আমার দুইপাশে ইটের দেয়াল । সামনে অস্বচ্ছ থাইগ্লাস লাগানো জানালা । জানালার গ্রিলে ইঞ্চি চারেক প্রস্থ আর ফুট দুয়েক দৈর্ঘের একটা সবুজ রঙের কাপড়ের ব্যানার লাগানো আছে । তাতে সাদা কালিতে লিখা আছে বিজয় দিবস । ‘বিজয়’ আর ‘দিবস’ শব্দ দুটোর মাঝে গোলাকার একটি লাল বৃত্ত আঁকা আছে । সবুজ কাপড় আর লাল বৃত্ত, জাতীয় পতাকার প্রতীক বহন করছে । শুধু ১০ আনুপাত ৬ মাপটা ঠিক নাই । পিছনটাতে কাঠের দরজা, সেটারও ছিটকানি লাগানো । দরজাতেও অবশ্য একটা কাগজের পতাকা লাগানো আছে । আমিই লাগিয়েছিলাম । বিজয় দিবসের প্রথম ক্ষণটা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে । এটার মাপও ঠিক আছে কিনা জানি না ! তবে শ্রদ্ধার মাপটা ঠিক ছিলো !
বলতে গেলে এই মূহুর্তে আমি স্বনিয়ন্ত্রিত বন্দি । ইচ্ছে করলেই জানালাটা খুলে দিতে পারি । আকাশটাও দেখে নিতে পারি এক পলক । না এখন খুলব না । রাতের বয়সটা একটু বাড়ুক আর ঠান্ডাটাও রীতিমত পড়ুক । তারপরই না জানালার এক পাশটা সরিয়ে দিবো । ঠান্ডা বাতাস আসলেও । আজকের মধ্যরাতের আকাশে ফুটে থাকা চাঁদটা দেখবোই । কতদিন রাতের আকাশটা দেখা হয় না, তারাও না । সকালটা, সকালের কোমল লালাভ সূয্যটাও না । নগরের নাগরিক ব্যস্ততায় অমাবশ্যা-পূর্ণিমার হিসাবটাও রাখা হয় না আর । সেই কবে দেখেছি ভরা পূর্ণিমা মনে নেই । কবে যে জমিদার পেরুবাবুর দীঘিটার পাড়ে বসেছিলাম তাও মনে নাই । কবে রেল লাইনের দুপাশটা ধরে বন্ধুরা মিলে হেঁটেছি, শেষ কবে বটপাতার গান শুনেছি, কবে ধবল বকদের উড়াউড়ি দেখেছি, কবে পাঁকা ধান ক্ষেতের আইল ধরে মানিকদের বাড়ী গিয়েছি- এসবের কিচ্ছু মনে নেই ।
জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস আসছে । ইস আজকে এতো ঠান্ডা পড়েছে বাইরে ! আর পড়বেই না বা কেনো এটা যে পৌষের পরে মাঘ মাস ! মা বলতেন মাঘের শীতে নাকি বাঘও কান্দে । সামনের বিল্ডিংটার মাথার উপর দিয়ে চাঁদটা খোঁজার চেষ্টা করেও পেলাম না । এই মূহুর্তে ভালোলাগার এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছে । অবাধ্য মনটা কোথায় যেনো হারিয়ে যেতে চাইছে খোলা জানালার ঠান্ডা বাতাসে মতো আমার মনোজানালাও যেন খুলে খুলে যাচ্ছে স্মৃতির বাতাসের তোড়ে !
এই পৌষ আর মাঘ মাস দুটো আমার ভিষন প্রিয় ।এই মাস দুটোকে আমি আমার মা’য়ের মাস বলি ! এই মাস দুটোতে আমার মায়ের যে এক্কেবারে জুড়ি নাই ! দুইদিন পর পর আমনের নূতন কালিজিরা ধান ভানা, চাল ভিজানো, আটা করানো আর বাহারি পিঠা বানানোর উপর দিয়ে যায় মাস দুটো তাঁর । খুব মনে পড়ে এই দিন গুলোতে বাড়িতে খেঁজুরের মিঠাই আর চিনি না থাকলে আব্বার বারোটা বাজতো !
মা পিঠা বানানো শুরু করতেন ঠিক সন্ধার একটু পরে । যেদিন পিঠা বানাতেন সেদিন মা অন্যান্য রান্নার কাজ সেরে ফেলতেন আগেই । পিঠা বানানোর আগে সবাইকে ডেকে বসাতেন চুলার পাড়ে । আমরা ভাই বোনরা গিয়ে দেখতাম চুলার আশেপাশে মা মোড়া পেতে রেখে দিয়েছেন আগে থেকেই । আর পিঠা বানানোর সব সরঞ্জামও থাকতো সাজানো চুলার পাশে । আমরা সবাই বসে পড়তাম যুত মতো । বাইরে ঠান্ডা বাতাস বইতো । মা পিঠা বানানো শুরু করতেন একটা পান মুখে নিয়ে ।
মা ভাপা পিঠা আর পুলি পিঠাটা বানাতেন বেশি । হয়তো আমি এই পিঠাটা একটু বেশি পছন্দ করি বলেই বানাতেন । পাতলা সাদা কাপড় দিয়ে পিঠাটা মুড়ে পিঠা বানানোর বিশেষ যন্ত্রের উপড় বসিয়ে দিতেন । যন্ত্রটা মা অনেক কষ্ট করে বানাতেন মাটির কলস ভেঙ্গে । আর আমরা প্রথম পিঠার জন্য অপেক্ষা করতাম । ভাপা পিঠা বানানোর অদ্ভূত যন্ত্রটার উপর রাখা পিঠা দিয়ে যখন ভাপ উঠতো তখন বুঝতাম পিঠা এখন নামানোর সময় হয়েছে । মা পিঠা নামিয়ে আমার থালাতে আগে দিতেন । হয়তো আমাকে একটু বেশি ভালোবাসেন বলে তার এই অগোপনীয় পক্ষপাতিত্ব সবাই মেনে নিতো ! অবশ্য প্রথম পিঠাটা আমরা সবাই ভাগ করে খেতাম কোনো দ্বন্দ ছাড়া ! মা পিঠা বানিয়ে যেতেন আর আমরা খেয়ে যেতাম । কোনোদিন আমি যদি পিঠা কম খেতাম মা রাগ করে বলতেন আমি আর পিঠাই বানাবো না ! আমি সাথে সাথে আরো দুইটা পিঠা বেশি খেতাম । এই খাওয়া দেখে পরের দিন খুব ভোরে আবারো পিঠা বানাতেন মা । সকালে বিছানায় ঘুমে থাকা অবস্থায় মার ডাক শুনতে পেতাম পিঠা খাওয়ার নিমত্তে । ঘুম থেকে উঠে দেখতাম চারিদিক কুয়াশায় ঢাকা । বাড়ান্দা থেকে কলপাড়ও ভালোভাবে দেখা যায় না এমন কুয়াশা । কয়লা দিয়ে কোনোমতো দাঁত মেজে এসে বসে যেতাম চুলার পাড়ে । কি আর করা মার জন্য অগত্যা পরের দিনও বেশি বেশি করে পিঠা খেতে হতো !
এভাবে পৌষ আর মাঘের প্রতিদিন নতুন নতুন পিঠা বানানো চলতো মার । কোনোদিন ভাপা পিঠা, কোনোদিন পুলি পিঠা, দুধপুলি পিঠা, কোনোদিন সাতখোলা পিঠা, কোনোদিন পাটিসাপটা পিঠা, দুধপিঠা, কোনোদিন অনেক…… পিঠা !
কতদিন মায়ের হাতের পিঠা খাই না । কোন মাঘে যে মা’র হাতের পিঠা খেয়েছিলাম মনে নেই । এই ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত দিনে শত মাইল পাড়ি দিয়ে আর শীতের পিঠা খাওয়া হয় না । শীত এলেই - মাঘ এলেই - কুয়াশা দেখলেই মা’র পিঠার কথা মনে পড়ে । মা’র কোমল হাতের কথা মনে পড়ে । কি সুন্দর হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পিঠা বানাতেন নিমিষে। যে পিঠার গায়ে মাখা থাকতো মা’র অমলিন ভালোবাসা আর মমতা । সে ভালোবাসা আর মমতা যে আমাদের জন্যই ছিলো । মা এই মুহূর্তে তোমাকে খুব-খুব বেশি মনে পড়ছে । তোমাকে খুব বেশি ভালোবাসি মা । যদিও কখনও মুখ ফুটে বলিনি ‘মা তোমাকে ভালোবাসি’ । বছরের সবগুলো দিনে তোমায় ভালোবাসি মা ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।