সরলের মন ভালো নেই, কারণ সে তার স্বপ্নকে হারিয়ে ফেলেছে। সে মনে মনে ভাবে পৃথিবীতে আপন কেউ নেই বলে স্বপ্নগুলোও তার চিরদিনের জন্য পর হয়ে যাবে? ব্যথায় তার বুকটা ফেটে যায়। চোখ দিয়ে বেয়ে পড়ে কষ্ট মেশানো ফোটা ফোটা অশ্রুজল। কারও প্রতি কোন অভিযোগ নেই তার, এটি যে তার ভাগ্যের-ই লিখন। তার ভেতরটা হুঁ-হুঁ করে কেঁদে উঠে। ভবদাস পুরের ছোট্র্র একটি পরিবারে জন্ম নিয়েছিল সরল। সে বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবার হাঁটে একটি ছোট মুদির দোকান ছিল। দোকান থেকে যা আয় হত তাতে তাদের সংসার খুব ভাল ভাবে চলে যেত। সারাদিন খেলাধুলা আর দুষ্টুমিতে দিন কাটত সরলের। স্কুল থেকে ফেরার পর তাকে আর ডেকেও কোন সাঁড়া পেত না তার মা। সন্ধ্যার পর ধুলিমাখা শরীর নিয়ে ঘরে ফিরত সে। এরপর হাতমুখ ধুয়ে লক্ষ্মী ছেলের মত স্কুলের পড়া করতে বসত। খেলাধুলার মধ্যে সে ক্রিকেট-ই বেশী পছন্দ করত। টিভি চ্যানেলে বসে খেলা দেখাটা খুব ভালো লাগত না তখনও, তবে খেলাটা সে খুব বেশী পছন্দ করত। চাঁতাল থেকে কাঠ চুরি করে দাঁ দিয়ে কেটে ব্যাট তৈরি করেছিল সে। অবশ্য পরে ধরা পরার পর মার কাছে বেশ বকুনিও খেতে হয়েছিল তার। নিজ তৈরি ব্যাট আর পাশের বাড়ির বাতাবি লেবুর গুটি দিয়ে পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলত বাড়ির পাশের ফাঁকা ছোট ভিটেটাই।
তখনও বেশ ছোট সরল। একদিন বাবাকে বেশ করে ধরল একটি বল কিনে দেওয়ার জন্য। সে দিন বিকেলে স্কুল থেকে ফেরার পথে তাকে একটি সুন্দর নীল বল কিনে দিল বাবা। এখন সরলের ব্যাট আছে, সাথে একটি বলও, এখন তো আর আগের মত সপুঁরী গাছকে স্ট্যাম্প বানিয়ে অগোছালো ভাবে খেলা চলে না । রুবেল ভাইয়ারা সবাই টিম করে খেলে, ওনাদের টিমের আবার নামও আছে। ছোট বলে আমাদের ওনারা খেলায় নেয় না। না আমরাও একটি টিম গড়ব, মনে মনে ভাবে সরল। তারপর পাড়ার ছেলেদের নিয়ে সে একটি টিম গড়ে ফেলে। সে টিমটার সুন্দর একটি নামও দেয়,"সরতী"।
সরলের ব্যাট আর বল তো ছিল, কিন্তু স্ট্যাম্প। সে বাকিদের কাজ দিল স্ট্যাম্প তৈরি করার। কিন্তু কেউই তা করতে পারল না। সবাই প্রথমে না বুঝেই দায়িত্ব নিয়েছিল, কিন্তু কি দিয়ে তারা স্ট্যাম্প তৈরি করবে? কারও বাড়িতেই কোন বাঁশঝাড় নেই। মনুর বাড়িতে আছে, কিন্তু সে বাঁশ বেঁয়ে উঠতে পারে না। সরল খুব ভালো গাছ বয়তে পারত। সে মনুকে বলল, "আমি তোর বাঁশঝাড় থেকে কুঁনচি কেটে আনতি পারবো, কিন্তু তোর মা কিছু বলবি না-তো"। মনু ভাবে, মা হয়তো কুঁনচি কাটতে নাও দিতে পারে। যদি না দেয় তবে হয়ত খেলাও আর হবে না। মনু বলে, "মা না জানলি কিছু বলবি কেমনে? তোরা সন্ধের পর গিয়ে কুঁনচি কেটে আনবি, মা জানতি পারবি না"। সেদিন সন্ধ্যার পর সরল, সজল আর তুষার যায় কুঁনচি কাঁটার জন্য। নিচের দিকের কুঁনচি গুলো সবই ছোট ছোট তাই সরলকে বাঁশ বেয়ে উঠতেই হলো। গরমের দিন, চারদিকের ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। ঐদিকে রফিকের বাড়ির পিছের বড় ঝাড়ের দিক থেকে মাঝে মাঝে দুই একটা শেয়ালের ডাকও শোনা যাচ্ছে। বেশ ভয় ভয় করতে লাগল তাদের। সজল তো বলেই বসল " চল চলি যায়, আমার খুব ভয় করছে"। "না, ভয় করে চলি গেলি কি খেলা হবিনি" দৃঢ় কণ্ঠে বলে সরল। তোরা দাড়া আমি খুব টপকরি কুঁনচি কেটে দিচ্ছি। দেখতে দেখতে সরল বাঁশ বেয়ে বেশ উপরে উঠে গেল। তুষার ওর হাতের টর্চ লাইটটা সরলের দিকে ধরে বলল, কিরে দেখতে পারছিস তো। হাঁ পারছি। বাঁশঝাড় থেকে মনুর বাড়িটা বেশ দুরে, অতএব এখান থেকে কুঁনচি কাঁটার শব্দ মনুর বাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার কথা নয়, তবু আস্তে আস্তে কাটতে হবে যেন তারা টের না পায়। সরল বড় বড় দুইটি কুঁনচি কেটে তা নামানোর জন্য আস্তে টানতে থাকে। কিন্তু বাঁশের কুঁনচি কি আস্তে টানলে নামে? সেহেতু একটু জোরেই টানতে হলো। কিন্তু সে টানে কুঁনচি না নামলেও শব্দটা মনুর বাবার কানে ঠিকই পৌছালো। মনুর বাবা এগিয়ে আসতেই সজল আর তুষার দৌড়ে
পালালো। কিন্তু উপরে থাকা সরলের ভাগ্যে যা জুটল তা হল- কিছু চর-থাপ্পড় এবং তার সাথে বাবার কাছে নালিশ। বাবা কিন্তু সরলকে কিছুই বলল না বরং তার কাটা কুঁনচি দুটি কিছু টাকা দিয়ে মনুর বাবার কাছ থেকে নিয়ে দিল। এরপর থেকে সরলের যা লাগত সবই বাবাকে বলতো। কিন্তু বেশী দিন বলা হল না তার। সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা-মাকে এক সাথে হারাল ১৩ বছর বয়সী সরল। সরলের নিকটতম আত্নীয় বলতে যিনি ছিলেন তিনি হলেন তার বাবার চাচাতো ভাই। সরলের বর্তমান অভিভাবক তিনিই। সরলের এবং ওর বাবার দোকান দেখাশুনার ভার তিনিই নিলেন। এভাবেই চলছিল কিছুদিন। একদিন সকালে যখন সরল স্কুলে বের হচ্ছিল সে সময় তার চাচা তাকে ডাকল। "আর স্কুলে গিয়ে কোনো কাম নাই, তুমার আমার সাথে দোকানে যাইতি হবে"। সরল বই রেখে চাচার সাথে দোকানে বের হয়। তারপর আর কখনই তার স্কুল যাওয়া হয়নি।
সরল,"ওনারে দুই কেজি আলু মেপে দে"। সরল খেলা দেখা ছেড়ে আল ু মেপে দেই।
সরলদের দোকান এখন অনেক বড় হয়েছে। না সরলের দোকান নই, সে এখানে শুধুই একজন কর্মচারী। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সব কিছুই নাকি উনার হয়ে গেছে, এমনটিই শুনে আসছে সরল। তাতে কোন দঃ খ নেই সরলের। কাজ সেরে সরল আবার খেলা দেখতে বসে। টেলিভিশনটি দোকানেরই, ওর বাবার হাতে কেনা। সাদা কালো হলেও এখনও বেশ ভালো আছে। এটি আগে বাড়িতে ছিল। এই টেলিভিশনেই সে প্রথম বিশ্বকাপ খেলা দেখেছিল তার বাবার সাথে বসে।
সেবারই বাংলাদেশ প্রথম বিশ্বকাপ খেলেছিল। তখন খেলাটা অত ভালোভাবে বুঝত না সরল। তবে সেবার বাংলাদেশ পাকিস্তানকে হারিয়েছিল সে কথাটা তার বেশ মনে আছে। বাবা আনন্দিত হয়ে বলেছিল দেখিস বাংলাদেশ একদিন খুব ভালো খেলবে। বাংলাদেশ দল ভালো খেললেই তাই তার বাবার কথা খুব বেশী মনে পড়ে ।
কালকেই রওনা হতে হবে, কারণ খেলা আগামী পরশু দুপুরে শুরু হবে। এইবার প্রথম বাংলাদেশে বিশ্বকাপ খেলা হচ্ছে। সরল তার এক বন্ধুকে দিয়ে বিশ্বকাপের টিকিট কিনে আনিয়েছে। চাচাকে এখন বলা হয়নি। কিভাবে বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা সরল। না থাক কালই বলা যাবে, মনে মনে ভাবে সরল। সরল তার পকেট থেকে টিকিটটি বের করে দুচোখ ভরে দেখে। হঠাৎ তার চোখ দুটি জলে ভিজে ওঠে। কিন্তু কেন? কোন ব্যথার কারণে? এসব প্রশ্নের উত্তর কি সরল দিতে পারবে?
ঘড়ির কাটার শব্দে হঠাৎ চমকে ওঠে সরল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত ১১ টা বাজে। তড়িঘড়ি করে সে মালপত্র গুছিয়ে দোকান বন্ধ করে।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুতে যায় সরল। ঠিক তখনই ওর টিকিটের কথা মনে পড়ল।পকেট হাতড়ে দেখে তা শূন্য। ঘরের সব কিছু উল্টে পাল্টে দেখে সরল, কিন্তু কোথাও টিকিট নেই।
তাড়াহুড়া করে সে দোকানের দিকে ছুটে যায়। ততক্ষণে দোকান খোলা হয়েছে। সরলের চাচাই আজ দোকান খুলেছে। সরল তার টিকিটটি খুঁজে পায়নি।
০২ মার্চ - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৪ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪