১.
কালামের প্রস্তাবটা খুববেশি পছন্দ হলো না আছানের। যদিও এই জিনিসটার প্রতি বরাবরই তার দুর্বলতা থাকে। তাই বলে এই সময় রস চুরি করে খেতে হবে? তাও আবার মোমেনাদেরই গাছ থেকে? নাহ, প্রস্তাবটা ন্যায় সঙ্গত মনে হচ্ছে না। আছানের সম্মতি না পাওয়ায় পুনরায় মনঃসংযোগের জন্য কালাম তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়- আজকের রসটা কাটের রস। বিকালেই সে গনি শিউলীকে (গাছি) গাছ কাটতে দেখেছে। আছান ভালো করেই জানে গাছ কাটার পর যে তিন দিন রস সংগ্রহ করা হয় তার মধ্যে প্রথম দিনের রসটাই সবচেয়ে সুস্বাদু হয়। কালাম কথাটা বলার পর আছানের সম্মতি পাওয়ার আশায় থাকে। কিন্তু তাতেও কাজ হয় না। আছানের পক্ষ থেকে ইতিবাচক রায় পাওয়া যায় না। কালাম কিছুক্ষণ চুপ থেকে ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি নিয়ে বলে- "বুঝতি পারিছি, মোমেনারে ভালোবাসো তো তাই তাগো গাছের রস চুরি কুরে খাতি বিবেকে বাধদিছে। এটা ভাবার কোনো দরকার নাই, মোমেনার ভাই শিউলীর মজুরীর টাকা দিতি পারবে না বুলে তারে ভাগে (বর্গা) দিয়ে দেছে। এই রস সকালবেলা শিউলী আইসে নিয়ে যাবে। লস হলি শিউলীর হবে, মোমেনাগো তো লস হবে না"। এ কথায় আছান যেন কিছুটা আশ্বস্তবোধ করে। আছানের এই ভাব রাতের স্বল্প আলোতেও কালাম বুঝতে পারে। সে আছানের দিকে তাকিয়ে খেজুর গাছের কাছে এগিয়ে যেতে ইশারা করে।
সচরাচর কোনো কিছু চুরি করতে গেলে আশে পাশে তাকিয়ে পরিবেশ বুঝে নেয়ার দরকার হয়। কিন্তু কালাম ও আছানের কাছে এখন সেটার প্রয়োজন মনে হচ্ছে না। কারণ রাত একটার সময় গ্রাম একেবারেই নিঝুম থাকে। একজনও মানুষ জেগে থাকে না। তারা দু'জন ঈশ্বরীপুর থেকে যাত্রাপালা দেখে ফিরছে বলেই এই জেগে থাকা, নইলে তারাও ঘুমের ঘোরে বিভোর থাকতো। প্রতি বছর এই সময়টা ওখানে যাত্রাপালার দল আসে। আছান গত বছর যাব যাব করেও শেষমেশ যেতে পারেনি। এবার ভাটার কাজে যাওয়ার সময়টা একটু দেরীতে হওয়ায় এবারের যাত্রাপালা মিস করতে চায়নি। একা একা গিয়ে কোনো মজা হবে না বলে কালামকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কালাম তার দুলাভাইয়ের সাথে বনের নদীতে মাছ ধরার কাজ করে। আজ সেখানে যাওয়ার কথা থাকলেও গতকাল দুলাভাইকে শরীর খারাপের কথা বলে বনে যাওয়ার শিডিউলটা বাতিল করে বন্ধু আছানের কথামত যাত্রাপালা দেখার শিডিউলে মনে মনে সাইন করে নিয়েছে। অবশ্য এর পেছনে আছানের জোর তাগাদাও ছিল। দুজনের টিকিটের খরচ আছান একাই বহন করবে এমন একটা প্রস্তাব আগে থেকেই তার কাছে জমা দেয়া ছিল। তাই কালামও ফ্রি যাত্রাপালা দেখার সুযোগটা হেলায় হারাতে চায়নি।
খেজুর গাছগুলো খুব বেশি লম্বা না হওয়ায় হাত লম্বা করেই রসের ভাড় (হাড়ি) নামায় দু'জন। যদিও এতরাতে এদিকে কারো আসার সম্ভাবনা নেই তারপরও আছানের কাছে জায়গাটা সুবিধাজনক মনে হয় না। এমনিতেই মোমেনা তাকে পছন্দ করে না। আর যদি কোনোভাবে ধরা খায় তাহলে তো আর কোনো দিন মোমেনার সামনে দাঁড়াতে পারবে না। তিনটা গাছের মধ্যে দুইটা বড় আর একটা ছোট। ছোটটাতে আর হাত না দিয়ে বড় গাছ দু'টার রস সাবাড় করা হয়েছে। খাওয়া শেষ করে ভাড় দু'টি আবার যথাস্থানে রেখে দ্রুত সরে পড়ে দু'জন।
ঈশ্বরীপুর থেকে আসার পথে এতক্ষণ পর্যন্ত্ম তাদের আলাপচারিতার বিষয়ে যাত্রাপালার নাচ, গান আর অভিনয়ের দু'একটি ঘটনা উঠে আসলেও এখন তাদের আলাপচারিতায় ঠাই করে নিয়েছে মোমেনার প্রসঙ্গ। মোমেনার প্রতি আছানের দুর্বলতা কালাম ভালো করেই জানে। প্রায় এক বছর যাবৎ আছান মোমেনার পিছে ঘুরেও এখনো কোনো সম্মতি জুটাতে পারেনি। কালাম বন্ধু হিসেবে আছানের পছন্দকে গুরুত্ব দিলেও আজো পর্যন্ত মোমেনার কোন সুমতি না দেখে কথা প্রসঙ্গে বলে- "মোমেনার তো তোর দিকি ফেরার কোনো মতিগতি দেখিনে, তুই শুধু শুধু এখনো তার ভরসায় থাকিস কেন?" আছান চুপ থাকে। বুঝতে পারে না কি বলবে। কথাটা সে মন্দ বলেনি। কিন্তু আছান নিজেকে যে মানাতে পারে না। মোমেনা তাকে যতই অবহেলা করুক মনের আসনে মোমেনাকে ছাড়া সে আর কাউকে ভাবতে পারে না। তবে মোমেনার বড় ভাই বা ভাবীর সাথে আছানের সম্পর্ক বেশ ভালো। শুধু মোমেনা একটু রাজি হলেই হতো। বাপ-মা মরা একমাত্র বোনটার অমতে বিয়ে দিতে চায় না বলেই আছানের এই ভালোবাসার আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
মোমেনার ভাই কাসেম আলী বাড়ি না থাকলে সংসারের পুরুষালি কাজগুলোর জন্য আছানের ডাক পড়ে। যেমন, লাকড়ির জন্য বড় গাছের দু'একটা ডাল কেটে দেয়া, হাটে যাওয়ার সময় হাস-মুরগীর ডিমগুলো বিক্রি করতে দেয়া, হাটের দিন অতি প্রয়োজনীয় কিছু সদায়পাতি কিনতে দেয়া। এসব কাজ উপলক্ষ্যে যখন তাদের বাড়িতে যাওয়া হয় তখন সহজভাবেই দু'এক বার মোমেনার চোখাচোখি হওয়ার সুযোগ হয়। সেই চোখাচোখিতে আছান কিছু বোঝানোর চেষ্টা করলেও মোমেনা তা কখনো গায়ে মাখে না।
মাঝে মাঝে আছানের ভাবনা জাগে- কী কারণে সে মোমেনার মন পায় না? নিজের আচারণের খারাপ দিক বলতে গঞ্জে কেরামতের সিডিঘরে সপ্তাহে গোটা চারেক ছবি দেখে, মাঝে মধ্যে একটু যাত্রাপালা দেখে আর শখের বশে এক-আধটু বিড়ি টানে। অবশ্য এখন বিড়ির পরিবর্তে সিগারেট চলে। আছান ভেবে দেখেছে একজন ইয়াং মানুষ হিসেবে তার বিড়ি খাওয়া মানায় না; সেকেলে সেকেলে মনে হয়। সিগারেট একটু ব্যায়বহুল হয়, তবে এক প্যাকেট নেভি কিনলে পরের সপ্তাহজুড়ে সেই প্যাকেটে আকিজ বিড়ি রেখে অনায়াসে স্টাইল বজায় রেখে চলা যায়। সিডি দেখতে গিয়েই বিড়ির অভ্যাসটা তৈরী হয়েছে। সিডিঘরে সাকিব খানের নতুন ছবি আসলে না দেখা পর্যন্ত্ম মনটা স্থির হয় না। মোমেনা কি এ সবের কারণে তাকে অপছন্দ করে নাকি দৈহিক গড়ন বা চেহারা-সুরতের ব্যাপার স্যাপার আছে? সৌন্দর্য চর্চার উদ্দেশ্যে আয়নার মুখোমুখি না হলেও প্রতিদিন গোসলের পর অন্তত একবার চুল আঁচড়ানোর জন্য আয়নার সামনে যাওয়া পড়ে। আয়নাতে যা দেখা যায় সে অনুযায়ী তার কাছে তার চেহারাটা খুব বেশি খারাপ বলে মনে হয় না। ইট ভাটায় ধুলো-কাদার কাজ করতে হয় বলে সব সময় ভালো কাপড়-চোপড় পরে ঘুরে বেড়াতে পারে না। আয়রন করা শার্ট-প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়ালে তাকেও ভালো দেখাতো। এটা কি মোমেনা একবারও বোঝার চেষ্টা করে না? তাছাড়া ছবিতে সাকিব খানও তো সব সময় চৌধুরীর ছেলের ভূমিকায় থাকে না। মাঝে মাঝে লেবারের অভিনয়ও করে। কই, তাতে তো তার নায়িকা তারে অপছন্দ করে না!
সেবার যখন ইটভাটার মজুরী পেয়ে ছাব্বিশশো টাকা দিয়ে চায়নিস কোম্পানীর ভিডিও মোবাইলটা কিনে মোমেনাদের বাড়ি গিয়েছিল তখন মনে হয়েছিল, এবার আর মোমেনার মন পাওয়া কঠিন ব্যাপার হবে না। মোমেনার একমাত্র ভাতিজা মিলন থেকে শুরু করে কাসেম ভাই এবং ভাবীও যেমন অবাক হয়েছিল তেমন খুশিও হয়েছিল। কিন্তু মোমেনা একবারও মোবাইলটার প্রতি কোনো আগ্রহ দেখায়নি। নতুন মোবাইলে সত্তর টাকা দিয়ে কম্পিউটারের দোকান থেকে সাকিব খানের ছবি থেকে পছন্দের গানগুলো ঢুকিয়ে আনা হয়েছিল। সেদিন মোমেনার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে মিলনকে বলেছিল- "এর মদ্দি মেলা ভিডিও গান আছে"। মনে হয়েছিল কথাটা শুনে মোমেনা এদিকে এগিয়ে আসবে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আড়চোখে মোবাইলটার দিকে তাকাবে। কিন্তু না, তার মধ্যে কোন আগ্রহবোধ তৈরী হয়নি।
মোমেনাকে পছন্দ করার কথাটা তার ভাই কাসেম আলী তেমনভাবে না জানলেও তার ভাবী জানে। মাস দুয়েক আগে হরিনগর বাজার থেকে আছান লাল জরি বসানো একটা থ্রি-পিচ কিনে মোমেনার ভাবীর কাছে দিয়ে তাকে দেয়ার জন্য বলেছিল। মোমেনা থ্রি-পিচটা গ্রহণ করেনি। ওটা ফেরত দেয়ার ফলে আছান বুঝতে পারে মোমেনাকে নিয়ে সে যা ভাবে মোমেনা তাকে নিয়ে তা ভাবে না। সেদিন আছানের মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মনে কষ্ট নিয়েই থ্রি-পিচটা বাড়িতে এনে ট্রাঙে তুলে রেখেছে। তারপর থেকে তাদের বাড়িতে যেতে লজ্জা করে। তবে ভাবীর কোনো কাজের জন্য ডাক পড়লে ঠিকই সাড়া দেয়া হয়।
হাঁটতে হাঁটতে কালামদের বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছে দু'জন। আর একটু সামনে আছানদের বাড়ি। কালাম বিদায় নিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে। আছান হাঁটতে থাকে তার বাড়ির দিকে।
২.
ভোরে মায়ের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙ্গে যায় আছানের। রাতে ঘুমোতে একটু দেরী হওয়ায় আজ সকাল নয়টার আগে ঘুম থেকে ওঠার ইচ্ছে ছিল না তার। কিন্তু তা আর হলো না। লেপের মধ্য থেকে মুখটা বের করে দিয়ে মায়ের ডাকার কারণ জানতে চায়। জবাবে মায়ের কথাটা শোনার সাথে সাথেই সেই চমকে ওঠে। মা জানায় কাসেম আলী নাকি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে; তাকে ডাকছে। কাসেম আলীর নামটা শুনেই আছানের সব জড়তা নিমিষেই যেন দূর হয়ে যায়। রাতে কাসেম আলীর গাছের রস চুরি করার কথাটা এতক্ষণে বোধহয় সারা পাড়ায় হয়ে গেছে। কী সর্বনাশ না হয়ে গেল! কাসেম আলী আর তার বৌ আছানকে স্নেহ করতো সেটাও শেষ হলো। সেই সাথে ছেঁচড়া চোরের খেতাবটাও জুটে গেল। সব দোষ ঐ কালামের। শালার চৌদ্দগোষ্ঠি উদ্ধার করতে ইচ্ছে করছে। যা হয়ে গেছে যাক, এখন যে করেই হোক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা দরকার। লেপটা টান মেরে সরিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে আছান।
উঠানে এসে আছান খেয়াল করে তার মায়ের সাথে বেশ শান্তভাবেই কথা বলে যাচ্ছে কাসেম আলী। এ ধরনের ঘটনায় সাধারণত একটু উত্তেজিত কথাবার্তা চলে। কিন্তু তাদের মধ্যে তেমনটা নেই। আছান আস্তে আস্তে তাদের দিকে এগিয়ে যায়। সামনে এসে দাঁড়াতেই কাসেম আলী বলে- "আছান, তোমার ভাবী আজ খেজুর রসের পায়েস রান্না করতেছে তাই তোমারে দাওয়াত দেছে। আমি বেপারির বাড়ির দিকি যাচ্ছেলাম তাই আমারে বুলে দেলো তোমার যাওয়ার কথাডা বুলে যাতি। অবশ্যই যাবা, নয়তো তোমার ভাবী আবার রাগ করবেনে।" আছান অবাক হয় কাসেম আলীর কথা শুনে। কাসেম আলী আরো জানায় তার ছেলেটা নাকি অনেক দিন ধরেই রসের পায়েস খাওয়ার আবদার করছে। কিন্তু টাকার অভাবে রস কিনতে পারে না বলে গত বছরও ছেলেটার ইচ্ছে পুরণ করতে পারেনি। এমনকি নিজেদের খেজুর গাছ থাকার পরও শিউলীকে দিয়ে কাটিয়ে নেয়ার মত মজুরীও সে ব্যবস্থা করতে পারেনি। এ বছর গাছগুলো শিউলীর কাছে বর্গা দিয়েছে। যে পরিমাণ টাকার রস পাওয়া যাবে তার থেকে একটা অংশ তাকে দেবে। তবে গতকাল শিউলীকে বলা হয়েছিল আজকের রসটা যেন সে না নিতে আসে। বিনিময়ে তার পাওনা অংশ থেকে এই বাবদ টাকা কেটে রাখবে। সেই হিসেবে আজকের রস দিয়েই ছেলের আবদারের রসের পায়েস রান্না করা হবে। আছান বিস্ময়ভরা দৃষ্টি মেলে কাসেম আলীর কথাগুলো শুনতে থাকে।
আছান বিভিন্ন সময়ে কাসেম আলীর বৌয়ের অনুরোধে নানা রকম কাজ করে দেয়। তাই কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এই আয়োজনে সে আছানকে মেহমান হিসেবে পেতে চায়। কাসেম আলীর কথাগুলো শুনে আছানের ভিতরে অনুশোচনার দাবানল যেন সহসাই জ্বলে ওঠে। কসেম আলীর কথাবার্তায় বোঝা যায় সে খেজুর গাছ থেকে রস না নামিয়েই এসেছে, তারপরও আছান নিশ্চিত হওয়ার জন্য বলে, "কাসেম ভাই, গাছে কতটুকু রস হলো?" জবাবে কাসেম আলী জানায় খেজুর গাছগুলো খুব বেশি বড় না হওয়ায় মোমেনাই নামাতে পারবে। তাই সে বেপারীর সাথে দেখা করার জন্য দ্রুত বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছে। ভোরে না গেলে বেপারীকে বাড়ি পাওয়া যায় না। কথাগুলো বলে সে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়, "আমার দেরী হুয়ে যাচ্ছে, আমি যাই। তুমি অবশ্যই যাবা, নয়তো তোমার ভাবী রাগ করবেনে"। কথাটা বলেই সে হাঁটতে শুরু করে। আছান তাকিয়ে থাকে কাসেম আলীর চলে যাওয়া পথের দিকে। ধীরে ধীরে কাসেম আলী সকালের ধোঁয়াটে কুয়াশার মাঝে মিলিয়ে যেতে থাকে। আছান বুঝতে পারে এতক্ষণে কাসেম আলীর বাড়িতে কি ধরনের অবস্থা বিরাজ করছে। এমনিতেই ছেলের আবদার পুরণ করতে না পারার জন্য ভাবীর মন খারাপ হয়ে থাকবে তার উপর সে যখন মেহমান হিসেবে হাজির হবে তখন তারা রীতিমত লজ্জায় পড়ে যাবে। কিছু একটা করা দরকার। আছান মাফলারটা গলার সাথে পেঁচিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। তারপর দ্রুত বেগে হাঁটতে থাকে শিউলীদের বাড়ির দিকে।
৩.
মিলনের দিকে তাকাতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে মোমেনার। ছোট্ট বাচ্চারা মন খারাপ করলে নিজেদেরও খারাপ লাগে। মিলন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। আজকের সকালটা তার জন্য অনেক আনন্দের হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা আর হলো না। অন্যদিন যে মিলনকে লেপের মধ্য থেকে বের করা যায় না আজ সে-ই আগে উঠে মোমেনা ডেকে তুলেছে, "ফুপু.... ও ফুপু, রস পাড়তি যাবা না? তাড়াতাড়ি ওঠ"। দুইজন আনন্দের সাথে খেজুর গাছের কাছে গিয়ে শূন্য ভাড় দেখে হতবাক হয়ে যায়। চোরেরা মিলনের সমস্ত ভালো লাগার অনুভূতি মাটি করে দিয়েছে। মিলনকে সান্ত্বনা দেয়ার মত কোনো ভাষা খুঁজে পায় না মোমেনা।
মোমেনা বাড়ির মধ্যে এসে ভাবীকে বলার পর তার মনটাও খারাপ হয়ে যায়। মিলনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে, "কাঁদিসনে বাবা, তোর আব্বারে বুলে রস জোগাড় করবানে"। ছেলেকে সান্ত্বনা দিতে দিতে আমেনা বেগমের মনে আরেকটা সংশয় ভেসে ওঠে। মিলনের আব্বারে দিয়ে আছানকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে। আছান আসলে তখন কী হবে? ওর সামনে বড় লজ্জায় পড়তে হবে। মানুষকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াতে না পারা কী লজ্জার তা আজ তাকে পেতে হবে।
আমেনা বেগম আছানের আমন্ত্রণের কথাটা ভাবতে ভাবতে সামনে নজর করে একটা ছেলেকে হেঁটে আসতে দেখে। চেনা চেনা লাগছে। হ্যাঁ, শওকত গাজীর ছেলে কাদের। তার দুই হাতে দুইটা রসের ভাড়। ছেলেটা কাছে এসে বলে, "ভাবী, কাসেম ভাই আমারে দিয়ে এই দু'ভাড় রস পাঠিয়ে দেছে। এই রস দিয়ে পায়েস রান্না কত্তি বুলেছে।" আমেনা বেগম অবাক হয় কাদেরের কথা শুনে। কাসেম আলী এখন কোথায় জানতে চাইলে কাদের জানায় সে বেপারীদের বাড়ি যাওয়ার কথা বলেছিল। আমেনা বেগম তার হাত থেকে ভাড় দুটি নিয়ে একটি পাত্রে রস ঢেলে রাখে। মিলনের মুখে হাসি ফিরে আসে।
চুলার উপর পায়েস রান্না চলছে। মিলন খুশি মনে চুলার পাশ দিয়ে হাঁটাহাটি করছে। মোমেনা চুলার মধ্যে বিচলী ঠেলে দিতে দিতে বলে, "ভাই তো রস পাড়ার আগেই বাড়ি থেকে চলে গেছে। রস চুরির কথা জানলো কি কুরে?" আমেনা বেগম হাড়ির মধ্যকার পায়েসের মিশ্রণ ঘাটতে ঘাটতে জবাব দেয়, "বাড়ি আসলি জানা যাবেনে, যাইহোক মেহমানের মুখডা (সম্মান) রক্ষা করা যাবে। আছানরে আসতি বলিছি, আমি তো সেই চিন্ত্মা কত্তিছিলাম"।
বাড়ির মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে পায়েসের ঘ্রাণ নাকে আসতেই কাসেম আলী সোজা চুলার দিকে এগিয়ে আসে। চুলার কাছে এসে দাঁড়াতেই আমেনা বেগম জানতে চায়, সে কোথা থেকে রস পাঠিয়েছে। কথাটা শুনে কাসেম আলী অবাক হয়ে বলে, "কিসের রস?" আমেনা বেগম রস চুরি হয়ে যাওয়ার কথা এবং কাদেরের রস দিয়ে যাওয়ার কথা খুলে বলে। কথাগুলো শুনে কাসেম আলী আরো বেশি অবাক হয়। সে জানায় এসবের কিছুই সে জানে না। ঘটনার আকস্মিকতায় তিন জনই ভাবনায় পড়ে যায়। কেউ-ই বুঝতে পারে না এই রস কে পাঠালো। তাদের ভাবনার বিষয়টাতে অংশগ্রহণের মত বয়স মিলনের এখনও না হওয়ায় সে এসবে কর্ণপাত না করে পায়েস ভোজনের প্রহর গুনতে থাকে।
নিজেদের গাছের রসটা না হয় কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে কিন্তু কে আবার তার নাম করে রস পাঠিয়ে দিয়েছে সেটা অন্ত্মত জানা দরকার বলে মনে করে কাসেম আলী। কাদেরের সাথে দেখা করে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে এমন একটি আশ্বাস কাসেম আলীর পক্ষ থেকে স্ত্রী আমেনা ও বোন মোমেনাকে দেয়া হয়। পারতপক্ষে বিলম্ব না করে এটা যেন তদন্ত করা হয় এমন একটি তাগাদাও আমেনা বেগম দিয়ে দেয়। চুলার পাশে অনুষ্ঠিত আলোচনায় আপাতত এই সিদ্ধান্তই গৃহীত হয়।
৪.
মিলনের নাম ধরে একটা ডাক দিয়ে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে আছান। অন্যদিন এ বাড়িতে ঢোকার সময় মিলনের নাম ধরে না ডাকলেও আজ মিলনের আবদারের জিনিস নিয়ে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটা মাথায় থাকায় তাকে স্মরণ করা হয়েছে। আছানের কণ্ঠস্বর পরিচিত হওয়ায় সামনে আসার আগেই আমেনা বেগম বুঝতে পারে আছান এসেছে। বারান্দায় বসার জায়গা ঠিক করতে করতে সে জবাব দেয়, "মিলন ওর আব্বার সাথে বাইরির দিকি গেছে"। মোমেনা ভাবীর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। আছানের উপস্থিতি বুঝতে পেরে সে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। আছানের দেয়া থ্রি-পিচটা ফেরত দেয়ার পর থেকেই সে খুব প্রয়োজন ছাড়া তার সাথে কথা বলে না বা সামনে যায় না।
আমেনা বেগম আছানকে বসতে বলে তার মা কেমন আছে জানতে চায়। জবাবে আছান জানায় তার মা ভালো আছে। কথা বলার সময় আছান খেয়াল করে আমেনা বেগম সব সময় হাসি-খুশির মাঝে কথা বললেও এখন যেন তার কথাবার্তায় সেই ধরনের উচ্ছলতার প্রকাশ নেই। কেমন যেন গম্ভীর গম্ভীর ভাব। সে আমেনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে, "ভাবী তোমার কি মন খারাপ? কোনো কিছু চিন্ত্মা করতেছো বুলে মনে হচ্ছে।" আমেনা বেগম বুঝতে পারে সকালের ব্যাপারটার রেশ এখনো তার মনের মধ্যে থেকে যাওয়ায় কথাবার্তার মাঝে এর প্রতিফলন পেয়ে আছান এমন ধারণা করছে। সে আছানের কাছে কোনো কিছু লুকানোর চেষ্টা না করে রস চুরি হওয়ার এবং কাদেরের মাধ্যমে রস প্রাপ্তির ঘটনা খুলে বলে। আছান যদিও ধারণা করেছে কোন কারণে ভাবীর চিন্তা হচ্ছে তারপরও প্রশ্নটা করে পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত হয়। তাছাড়া গত রাতে কালামের সাথে বাড়ি ফেরার সময় যে কাণ্ড করা হয়েছিল সেটা বলার জন্য এই প্রশ্নটা পেশ করে সেই রকম একটা পরিবেশ তৈরী করারও দরকার ছিলো। ভাবী ঐ কথাগুলো বলায় রাতের ঘটনাটা তুলে ধরার সুযোগ হয়। আছান মুচকি হেসে বলে, "চিন্তা কোরার দরকার নি, আমি সব জানি। আমি খুলে বলতিছি, তার আগে বলো আমার ওপর কোনো রাগ করবা না?" আমেনা বেগম কিছুটা অবাক হয়ে বলে, "তোমার ওপর আমি রাগ করবো কেন? বলো"। রাতে কালামের প্ররোচনায় চুরির ঘটনাটা আছান খুলে বলে। কথাগুলো বলার সময় এটাও জানায় যে, রসটা শিউলী নিয়ে যাবে এমন কথা কালাম বলেছিল বলেই কালামের কথায় সে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে সে যখন কাসেম আলীর কাছে শোনে মিলনের আবদার পুরণ করতে আজকের রসটা বাড়ির জন্য রাখা হয়েছে তখন তার নিজের কাছে অত্যন্ত্ম খারাপ লেগেছিল। মিলনের আবদারের কথা জানলে আদৌ সে অমন কাজ করতো না। সে আরো জানায় মিলনকে সে আপন ভাতিজার মতই ভালোবাসে। আমেনা বেগম তন্ময় হয়ে শোনে আছানের কথাগুলো। মিলনের প্রতি আছানের অনুরাগের কথা তার অজানা নয়। হাটে গেলে প্রায়ই সে মিলনের জন্য এটা সেটা কিনে আনে। আছান অপরাধীর মত জানায়, তার কৃতকর্ম তাকে অনেকক্ষণ অনুশোচনায় ভুগিয়েছে। কাসেম আলী যখন তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বেপারীদের বাড়ির দিকে গিয়েছিল তখনই সে শিউলীর বাড়িতে গিয়ে দুই ভাড় রস কিনে কাদেরের কাছে দিয়ে এখানে পৌছে দিতে বলে। আর এই রস কাসেম ভাই-ই পাঠিয়েছে এ কথাই তাকে বলতে বলা হয়েছিল। কাসেম ভাই বাড়িতে ফিরলেই তার নাম করে রস পাঠানোর সুযোগ থাকবে না এবং পায়েসও আর রান্না করা হবে না। তাই কাসেম ভাই বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই তার নাম করে রস পাঠানো হয়েছে। আমেনা বেগমের কৌতুহল দূরীভূত হয়ে মুখমন্ডলে তৃপ্তির হাসি ভেসে ওঠে।
বারান্দায় পাতা চৌকিতে আছানকে পায়েস খেতে দেয়া হয়েছে। খেতে খেতে আছান জানায় মিলন বাড়িতে থাকলে তার সাথে বসে খেতে ভালো লাগতো। অবশ্য সে এখন না থাকায় একদিক দিয়ে ভালো হয়েছে। তার সামনে চুরির ঘটনাটা বলা যেত না। মোমেনা এতক্ষণ ঘরের মধ্যে চুপচাপ সব শুনে যাচ্ছিল। এবার সে মুখ খুলে বলে, "ভাবী তারে কইয়ো থ্রি-পিচটা পাঠিয়ে দিতি"। কথাটা কানে আসতেই আছান রীতিমত থমকে যায়। খাওয়া বদ্ধ হয়ে যায়। কি কারণে মোমেনার সুমতি হলো সেই প্রশ্নটাও মনের মাঝে উকি দেয়। তবে কি তার অনুতপ্ত অনুভূতি মোমেনাকে অভিভূত করেছে? আছানের ভাবভঙ্গি দেখে আমেনা বেগম বুঝতে পারে এটা পছন্দের মানুষের ইতিবাচক কথার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। আছানের তন্ময় মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, "কী ভাবতেছো আছান?" ভাবীর কথায় সে যেন সম্বিত ফিরে পায়, মুচকি হেসে বলে, "ভাবতিছি আগে জানলি চুরিডা আরো আগে করতাম"। কথাটা শুনে মোমেনা ফিক করে হেসে ফেলে। সে হাসির সময়সীমা ততটা দীর্ঘ নয়, শব্দটাও উচ্চাঙ্গের নয় তারপরও সেই ছোট্ট হাসির শব্দটা যেন আছানের সকল শিরা উপশিরায় অদ্ভুত তরঙ্গের দোলা সৃষ্টি করতে থাকে।