকেই দেখেছে যে তারা এটা সেটা ব্যাগে লুকিয়ে নিয়ে যায় । জামা কাপড়, কিছু কসমেটিক, কানের দুল, চুড়ি, হার যা সামিয়াই তাকে বিভিন্ন সময় কিনে দিয়েছিল এগুলো ছাড়া ব্যাগে আর কিছু নেই । কিন্তু ব্যাগের তলায় সামিয়া ভাজ করা তিনটা কাগজ দেখতে পায় । কাগজ তিনটা খুলে দেখে বকুলির ভাঙা ভাঙা হাতে লেখা চিঠি । সামিয়া উৎসুক হয়ে ওঠে । বকুলি লিখতে পড়তে পারে । মাঝে মাঝে গল্পের বই ও পড়ে । ভুল বানানে ভরা চিঠি । তবুও সামিয়া যতটুকু বুঝে বকুলি তার বাবাকে লিখেছে,
বাজান,
আমারে ছাইড়া তুমি কেমনে আছ বাজান ? আমার এইহানে দম আটকাইয়া আহে । বাজানগো তোমারে কতদিন দেহি না । একবার আহ । আমারে বাড়িত লইয়া যাও । তোমার হাত ধইরা আমি নাও এ চড়বাম ।
বকুলি
বাবাগো,
ঢাকা শহরে খালি দালান আর দালান । এইহানে আকাশ নাই, নদী নাই, গাছ নাই । তুমি যে দ্যাশে থাহ, ওইডা কেমন ? ইচ্ছা হয় পাখি হইয়া তোমার কাছে উইড়া যাই । আমার কিছু ভাল্লাগে না । বাজান, তুমি আমারে কেমনে ভুইলা আছ ?
বকুলি
বাজান,
জানো ? আইজ আমি তোমারে লইয়া সুন্দর একটা স্বপন দেখছি । তুমি আমারে ট্রেনে কইরা ময়মনসিংহ লইয়া যাইতাছ । আমি নতুন জামা পিনছি । তুমি আমার হাত ধইরা বইয়া আছ । আমি ট্রেনের জানালার বাইরে মাথা দিয়া আছি । তুমি কইতাছ, মাগো, মাথায় বাড়ি খাইবা । তক্ষুনি আমার স্বপ্নডা ভাইঙ্গা গেল । চোখ খুইলা দেহি , তুমি নাই মার বুকটা ফাইটা যাইতাছে । কবে তোমরা দেহুম ?
বকুলি
সামিয়া চিঠিগুলো পড়ে স্থবির হয়ে বসে থাকে । তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ে । মেয়েটার বুকে যে বাবার জন্যে এত কষ্ট সে বুঝেনি । সে ঠিক করে ময়মনসিংহে গিয়ে বকুলিকে আর আনবে না । তার মনে হল বকুলিকে সে বন্দি করে রেখেছে । এটা অন্যায় ।
ট্রেন ছুটে চলেছে ময়মনসিংহের দিকে ।সাড়ে চারটার ট্রেন , ছেড়েছে সাড়ে পাঁচটায় । বাংলাদেশের ট্রেনগুলো যে কবে ঠিক সময়ে ছাড়বে !
ট্রেনে বকুলির সময় যেন কাটতেই চায় না । একটু পরপর জানতে চায়, খালাম্মা আর কতক্ষন লাগব ?
ট্রেন যখন ময়মনসিংহ স্টেশনে থামল তখন রাত প্রায় সাড়ে নয়টা । উত্তেজনায় রাতে বকুলির চোখে ঘুম নেই । ভোর না হতেই সামিয়াকে তাগাদা দিতে থাকে । খালাম্মা, আমাগো বাড়িতে কহন লইয়া যাবেন ?
সামিয়া সকাল নয়টার দিকে একটা অটোরিকশায় করে ওর বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে রওনা হয় । বিশ মিনিট যাওয়ার পর শহর ছেড়ে একটা কাঠগোলা নামক একটা বাজারে উপস্থিত হয় তারা । বড় সড়কের পাশেই সরু একটা গলি ।গলির মুখে বকুলির মা মেয়ের জন্যে আগে থেকে অপেক্ষা করছে । কিছুটা এগোলেই ছোট ছোট অনেকগুলো ঘর । ঠিক বস্তিও বলা যাবে না , আবার গ্রাম ও নয় । ফাঁকা ফাঁকা পাশাপাশি অনেকগুলো ঘর । ঘরের সামনে এক চিলতে উঠোন । কয়েকটা ঘর পার হয়েই বকুলিদের ঘর। বকুলিদের ঘর থেকে মোটামুটি পঞ্চাশ গজ দুরেই ব্রহ্মপুত্র নদী দেখা যাচ্ছে । চারদিকে গাছগাছালিতে ভরা ।
খুব ছোট ঘরটা কম বেশি আট হাত বাই দশ হাত হবে হয়ত । ঘরের এক পাশে একটি চৌকিতে বিছানা পাতা । চারদিক চাটাইয়ের বেড়া দিয়ে ঘেরা উপরে টিনের ছাওনি । চৌকির ধার ঘেঁসে দুটি লাঠির মাঝে দড়ি বেধে অদ্ভুতভাবে আলনা তৈরি করা হয়েছে । তাতে কয়েকটা কাপড় ভাঁজ করে রাখা । চাটাইয়ের গায়ে পেপার, নায়ক নায়িকার ছবি সাঁটানো । মেঝেটা মাটির তবে আজই কাদা দিয়ে লেপা হয়েছে বোঝা যায় । এই ধরণের বাড়িতে সামিয়া আজ প্রথম এসেছে । একটা জিনিস দৃষ্টি কাড়লো সেটা হল ঘরের সব কিছুই গোছালো এবং পরিস্কার ! দরজার বাইরে অন্য ঘরের মহিলারা এসে সামিয়াকে উঁকি দিয়ে দেখে যাচ্ছে । তাদের সবার উৎসুক দৃষ্টি !
বকুলির মা খাওয়াদাওয়ার তোড়জোড় শুরু করে ।
সামিয়া বাঁধা দেয় , “না না কিচ্ছু করতে হবে না । আমি মাত্রই খেয়ে এলাম । আমাকে এখনি যেতে হবে ”।
বকুলির মায়ের চোখ ভিজে ওঠে । বলে, “আফা আপনি এই গরিবের ঘরে আইছেন । আমরা কত খুশি হইছি । আপনি যদি কিছুই না খায়া যান, তাইলে আমি অনেক কষ্ট পাব ।
আইজ পরথম আপনার লাহান কুনো বড় মানুষ আমগো ঘরে আইল । এইডা যে আমার কত্ত বড় সৌভাগ্যি !আফা, দয়া কইরা না কইরেন না । গরীব মানুষ, ডাইল ভাত রানছি । খাইবাইন ।
সামিয়া আর না করতে পারল না । বিছানার উপর একটা সুন্দর কাজ করা দস্তর খানা বিছিয়ে সেখানে বাটিতে করে আলু ভাজি, ডাল, মুরগির মাংস, গরুর মাংসের শুটকির তরকারী রাখল সে ।”
“আরে, বকুলির মা, এত কিছু করেছ !”
“কই আর এত ? কি যে কোন আফা ! গরুর হুডকি বকুলির বিরাট পছন্দ । খাইয়া দেহেন ভালা লাগব ।”
সামিয়া আগে কখনো এ ধরণের খাবার খায় নাই । ভয়ে ভয়ে একটু চেখে দেখল যে আসলেই মজা । খাওয়ার সময় সামিয়ার মনে হল যে এই গরীব কুটিরের এক দরিদ্র মায়ের হাতের রান্নায় যে আন্তরিকতার প্রকাশ, উঁচু দালানের বিলাসী ডাইনিং টেবিলে সেটার বড় অভাব ।
খাওয়া শেষ হলে বকুলির মা সামিয়ার হাত ধরে কেঁদে ফেলে । বলে, “আফা আমার মাইয়াডা আইন্নের লাহান একটা ভালা বাসায় কাম পাইছে । আমার অহন কুনো চিন্তা নাই । ”
সামিয়া বলে, “আর কেঁদো না । কিন্তু, আমি যে এবার ভেবে আসলাম যে, ওকে আর নিয়ে যাব না । ও ছোট একটা মেয়ে, ওখানে ওর মন টিকে না । খালি বাবার জন্যে সবসময় মন খারাপ করে থাকে । ওর বাবা কোথায় থাকে ?”
বকুলির মা অবাক হয়ে সামিয়ার দিকে চেয়ে থাকে । সামিয়া সেদিকে খেয়াল না করে । পাঞ্জাবিটা বের করে তার হাতে দেয় ।
“এই যে দেখ, তোমার মেয়ে তার বাবার জন্যে এই পাঞ্জাবিটা খুঁজতে সারা বাজার ঘুরেছে।”
“আফা, আইন্নে এইগুলান কি কইতাছেন।” গলায় কষ্টে চাপা আর্তনাদের শব্দ ।
সামিয়া দেখে বকুলির মায়ের চোখ থেকে দরদর করে পানি পড়ছে ।
“আরে কাঁদছ কেন ? কি হয়েছে ?”
“আফা, ওই পাঞ্জাবি ক্যাডা পরব ? বকুলির বাপরে তো ও দেহে নাই । আমার প্যাডে থাকতেই তো ওর বাপে ট্রাকের নিচে পইড়া মরছে ।”
সামিয়ার মুখ থেকে কোন কথা বের হয় না । বকুলির মা মুখ ঢেকে কাঁদছে । সামিয়া ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হয়ে নদীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায় । বাবার সম্পর্কে বলা বকুলির কথাগুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে । একটু দুরেই বকুলি সমবয়সীদের সাথে হাত নেড়ে নেড়ে গল্প করছে । হয়ত বাবার গল্প ।
-০-