গ্রাম-বাংলার আত্ম-কথা

গ্রাম-বাংলা (নভেম্বর ২০১১)

M.A.HALIM
  • ৪১
  • 0
  • ৬১
আমি একটি 'গ্রাম,। ১৯৭১ সালে অজস্র গোলা বারুদ ও কামানের আঘাতে আমার বুকটা একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল। আমার এই ছোট্ট বুকের উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল অগনিত মানুষের বুকের তাজা রক্ত, মানুষের লাশ ও পশু-পাখির মৃতু্য দেহ আমার কোমল মাটির সাথে পচে গলে মিশে হয়েছিল একাকার। হানাদার বাহিনীর আগুনের লেলিহান শিখায় গ্রামের ঘর-বাড়ী গুলি জ্বলে পুড়ে হয়েছিল ছাই। আমি প্রায় জনশূন্য হয়ে একাকী নীরবে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এসব হূদয় বিদারক দৃশ্য ও রক্তের হোলি খেলা দেখে আসছিলাম একনাগাড়ে দীর্ঘ নয়-নয়টি মাস। স্রষ্টার অসীম কৃপায় ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো আর সেই সুবাদে আমি ও বাংলাদেশের একটি 'গ্রাম, হিসাবে নবরূপে পরিচিতি লাভ করলাম। (আমিন!)

প্রারম্ভে সহজ সরল কতিপয় কৃষক পরিবার ও ছোট ছোট কয়েকটি ঘর বাড়ী নিয়ে শুরু হল 'আমি গ্রামের, পথচলা। আমার চার পাশে ছিল খোলা ফসলের মাঠ, বাড়ী ঘরের আশে পাশে ছিল রংবেরং-এর ফুল ও ফলের গাছ, প্রত্যেক পরিবারের ছিল গোলা ভরা ধান, দীঘি ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু, ঝিল-বিলে ছিল হরেক রকম মাছ, গাছে গাছে ছিল নানা প্রজাতির পাখ-পাখালির অবাধ বিচরণ। নদীর কলকল ধবনি, খোলা মাঠের মুক্ত বাতাস, গাছের সবুজ পাতার দোলন, প্রশান্তির শীতল পরশ ও মায়ার আঁচল আমায় করেছিল আপনার চেয়ে কতনা আপন। কত জ্ঞানী গুণী শিল্পী-সাহিত্যিক গাঁয়ের রূপ-লাবন্য বর্ণনা করে অর্জন করেছে খ্যাতি, কুড়িয়েছে সুনাম। বাহ! মনে হচ্ছিল নূতন দেশের নূতন গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়ে আমি বুঝি স্বার্থক হলাম।

'আমি গ্রামে' বসবাসরত সহজ সরল মানুষ গুলোর প্রচুর টাকা বা ধনসম্পদ ছিল না বটে, তবে খুব সুখেই বসবাস করে আসছিল। সাজ সকালে পান্তাভাত খেয়ে কৃষাণ-কৃষাণীরা যে যার যার কাজে নেমে পড়ত। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা মনের আনন্দে মাঠে মাঠে নানারকম খেলা ধূলায় ব্যস্ত থাকত। সবুজ শ্যামল খোলা মাঠে গরু ছাগল দিনভর চরে বেড়াত আর গোধূলী বেলায় ধূলা উড়িয়ে গোয়াল ঘরে ফিরে আসত। সন্ধ্যা বেলায় মহিলারা জড় হয়ে খোশগল্পে বসে যেত ও কোরাস মিলিয়ে মিষ্টি মধুর গানে গানে পাড়াময় মুখরিত করে তুলত। চাঁদনী রাতে হরিবদল দিয়ে ছেলেরা মিলিত হয়ে ধূলিময় ক্ষেতে হা-ডু-ডু খেলার আয়োজন করত। রাতে যাত্রা গানের সানাই সুর পরিশ্রান্ত মানুষ গুলোর মনঃপ্রাণ অনন্দ ও বিনোদনে পুলকিত করে তুলত। আপদে বিপদে সুখে-দুঃখে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসাথে সকলেই যেন সকলের তরে ছিল একটিই পরিবার।





কিন্তু বিধিবাম, দিন দিন ছোট ছোট পরিবার গুলোর জন সংখ্যা বাড়তে লাগলো আর 'আমি গ্রামের, উপর নেমে আসল অমাবস্যার কালো রাত। অধিক জন সংখ্যার খাদ্য আহরণের জন্য বিদেশ হতে বিভিন্ন প্রজাতির বীজ এনে জমিতে আবাদ শুরু করল আর সেই সাথে জমিতে রাসায়নিক সার ও পোকা মারার বিষাক্ত ঔসধের অবাধ ব্যবহার। সার ও বিষাক্ত ঔষধের তেজস্ক্রিয়তায় একদিকে মাঠের কোমল মাটি যেমনি দগ্ধ হতে লাগলো ঠিক তেমনি বিল ঝিল ক্রমান্বয়ে মাছ শুন্য হয়ে গেলো আর হারিয়ে গেলো জীব-বৈচিত্র। আহারে! কি মিষ্টি মিষ্টি ফলের গাছ, মনোহর ফুলের গাছ, সবুজ পত্র পল্লবে ঘেরা ছায়াময় বৃক্ষাদি কেটে, পুকুর-দীঘি ভরাট করে আমার নরম তুলতুলে মাটির উপর নতুন নতুন বিল্ডিং বানানোর জন্য সবাই হতব্যস্ত পড়ল। উন্নয়নের নামে আমার বুক চিরে চিন্নভিন্ন করে তৈরী হলো উঁচু-নিচু ইটের রাস্তা, শহর হতে বিতাড়িৎ হয়ে লক্কর ঝক্কর দানবের মত ট্রাক, ট্রাক্টর ও বাসগুলি আমার পাঁজরের উপর অবিরত ধপাস ধপাস করে আঘাত করে চলছেত চলছেই।

এখন আবার বৈদু্যতিক লাইন ও এসেছে, এসেছে ডিস লাইন, এখন আর আগের মত ছেলে মেয়েরা হাডুডু বা কানা মাছি খেলে না, বউ ঝিরা সেই কুপি বাতি জ্বালিয়ে উঠানে বসে মনোমুগ্ধকর গান ধরে না। বাচ্চা কাচ্চা জোয়ান বুড়ো, গাঁয়ের সেই সরলা বধু সবাই আজকাল ইন্দি-হিন্দি ইংরেজী কি সব ভাষার দুম দামাক্কা নাচ দেখে, গান শুনে। হারিয়ে গেছে 'আমি গ্রামের, সেই চিরচেনা আকার, আকৃতি, রমণীয় সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য। 'আমি গ্রাম, ফেঁপে ফোলে মোটিয়ে মোটিয়ে অন্য গ্রাম গুলোর সাথে একাকার হয়ে মিশে গেছি, আমিতে আর আমি নেই। আমাকে আলাদা করে চিন্থিত করার আর কোন জো-নেই। আমি গ্রামের এখন নাকাল অবস্থা। যেভাবে ওজনের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছি (আল্লাহ না করুক) যে কোন মুহূর্তে সামান্য ভুমিকম্পের ধাক্কাতে হয়ত চিরতরে আমি তলিয়ে যেতে পারি। তাইত শঙ্কা জাগে বারেবার, অচিরেই হয়ত বিলুপ্ত হয়ে যাবে আমার নাম আর নতুন প্রজন্ম হয়ত একদা ইতিহাসের পাতায় খুজে বেড়াবে আমার জন্ম, ঐতিহ্য ও অবসানের আত্মকাহিনী। (খোদা তুমি রহম করো)।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মাহবুব খান ভালো লাগলো
রোদের ছায়া (select 198766*667891 from DUAL) বেশ একটু অন্য রকম লেখা পেলাম, ভালো লাগলো, কিন্তু ভাই হালিম, গ্রামটির নিশ্চয় একটা নাম ছিল, এখনে '' আমি গ্রামের উপর'' না লিখে আমার উপর লিখলেই বেশি ভালো লাগত, আমার মনে হলো.আর একটা কথা একটু বলতে চাই... গ্রামটি কি মুসলিম গ্রাম ছিল ? অনেক জায়গায় আমীন,আল্লাহ না করুক এরকম কিছু শব্দ না থাকলেই ভালো হত/
বিষণ্ন সুমন একটা মনোকষ্ট ফুটে উঠেছে আপনার লিখায় । যার রেশ স্পর্শ করে গেল পাঠক মনকে । এমন করে যদি সবাই বলতে পারত, তবে বোধ করি আমাদের এই দেশ সোনারাঙ্গা হয়ে উঠত ।
প্রজাপতি মন খুবই সুন্দর হয়েছে একটি গ্রামের আত্মকথা, শেষের দিকে এসে আমারও শঙ্কা জাগছে গ্রামের শেষ পরিণতির জন্য। কিভাবে ফিরে পাবো আমাদের এই গ্রামের ঐতিহ্য আবার নিতুন করে?
রোজ মোহাম্মদ আধুনিকীকরণের পরিবর্তনের ছোঁয়ায় গ্রামবাংলার চিরচেনা পরিবেশ তার স্বকীয়ত্ব হারাচ্ছে -- লেখক তার অসাধারণ বর্ণনা ও ভাষাসমৃদ্ধ গ্রামের আত্মকাহিনীতে সরল-সহজ জীবন যাপনের সুখী পরিবেশের বিলুপ্তির কঠিন বাস্তবতাকে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। যদিও যেকোনো পরিবর্তন আশীর্বাদ ও অভিশাপ দুটোই বহন করে। ভোট দিলাম।
Md. Akhteruzzaman N/A আমি গ্রামের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামের চরম চরম বাস্তবতার সুন্দর চিত্র একেছেন| আরও বিশদ বিবরণে লিখলে আমার মনে হয় আমাদের তৃপ্তির পরিমানটা অসীম হত| হালিম ভাই, অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইলো|
হিরো অনেক দুরদর্শী একটি গল্প। এক কথায় অসাধারণ।
আশা খুব ভালো লিখেছেন বন্ধু। আপনার চিন্তাশক্তি আপনাকে এর চাইতেও বেশি কিছু দিতে সক্ষম। তার প্রমাণ গ্রামের আত্মকথনেই বুঝা গেল। শুভকামনা আপনার জন্যে। ভালো থাকুন সবসময়।
Shohel বাহ! অসাধারণ ছাড়া আর কোন অপশন নেই। শুভকামনা রইল বন্ধু চিরজীবি হও।
খোরশেদুল আলম আপনার চমৎকার চিন্তার প্রকাশ একটি গ্রামের সুন্দর আত্মকথা। ভালো হয়েছে।

০১ মার্চ - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "পদত্যাগ”
কবিতার বিষয় "পদত্যাগ”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ জুন,২০২৫