সাতটা বাজতে পনেরো মিনিট বাকি। কফি শপের ভিড় ক্রমশ বাড়ছে।
রত্না তেতালার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। বাস,রিক্সা,প্রাইভেট কার গায়ে গায়ে লেগে গলিত লাভার মত একটা প্রবাহ তৈরি করেছে। গাড়ির ফাঁকে ফাঁকে রিক্সা গুলো জলে ভাসা টিনের তোরঙ্গের মত দুলছে। রাস্তার উপরে সার বাঁধা স্ট্রিটল্যাম্পের আলো ঝাপসা ধূসর থেকে উজ্জলতর সাদা হচ্ছে। এরই মাঝে কোথাও কোথাও থোকা থোকা অন্ধকার কালো গোলাপের মত পাপড়ি মেলে আছে।
সন্ধ্যে নামার পর ঢাকা শহরটা কেমন অজানা, অস্থির, আর রহস্যময় হয়ে ওঠে।
সাতটা বাজতেইমুঠোয় ধরা মোবাইলটা স্নায়ু রোগীর মত কেঁপে উঠল। মোজাফফর।
‘কোথায় তুমি? দেখছি না তো’, মোজাফফরেরকণ্ঠে উষ্মা।
‘আমি গ্লোরিয়া কফি শপে’ , রত্নার কোন বিকার নেই।
‘তোমাকে তো বললাম আবাহনীর মাঠের কাছে আসতে’
‘গ্লোরিয়াতে আসুন’, রত্না ফোন কেটে দিলো।
মিনিট পাঁচেকের ভেতর মোজাফফর কফি শপের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। মুখের চোয়াল লোহার বল্টুর মত শক্ত। ভ্রু জোড়া গিট্টূ খাওয়া জুতোর ফিতার মত প্যাঁচানো। চেয়ার টানতে টানতে মোজাফফর বললো,
‘সমস্যা কী তোমার? যেখানে আসতে বললাম সেখানে আসো নাই কেন?’
‘উল্টো দিকে কফি শপ থাকতে মাঠে দাঁড়িয়ে কথা বলব কেন? এখানে দেখুন কেমন সভ্য-ভব্য পরিবেশ। কাপুচিনো গিলব আর দুজনে অনেক গল্প করব। এনিপ্রব্লেম?’, রত্নারকণ্ঠে হাল্কা শ্লেষ।
‘গল্পের কী আছে?’
‘এতদিন মিলমিশ করলেন, রত্না আমার রত্না করে চোয়াল বাঁকায়েফেল্লেন,এখন সব ভ্যানিশ?’
‘ইয়ার্কি মারছ?ফালতু ফাজলামোরাখো। খাম কই?’, মোজাফফর উঠে দাঁড়ালো।
‘আহা, বসুন না। এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন। খামটাম সব পাবেন’, রত্না সাথে আনা বড়সড় চামড়ার ব্যাগটার দিকে ইশারা করল। তারপর বললো,
‘আগে বলুন কী নেবেন,ল্যাটে নাকি কাপুচিনো?’
মোজাফফর উত্তর দিলো না। ওর তাড়া আছে।
‘আচ্ছা, আমি কাপুচিনো আনছি’। রত্না উঠে কাউন্টারের গ্যালো। কাউন্টারে অর্ডার করে রেস্ট রুমে ঢুকলো। মোজাফফরের এখন নিজের উপর রাগ লাগছে। শেষের দিনে ও কখনোই নিয়ন্ত্রণ হারায় না। মেয়েরা এই সময় বিচলিত আরে ভঙ্গুর থাকে। তাই নিয়ন্ত্রণ হারানোর প্রশ্নও ওঠে না। কিন্তু রত্নার মধ্যে উৎকণ্ঠার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। রত্নাই বরং সুতো টানার সূক্ষ্ম চেষ্টা চালাচ্ছে। শেষ মুহূর্তে লোকেশন পাল্টে ওর মাথাটাই ওলটপালট করে দিয়েছে।
কিন্তু উত্তেজিত হলে চলবে না। দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতায় ও দেখেছে তাড়াহুড়ো করলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশী হয়। রত্না যা বলে তাই মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে, যতক্ষণ চায় ততক্ষণ থাকতে হবে। কাজ হাসিল নিয়ে কথা।
রত্না কাপুচিনো নিয়ে ফিরেছে। রেস্ট রুমে গিয়ে বোধ হয় মেকাপটা চড়িয়ে এসেছে। চোখের কাজল আর মুখের লিপস্টিক এখন আরেকটু গাঢ় কি? নীল শাড়িতে ওর দেহবল্লরী আঁকা বাঁকা দুরন্ত নদীর মত তুফান ছুটিয়েছে। ইস আর কিছুদিন যদি ওকে…না এসব ভাবলে চলবে না। মোজাফফর কাপে চুমুক দিয়ে বললো,
‘থ্যাঙ্কিউ রত্না,আমার মাথাটা কেমন টন টন করছিল।’
‘আপনার কোথায় কিসের টনটনি আমার চেয়ে ভালো কে বুঝবে বলুন?’
মোজাফফর কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক তখনি পাশের টেবিলের বোরকা পরা মহিলাটি চেয়ার ছেড়ে এদিকে এগিয়ে এলো। মোজাফফরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো,
‘স্যার, কেমন আছেন?’
মোজাফফর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই মহিলা বলল,’স্যার আমাকে চিনতে পারছেন না?’
মোজাফফরের চোখে মুখে অস্বস্তি,
‘পাঁচ বছরে কি এতই বদলে গেলাম, আমি তারানা’
‘বোরকা পরে থাকলে কিভাবে চিনব?’, মোজাফফর বিব্রত বোধ করছে।
‘বোরকা ছাড়া উপায় কি স্যার? গলার স্বরটা চিনবেন ভেবেছিলাম’
মোজাফফর বুঝতে পারছে না সবদিন বাদ দিয়ে আজই কেন এই ঝুটঝামেলায় পড়তে হলো।
‘আমরা পরে কথা বলি? তুমি নাহয় তোমার আগের টেবিলে গিয়ে বস, আমি আসছি।’
‘না স্যার এখানেই ঠিক আছে’, রত্নার দিকে তাকিয়ে বললো,’আপা বসি?’
রত্না বললো ‘অবশ্যই, বসুন না’
তারানা চেয়ার টেনে বসল।
‘মোজাফফর ভাই কি আপনার শিক্ষক?’, রত্না জানতে চাইলো।
‘মোজাফফর?’ তারানা ফিক করে হেসে বললো,
‘উনি তো জসিম স্যার,বিএক্লাসে আমার দর্শনের টিচার ছিলেন’
রত্না মোজাফফরের দিকে বিভ্রান্ত দৃষ্টি মেলে বললো,
‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এতদিন জানলাম আপনি গারমেন্টস ব্যবসায়ী,এখন শুনছি আপনি ফিলোসফির শিক্ষক!’
‘সব কথা কি তোমাকে বলতে হবে! গারমেন্টস আমার সাইড ব্যবসা।’
‘আর নাম? জসিম নাকি মোজাফফর? মোজাফফর কি আপনার সাইড নেইম?’
মোজফফর থতমত করছে। এই সময় তারা না বললো,
‘নাম নিয়ে সবারই ঝামেলা। আমার নামটাই ধরুন না। আমি তারানা। স্যার আমাকে ডাকতো চার আনা। স্যার, মনে আছে শেষের দিকে আপনি আমাকে চার আনা বলতেন?’
‘চার আনা কেন?’রত্না অবাক হয়ে জানতে চাইলো।
‘স্যারের কাছে সস্তা হয়ে গিয়েছিলাম… তাই না স্যার?’
‘কেন কী হয়েছিল?’, রত্না উৎসুক বাকিটা জানতে।
‘তারানা, তুমি প্লিজ অন্যখানে গিয়ে বস। বললাম তো আমি আসছি’,মোজাফফর তারানাকে একরকম ঠেলে সরিয়ে দিলো। তারপর রত্নাকে বললো,
‘খাম দাও, এখুনি।’
‘কেন মোজাফফর নাকি জসিম ভাই, খাম নিয়ে কি দৌড় দিবেন?’
‘ঝামেলা না চাইলেএখুনি খাম দাও।’
‘আচ্ছা বাবা দিচ্ছি। তার আগে বলুন, আপনি কি সত্যি সত্যি দর্শন পড়ান?’
‘হুম’
‘ওরেব্বাস, ক’জন দার্শনিকের নাম বলুন না, খুব শুনতে ইচ্ছে করছে’
এখন মাথা বিগড়োলে চলবে না। আর তো ক’টা মুহূর্ত। সাবধানে মাটি কামড়ে থাকতে হবে। নড়াচড়া দিলেই প্যাঁচ লেগে যাবে। মোজাফফর রাগ সামলে বললো,
‘প্লেটো, সক্রেটিস, এরিস্টটল, চার্বাক,নিতসে,জা-পল সার্ত্,দেরিদা, কত দার্শনিকই তো আছে’
‘ও বাবা কী সব নাম। বিশেষ করে চার্বাক নাম শুনে তো নির্বাক বনে গেলাম। ওনার কী প্রকার দর্শন মোজাফফর ভাই মানে জসিম স্যার?’
‘উনি ভারতীয় দার্শনিক। বস্তুবাদী ভোগবাদী দর্শন। খামটা দাও, আমার তাড়া আছে’
‘ভোগবাদী দর্শন? ও বাব্বা! ওনার একটা বানী চিরন্তনী ঝারুন না, প্লি-জ…’
‘উনি বলেছেন ‘যতদিন বেঁচে আছ সুখে বাঁচার চেষ্টা কর, ধার করে হলেও ঘি খাবার ব্যবস্থা কর’’
‘মানে ‘দুনায়াটা মস্ত বড়, খাও দাও ফুর্তি কর’, তাই তো?’,রত্না মোজাফফরের কথায় ফোঁড়ন দিলো।
‘ওটা বাংলা সিনেমার গান।’
‘হ্যা কিন্তু ওই বুরবাকের কথার মতই’
‘বুরবাক না চার্বাক’
‘ওই হলো। আপনি দর্শনের শিক্ষক শুনে তো আঁতকে উঠেছিলাম। কোন ভাবেই দুয়ে দুয়ে চার মিলছিল না’
‘কী বলতে চাইছ?’
‘ভাবছিলাম, একজন দর্শনের শিক্ষক এরকম ইয়ে হয় কি ভাবে হয়। বুরবাকের দর্শন শুনে মনের ভেতরটা ফকফকা পরিষ্কার হয়ে গ্যালো। বুঝলাম আপনার জীবনে তেনার প্রভাব প্রবল। । যাকে ইয়ে করছেন তার টাকায় ঘিও খেতে চাইছেন। কী বলেন?’
‘এনাফ্’ মোজাফফর উঠে দাঁড়ালো। ‘গিভমি মাই এনেভেলাপ।’
‘আপনার না কোন রসবোধ নাই,এই নিন আপনার খাম’,রত্না বড় ব্যাগের ভেতর থেকে বাদামী রঙের একটা এ-ফোর সাইজের খাম বের করল। মোজাফফর উইকেট কিপারের মত ছোঁমেরে খামটা লুফেনিলো। বললো,
‘কত আছে এতে? এত হাল্কা লাগছে কেন? চেক দিলা নাকি, আমি তো ক্যাশ আনতে বললাম?’
’খুলে দেখুন না’
মোজাফফর উত্তেজনার বশে একটু জোরেই কথা বলে ফেলেছে। আশেপাশের দু’ একজন আড়চোখে তাকাচ্ছে। হারামজাদীকে এই জন্য বলেছিলাম আবাহনীর মাঠের কাছে আয়, মোজাফফর মনে মনে বিড়বিড় করল। তারপর আবার চেয়ার টেনে বসল। তাড়াহুড়োয় খামের একপাশটা একটু বেশীই ছিঁড়ে গ্যাছে। ভিতরে থেকে কতগুলো টুকরাটাকরা জিনিস ফ্লোরে পড়ল। জিনিসগুলো উঠিয়ে মোজাফফর আবার খামের ভেতর ভরলো। রত্নার কানের কাছে মুখ এনে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘এইগুলা কী খামের ভেতর? ইউএসবি কার্ড,সিএফ কার্ড, এসডি কার্ড! আমারে কি মেমোরি কার্ডের দালাল পাইছ? টাকা কই?’
‘উফ!এত উত্তেজনা! একটু পরে না আমাদের চারপাশে ভিড় জমে যাবে! আপনি তো আবাহনীর মাঠ আবাহনীর মাঠ করছিলেন,? চলুন ওখানেই যাই।’
‘সে কথা তো আগেই বলেছিলাম।’ মোজাফফরের স্বস্তি হলো এইভেবে যে রত্না আস্তে আস্তে লাইনে আসছে। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে মোজাফফর ভাবল, রত্নার নাটক করার খায়েশ এখনও গেলো না। টাকা যদি দিতেই হয়, জাস্ট দিয়ে দে না শালী...খামে ভেতর কি সব আলতু ফালতু বৈদ্যুতিক বর্জ্য ভরে ভড়ং করছে।
ওরা দুজন যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছে, পেছন থেকে তারানা ছুটে এলো। হাঁফাতে হাঁফাতে বললো,
‘আরে, আমার সাথে কথা না বলেই চলে যাচ্ছেন যে স্যার?’
‘আরেকদিন কথা বলব, সরি’,জসিম স্যার ওরফে মোজাফফর ভাই তারানা কে পাশ কাটানোর চেষ্টা করছে।
রত্না বললো, ‘আমরা আবাহনীর মাঠে হাওয়া খেতে যাচ্ছি, যাবেন নাকি আমাদের সাথে?’
জসীম স্যার ওরফে মোজাফফর ভাই কটমট করে রত্নার দিকে তাকালো। রত্নার কথায় তারানা খুশীতে খলবল করে বললো,
‘আমারও কেমন দম বন্ধ দম বন্ধ লাগছে। মাঠের কোনায় গিয়ে ফুচকা খাবো আর জসিম স্যারের সাথে পুরনো দিনের গল্প করব। একটু সময় হবে তো স্যার?’
জসিম স্যার উত্তর দিলো না।
আবাহনীর মাঠ এখন প্রায় জনশূন্য। গেটের কাছে হারিকেন জ্বালিয়ে ফুচকা বিক্রি হচ্ছে। তারানা তিন প্লেট ফুচকা কিনেছে।
‘তুমি গেটের ওদিকেই থাকো, আমার সাথে রত্নার আরেকটু আলাপ আছে’, তারানাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই জসিম স্যার ওরফে মোজাফফরর ত্নাকে হর হর করে মাঠের অন্যপাশে টেনে নিয়ে এলো।
‘এত ফোর-প্লে করার কী দরকার, অ্যা? ঢালো দেখি ব্যাগ থেকে…’
‘কী ঢালব?’, তারানা অবাক চোখে মোজাফফরের দিকে তাকালো।
‘খেলাটা কিন্তু বেশী লম্বা হয়ে যাচ্ছে। আই উইল রিলিজ দা ভিডিও ইন ফেইসবুক’
‘মোজাফফর ভাই, আপনি খামোখাই রাগ করছেন। আপনি কিআসলেই খামের মর্মবুঝেন নাই?’
‘উফ, আবার খাম।’
‘বার বার কথার মাঝে কথা না বলে এই গল্পটা মন দিয়ে শুনুন। রত্না নামের একটা মেয়ে আপনাকে ভালবাসত,অ্যাপারেন্টলি আপনিও তাকে ভালবাসতেন। ভালবাসার জন্য বাঙ্গালী মেয়েদের অনেক ছাড় দিতে হয়। রত্নাকে দিতে হলো শরীরের ছাড়। বিকাশ হোটেল। দু’শ বারো নম্বর রুমে ভুলিয়ে ভালিয়ে মাঝে মধ্যেই রত্নাকে নিয়ে আসতেন। ওসব করার সময় গোপনে ওর ভিডিও রেকর্ড করতেন’
‘সে তো বুঝতেই পারছ, নতুন করে বলার কী আছে?’মোজাফফরের কণ্ঠে তাচ্ছিল্য।
‘এখন ফেইসবুকে সেই ভিডিও ফাঁস করার হুমকী দিয়ে টাকা চাইছেন।’
‘বল্ এখন আমার কোর্টে, যে ভাবে খেলাবো সেভাবে খেলবা। আমার গল্প আমারে শুনায়ে লাভ কী?’ মোজাফফর হারানো নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাচ্ছে।
‘কিন্তু আমিই প্রথম না। আপনি এই ঘটনা আগেও ঘটিয়েছেন কয়েকবার। একটা সতেরো বছরের মেয়ে তো মুঠো মুঠো ঘুমের বড়ি গিললো।তারানা পে’ করতে পারেনি বলে ওকে ফেইসবু কে ফাঁসিয়ে দিলেন। বেচারী এখন আর বোরকা ছাড়া বাইরে বেরুতে পারে না’
‘হুম, খুব আনফরচুনেট বাট দিজ আর হিস্ট্রি নাও’ মোজাফফর সতর্ক হয়ে গ্যালো। রত্না এত কিছু জানে কিভাবে? তারানা তাহলে এমনি এমনি আসেনি, একটা গিট্টু আছে।
‘আমাকে দেখুন।রূপবতী তরুণী, দেহের গড়নটাও কেমনটান টান। আমার ছবি ফাঁস হলে লোকে কিন্তু ছোকছোক করে হামলে পড়বে। মুখে যতই ছি ছি করুক, লুকিয়ে চুরিয়ে আমাকেই দেখবে। এখন উল্টোটা ভাবুন। যদি আপনার ভিডিও ফাঁস হয়? থল থলে চর্বি, নাক কান থেকে সজারুর কাঁটার মত বের হয়ে আছে সাদা কালো লোম। টাকলু মাথা। কুকুরের পাছার মত মুখ। এমন কদর্য মানুষকে নগ্ন দেখা তো চোখ আর মনের উপর ভয়াবহ অত্যাচার! আপনার ছবি ফাঁস হলে মানুষ তো স্রেফ ঘেন্নার বশেই আপনাকে পিটিয়ে মারবে!’
‘আমার কথা আসছে কেন, আমি কি ছাগল যে আমার নিজের চেহারা রেকর্ড করব?’
‘আপনি কেন করবেন? আপনি যখন গোপনে আমার ভিডিও করতেন, আমিও আপনার ভিডিও করতাম।’
‘কী করতা?’ মোজাফফর নিশ্চিত হতে চাচ্ছে ও ঠিক শুনতে পেলো কিনা।
‘আপনি যখন আমার ভিডিও করতেন, আমিও আপনার ভিডিও করতাম। তবে আপনার মত ছুটকা নোকিয়া মোবাইল ফোনে না। হাই রেসুলুশন ক্যামেরায়। হোটেলওয়ালার সাথে বনিবনা করে দু’শ বারো নম্বর রুমকে মোটামুটি একটা লুকনো স্টুডিও বানিয়ে ফেলছিলাম। আপনাকে যে ইউএসবি পেন, সিএফ কার্ড, এসডি কার্ড দিয়েছি, ওগুলোতেই সব পাবেন, সর্বসাকুল্যে আট’শ এগারো গিগাবাইট।’।
রত্না ওর মোবাইলটা মোজাফফরের দিকে এগিয়ে বললো,
‘এই দেখুন, আমার ফোনেও একটা ছোট ক্লিপ আছে। স্যাম্পল কপি। শুধু আপনাকেই দেখা যাচ্ছে’
‘খানকী মাগীর বাচ্চা’, ক্লিপ্টা দেখে মোজাফফর নিজেকে মুখ ঠিক রাখতে পারলো না।
‘এই একটা কথা আপনি ঠিক বলেছেন।’
‘মানে?’
‘মানে হলো, আপনি যা বললেন আমি আসলেই তাই। হাই সোসাইটি কল গার্ল। আমার মাও তাই ছিলেন। ফ্যামিলি বিজনেস। রান্স্ ইন দা ব্লাড। ইন ফ্যাক্ট, আমাকে হায়ার করা হয়েছে আপনার গুমর ফাঁস করার জন্য। উপ্স্, একটার পর একটা শকিং নিউজ!’ রত্না হাত দিয়ে ঠোঁট চাপা দিলো।
‘কে হায়ার করেছে তোমাকে?’
রত্না আঙ্গুল দিয়ে তারানাকে দেখালো। তারানা ফুচকা খেতে খেতে দূর থেকে হাত নাড়ল। একটা ফ্লাইংকিস দিলো মনে হয়?
‘সত্যি কথা বলতে কি, আমার ছবি মানুষ যত দেখবে ততই আমার লাভ। ওই যে বলে না প্রচারেই পসার?থ্যাঙ্কিউ ফর রেকর্ডিং মি অ্যান্ড ওয়েলকাম টু দি ওয়ার্ল্ড অফ স্ক্যান্ডেল। এভরি ওয়ান উইল ওয়াচ ইউ টু নাইট।’ রত্না মোজাফফরের সামনে দাঁড়িয়ে কুর্নিশের ভঙ্গী করল।
‘টুনাইট মানে? আমি এখনও বুঝতে পারছিনা কী যা তা বলছ এসব!’ মোজাফফরের কপাল বেঁয়ে ঘাম ছুটছে। ডুবন্ত মোজাফফর আঁকড়ে ধরার মত খড়কুটো খুঁজছে।
‘আপনার মেয়ের বয়স সতেরো, তাই না? কী নামে যেন? জুঁই? আর আপনার স্ত্রী মিনারার কোন জবাব নেই। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। আবার হিজাবও করেন। ওদের নির্মল চোখে আপনি একজন আলাভোলা দার্শনিক হিরো। এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় চ্যানেল বি সেই আলাভোলা দার্শনিক হিরোর ভিডিও দেখাচ্ছে। হাজি আব্দুল করিম কলেজের দর্শনের শিক্ষকের নারী ধর্ষণ। সবাই সেই কুৎসিত দৃশ্য দেখছে।আপনার স্ত্রী, মেয়ে শ্বশুর শাশুড়ি, কলিগ, ছাত্রছাত্রী,সবাই। ভাবা যায় কত বড় অডিয়েন্স?’
‘রত্নাপ্লিজ ওদেরকে থামাও, আমি কাউকে রেইপকরিনি, সব কনসেনচুয়াল।’
‘কনসেনচুয়াল? মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় সবার কাছে উন্মুক্ত করে দেয়া কি কনসেনচুয়াল? পাঁচ বছর আগে তারানার যে অবস্থা করেছিলেন, আপনার অবস্থা এখন তার অন্তত বিশপঁচিশ গুন খারাপ। মা গো মা, কি প্যাথেটিক সিচুয়েশন!’
‘রত্না, আই প্রমিজ, আমি আর এসব করব না । আমি হজে যাব। দিনরাত মসজিদে পরে থাকব।’ রত্নার কোন বিকার নেই দেখে তারানার দিকে মুখ ঘুরিয়ে চিৎকার দিয়ে বললো ‘এই তারানা প্লিজ ওকে বোঝাও।’ তারানা অত দূর থেকে শুনতে পেল কিনা বোঝা যাচ্ছে না। ও কি মুখ থেকে পর্দা সরিয়ে মিট মিট করে হাসল?
রত্নার কথা তখনও শেষ হয়নি,
‘অনভিজ্ঞ মেয়েদের আবেগ ভাঙ্গিয়ে খুব খেলারাম খেলে গ্যাছেন। কখনো চার পিটিয়েছেন, কখনো ছক্কা হাঁকিয়েছেন। শেষমেশ আমার বেলা এসে, মাইরি, কি সাংঘাতিক মিস্টেইক! এই বিভ্রম উপলক্ষ্যে একটা গান কিন্তু আমায় নিয়ে গাইতেই পারেন, ‘আমার খেলা যখন ছিল তোমার সনে, তখন কে তুমি তা কে জানত…’’ রত্নার গানের গলা মন্দ না।আবাহনীর মাঠের উপর দিয়ে একটা সুরের লহরী বয়েগ্যালো।
মোজাফফরের মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না। মোজাফফর হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে মাঠের উপর।
‘আর আপনার ঘাম ছুটা দেখে আমি গাইতে পারি ‘লাজে ভয়ে ত্রাসে, আধো বিশ্বাসে...’যাকে বলে খাপের খাপ মন্টুর বাপ লিরিক’
মোজাফফর বোবা বনে গ্যাছে। ওর মুখ দিয়ে কোন কথা বেরুচ্ছে না।
‘নিন, এটা ধরুন, অত চিন্তা করবেন না, চিন্তায় চিন্তা বাড়ে’, রত্না ব্যাগ থেকে ভারী একটা কিছু বের করে মোজাফফরের হাতে গুঁজে দিল। পয়েন্ট টুটুক্যালিবার পিস্তল। পিস্তল্টা হাতে নিয়েই মোজাফফর একবার রত্নার দিক আরেকবার দূরে তারানার দিকে তাক করল। তারানা আবার দূর থেকে হাত নাড়ল। ও আরেক প্লেট ফুচকা অর্ডার করেছে।
‘শুনুন সুপার হিরো। গুলি মাত্র একটা। সবাইকে মেরে আপনিও মরবেন অমন নাটুকেপনার সুযোগ নেই। যাকে নিকেশ করলে আপনার পরিবারের মানসম্মানবাঁচে তাকেই করুন। হারাধনের তিন ছেলেমেয়ে রইবে বাকি দুই।’
রত্না তারানাকে নিয়ে আবাহনীর মাঠ থেকে বেরিয়ে এলো। মোজাফফর মাঠেই রয়েগ্যাছে।
সন্ধ্যার মদমত্ত উচ্ছলতা এখন ম্রিয়মাণ। ঢাকা শহরের পথঘাট নির্জন হয়ে আসছে। আজ মেঘ নেই। আকাশে জ্বল জ্বল করছে সপ্তর্ষি মণ্ডলীর নক্ষত্র পুঞ্জঃক্রতু, পুলহ, পুলস্ত,অত্রি, অঙ্গিরা, বশিষ্ঠ,মরীচি।
হঠাৎ দুজনেই পেছন ফিরে তাকালো। পটকা ফাটার মত একটা তীব্র তীক্ষ্ণ স্বল্পায়ু আওয়াজ কি ভেসে এলো মাঠের ভেতর থেকে?