দক্ষিণের টুকরী ঘরটাতে বসে লিখছি। ঘরটির উপরে প্রকাণ্ড একটি আমগাছ থাকায় প্রবল রোদেও একটু স্বস্তি পাওয়া যায় । ঘরটি ঠাণ্ডা থাকে। তাছাড়া দক্ষিণের মৃদু মৃদু হাওয়া তো আছেই। লেখালেখিতে কখনই ভালো ছিলাম না। হাতের লিখা কোনরকমে পড়া যায়। হবে না,, মাত্র ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছি যে। এই বৃদ্ধ বয়সে আজ হাতে কলম তুলে নিয়েছি শুধু একটি কারণে, তা হচ্ছে অতীতের সুখস্মৃতিকে একটু স্মৃতিচারণ করা।
সে অনেক বছর আগের কথা। আমাদের গ্রামটি ছিল শিল্পীর আঁকা তুলির মত সুন্দর। নিবিড় বাংলার গ্রাম বলতে যা বুঝায় তাই। গ্রামের পাশ দিয়ে ছবির মত বয়ে গেছে নদী। নদীর পাড়ে আম হিজলের জটলা। হিজলের ফুল নিয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কত যে ঝগড়া হত তার ইয়ত্তা নেই। নদীর পানি এতই টলমলে ছিল যে দেখলেই আজলা ভরে খেতে ইচ্ছে করত। পানি এত টলটলে থাকার মূল কারণ ছিল এখানে শুধু নৌকা ছাড়া অন্য কোন জলযান চলাচল করত না। শুধু নৌকা, তাও চলত বৈঠা দিয়ে।
আমি তখন পড়ি ক্লাস সিক্সে। ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে কানামাছি, ভো-দৌড়, গোল্লাছুট খেলার অভ্যাস তখনও ছাড়তে পারি নি। স্কুল পালিয়ে এর ওর গাছের আম কাঁঠাল কত যে চুরি করে খেয়েছি সে কথা ভাবলে এখনও মনে দস্যিপনা চলে আসে । কিন্তু কি হবে, বয়স যে লাগামহীন। সবে ক্লাস সিক্সে উঠেছি, বিভিন্ন গ্রামের অনেক ছেলে মেয়ে এসে ভর্তি হয়েছে। যারা আমার সাথে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে তারাই শুধু আমার পরিচিত। বাকি সবাই অপরিচিত। কয়েকমাসের মধ্যেই সবাই একেবারে পরিচিত হয়ে গেল। আর একজন হয়ে গেল খুবই পরিচিত । মনের বাড়িতে যে তাকে ঠাই দিয়ে ফেলেছিলাম। সে ইতিহাসেই তো আসছি।
সেদিন ছিল মঙ্গলবার। স্কুলে আসার আগেই দেখেছি আকাশে ঘন কালো মেঘ। টিফিনের ঘণ্টা পরতে না পরতেই শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি। কি মনে করে সাথে ছাতা আনি নি। ভাবলাম স্কুল ছুটির সময় হয়ত বৃষ্টি থেমে যাবে। কিন্তু বিধি বাম। স্কুল ছুটি হয়ে গেল কিন্তু বৃষ্টির আঁচ এতটুকুও কমে নি। মনে হচ্ছে বেড়েছে কিছু। ঠায় দাড়িয়ে থাকলাম বন্ধুদের সাথে স্কুলের রেলিঙে পিঠ ঠেকিয়ে। হঠাৎ পাশে এল সে। চন্দন তার নাম । উজ্জ্বল ফর্সা গায়ের রঙ। চোখে নেশা লাগান দৃষ্টি। আস্তে করে বলল, তোমার বাসা কি কাছে কোথাও? আমি শুধু মাথা নাড়লাম। ও বলল, তাহলে চলো তোমাকে পৌছে দেই। আমি বললাম, না ঠিক আছে আমি পৌছে যেতে পারব। ও মৃদু হেসে বলল, কিভাবে যাবে বৃষ্টিতে ভিজে? বৃষ্টিতে ভিজলে তো জ্বর আসবে, ক্লাস করতে পারবে না। আমার কাছে ছাতা আছে, এস কোন ভয় নেই। আমি আস্তে করে মাথা নেড়ে ওর সাথে পা বাড়ালাম। হাঁটছি দুজনে নীরবে, হঠাৎ ও প্রশ্ন করল, তোমার কি শীত লাগছে? আমি বললাম, একটু একটু লাগছে, আচ্ছা তোমার কাছে ছাতা থাকা সত্ত্বেও তুমি চলে গেলে না কেন? ও ফিসফিসয়ে বলল, তোমার জন্য। আমরা কেউই আর কোন কথা বললাম না। কেমন যেন একপ্রকার ভালোলাগায় মনটা ভরে গেল। এভাবেই চলল কিছুদিন। কখন যে আমরা একে অপরের প্রেমে পড়ে গেলাম টেরই পেলাম না।
আর মাত্র দুই দিন পর পহেলা বৈশাখ। বাঙলা নববর্ষ। ওহ কি যে মজা করব। চন্দন বলেছে আমাকে নিয়ে সারাদিন মেলায় ঘুরবে। যাত্রা দেখাবে, সার্কাস দেখাবে, চুড়ি ফিতা কিনে দেবে। ভাবতেই যে কি ভালো লাগছে। এল সেই দিনটি। আমরা দুজনে মেলায় গেলাম। মেলায় ঘুরছি ফিরছি, হঠাৎ কোথেকে এল একদল সাদা পাঞ্জাবী পড়া মানুষ। এসেই বলল, এসব হিন্দুপনা এখানে চলবে না। এই বলেই ওরা যাকে সামনে পেল তাকেই অস্ত্রদ্বারা বিধ্বস্ত করে চলল। আমি ও চন্দন দৌড় দিলাম। কিন্তু বেচারা হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল।্ আমি ততক্ষণে অনেকটুকু পথ চলে এসেছি। ফিরে যাওয়ার আগেই যা হবার তা হয়ে গেল। সেই কথা মনে পড়লে আজও আমার দুচোখে পানির বাধ মানে না। কতই না ভালবাসতাম তাকে। যেই নববর্ষ আমাদের শত বছরের লালিত ঐতিহ্য, সেই নববর্ষ হিন্দুপনা হয় কিভাবে? কেউকি এর উত্তর দেবেন? মানুষের স্বপ্ন কি এভাবেই অবুঝদের হাতে বলী হবে? আজও সেই নববর্ষ আছে, শুধু নেই আমার চন্দন। আমি বিয়ে করিনি শুধু আমার চন্দনের ভালোবাসার কথা বুকে আগলে রেখে।
০১ মার্চ - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৬ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪