সাত গ্রামে যুদ্ধ বাধিয়ে পরিবানকে যখন ঘরে আনে প্রবাসী নরিন শেখ, তখন ঢিঢি পড়ে গিয়েছিল নাকি--এমন সুন্দরী বউ ঘরে রাখা দায়। তা হলে বলতে হবে, পৃথিবীর সমস্ত সুন্দরীকে হত্যা করা শ্রেয়। মানুষ সবকিছু করতে পারে তবে কিছু আদত বদলাতে পারে না। কারও ক্ষতি করতে পারল না কমপক্ষে হিংসা হলেও করবে। মানুষের এক অদ্ভুত স্বভাব!
আমরা নরিন শেখকে যতটুকু চিনি পরিবানকে ততটুকু চিনি না। শুনা যায়, সাত গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে পরিবান। তিন ভাই চার বোনের মধ্যে সে পঞ্চম। শিক্ষাদীক্ষায় উচ্চডিগ্রি হাসিল করতে না পারলেও সুন্দরীর বড় ডিগ্রি সহজেই হাসিল করতে পেরেছিল ‘অতুলনীয়া’। আরও শুনা যায়, এ অতুলনীয়াকে এক পল দেখার লক্ষ্যে নাকি সাত গ্রামের যুবকেরা দলবেঁধে তার চলার পথে স্থানে স্থানে দাঁড়িয়ে থাকত। অনেকের সেই স্বপ্নসম্রাজ্ঞী হঠাৎ এভাবে কারও ঘরণী হবে কল্পনা করে নি কেউ। বিয়ের কথা পাকাপোক্ত হওয়ার পর নাকি কিছু মেয়েলোক জোটে তাকে কুসলা দিতে। সকল কুমন্ত্রণা উপেক্ষা করে তবে পরিবান নরিন শেখের স্ত্রী বনে। চক্রান্তকারীরা বিয়ের দিন যে ব্যর্থ এক হাঙ্গামার চেষ্টা চালিয়েছিল সেটা এখনো মুখরিত আছে। এপর্যন্ত আমরা তার এটুকু তথ্যপরিচিতি উদ্ধার করতে পেরেছি। 
আজ থেকে দেড় শ বছর আগে এক দরিদ্র কৃষকপরিবারে জন্ম নিয়েছিল নরিন শেখ। তখন প্রবাসসম্বন্ধে অনেকেরই অজ্ঞতার কথা আমরা জানি। পরদেশ গিয়ে অর্থোপার্জন করে ধনাঢ্য হওয়া যায় এ কথাটা আমাদের অনেকেরই অজানা ছিল। নরিন শেখের প্রবাসগমন শুধু ভাগ্যই নয় একেবারে ব্যতিক্রমই বলা যায়। 
একদিন বিরক্ত হয়ে বর্গাজমিতে হাল দিতে গিয়ে যখন বলদের পা কেটে ফেলে তখন বাবার রাগের ভয়ে পালিয়ে যায় শহরে। সেখানে দুয়েকদিন ঘুরাঘুরির পর এক বন্ধুর সঙ্গে কুলির কাজে নিযুক্ত হয় বন্দরে। বেশ কিছু দিন কেটে যাওয়ার পর একদিন ব্রিটিশ এক জাহাজে বোঝা নিয়ে উঠে সুযোগ বুঝে আর নামল না। জাহাজটা লন্ডনবন্দরে এসে ভিড়লে ওই ইংরেজদম্পতির নজরে পড়ে সহানুভূতি পায়। ইংরেজ টুকটাক বাংলা বলতে পারত। ভদ্রলোক নাবিককে তার চাকরপরিচয় দিয়ে নিয়ে আসে সঙ্গে। 
নরিন বার কয়েক মায়ের কাছে শুনেছে তার মায়ের এক দূরসম্পর্কীয় আত্মীয় থাকে লন্ডন, ধনেমনে বিরাট বড়লোক। ইংরেজ ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলে জানায় ওই আত্মীয়ের কথা। নাম সুহান হৃদ্দার। হৃদ্দার হোসেনের ছেলে। বাড়ি ডেউয়াতলা। এটুকু মাত্র জানা। ইংরেজদম্পতি তার বাড়ির অদূরে একটা হোটেলে নরিনকে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে...তার পরের দিন পুলিশ ডেকে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে সুহানকে খুঁজিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দেয়। পুলিশ এবার নরিনকে নিয়ে প্রতিদিন ডিউটি করতে থাকে । আজ এই শহরে ত কাল ওই শহরে। এভাবে কয়দিন খোঁজাখুঁজির পর অনেক সুহানের দেখা পাওয়া যায়, তবে সুহান হৃদ্দার নামে কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রায় পনের দিন পর ব্র্যাডফোর্ড শহরে সুহান হৃদ্দারের হদিশ মিলে। ভদ্রলোক নরিনকে স্বপ্নেও দেখে নি কোনদিন, নরিনও তাঁকে দেখে নি কোনদিন। কিন্তু পুরো পরিচয় দানের পর সুহান নরিনকে সহজেই চিনতে পারে। তারপর থেকে নরিনকে আর অতীত ফিরে দেখতে হয় নি। এদিকে নরিনের নিরুদ্দেশের খবর পেয়ে পরিবারবর্গ কান্নার জলে প্লাবিত। তখনকার পৃথিবী আর এখনকার পৃথিবীর মধ্যে যেমন একটা আকাশপাতাল তফাৎ দেখছি তদ্রূপ তখনকার প্রবাস এবং এখনকার প্রবাসের মধ্যে অনেক ব্যবধান আমরা দেখতে পাচ্ছি। বর্তমানের পৃথিবী যতই সহজ হচ্ছে কিন্তু বর্তমানবিশ্বের মানুষ ততই কঠিন মনে হচ্ছে!  
বিয়ের পর স্বামীর জন্যে ভালবাসার পাত্রী একমাত্র বউ এবং বউয়ের জন্যে একমাত্র স্বামী। তাই নরিনকে আমরা দোষ দিতে পারব না। কারণ বিযের পর থেকে দেখা গেছে, তিন চার মাসের বেশি সে বিদেশ অবস্থান করছে না। তা হলে প্রবাসী বলে ওকে আমরা অবহেলা করতে পারি না। তবে হাঁ পরিবানের কিছু ত্রুটি আমরা লক্ষ্য করি, তন্মধ্যে প্রধান--ঘরের বার-তেরটা কক্ষের মধ্যে সদর দরজা ছাড়া কোনো একটা কক্ষে খিল দিতে দেখি না সচরাচর। এমনকি নিজের কক্ষেও না! এটাকে তার বদাভ্যাস বলব, না বোকামি বলব আমাদের বুদ্ধিতে আসে না। স্বামীর বর্তমান হলে একথা উত্থাপন করা নিষ্প্রোয়জন ছিল কিন্তু স্বামীর অবর্তমানের কথা প্রকাশ করা আমাদের কর্তব্য। কেননা মেয়েরা যতই সাহসিনী হোক-না কেন, মেয়েদের সতর্কতা অবলম্বন করে চলা খুবই জরুরি। এখানে ত পরিবানকে অত সাহসিনী বলেও মনে হয় না। তা হলে? সূচ্চ প্রাচীরঘেরা একটা বাড়িতে একজন চাকর ও একজন চাকরানী এবং দুটো যমজ শিশুসন্তান কিবা তার বেশি অথবা নিঃসন্তান একজন গৃহিণী যখন বাস করবে তখন তাকে অনেকবেশি সচেতন থাকার পরামর্শ আমরা দিব। কারণ মানুষের ঘুমমাত্র মৃত্যু। তাই সাবধানতা অবলম্বন করা এখানে খুব দরকার। কিন্তু এ সাবধানতা পরিবানের মধ্যে আমরা দেখি নি কখনো! যাই হোক, এটা মেয়েদের দোষ বলব না, মেয়েরা যে পুরুষের চেয়ে বুদ্ধিতে একটু খাটো সেটা একদিন প্রমাণ করাব।
পরিবানকে নিয়ে নরিন শেখ লন্ডনে বসবাস করতে পারত তবে এ বসবাসের শান্তির চেয়ে ক্লান্তি বেশি অনুভব করত সে। কারণ যেই সংস্কৃতিতে নরিন বড় হয়েছে সেই সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে তার সন্তানদেরও উদ্বুদ্ধ রাখা চায়। তার কারণ ভিনদেশি সংস্কৃতিতে যারা বেড়ে উঠে তাদেরকে স্বদেশের সংস্কৃতি কখনো অনুপ্রাণিত করতে পারে না। তারা সহজেই জন্মস্থানকে ভুলে যেতে সক্ষম। তা হলে জন্মদাতাদাত্রীকে ভুলতে কতক্ষণ। এটাই তার প্রতীতি। সাধারণত এমন প্রত্যয় অন্য প্রবাসীদের মধ্যে দেখা যায় না। তাই নরিনকে আমরা অসাধারণ দেশপ্রেমিক বলব। কেননা স্বদেশের প্রতি তার যে একটা টান--একটা মমত্ব দেখতে পাই তা সচরাচর অনেক প্রবাসীদের মধ্যে দেখা যায় না। সুতরাং নরিন অশিক্ষিত হলেও একজন শিক্ষিত মানুষের গুণ ধারণ করে--তার প্রমাণ, সন্তানদের উচ্চশিক্ষিত করে গড়ে তোলা এবং তাদেরকে স্বদেশপ্রীতির আদলে মানুষ করা।
নরিন শেখ আর পরিবানের দুটি যমজসন্তানের কথা স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে কিন্তু একমাত্র কন্যার কথা এপর্যন্ত কোথাও অস্পষ্টভাবেও উল্লেখ করা হয় নি--তার নাম শেরিন। তাকে বিয়ে দিয়েছিল চরণদ্বীপ ধনাঢ্য এক কুলীন পরিবারে। তার সুখসংসারের কথা এখানে টানব না। শুধু টানতে চাই যমজ পুত্রদ্বয় হিরণ আর কিরণের কথা। হিরণ ডাক্তারি পাস করার পর হাসপাতাল খুলে ব্যস্ত, কিরণ বিমানবাহিনীর পাইলট। তাদের সংবাদ এপর্যন্ত দিলাম। এর বেশি প্রয়োজন নেই। যা বিশেষ প্রয়োজন তা প্রচার করতে আমরা একদণ্ড পিছ পা হব না। 
শেরিনের বিবাহের বছর দেড়েক পরের ঘটনা। নরিন শেখের বয়স তখন সাতচল্লিশ কি বা আটচল্লিশ। মেয়েকে আনতে গিয়েছিল তার শ্বশুরবাড়ি। মেয়ের শ্বশুরবাড়ির অদূরে--বড়খাল। গ্রীষ্মকালে কোথাও কোথাও শুকিয়ে একেবারে কাঠ হতে দেখা যেত; আবার বর্ষাকালে স্রোতের কলকলানিতে কোথাও ভেসে যেত দুকূল। খালটার উপর একটা পুল হবে হবে শুনা যাচ্ছিল তখন প্রায়ই পঞ্চাশ বছর ধরে। যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে গেলে, এপাড় থেকে সব শুরু এবং এপাড়েই সব শেষ। তখন গ্রীষ্মকাল। পায়ে হেঁটে পার হচ্ছে দুজন। খালের এপাড়ে ছোট্ট একটি বন। ছোট ছোট অগাছায় এক অপূর্বসৌন্দর্য বর্ধন করেছে। তার পাশে এলে নরিন মেয়েকে নির্দিষ্ট এক জায়গা দেখিয়ে দিয়ে দাঁড়াতে বলে। নরিনের মুত্রবেগ অসহ্য...
শেরিন বুকে হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রোদে। চোখে কালো চশমা। কপালে লালটিপ। শাড়ি নীলাম্বরি। ঝলমলে বাহারি চুল হওয়ায় উড়ছে অনেকটা। এমন সৌন্দর্য তার অবয়বে আছে, যেকোন চতুর কেন, নির্বোধ-বোকারা দেখেও আশ্চর্য হবে। তার সুন্দরের কাছে বিশ্বমুকুটপাওয়া সুন্দরীরাও ম্লান, একথা তার নিন্দুকেরাও বলে জোরগলায়। নরিন মেয়েকে ঘুরে দাঁড়াতে দেখে হঠাৎ তার মনে কুকামনা জাগে! যা একজন পিতার কল্পনাতেও বিরাজ করা সম্ভব না। একজন মানুষের দুটি রূপ থাকে, একটা ভাল অপরটা মন্দ। মন্দ বেশিরভাগ ভালর কাছে পরাজিত হলেও তবে ভালও কখনো কখনো মন্দের কাছে পরাজিত হতে হয়। কিন্তু সত্য কখনো মিথ্যার কাছে পরাজিত নয়। সাক্ষী থাকুক বা না থাকুক সত্য একদিন-না-একদিন যেকোনোপ্রকারে উন্মোচিত হবেই। নরিন মেয়ের দিকে আর তাকাতে পারছে না, সঙ্গে সঙ্গে নিজের মন্দাত্মাকে ধিক্কার দিয়ে মনে মনে ভাবতে থাকে...
সপ্তাখানেক পর মেয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে পরিবানকে ডেকে কাছে বসায় নরিন শেখ। পরিবান স্বামীর বজ্রাহতরূপ দেখে রীতিমতো কম্পিত এবং ভিতরে ভিতরে ভয়ে আতঙ্কিত। এত দিনে তার আচার-আচরণে বুঝেছে কিছু একটা ঘটেছে। তবে জিজ্ঞেস করার দুঃসাহস করতে পারে না। স্বামীকে যতটুকু ভালবাসত তারচেয়ে অনেকবেশি ভয় করত। আর এটাই বেশিরভাগ বাঙালি মেয়েদের চরিত্র। তবে? মানুষ ভুল করে জানি কিন্তু কিছু কিছু ভুলের মাশুল দেওয়া যে যায় না তা জানতাম না।
পরি, তুমি আমার বড়ই আদরের বউ। (নরিন শেখ স্ত্রীর হাতদুটো চেপে ধরে বলল) তোমার ভালবাসার কাছে সবকিছু তুচ্ছ, এত যে ভালবাসি তোমাকে। 
পরিবান বলল, হঠাৎ এ কথা কেন? আমার ত খুব ভয় করছে।
নরিন বলল, ভয় করার কী আছে। তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব, আশা করি মিথ্যা বলবে না।
পরিবান বলল, কথাটা যদি সত্যি না হয়, তবেও কি সত্য বলতে হবে?
নরিন বলল, আমার মন বলছে--সত্য।
পরিবান ম্লানহেসে বলল, মনের উপলব্ধি সব সময় যে ঠিক হবে এমন কথাও ত নয়।
নরিন গম্ভীরগলায় বলল, আমার উপলব্ধি কখনো বেঠিক হয় না।
পরিবান ইতস্তত করে বলল, তা হলে কর।
নরিন বলল, আগে আমার মাথায় হাত রেখে ওয়াদা কর।
পরিবান সঙ্কোচে : করলাম। 
নরিন : শেরিন আমার মেয়ে নয়।
পরিবান আকাশ থেকে পড়ে : একি বলছ তুমি! 
নরিন : অর্থাৎ আমার ঔরস্য...
আমরা এবার সত্য উদ্ঘাটন করতে চললাম। পরিবান কখনো স্বপ্নেও কল্পনা করে নি যে, এভাবে কোনেকদিন তাকে সত্যের সম্মুখীন হতে হবে! কারণ, যেকথা দুয়েতে সীমাবদ্ধ থাকে সেকথা তৃতীয়তে উন্মোচন করা দুষ্কর। নরিন শেখের অবর্তমানে দুই পুত্রকে নিয়ে যখন পরিবান ঘুমাত...ছেলেদের বয়স তখন দেড় কি বা দুই। তার ঘুমের কথা যদি আমরা বলি, তা হলে অনেকটা দৈত্যের ঘুম বলতে হয়। ঘটনাটা এবার পরিবানের মুখ থেকে শুনি : প্রথমদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে মনে করলাম...কিবা...দ্বিতীয়...তৃতীয়...আমার শরীরের লক্ষণ ভাল লাগছে না। এবার ঘুমের ভানে জাগতে লাগলাম...আমার সন্দেহ...তখন...কিছু বাকি রইল না। আমাকে হত্যা করবে বড় কথা নয় : আমি বাঁচতেও চাই নি--কিন্তু আমার দুই অবুঝশিশুর জন্যে সবকিছু মেনে নিতে বাধ্য তখন। পৃথিবীতে এমন কোনো মা নেই যে, সন্তানের জন্যে মরতে পারে না। তা হলে? 
প্রশ্ন সমীচীন। তবে পৃথিবীতে এমন কোনো মহামানবও জন্ম নেয় নি যে, এধরনের ভুলকে মেনে নিতে পারে। এখানে ত নরিন শেখ মাত্র একজন মানুষ। নিজের প্রবাসজীবনের প্রতি দুঃখপ্রকাশ করে এবং প্রাচুর্যকে ধিক্কার দিয়ে বলে, একজন চাকর...দেশে আইনকানুন বলতে কি কিছুই নেই? (আশ্চর্য প্রকাশ করে)
পরিবান : সবকিছু আছে।
নরিন : তা হলে?
পরিবান : আইন করে হয়তো বিচার পাওয়া যেত তবে আমার সম্ভ্রম পাওয়া যেত না। আর পৃথিবীর এমন কোনো আদালত নেই, এ জিনিসটাকে ফিরে দিতে পারে।
নরিন : তা হলে আমার কাছ থেকে গোপন করলে কেন? 
পরিবান : তোমাকে হারাব বলে। সেই সিদ্ধান্ত আমার চরম ভুল ছিল। তার জন্যে যত শাস্তি আছে--মাথাপেতে নিলাম...
নরিন : কিছু কিছু ভুলের জন্যে আত্মহত্যা করা যায় তবে মাফ করা যায় না। বলে ওঠে দাঁড়াতেই পরিবান স্বামীর পাদুটো জড়িয়ে ধরে মহাকর্মিক সন্তানদের কাছে ছোট না করার দোহাই দিয়ে কাঁদতে থাকে--কলঙ্কিত জীবনের চেয়ে আত্মহত্যা ভাল। কিন্তু আত্মহত্যায় কলঙ্কের সমাধান নয়। যারা আত্মহননকে সমাধান মনে করে তাদেরকে আমরা মুক্তির পথ দেখাব কীভাবে? এখানে তবে পরিবানের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় মিলে। তাকে আমরা যতটুকু বোকা মনে করি ততটুকু বোকা কিন্তু পরিবান নয়। 
নরিনের ঘুম নেই, সারা রাত সমাধান খুঁজতে থাকে : ভাবতে থাকে--বিবেকের কাছে প্রশ্ন করা যায় তবে আজীবন বিবেকের প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকা যায় না। মেয়ের দূরত্বের কথা জানা আছে। তার দোষের কথাও কেউ বলতে পারবে না, তার কথা নাহয় বাদই দিলাম কিন্তু প্রতিষ্ঠিত ছেলেদের কথা ত বাদ দেওয়া যায় না। আজ না হয় কাল বা কোনেকদিন আচার-আচরণে ছেলেরা যে জানতে পারবে না এমন কথা কে বলে। অদৃষ্টের লিখা যেমন খণ্ডানো যায় না দৃষ্টের চিহ্নও ত তেমন মুছে ফেলা যায় না। তাই ইয়াদগার কিছু ভুলাতে হলে অদৃশ্য হওয়া জরুরি...
নরিন শেখের নিখোঁজখবর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। আত্মীয়স্বজনেরা কৌতূহলী। অনেক খোঁজাখুঁজির পর কথা উঠে পেপারপত্রিকায় ঘোষণার। অতঃপর এমন কোনো সংবাদমাধ্যম নেই যেখানে নরিন শেখের সন্ধানসংবাদ প্রচার করা হয় নি। 
একদিন--প্রায় চব্বিশ বছর পর বেশকিছু দৈনিকপত্রিকার শিরোনাম হয় সড়কদুর্ঘটনার একটা মর্মান্তিক খবর : জনৈক পথচারী মারাত্মক আহত অবস্থায় রায়গড় জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি আছে। আহতের ঠিকানা উদ্ধারের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় নি। বয়স আনুমানিক সত্তরের উপরে। মানিব্যাগে প্রায় নষ্ট একটা ছবি ছাড়া অন্য কোনো প্রমাণ মিলে নি। তিন শিশুর সঙ্গে একজন মহিলার ছবি। সম্ভবত পরিবারবর্গ। ছবিটা আমরা পত্রিকায় ছাপালাম। পরিবারের কেউ থাকলে সত্তর যোগাযোগ করুন। মুমূর্ষুর রক্তের প্রয়োজন। রক্তের গ্রুপ এবি নেগেটিভ। এবং কোনো উদার মনের মানুষ থাকলে নিঃস্বকে বাঁচাতে এগিয়ে আসুন। 
--হাসপাতাল কতৃপক্ষ। 
কিরণ পেপারহাতে দ্রুত যায় মায়ের কামরায়। ছয় ঘণ্টার পথ অতিক্রম করে ছুটে আসে তারা হাসপাতালে। ফ্লোরে বসে পায়ে হাত বুলাতে বুলাতে কাঁদতে থাকে শেরিন এবং তার পাশে ম্লানমনে দাঁড়িয়ে থাকে স্বামী ও তার অবোধ সন্তান দুটো। নাড়ি দেখে হিরণ আর তার পাশে বসে মাথায় হাত বুলাতে থাকে কিরণ। শিয়রে দাঁড়ানো দুই পুত্রবধূ এবং তাদের ছেলেমেয়েরা। সকলের চোখে অশ্রুজোয়ার। অন্য পাশে বসে হাত একটা বুকে চেপে নীরবে কাঁদছে পরিবান আর মনে মনে ভাবে, আমার ভুল ক্ষমার যোগ্য নাইবা রইল কিন্তু আপনারও যে কিছু ভুল ছিল না একথা কে বলবে। তবু আমি সমস্ত ভুল একান্ত আমার বলে স্বীকার করলাম : মাথাপেতে নিলাম--যেকোনো শাস্তি ভোগ করতে প্রস্তুত ছিলাম; তার পরেও আপনার ভুল ভাঙল না কেন! কাণ্ডজ্ঞানহীন বালকের মতো এমন কেন করলেন আপনি! ভুল মানুষেতে হয় দেবতাতে নয়। খোদার মতো যে আপনাকে ভালবেসেছিলেম সেকথা বুঝার একবারও চেষ্টা করলেন না কেন। মৃত্যুর পরেও বোধহয় এ আফসোস আমাকে তাড়িত করবে। 
তিন দিনপর এমাত্র জ্ঞান ফিরে মুমূর্ষুর। আবছা আবছা দেখে প্রথমে। তারপর--চোখ ঘুরিয়ে দেখে নেয় পরিবারবর্গকে একবার। সঙ্গে সঙ্গে তার দুচোখ বেয়ে বয়ে যায় অশ্রুবন্যা। প্রাণপ্রিয় সন্তানদেরকে বুকে জড়িয়ে চুমু খেতে চাইল মন বারবার। বিরহকালের হাজার যন্ত্রণা ভুলে সন্তানদের সুখের সংসারে ফিরে যেতে চাইল মন এবার। অক্সিজেন মাকস্ খুলে ফেলে দিয়ে প্রাণখুলে সন্তানদের সঙ্গে মাততে চাইল মন অনর্গল। সব দুঃখ ভুলে গিয়ে স্ত্রীকে আবার আপন করে নিতে চাইল মন। আবার হাসিখুশি সংসারযাপন করতে চাইল মন আগের মতো--বাঁচতে চাইল অনেক দিন। কিন্তু না, কিছু জিনিসের নির্দিষ্ট সময় শেষ হয়ে গেলেও মেয়াদোত্তীর্ণ সময়ে কিছুটা চলতে পারে। তবে মানুষের কোনো মেয়াদোত্তীর্ণ সময়সীমা নেই, তাকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চলে যেতে হয়। দুঃখের বোঝা নিয়ে নরিন শেখ চলে যায়। পরিবান অপরাধীর করতলে দেবে কিছু দিন বেঁচেছিল জিন্দালাশ। মানুষেতে এমন কতক ভুল হয়ে যায় যেগুলোকে সংশোধন করাও যায় না এবং প্রায়শ্চিত্ত করাও যায় না। এমন ভুলের জন্যে অনেক জনাকে জীবন বিসর্জন দিতেও দেখা যায়। এখানে কিন্তু মেয়েদের বুদ্ধিখর্বত্বের পরিচয় পাওয়া যায়।             
                        
            
            
            
                        
            
            
                        
            
         
        
               
   
    
                    
        
        
            
            
                 ০২ মার্চ  - ২০১১ 
                                        
                            গল্প/কবিতা:
                            ৭৯ টি
                        
                    
            
            
         
     
    
        
বিজ্ঞপ্তি
        এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
    
    
        প্রতি মাসেই পুরস্কার
        
            বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
        
        
            লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
            
                - 
                    
                    
                        প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
                        প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
                     
- 
                    
                    
                        দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
                        প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
                     
- 
                    
                    
                        তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
                     
 
     
    
        
        বিজ্ঞপ্তি
        “নভেম্বর ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ নভেম্বর, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।
        প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী