(এক)
গত নভেম্বরে ঢাকায় এসেছিলাম চাকুরীর সন্ধানে। এর আগের মাসের ১১ তারিখ ‘হ্যাপী’ বাড়ি চলে গিয়েছিল। খবর পেয়েছিলাম তিন মাস পর বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিতে আবার আসবে। পরীক্ষা যেহেতু শেষ, সেহেতু দুই দিন আগে, আর পরে তাকে ছাত্রী নিবাস ছেড়ে বাড়িতে যেতেই হত। হ্যাপীদের মূল বাড়ি ছিল আমাদের উপজেলার দক্ষিনের একটি উপজেলায়। সেখানে প্রবাসিদের আধিক্য ছিল চোখে পড়ার মত। জীবন-জীবিকার তাগিদে ওই এলাকার প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ বছরের পর বছর ধরে (লন্ডন)সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রয়েছেন। লোকমুখে শুনা যায়, সারা বাংলাদেশে যত সংখ্যক লন্ডনী রয়েছেন, হ্যাপীদের উপজেলা ছিল ৩য় স্থানে। ধনাঢ্য এই উপজেলাতে জন্ম নিতে পেরে, অহংকারের পাশাপাশি হ্যাপীর মনে হতাশাও ছিল!
হ্যাপী প্রায়ই বলতো,-লন্ডনী এলাকার মেয়ে বলে,-সে নাকি বিভিন্ন বিড়ম্বনার শিকার হয়। কারণ সে তো আর লন্ডনী নয়! হ্যাপীর সাথে আমার মতের অমিল থাকলেও এই একটি বিষয়ে আমরা একমত ছিলাম। হ্যাপী মনে মনে বলতো,-আল্লাহ আমাদের উপজেলায় কেন তুমি এত লন্ডনী দিলে? আমি বলতাম, আল্লাহ, আমাদের জেলায় লন্ডনী দিলেতো দিলেই, এত প্রবাসী দিলে কেন? দিন দিন আমাদের জেলায় প্রবাসীর সংখ্যা বেড়েই চলছিল।
হ্যাপী আর আমি, সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নিয়েছি। আমাদেরকে কোন প্রকার পার্সেন্টে ফেলে হিসাব করা যায় না। শুধু আমাদেরকেই কেন, আমাদের মত মধ্যবিত্ত এমন অনেক ফ্যামিলি রয়েছে। যাদেরকে বেঁচে থাকার জন্য নিরন্তর পরিশ্রম করতে হয়। অথচ উচু তলার মানুষরা মনে করেন, আমরা সুখী মানুষ।
কিন্তু আমাদের মত মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিতে সুখ যে সোনার হরিণ, তা কেউ বুঝতে চান না। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়,আমাদের মত ফ্যামিলিতে জন্ম নেয়া মানুষের জীবনে সুখ থাকতে নেই। তারা কেউ সুখী নয়, তারা কখনো সুখী ছিলনা।
চাকুরীর সন্ধানে ঢাকায় এসে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে,-আমি অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি। কর্তা-ব্যক্তিরা আমার কাছে জানতে চেয়েছেন,-আমাদের এলাকার মানুষদেরকে চাকুরী করতে হয় কেন! এরকম প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার জানা ছিল না!
কোন এলাকার ৭০% লোক প্রবাসে থাকার মানে এই নয় যে, সে এলাকার সকল মানুষই সুখী। আমরা নাকি আরামপ্রিয় মানুষ। শারিরীক পরিশ্রম নাকি আমাদের দ্বারা অসম্ভব! প্রশ্ন উঠতেই পারে, আমাদের এলাকার সকলেই কি প্রবাসী? এখানকার মানুষ কি চাকুরী করে না, ব্যবসা-বাণিজ্য করে না, চাষাবাদ করে ফসল ফলায়না? এখানকার মানুষরা কি শ্রমিকের কাজ করতে গিয়ে অভাব-অনটনের শিকার হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যায় না? গার্মের্ন্টেসে কাজ করতে গিয়ে আগুনে পুড়ে এবং পাথরের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যুবরণ করে না? দেশকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত করার পেছনে আমাদের মত সাধারণ মানুষদের কি কোন অবদান নেই? আমাদের এলাকায় যারা প্রবাসী রয়েছেন, সবই কি তাদের অবদান!
আমার মনে হয়,যত সমস্যা, যত প্রশ্ন, সব মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষদের নিয়ে। বেঁচে থাকার জন্য এ শ্রেণীর মানুষদেরকে শ্রমের সাথে সংগ্রাম করতে হয় বছরের পর বছর ধরে। তবু এ শ্রেণীর মানুষদের ভাগ্যের কোন উন্নতি ঘটে না! তবে একটা জিনিস আমাদের এলাকায় দেখা যায়, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অনেক পরিবার লন্ডনী (প্রবাসী) না হলেও ছেলে-মেয়েদেরকে প্রবাসী পাত্র-পাত্রীর নিকট পাত্রস্থ করতে মরিয়া হয়ে উঠেন! দু/একটা ব্যতিক্রম ঘটনাও ঘটে।
হ্যাপীদের এলাকার মানুষজন, আমাদের এলাকার চাইতে আরেকটু একটু ভিন্ন ছিলো। সেখানকার, অধিকাংশ বাবা-মায়েরা’ই সন্তান বড় করেন কেবলমাত্র লন্ডন প্রবাসিদের নিকট পাত্রস্থ করার আশায় এবং ছেলে-মেয়ের বয়স বিশ হবার আগেই বিয়ে দিয়ে দেন নিকটাত্মীয় কোনো লন্ডনীর সাথে। আর যারা বয়স বিশ থাকতে পারেন না, তারা ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত ওয়েট করেন। কিন্তু বেশিরভাগই সময়ই দেখা যায়, শেষ পর্যন্ত আমার মত মধ্যবিত্ত পরিবারের পাত্রও অনেকের ভাগ্যে জোটেনা।
ঢাকায় আসার পর, হ্যাপী যোগাযোগের সব মাধ্যম বন্ধ করে দিয়েছিল। যাতে আমি তার সাথে যোগাযোগ রাখতে না পারি। প্রচুর টেনশন হত আমার। কেন এবং কি কারণে হ্যাপী, এমন করল? আমি ভেবেই পাচ্ছিলাম না!
গত ৯ ডিসেম্বর হ্যাপীর সাথে শেষবার কথা হয়েছিল। কলেজে ভাইবা পরীক্ষা ছিল। শত ব্যস্ততা স্বত্তেও আমাকে বাড়ি আসতেই হয়েছিল। বাসে করে হবিগঞ্জ আসার পথে মনে হচ্ছিল ৯ ডিসেম্বরই আমার প্রেমের সমাধি হবে। অলৌকিভাবে হলও তাই!
রাত আড়াইটা নাগাদ বাড়ি ফিরে সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে গিয়েছিল। সকাল ৯টার পরীক্ষায় পৌনে ১০ টায় গিয়েছিলাম।
দশজনের পরে ছিলাম আমি। আর আমার পরে ছিল হ্যাপী। ঘুম থেকে উঠে তৈরি হতে হতে সাড়ে ৯টা বেঁজে যায় বাড়িতেই। স্যারসহ বন্ধুদের ফোন পাচ্ছিলাম একের পর এক। এরপর যতক্ষনে কলেজে গিয়ে পৌছলাম, ততক্ষনে হ্যাপী ভাইবা রোমে ঢুকে পড়েছিল। আমার দেরী হওয়াতে টি আলী স্যার তাকে ঢেকে নিয়েছিলেন।
৬/৭ মিনিট ওয়েট করতেই হল আমাকে। অপেক্ষার পর, হ্যাপী যখন রোম থেকে বেরিয়ে আসছিল, আর আমি ঢুকছিলাম, তখনই দুজনের দেখা।
হ্যাপী বলেছিল,-কেমন আছিস! এত দেরী হল কেন?
বলেছিলাম-ভাইবা’র পর থাকিস, কথা আছে।
হ্যাপী-আমি ওয়েট করব!
করেছিলও!
ভাইবা শেষে সেদিন প্রায় দুই ঘন্টা চল্লিশ মিনিট কথা হয়েছিল তার সাথে।
এরপর গত ৪ মাসে সরাসরি কোনো কথা হয়নি। ১ বার ফেসবুকে, ২ বার বাইবারে, ১ বার লাইন আপে, ১বার ট্যাংগোতে, ১বার ইমোতে, আর সবশেষ ১বার টুইটারে.....
(দুই)
ভাইবা শেষে ফের ঢাকায় ফিরে আসি। স্মৃতি বলতে ওই দিনের আলাপ, আর বিশেষ মুর্হুতে তোলা, আমাদের যুগল কয়েকটা ছবি। যে সময় নিজেকে একা মনে হয়, ফোনে থাকা ছবিগুলো দেখি এবং পুরোনো দিনে ফিরে যাই ক্ষনিকের জন্য।
মনে পড়ে একবার হ্যাপীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তার কাছে কোনটা প্রিয়, ডাল ভাত-নাকি বিরিয়ানি!
সেদিন হ্যাপী হয়ত, খানিকটা বুঝে, খানিকটা না বুঝেই উত্তর দিয়েছিল, বিরিয়ানি!
শুনে আহত হয়েছিলাম।
তার মত বুদ্ধিমতি মেয়ে,-এরকম উত্তর দিতে পারে, ভাবতেই পারিনি!
‘ডাল-ভাত’ এমন এক ধরণের খাবার। যা সব শ্রেণীর মানুষের জন্য বাধ্যতামূলক। আর বিরিয়ানি মাঝে মাঝে মানুষ খেয়ে থাকে। বড়লোকদের কথা আলাদা।
সামান্য ডাল-ভাতের জন্য মানুষ কতইনা পরিশ্রম করে, মেহনত করে। তারপরও অনেক সময় দেখা যায়,-ডাল-ভাত’ কারো ভাগ্যে জুটে আবার কারো ভাগ্যে জুটে না! তার এরকম উত্তরেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম,-‘হ্যাপী হল স্বপ্ন বিলাসী এক মেয়ে’। সব সময় আকাশে উড়ে!
ভাইবা শেষে দুজন গল্প করছিলাম, গল্প-ছলে হ্যাপী আমাকে বলেছিল;‘যেদিন আমার মাথার উপরে অন্তত সাড়ে তিন হাজার স্কয়ার বর্গ ফুটের একটি ছাদ হবে,-সেদিন যেন আমি তার সামনা-সামনি হই! তার আগে নয়!
বলেছিলাম-এটি কোন কথা হল!এতো আমার পক্ষে কঠিন কাজ।
হ্যাপী বলেছিল,-অসম্ভবতো নয়!
উত্তরে বলেছিলাম-সাড়ে তিন হাজার স্কর্য়ার ফিটের বাড়িতে তো আমি থাকি।
কাউন্টার এট্যাকে না গিয়ে, নিরবে বলেছিল,-বাড়িটাতো আর তুই তৈরি করিসনি! পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া!
তুই নিজে তৈরি করে দেখা!
সমস্যা হল,-ছাত্র থাকাবস্থায় আমি কিভাবে তৈরি করবো এত বড় বাড়ি!
বলেছিলাম-মানুষের কত ধরণের শখ হয় হ্যাপী। পছন্দের মানুষের কাছে মানুষ কত কিছুই না আবদার করে!
হ্যাপী-আমি কি কোন অযৌক্তিক আবদার করেছি?
বলেছিলাম,-তোর আহবানের যৌক্তিকতাকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়তো আমার নেই। তুই তো জানিস,-সবেমাত্র উন্নতি হচ্ছে আমাদের দেশটার। তোর আবদার মেটাতে গেলে আমাকে’তো দুই নাম্বারী কোনো পথ বেঁচে নিতে হবে!
হ্যাপী-এটা তোর সমস্যা! তবে,-আমি তা চাইনা।
তুই এমন একটা কাজ কর। যাতে করে তোর শ্রমের বিনিময়ে দেশের অর্থনৈতিক চাকা গতিশীল হয়, গতিশীল থাকে সব সময়।
নিরূপায় আমি বলেছিলাম-দেশের অর্থনৈতিক চাকা গতিশীল করতে গিয়ে যদি, তোর প্রতি আমার যে অধিকার আছে তা যদি ক্ষুন্ন হয়,তবে এর কি হবে? আমি চাইনা; তোর আবদার মেটাতে গিয়ে এমন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হউক!
ধরে নে, তোর আবদার মেটাতে গিয়ে,-আমি হবিগঞ্জ ছেড়ে ঢাকা গেলাম। সেখানে গিয়ে কেবলমাত্র চাকুরী করে এত বড় একটা বাড়ি করবো আমার কল্পনাতে আসেই না! শ্রমিকের কাজ করে, তা’ও তো অসম্ভব! চাকুরী করে, কিংবা শ্রমিকের কাজ করে বড়লোক হয়েছে এমন দু/একটা মানুষ আমাকে দেখাতে পারবি! পারবি না।
মানুষ যেভাবেই বড়লোক হউক না কেন? অন্তত কোন মানুষ চাকুরী করে, কিংবা শ্রমিকের কাজ করে বড়লোক হতে পারে না! মানুষ চাকুরী করে ভবিষ্যত নিরাপত্তার জন্য। শিল্প কারখানায় মেহনত করে বেঁচে থাকার তাগিদে।
তুই ব্যবসা করবি!
ব্যবসার ক্ষেত্রে লাভবান হওয়া কি এতই সহজ?
মানুষের জীবনটাকে তুই কি মনে করিস হ্যাপী? বাংলা সিনেমা! জীবন কোনো সিনেমা নয়!
হ্যাপী আমাকে পৃথিবীর অনেক গুনী মানুষের উদাহরণ দেখায়!
আমার সমস্যাটা একটু ভাব হ্যাপী?
আমি তোকে চাই। তোকে পেতে চাই!
নিজের আয়ে বাড়ি করতে গেলে,-কতটা দিন লাগবে, ভেবে দেখেছিস! ততদিন, তুই তো আমার জন্য বসে থাকবি না! তোর বাবা-মা’ও না!
আমার প্রতি তোর বিশ্বাস নেই!
তাছাড়া আমার নিরাপত্তা নিয়ে তোর কি কোনো ভাবনা হয় না!
তুই কি জানিস না, আমাদের এ দেশে শ্রমের মূল্য কম। রক্তের দাম কম। জীবনের দাম তার চেয়েও আরো অনেক অংশে কম!
মৃত্যুর স্বাদ কেমন হতে পারে? তুই কি একবার কল্পনা করেছিস!
খুবই সহনীয় তোর কাছে, তাই না হ্যাপী!
সাভারের রানা প্লাজার ঘটনাটা তোর মনে নেই। মৃত মানুষগুলো ও লাশের মিছিল দেখে তোর মনে কি একটুও সহানুভূতি জাগে না।
সাড়ে তিন হাজার স্কর্য়ার ফিটের বাড়ি বানাতে গেলে, কত টাকা লাগবে, ভেবে দেখেছিস! টাকা ইনকাম করতে গিয়ে, রানা প্লাজার শ্রমিকদের মত আমার জীবনটাও চলে যেতে পারে যে কোনো সময়! যখন আমার জীবনটাই থাকবে না, তখন বাড়ি বানাবো কি করে? আগেতো আমাকে বেচেঁ থাকতে হবে! এ জন্য সময়ের প্রয়োজন! তুই কি আমাকে এতটা সময় দিবি!
একটু বুঝার চেষ্টা কর হ্যাপী, আমাদের দেশে মানুষের জীবন বিক্রি হয় খুবই অল্প দামে। তাও আবার বাকীতে।
মৃত্যুর পর অনেক পরিবার জীবনের দামটাও ঠিকঠাক বুঝে পান না!
পরিকল্পনা, কিংবা কল্পনা অনুযায়ী বাস্তব জীবন চলে না রে হ্যাপী!
গরীবের জন্য, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষদের জন্য’ত আরো কঠিন পরিকল্পনা মাফিক জীবন চালানো। আমাদের মতো মানুষদেরকে স্বপ্ন দেখতে নেই! স্বপ্ন থাকতে নেই।
আমাদের মতো,-গরীব মানুষেরা সারাজীবন বড় লোকদের জীবন সাজাতেই কাজ করে যায়, নিজেদের জন্য কিছুই করতে পারে না!
তুই কি চাস হ্যাপী,-তোর আবদার পূরণ করতে গিয়ে আমি দিনের পর দিন, অনাহারে-অর্ধাহারে থেকে রানা প্লাজার শ্রমিকদের মত পাথরচাপা পড়ে মারা যাই!
আমি তাদের মত হতে চাই না! আমি হতে চাই অসাধারণ!
তোর জন্য-আমি তো নিজেকে আর লোভী বানাতে পারি না!
তার চেয়ে তুই আমাকে বল, আমি কি করে অসাধারণ হতে পারব? অসাধারণ হয়ে মানুষের কল্যাণে কাজ করবো?
নিজের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে গিয়ে মানুষের জন্য অকল্যান ডেকে আনতে পারবো না আমি! তুই তো মেয়ে মানুষ। বাড়ির ভেতরে থাকিস বেশীরভাগ সময়। সমাজের দশ পাঁচজন মানুষের সাথে উঠাবসা নেই তোর। সংসার খরচ চালানোর তাগাদা নেই। মাথার উপর কোন বোঝা নেই। সংসার খরচে কোনো ব্যায় করতে হয় না! আজগুবি স্বপ্ন, আজগুবি কল্পনা কেবল তোকেই মানায়?
তুই জানিস না-সারা মাস কাজ করে যারা, পরের মাসে মাত্র ৪/৫ হাজার টাকা দিয়ে জীবনের ব্যয় বহন করে, তাদের জীবন কেমন করে চলে!
আমি সাধারণ এক পরিবারের ছেলে! বাবা অতি সাধারণ। সামান্য টাকা দিয়েই আমাদের সংসারের ৫ জনের জীবন চালাতে হয়। তবুও বাবা বলেন, সুখে আছি।
আর কেউ না জানুক,-আমি তো জানি, এটা বাবার মনের কথা নয়। আজকালকার দিনে ঘর থেকে বের হলে পরে চা- পান, বিড়ি-সিগারেটের জন্যই’ত আমার খরচ হয়ে যাচ্ছে দৈনিক ১শ টাকা। অন্যান্য খরচতো আছেই। সংসারে আমাকে টাকাও দিতে হয় না বলে রক্ষা!
হ্যাপী জানত, আমাদের সর্ম্পকে ফাটল ধরেছে। যে কোন সময় ভেঙে পড়তে পারে! এজন্যই মনে হয়,- শর্ত জুড়ে দিয়েছে সে।
মহাখালী সুপার মার্কেট এলাকার ছাত্রবাসের রোমে আধো আধো চোখে ঘুমিয়ে যখন,-এসব ভাবি, তখন-আমার কেন জানি,ফেলে আসা হবিগঞ্জ শহরটাকে নদীর মতো মনে হয়। আর ঢাকাকে,‘বঙ্গোপসাগর’!
এমনটা মনে হতো না। হ্যাপীর একটি মাত্র সিদ্ধান্তই আমাকে বাঁচিয়ে দিতো।
(তিন)
হ্যাপীবিহীন হবিগঞ্জ শহর আমার কাছে ধূ-ধূ মরুভূমির মত মনে হত। একটা সময় ছিল, হ্যাপীকে নিয়ে কেউ কিছু বললে, আমার সহ্য হত না। এমনকি কেউ তার সাথে কথা বলুক, সেটিও না। যখন হ্যাপীকে কোন ছেলের সাথে কথা বলতে দেখতাম, আমার মনে হত, পায়ের নিচের মাটি কেন দুভাগ হয়ে যায় যায়না!
২০০৮ সাল। সবে মাত্র সম্মান ১ম বর্ষে ভর্তি হয়েছি। হ্যাপীর সাথে তখনই দেখা। সেবারই ঢাকায় ল কলেজে পড়তে চেয়েছিলাম। বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল, উকিল হবো! কিন্তু আমার স্বপ্ন ছিল,-সাংবাদিক হওয়া। আর হ্যাপীর স্বপ্ন ছিলো,-আমি যেন প্রবাসী হই। মা বলেছিলেন, টানাটানির সংসার। ঢাকায় পড়াশুনা করতে মেলা খরচ। বাবা বলেছিলেন, অর্ধেক এর বেশি তিনি দিতে পারবেন না!
শেষ পর্যন্ত আমি কিছুতেই কিছুই করে উঠতে পারলাম না!
জেলা সদরেই ভর্তি হয়েছিলাম। নামকরা সরকারি কলেজ!
ছোট বেলায় সিনেমাতে দেখতাম, ‘কর্ম খালি নাই’ লিখা থাকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। ঢাকায় আসার পর এখন বাস্তবে দেখতে হয় আমাকে।
মাঝে ভাবি, লেখালেখিটাকেই পেশা হিসেবে বেঁচে নিব। কিন্তু মনস্থির করতে পারিনা। মা বলতেন- লেখালেখি ফালতু একটা জিনিস। সময় ব্যায় হয়, কোন পয়সা আসে না।
আমি বলতাম-নাম-তো হয়!
মা বলতেন,-নাম’তো অনেকটাই হয়েছে তোমার। জেলার নামীদামী মানুষদের বেশিরভাগই তোমাকে চিনে! এভাবে দৌড়াদৌড়ি না করে, কয়েকটা টিউশনি করলেই তো পার! হাতে কয়টা পয়সা আসে!
আমার মনে হয়,-পৃথিবীর সব মা’ই আমার মায়ের মত। জ্ঞানার্জনের জন্য ইন্টারনেট ঘাটি। পৃথিবীর মা-ছেলেদের নিয়ে কিছু মূল্যবান কথাও পাই। এগুলো কতটুকু সঠিক আমি বলতে পারবোনা। দু/একটা এরকম।
যেমন-কলম্বাসের মা, তাকে প্রায়ই বলতেন,-‘বাইরে টো-টো করে ঘুরে তুমি কি আবিষ্কার করেছ, না করেছ, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। বাইরে বাইরে না ঘুরে, ঘরে বসেও’ত তুমি এটা লিখে দিতে পার।
আইনস্টাইনের মা বলতেন,-‘তুমি মানুষকে এতো এতো থিওরী দিচ্ছ রোজ, বুদ্ধি দিচ্ছ সবাইকে, অথচ তোমার মাথার চুলগুলি লম্বা-বড়, এলোমেলো যে, সোজা করার বুদ্ধিতো তোমার মাথায় দেখিনা। একটু স্টাইলিং করতে না পার, দিনে কমপক্ষে একটু তেলও তো মাথায় মাখতে পারো।
কম যাননি আমাদের রবী ঠাকুরের মা’-ও। তিনি নাকি বলতেন,-‘বাবা, জীবনভর তো গান লিখছো। লম্বা দাড়ি রাইখ্যা আমারে ফালাইয়া দেশ-দেশান্তর ঘুইরা বেড়াইছ, সেই দুঃখ না হয় চাপা দিমু। আমি না হয়, একটা দোতারা তোমারে দিতে পারি নাই, কিন্তু এত কিছু কইরাও তুমিও লালন ফকির হইতে পারলানা, হেই দুঃ রাখি কই?
আমার মনের মানুষ হ্যাপী বলতো,-নামের কারণেই নাকি আমার সাথে রিলেশনে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছিল সে।কিন্তু যখন দেখল,-শুধু নাম’ই হচ্ছে, পয়সা আসছে না, তখনই নাকি দুরে সরে যাওয়ার মনস্থির করেছে। হ্যাপী ও আমার মা,-প্রায়ই একটা কথা বলতেন, শুধু নাম হলেই হয় না, নামের পাশাপাশি টাকা-পয়সাও থাকতে হয়।
পয়সা ইনকামের জন্য কম্পিউটার চালানো শিখেছিলাম। চাকুরী করেছিলাম জেলা সদরে দুই একটা প্রতিষ্টানে। ইনকাম করেছিলাম। কিন্তু হাতে টাকা রাখতে পারি নি। আমার মা ও প্রিয়তমা হ্যাপী বলতো-আমি নাকি বে-হিসাবী!
আগেই বলেছিলাম-ছাত্রজীবনে আমি হ্যাপীর আগে ছিলাম। হ্যাপী আমার পরে। এই আগে-পিছে বসা নিয়ে হ্যাপী আমাকে ক্ষেপানোর চেষ্টা করতো।ছোট ছেলেমেয়েদের মতো প্রায়ই বলত;‘আগে থাকলে বাঘে খায়, পিছনে থাকলে টাকা পায়’!
ভাবতাম, তাহলে তো,-আমার পেছনেই থাকা উচিত। তাহলে টাকা পাওয়া যাবে! আজো পেছনেই পড়ে আছি আমি। ধন সম্পদই বলুন,-আর প্রেম-ভালবাসাই বলুন, সর্বক্ষেত্রেই আমি পেছনে! যতই সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া চেষ্টা করি, এগিয়ে যাওয়া আর হয় না!
হ্যাপী আর আমি স্নাতক পাশ করেছি,-দুজনেই ২য় বিভাগে। ভদ্র ঘরের মেয়েদের মতোই কলেজে আসত সে। যদিও মাথায় উড়না কম দিত। বাকী সব জায়গাতেই কাপড়ের যথাযথ ব্যবহার করতো। একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করতাম, মসজিদে আযান হলে পড়েই,-সে মাথাটি উড়না দিয়ে ঢেকে দিত। এব্যাপারটি আমার খুব ভাল লাগত। নিয়ম-কানুন কিছুটা হলেও মানতো মেয়েটি। ডিজিটাল যুগের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে নিয়ম-কানুন বির্সজন দেয়নি। আগে জানতাম, সে ভাল ইংরেজি জানে। ঢাকায় আসার আগে জানলাম, কলেজে শিক্ষিকার চাকুরী করে। তাও আবার বাংলা বিভাগে।
সাংবাদিকতার সুবাদে একদিন গিয়েছিলাম হ্যাপীর কলেজে। সেখানকার কয়েকজন শিক্ষিকা ও শিক্ষার্থীদের কানে যখন এই খবরটি গিয়েছিল, আমি তাদের হ্যাপী ম্যাডামের বন্ধু। তখন সকলে আমার জন্য আগ্রহে অপেক্ষা করছিলো।
শুধুমাত্র তাদের হ্যাপী ম্যাডামের বন্ধু হওয়ার কারণেই নাকি ছিল এ আগ্রহ। শিক্ষিকা হিসেবে অল্প দিনেই সকলের মনে কেড়েছিল হ্যাপী। শিক্ষার্থীরা আমাকে বলেছিল,-তাদের হ্যাপী ম্যাডাম,‘বাংলা গল্প’ খুব সুন্দর করে পড়ান। এমনভাবে গল্পের বর্ণনা করেন যে,-মনোযোগ সহকারে সকলকে শুনতেই হয়!
সেই হ্যাপী নিজে যখন কলেজে পার্ট টাইম লেকচার শেষে কলেজে পড়তে আসত, তখন তার সাথে আমার দেখা হত, কথা হত। আমরা যখন গল্প করতাম, অন্য শিক্ষার্থীরা হিংসায় জ্বলতো। বিশেষ করে ছেলেরা। আমাদের অলক্ষ্যে তারা প্রায়ই বলতো, আমরা নাকি স্বাভাবিক নই!
অর্নাস ২য় বর্ষে পড়াকালীন সময়ে তার সাথে আমার দুরত্ব একটু বেড়ে যায়। কথায় বলে-‘চোখের আড়াল হলে নাকি, মানুষ মনেরও আড়াল হয়ে যায়’। ২০১৫ সালের শুরুতে এসে আমি এটি উপলব্দি করেছি।
শুনেছি, হ্যাপী নাকি ইদানিংকালে বিলাসিতায় গা ভাসিয়েছে। নিজেকে বড় একা মনে হয়। ব্যস্ত এই ঢাকা শহরে হ্যাপীর জন্য সারাক্ষন মন কেমন জানি করে। ইচ্ছে করে আরো একদিন তাকে নিয়ে হাওয়া খেয়ে আসি সিলেটের সেই লালাখালে.......ঘুরে আসি, নারায়নগঞ্জে বাংলার তাজমহলে....
আমি জানি, হ্যাপির কাছ থেকে নিজেকে দুরে সরিয়ে আনা কঠিন। তবে অসম্ভব নয়। ভালবাসার ক্ষেত্রে আমি আর হ্যাপী কোনো নিয়ম নীতিরই তোয়াক্কা করিনি। অনেকেইভাবে ‘হ্যাপী আর আমি’ দুজন বিপরীত লিঙের আলাদা দুজন মানুষ। কিন্তু আমি মনে করি, তা নয়। আমার মনে হয়, আমরা দুজন শুধু নামেই ভিন্ন। অস্থিত্বের দিক থেকে একই। কেননা, বিশিষ্ঠজনরা বলে থাকেন,-যে যাকে ভালবাসে, হাশরের দিন তার সাথেই নাকি মিলন হবে! আমারও তাই বিশ্বাস হয়। তবে হ্যাপী যে আমাকে ভালবাসে,-সেটা আমি বাস্তবে দেখতে চাই, কল্পনাতে নয়.....
(চার)
শুনেছি হ্যাপি রাঁধতে পারতো না। হ্যাপী, সারাদিন, ফোনে ভাইবার, ওয়ার্টসআপ, স্কাইপি ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকত। আমি চ্যাট করতে চাইলেই নীতি কথা শুরু করে দিত।
রান্না না জানার জন্য বাড়িতে প্রচুর বকুনি খেত।
হ্যাপীর মা প্রায়ই তাকে বলতেন, রান্না না জানলে, জামাই বাড়ি যাবি কি করে? মায়ের মুখের উপর হ্যাপী, বিয়ে করবে না বলে দিত!তার মাও যেতেন রেগে। বলতেন, আমিতো আর তোকে চিরদিনের আইবুড়ো করে রাখতে পারবো না। মায়ের অনবরত বকুনি খাওয়ার পর নাকি হ্যাপী রান্না করা শিখে গিয়েছিল।
আমি জানলাম কিভাবে?
এসব কথা সে নিজেই আমাকে বলেছিল। সে বলতো,-পড়াশেষে যদি মান সম্মত একটা চাকরি পেয়ে যায়, তবে নাকি ‘চিরকুমারী’ হিসেবেই কাটিয়ে দিবে বাকী জীবনটা। আমি মনে মনে বলতাম, আল্লাহ হ্যাপীর একটা চাকুরীর ব্যবস্থা করে দাও। যেন বিয়ে না হয়।
লোক মারফত হ্যাপীর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম। আমার পাঠানো দ্রুতকে হ্যাপীর মা-বাবা, বলে দিয়েছিলেন,-মেয়ের বয়স বিশ থাকতে বিয়ে দেননি একটি মাত্র কারণে, সেটি হল মেয়েকে লন্ডনী পাত্রের হাতে পাত্রস্থ করবেন বলে। আত্মীয় স্বজনের মাঝেও অনেক ছেলে দেখে রেখেছেন তারা।
আমার বুদ্ধির ব্যাপারে হ্যাপী একশ ভাগ নিশ্চিত ছিল। ব্যাপারটা অনেকটা পাড়ে দাড়িয়ে সাগর দেখার মত। পাড়ে দাড়ালেও মায়ের কথার বিরোধিতা করে আমার প্রেম সাগরে ঝাপঁ দেবার মত দুঃসাহস তখন ছিল না হ্যাপীর!
আমার ব্যাপারটি হ্যাপীর পরিবার জেনে গেছিলো। ছেলে সাংবাদিক শুনে তার মা এক বাক্যে না করে দিয়েছিলেন।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছিল হ্যাপী।
প্রথমত আমি তখনো ছাত্র ছিলাম, এখনো আছি। ছাত্রত্বই আমার মূল পেশা। সাংবাদিকতা মূল পেশা নয়। আর মূল পেশা হলেও সমস্যা অন্য জায়গায়। সাংবাদিকদের জীবনে নাকি কোন নিরাপত্তা নেই। যে কোন সময় অঘটন ঘটে। মেয়েকে একজন সাংবাদিকের সাথে বিয়ে দিয়ে, অল্প বয়সে বিধবার বেশ দেখতে পারবেন না হ্যাপীর মা। তাই ওর পক্ষে আমাকে নিয়ে কল্পনা করা কঠিন ছিল কিন্তু অসম্ভব ছিল না।
হ্যাপীর পটাপট প্রেমে পড়া আর হুটহাট আমাকে ফিরিয়ে দেওয়া সবকিছুই আমাকে মুগ্ধ করতো।
নিজের জন্মভূমি হবিগঞ্জে, আমার অবস্থান গড়াই ছিল। কেন আমাকে ঢাকায় আসতে হল? কার জন্য? কিসের জন্য? আমাকে কে মদত দিয়েছিল? স্বপ্নবিলাসী সেই হ্যাপী!
তার আবদার মেটাতে হলে,- আমাকে আর কত দুর যেতে হবে।
পলাশীর যুদ্ধে মীর জাফরের খটকারিতায় জীবন দিতে হয়েছিল বাংলার সিপাহিদের। বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন, আর একাত্তরে স্বাধীনতার জন্য পাকিস্থানী হায়েনাদের হাতে জীবন দিতে হয়েছিল বাংলার মানুষদের। অনেকের জীবন নষ্ট হয়েছিল অকালে। আমি এসব দেখিনি!
তবে আমি কার জন্য এসব করব! নিজের জন্য! নাকি জীবন ধারণের জন্য! প্রশ্ন রয়েই গেল?
যার কারণে আমার ঢাকায় আসা। যার কারণে এত ছুটে চলা, তার কি হলো? না তার কিছুই হয়নি! শুনেছি, বিয়ের সমন্ধ চলছে। যদি সেই স্বপ্ন বিলাসী হ্যাপীর বিয়ে হয়ে যায়, তবে আমার কি হবে?
না, কিছুই হবে না।
আমি শুধু ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হয়ে রব প্রজন্মের পর প্রজন্ম.....
(এই গল্পটি সম্পূর্ণ কল্পিত এক কাহিনী। গল্পে ঘটনার স্থান, কাল, সবকিছুই কাল্পনিক। যদি কারো জীবনের সাথে মিলে যায়, তা কাকতালীয় ছাড়া আর কিছুই নয়!)