ভদ্রমহিলা দরজায় দু’বার টোকা দিলেন। কিন্তু অনুমতির অপেক্ষা করলেন না। স্থির ভাবে  ঘরে ঢুকে উল্টো দিকের চেয়ার টেনে বসলেন। 
সবে একটা স্যান্ডউইচ মুখে দিয়েছি। টেবিলের উপর ট্যাপা খাওয়া এলুমিনিয়ামের লাঞ্চ বক্স। লাঞ্চ বক্সের ভেতরে তার দ্বিগুণ ট্যাপা খাওয়া সিদ্ধ ডিম। 
এ সময়ই আসতে হবে? 
ভদ্রমহিলা মনে হলো না এসব কিছু খেয়াল করছেন। 
‘আমি অনন্যা আজাদ’
এমন ভাবে বললেন যেন নাম শুনেই চিনতে পারব। পেপার-টেপার আমার পড়া হয় না। খুব একটা টিভিও দেখি না। মুখশ্রী দেখে মনে হলো নায়িকা কিম্বা উপস্থাপিকা হবেন। অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়লাম,
‘অভিনয় করেন, তাই না?’
ভদ্রমহিলা ফিক করে হেসে দিলেন। বয়স-ঢাকা কাঁচ-ভাঙ্গা হাসি।  অফিসের একমাত্র ড্রাফটসম্যান মিজান পর্যন্ত ঘুরে তাকালো। ভদ্রমহিলা ব্যাগ থেকে কার্ড বের করে এগিয়ে দিলেন।
কার্ড দেখে আমি একটু নার্ভাস বোধ করলাম। উনি আমার অস্বস্তি টের পেলেন। বললেন।
‘একটা ডিজাইন করতে হবে’
‘আমাকে?’ বলেই বুঝলাম কথাটা বোকার মত হয়ে গেছে। এটাই তো আমার পেশা।
‘আপনি গুলশানে শুক্লাদের ইন্টেরিওর করেছেন’
খুব বেশী দিন হয়নি শুক্লাদের কাজটা শেষ করেছি। কিছু অর্থাগমও ঘটেছে। তার উপর ভর করেই ইস্টার্ন প্লাজায় অফিসটা নিয়েছি। ভদ্রমহিলা আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললেন,
‘কাজটা ভালোও না, খারাপও না। ভিন্ন রকম। সে কারণেই কাজটা ভালো।’
একটা নামী কন্সট্রাকশন ফার্মের অন্যতম মালিক উনি এবং ওনার হাসবেন্ড। বিভ্রান্তি নিয়ে বললাম,
‘আপনাদের কন্সট্রাকশন ফার্মেই তো অনেক ইন-হাঊজ আর্কিটেক্ট আছে’
‘আছে। বেশীর ভাগ মিডল এজ্ড্। করাপ্টেড অ্যান্ড কম্প্রমাইসিং। আপনি ইয়াং। সেলফ এমপ্লয়েড। ভেতরে এখনো আগুন আছে। নিভে যাওয়ার আগেই সে আগুনের স্পর্শটা জরুরী’। 
বুঝলাম না কার জন্য জরুরী। একটু থেমে আবার বললেন,
‘আমাদের বিয়ে বার্ষিকী জানুয়ারিতে। ন’মাসের ভেতরে বাড়িটা বানাতে হবে। আমার হাসবেন্ডের জন্য এটা একটা সারপ্রাইজ।’
বিয়ে বার্ষিকীতে বরকে যিনি বাড়ি উপহার দেন তার সাথে কথা কম বলাই ভালো। চুপ করে থাকলাম।
‘আমি আপনাকে ডিজাইন ব্রিফ ইমেইল করব। হ্যাভ এ লুক অ্যান্ড গেট ব্যাক টু মি’ 
পরদিন ভোরে ইমেইল খুলে ডিজাইন ব্রিফ পড়লাম। সাইট লোকেশন টঙ্গি। তুরাগ নদীর ধার ঘেঁষা জমি। দুই বিঘা। বাড়ি হবে তেতালা। বিল্ডিং ফুট প্রিন্ট পাঁচ কাঠা। বাকিটা ল্যান্ডস্কেপিং। নামও একটা রেখেছেন। স্ফটিক মহল।
প্রতিষ্ঠা নামক সুউচ্চ ভবনের সিঁড়ি ভেঙ্গে সবে ওঠা শুরু করেছি। একটু উঠেই যেন একটা লিফট পেয়ে গেলাম। এমন সুযোগ হেলায় হারাবার প্রশ্নই ওঠে না। সঙ্গে সঙ্গেই আমার আগ্রহের কথা জানিয়ে দিলাম।
এর পর মাসখানেক গত হলো। কোন খবর নেই। কাজটা নিশ্চয়ই বড় কাউকে দিয়ে দেয়া হয়েছে। এমনি হয়। আমিও দিবাস্বপ্ন ভুলে মধ্যবিত্ত জীবনের প্রাত্যহিক ঘানি টানায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। 
একজন উঠতি স্থপতিকে অনেক কিছুই করতে হয়। কখনো ফটোগ্রাফি, কখনো গ্রাফিক ডিজাইন, কখনো বাড়ির মডেল বানানো, আবার কখনো থ্রি-ডি রেন্ডারিং। এরকম খুচরো অকাজগুলোই তাকে টিকিয়ে রাখে। সবচেয়ে কম করা হয় বাড়ির ডিজাইন।
এই মুহূর্তে হাতে কর্পোরেট ব্রান্ডিং-এর একটা কাজ। কালার স্কিম, ব্রোশিওর ডিজাইন, কার্ড ডিজাইন, লেটার হেড, এই সব। একটা ভারী ফটোশপ ফাইল পজিটিভ বানানোর জন্য ইপিএসে কনভার্ট করছি এমন সময় দরজায় টোকা। অনন্যা আজাদ। এবার আর ভেতরে ঢুকলেন না। দরজায় দাঁড়িয়েই বললেন,
‘সন্ধ্যা সাতটায় গুলশান চলে আসুন। অ্যাসপ্যারাগাস রেস্টুরেন্ট। হাতে সময় নিয়ে আসবেন’ 
উত্তরের অপেক্ষা না করেই উনি চলে গেলেন।
সাতটা বাজার পাঁচ মিনিট আগেই রেস্টুরেন্টে হাজির হলাম। অনন্যা আজাদ জানালার পাশের একটি টেবিলে। আমাকে দেখে হাত নাড়লেন। এই প্রথম ওনাকে ভালো মত লক্ষ্য করলাম। জিন্স আর ফ্লানেল শার্ট পাল্টে কলাপাতা রঙ জর্জেট শাড়ি পড়েছেন।। ওপরে ঘন সবুজ শাল। মদিগ্লিয়ানির আঁকা নারীদের মত লম্বাটে মুখ। মেকআপ দিলেও এত হাল্কা যে বোঝার উপায় নেই। মাথায় ঘন চুল এক বেণী করে পেছনে বাঁধা। খাবার অর্ডার করেই উনি সরাসরি কাজের কথায় আসলেন।
‘কাঁচ-বাড়ি সম্পর্ক ধারণা আছে?’
স্থাপত্যের ইতিহাস পড়েছি ছাত্রাবস্থায়। মিজ ভ্যান্ডার রহ’র ফার্ন্স্ওয়ারথ হাউজ, ফিলিপ জন্সনের গ্লাস হাউজের কথা বললাম গড় গড় করে। হালের নরম্যান ফস্টারের কথা পাড়তেও ভুলিনি। নিজেকে আপ টু ডেইট দেখাতে হবে তো।
‘এর একশ’ বছর আগেই কিন্তু আরও বড় স্কেলের কাঁচ-বাড়ি হয়েছে’
আমার মনে পড়ছিল না। উনিই ধরিয়ে দিলেন।
‘ক্রিস্টাল প্যালেস। ১৮৫১। লন্ডনে। রবীন্দ্রনাথের জন্মের দশ বছর আগে। ক্রিস্টাল প্যালেসের সাইট থেকে চার মাইল দূরেই কিন্তু রবীন্দ্রনাথের দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথকে কবর দেয়া হয়। ১৮৪৬-এ।’
স্ফটিক মহল নামকরণের রহস্য উদ্ঘাটিত হলো। এও বুঝলাম যে উনি যথেষ্ট হোম ওয়ার্ক করেই এসেছেন। আমি কিছু বলার আগেই অনন্যা বললেন,
‘শালিমার গার্ডেনের ডিজাইন দেখেছেন, লাহোরে?’
‘দেখেছি। টেক্সট বুকে। মুঘল ল্যান্ডস্কেপিং। যোগ চিহ্নের মত পানির ধারা চারটি বাগানকে ধরে রেখেছে।’
‘শালিমার গার্ডেনের মত হবে ল্যান্ডস্কেপ । আর বাড়ির কথা তো আগেই বলেছি।’
ওয়েটার খাবার দিয়ে গেছে। আমার জন্য ফ্রাইড রাইস আর মুরগীর ভুনা। উনি প্লেটে সালাদ নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন। অনুরোধ করলাম বাড়ির ব্যাপারটা আরেকটু খোলাসা করতে।
‘একটা স্বচ্ছ স্ফটিক। প্ল্যানটা হবে অক্টাগনাল। ফর্মটা আপনি ঠিক করবেন। ভেতরে কাঁচের ফ্লোর, কাঁচের পার্টিশন। যতটা সম্ভব ওপেন প্ল্যান।’ 
কাঁচ নিয়ে ভদ্রমহিলার আসক্তি আমার মোটেও ভালো লাগছে না। জ্বালানির অপচয় আর কার্বন এমিশনের যন্ত্রণায় পরিবেশ অতিষ্ঠ। সময়টা এখন নবায়নযোগ্য উপাদান আর টেঁকসই স্থাপত্যের। কাঁচের মত জ্বালানিখোর পদার্থের চাকচিক্যের চমকে চিড় ধরছে ক্রমশ । কিন্তু কথাটা সরাসরি বলার সাহস পাচ্ছি না। কাজটা যদি অন্য কাউকে দিয়ে দেয়? বললাম,
‘এত কাঁচ। ভেতরে কিন্তু খুব গরম হবে। প্রাইভেসি বলে কিছুই থাকবে না।’
‘ড্যান ব্রাউনের নতুন উপন্যাসটা পড়ছেন, ইনফার্নো?’
‘না’
মনে মনে বললাম, আপনার মত যখন তখন বিদেশী বই কিনে পড়ার পয়সা নাই ম্যাম। 
‘পঞ্চম অধ্যায়ে একটা কাঁচের পার্টিশনের কথা আছে। বোতাম টিপে স্বচ্ছ-অস্বচ্ছ করা যায়। সাস্পেন্ডেড পারটিক্ল্ ডিভাইস। গুগল সার্চ করে দেখলাম জিনিসটা আছে। আপনি প্রাইভেসির কথা ভাবছেন। এইতো সল্ভ্ হয়ে গেলো।’ একটু থেমে বললেন,
‘করিম, কাজটা আমি আপনাকেই দিচ্ছি। দু’তিন মাস সময় নিন। শান্ত মনে রিসার্চ করুন। তারপর একটা প্রাথমিক ডিজাইন দাঁড় করিয়ে দেখান।’
ওনার মেঘমেদুর উদারতায় আমি দ্রবীভূত হলাম। মনে হলো পৃথিবী আজও কত সম্ভাবনাময়।
সেদিন যাবার সময় একটা চেক রেখে গেলেন। অন্তত মাস ছয়েক অফিসের ওভারহেড নিয়ে ভাবতে হবে না। কিছুটা কৃতজ্ঞতা, কিছুটা আকর্ষণ-মিশ্রিত উত্তেজনা আর কিছুটা নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদে আমিও উঠে পড়ে লাগলাম। 
পরের দুমাসে অনেক কিছুই শেখা হলো। ডবল গ্লেইজিং, ট্রিপল গ্লেইজিং, ট্রান্সপারেন্ট ইন্সুলেশন, উইন্ড ক্যাচার, স্ট্যাক ভেন্টিলেশন। শালিমার গার্ডেনের প্ল্যান নিবিড়ভাবে নিরীক্ষা করলাম। পাথরের কাঠিন্যে ঘেরা সবুজ বাগানে কোমল জলের তারল্য কেমন আশ্চর্য হুল্লোড় বাঁধিয়ে দিতে পারে! মুঘল স্থাপত্য আর ল্যান্ডস্কেপিং-এর সাথে আমাদের সংসদ ভবনের মিল দেখে পুলকিত হলাম। ধীরে ধীরে অনন্যা আজাদ আর তার প্রজেক্ট আমার মনের গভীরে ব্যক্তিগত হয়ে উঠলো। 
এর মাঝে উনি আরেকদিন ফোন করলেন। বেইসমেন্টের কথা বেমালুম ভুলে গেছেন। স্ফটিক মহলে পাতাল ঘর থাকবে। একটা কাঁচের সিঁড়ির ঝর্ণার মত গড়িয়ে নেমে যাবে পাতাল ঘরে। পাতাল ঘরের ঠিক মাঝে প্যানিক-রুম। প্যানিক-রুম নামে নাকি একটা সিনেমা হয়েছে ২০০২ সালে। সেখান থেকে ধারণা নিতে বললেন। 
প্যানিক-রুম ব্যাপারটা আমার কাজে একটা গতি আর থ্রিল নিয়ে এলো। সিনেমাটা রোমাঞ্চ নিয়ে দেখলাম। পুরু লোহার দেয়ালে ঘেরা ব্যাংকের ভল্টের মত এই ঘর। নয়-এগারোর পর থেকে উত্তর অ্যামেরিকার দামী বাড়িগুলো প্যানিক-রুমযোগেই বিক্রি হয়। হঠাৎ আক্রান্ত হলে ধনীদের বাঁচতে হবে যে! কাঁচের সিঁড়ি নিয়েও অনেক গবেষণা করলাম। একজন স্থপতির খোঁজ পেলাম। ইভা জিরিকনা। ভাস্কর্যের মত অপার্থিব সুন্দর সব কাঁচের সিঁড়ি বানিয়েছেন। দেখলে মনে হয় জমাট বাঁধা সঙ্গীত। তেমন একটা সিঁড়ি আমিও ডিজাইন করলাম।
অনন্যার সৌজন্য এর ভেতর অফিসে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বড় বড় কম্পিউটার মনিটর বসানো হয়েছে। পাইরেটেড অটোক্যাড সফটওয়ার পাল্টে লাইসেন্স নেয়া হয়েছে। মডেল বানানোর হাত থেকে রেহাই দিয়েছে থ্রি-ডি প্রিন্টার। পরিবর্তন এসেছে আমার নিজের জীবনেও। সামিয়ার সাথে ক্রমশ গাঢ় হয়ে ওঠা সম্পর্কটা ভালোলাগাতেই থমকে থাকলো। ওর ভাসা ভাসা জল তরঙ্গ জীবনে শোলার মত ভেসে বেড়ানো হয়তো সম্ভব কিন্তু নোঙ্গর ফেলার মত গভীরতা পেলাম না।
অনেক ইমেইল বিনিময়ের পর জুলাই মাসের মাঝামাঝি ডিজাইন চূড়ান্ত হলো। প্রবল বর্ষায় তখন শহর ডুবে গেছে আর আকাশে পেপার ওয়েইটের মত ভারী ভারী পড়ন্ত মেঘ। এক শুক্রবার ভোরবেলা গায়ে এক রাশ বৃষ্টির ছাঁট নিয়ে অনন্যা এলেন। আমরা সবাই অফিসের প্রিন্ট রুমে। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে প্রিন্ট বোতাম স্পর্শ করলাম। সাদা ফ্রেমের উপর একটার পর একটা স্বচ্ছ আর অস্বচ্ছ প্লাস্টিকের আস্তর পড়তে লাগলো। ধীরে ধীর স্ফটিক মহলের ত্রিমাত্রিক প্রিন্ট ভাস্কর্যের মতই বিমূর্ত হলো। অনন্যা আমার ডান হাতে আলতো করে চাপ দিলেন। ওনার চোখে নতুন কন্টাক্ট লেন্সের মত হাল্কা জলের চকচকে প্রলেপ। 
আগস্ট মাসে ভবন নির্মাণ শুরু হলো। থাইল্যান্ড থেকে স্পেশালিষ্ট কন্সট্রাকশন টিম আনা হয়েছে। আমি নাওয়া খাওয়া ভুলে প্রতিদিন সাইটে বসে থাকি। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি নবীন বৃক্ষের মত একটা ভবনের শেকড় গেঁড়ে বেড়ে ওঠা। মাঝে মধ্যে অনন্যা আসেন। হলুদ প্রটেকটিভ ক্যাপ পড়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সাইট ঘুরে দেখেন। সামান্য ভুল নজরে পড়লে ভেঙ্গে নতুন করে গড়তে বলেন। মিস্ত্রীরা বিরক্ত হয়। আমি আপ্লুত হই।
এমন এক বিকেলে অনন্যা আমাকে ওনার বাসায় নিয়ে এলেন। আমাকে ড্রইং রুমে রেখে উপরে গেলেন। ডবল-হাইট রুম জুড়ে বেশ কিছু ভাস্কর্য আর পেইন্টিং।  আমি আগ্রহভরে দেয়ালে ঝুলানো শিল্পী সুলতানের আঁকা  বিশাল এক অয়েল পেইন্টিং দেখছিলাম। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনে ফিরে তাকালাম। কমলা শাড়ি পড়া অপরূপা একটি মেয়ে সেগুন কাঠের রেলিং ধরে ব্যালেরিনার মত নেমে আসছে। পেছন পেছন মধ্য বয়স্ক একজন লোক। মেয়েটির অন্য হাত লোকটির হাতে ধরা। লোকটা কিছু একটা বলছে আর মেয়েটি হেসে গলে পড়ছে। একসময় ওরা নীচের সোফায় এসে বসল। মেয়েটি এখন লোকটিকে জড়িয়ে ধরেছে। লোকটি মেয়েটির গালে বার বার চুমু খাচ্ছে। পুরো সময়টা ওরা আমাকে দেখেও না দেখার ভাণ করল। একটু পরেই বাইরে বেরিয়ে গেলো। গাড়ির ইঞ্জিন চালুর শব্দ পেলাম। ইংরেজ আমলে মেম সাহেবরা ভারতীয় পুরুষ ভৃত্যকে দিয়ে কাপড় খুলিয়ে নতুন কাপড় পড়তেন। পুরুষ ভৃত্য কি দেখলো না দেখলো তাতে কোন যায় আসত না। কারণ ভৃত্যদের ওরা মানুষ বলেই গণ্য করত না। ভাবলাম আমাকেও  হয়তো ওরা মানুষ বলে গণ্য করল না। আমার কান দুটো গরম হয়ে গেলো। অনন্যা নীচে আসতেই বললাম,
‘এক ভদ্রলোক এই মাত্র নীচে নেমে বেরিয়ে গেলেন’
‘আমার হাসবেন্ড’
আমি জানতে চাওয়ার আগেই বললেন,
‘সাথের মেয়েটি ওর মিস্ট্রেস।’
তারপর বললেন,
‘চা না কফি, কি খাবেন?’
আমি কিছুই বলতে পারলাম না। মুখটা বিস্বাদ হয়ে গ্যালো।
ডিসেম্বরের এক বিকেলে ভবনের চাবি বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নিলো কন্সট্রাকশন টিম। নির্ধারিত সময়ের সপ্তাহ খানেক আগেই। অনন্যার চেয়েও বেশী আনন্দ আমার। যাক ওদের সংসারটা এবার রক্ষা হবে। রূপকথার মত অত্যাশ্চর্য এক উপহার দিয়ে পরীর মত সুন্দরী শাক চুন্নির হাত থেকে বরকে উদ্ধার করবে অনন্যা। দাম্পত্য জীবনের আনন্দে আর ঔজ্জ্বল্যে উথাল পাথাল করবে ওদের সংসার তরণী। আমার ভূমিকা তাহলে এখানেই শেষ। কেন যেন মনটা ভারী হয়ে এলো।
জানুয়ারির এক তারিখ ওদের বিয়ে বার্ষিকী। বিকেল চারটায় ভবনের উদ্বোধন। প্রবল উত্তেজনায় এক ঘন্টা আগেই উপস্থিত হলাম। নার্সিসাসের মত অবাক বিস্ময়ে স্ফটিক ভবনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। একটু পর কালো মার্সিডিসে চড়ে অনন্যার স্বামী এলেন। আমাকে দেখেও না দেখার ভান করলেন। বিরক্ত মুখে বাইরের বাগানে ঘোরা ঘুরি করতে লাগলেন। ভাবলাম, তবু ভালো, শাঁকচুন্নিটাকে সঙ্গে আনেননি। ঠিক চারটায় আমার ফোনে টেক্সট মেসেজ এলো,
‘প্যানিক-রুমে চলে আসো।’
অনন্যার প্রজ্ঞা আমাকে মোহিত করলো। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে একটা বোঝাপড়া হবে। সেটা যতটুকু পারা যায় প্রাইভেসীতে হওয়াই ভালো। অনন্যা চাচ্ছেন এ সময় আমিও ওনার পাশে থাকি।
আমি আর মিস্টার আজাদ ঝর্নার জলের মত কাঁচের সিঁড়ি ভেঙে পাতাল ঘরে নামলাম। প্যানিক-রুমের দরজা খোলা। ভেতরে বিয়ের ঝলমলে শাড়ি আর ঝঝকে গহনা পড়ে অপেক্ষমাণ অনন্যা আজাদ। 
শায়িত। প্রাণহীন।
আমি ফিরে গেলাম নিজের ডেরায়। দু’দিন ঘরের দরজা বন্ধ করে গুম হয় বসে রইলাম। বোঝার চেষ্টা করলাম কি ঘটলো। একসময় পুরো ব্যাপারটা আঁচ করে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো।
 
এত দিন ধরে আসলে অনন্যার অন্তিম ইচ্ছা পূরণ করেছি। একটা তাজ মহল বানিয়েছি। শালিমার গার্ডেনের ল্যান্ডস্কেপের কথা বলেছিল অনন্যা। সেটাতো তাজ মহলেরও ল্যান্ডস্কেপ। স্ফটিক মহলের প্ল্যানটা অক্টাগনাল এবং সিমেট্রিক, তাজ মহলেরও তাই। তাজমহলের পাতাল ঘরে মমতাজের সমাধি। অনন্যা শায়িত আছে স্ফটিক মহলের পাতাল ঘরের প্যানিক-রুমে। শালিমার গার্ডেনের কাছেই শাহ জাহানের শীস মহল, যার ইংরেজী ক্রিস্টাল প্যালেস। আর বাংলা? স্ফটিক মহল। 
আর হে খোদা আমাকে যেন অনন্যা আজাদের নাম বিশ্লেষণ করতে না হয়। আমি ভাবতে চাইনা অনন্যা শব্দের আরবী হলো মুমতাজ। আমি জানতে চাই না সম্রাট শাহ জাহানের আরেক নাম আজাদ। আর আমি আব্দুল করিম, সেও কি তাজমহলের তিন স্থপতির একজন ছিল না?
এত দিন ধরে আভাসে ইঙ্গিতে অনন্যা তাজ মহলের কথাই বলছিলেন। মৃত্যুর গহীনে তলিয়ে যাওয়ার সময় হয়তো একটা পিছু ডাকের অপেক্ষায় ছিলেন। চাইছিলেন যেন নিজ থেকেই বুঝতে পারি একটা সমাধির ডিজাইন করছি। 
আর আমি বুরবকের মত কিছুই ধরতে পারিনি? যা নিজের নয় তা হারানোর শোকও যে কত তীব্র হতে পারে এই প্রথম উপলব্ধি করলাম।
সেদিন রাতে নতুন কেনা মারুতি গাড়ি টেনে স্ফটিক মহলের কাছে গেলাম। অমাবস্যার রাত।  ঘন অন্ধকারে স্ফটিক মহল হীরের টুকরোর মত জ্বল জ্বল করছে। ধীরে ধীরে ভেতরের বাতি গুলো রঙ বদলাচ্ছে। হলুদ থেকে ক্রমশ কমলা, কমলা থেকে ক্রমশ হলুদ। হঠাৎ মনে হলো স্ফটিক মহল যেন একটা জ্বলন্ত চিতা যার আগুনে অনন্যার অশান্ত আত্মা অনন্তকাল ধরে দাহ্যমান। 
তবু তো ইচ্ছে পূরণ।            
                        
            
            
            
                        
            
            
                        
            
         
        
               
   
    
                    
        
        
            
            
                 ০১ মার্চ  - ২০১১ 
                                        
                            গল্প/কবিতা:
                            ৫২ টি
                        
                    
            
            
         
     
    
        
বিজ্ঞপ্তি
        এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
    
    
        প্রতি মাসেই পুরস্কার
        
            বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
        
        
            লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
            
                - 
                    
                    
                        প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
                        প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
                     
- 
                    
                    
                        দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
                        প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
                     
- 
                    
                    
                        তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
                     
 
     
    
        
        বিজ্ঞপ্তি
        “নভেম্বর ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ নভেম্বর, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।
        প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী