ক.
সারাটি রাত আরমান ঘুমাতে পারেনি। শেষ রাতের দিকে অল্প একটু ঘুম এর পরে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে। মনটা কিছুতেই মানাতে পারছে না। ছেলের বয়েস বারো হওয়া পর্যন্ত সে যা করেনি গত রাতে তা করেছে । ছেলেটির গালে ভীষন জোরে দুইটা চড় মেরেছে । অথচ যেই ছেলে তার ধমকেই চুপ মেরে যেত। আগেও তার ছেলে মুনতাসির বাবার মুখে মুখে যে তর্ক করেনি তা নয় কিন্তু ইদানিং কেন জানি একটু এগ্রেসিভ হয়ে গেছে – হতে পারে করোনা কালে স্কুল বন্ধ তাই বাসায় কত আর থাকা যায় এভাবে। ছোট্ট একটা হাফওয়াল তোলা টিনশেডের ভাড়া বাসা ।দুটি রুম তাতেই আরমান মিনু দম্পতি তিনটি বাচ্চা নিয়ে বসবাস করে। আরমানের গ্রামের বাড়ী এই ঢাকা শহরের পাশের জেলাতেই। বাবা-মা চলে গিয়েছেন দশ বছর হয়ে গেল।প্রথম প্রথম বাড়ি থেকে ফসল উঠলে চাল-ডাল নিয়ে আসতে পারত, এখন চাচাত ভাই ও চাচারা কাদের পরমর্শে জানি জমি ভিটা দখল করেছে, সেই বাড়ী আর বাড়ী নাই ওর দুই বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়াতে আরমানের শান্তি- আর নয়তো বিপদেই পরে যেত এখন। জীবন যে খুব সুখের তা নয়- অল্প বেতনের একটা প্রাইভেট কোম্পানীর স্টোর কিপার হিসাবে কাজ করে। বেতন এখন এই করোনা সময়ে আরো তিরিশ পার্সেন্ট কাট হয়েছে। কবে বাড়বে আল্লাহই জানেন। আবার চাকুরীটাও থাকে কিনা, সেটাও একটা চিন্তা,অলরেডি মার্কেটিং ডিভিশনে অনেককেই বিনা পারিতোষিক এ চলে যেতে হয়েছে।
আজকাল মুনতাসিরের বন্ধুরা অনলাইনে মোবাইলে নেট চালায়- ক্লাস করে, টিচারদের সাথে মাঝে মাঝে মিটিং হয় – সরকারী হাই স্কুলে অনেক কষ্টে ভর্তি করিয়েছে আরমান ছেলেকে। প্রাইভেট স্কুলে পড়াবার মত সামর্থ্য নেই-তারপরে আরো এক ছেলে এক মেয়ে রয়েছে মেয়েটার বয়েস সাড়ে চার বছর আর মেঝো মুক্তাদির তার বয়েস আট এ পরল।
অনেকদিন ধরেই মুনতাসির একটা স্মার্ট মোবাইল চাচ্ছে ওর বাবার কাছে।
-বাবা , আমাকে একটা ফোন কিনে দাও না, আমার বন্ধুরা বলেছে স্যামসাং এর ‘গ্যালাক্সি এ-টেন এস’ মডেল টা কম দামে অনেক ভাল সেট।
আরমান ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, মুনতাসির অনেক শান্ত ছেলে, যথেষ্ট বুঝদার, বাবা যে কষ্ট করে , ওর মা কষ্ট করে সংসার চালায় – ওরা বড়লোক না সেটা ও বুঝে বলেই - কমদামের সেট’ এই কথাটা দাবীর সাথে যুক্ত করেছে ।
আচ্ছা বাবা – এই করোনাকালটা যাক, সব কিছু ঠিক হোক। ততদিনে করোনা লক ডাউন চলে গিয়ে চার মাস চলছে।আরমানের এই এক গুন দিতে পারুক আর নাই বা পারুক হ্যা বলবেই। মিনুর একটা আবদার আজ এক দশকের- একজোড়া পাতলা-সাতলা সোনার চুড়ি। তাপরেও আরমান বলেছে সামনে যদি কোম্পানী কোন বোনাস দেয় সবার আগে মিনুর জন্য চুড়ি কিনবে। অথচ জানেনা আরমান, সেটা কি আদৌ হবে কিনা।তবুও আশ্বাস দিতে ত সমস্যা নাই। সংসারে 'না' –বলে অযথা মনোমালিন্য ডেকে আনার কি দরকার।
-বাবা এই করনার জন্যই ত লাগবে। - স্যার বলছে অনেলাইনে মিটিং ক্লাস এগুলো নাকি নিবে।
-ঠিক আছে আমি আমার ফোনটা রেখে যাই – সেটা চালাও- আর তোমার মায়ের টা আমি নিয়ে যাবো বাইরে।
এভাবেই চলছিল, আরমান তার ফোনটা বাসায় রেখে যায় যেদিন মুনতাসির এর ক্লাস বা অনলাইন-এক্সাম থাকে, আর মিনুর কাছে থাকা বাসার পুরনো ফিচার ফোনটা নিয়ে যায়। কিন্তু এর পরেও মুনতাসির যখন এলাকায় বের হতে শুরু করেছে বন্ধু বান্ধবের সাথে, তখন থেকেই মোবাইলের দাবীটা তীব্র আকার ধারণ করেছে। আরমান মিনুকে প্রায়ই সতর্ক করে দিয়েছে
-ছেলের দিকে লক্ষ্য রাখো, কার সাথে মিশে না মিশে।এই সব এলাকার বড়লোকের ছেলেদের সাথে তাল দিলে কি আমরা চলতে পারব !!
মিনু তেমন কিছু দেখেনি,মুনতাসির বের হলেও সবসময় বাসায় চলে আসে সন্ধ্যার আগেই, আর সবই ত এলাকার ক্লাসমেট।একটু আধটু বের না হলে ঘরকুনো হয়ে বসে থাকবে- এখন পর্যন্ত তো মুনতাসিরের নামে কোন অভিযোগ আসেনি। আর ওর বন্ধুদের তিন চারজনকে চিনে মিনু, বখে যাওয়া না, মিনুর গর্ব আছে ওর ছেলে মুনতাসির বখে যাওয়া ছেলেদের সাথে মিশবে না।
গতরাতে বাসায় আসতেই ছেলে বাবার কাছ থেকে মোবাইল নিয়েই দেখে এমবি নাই। আসলে আরমানের মিনি প্যাক নিয়ে নিয়েই কাজ চালাতে হয়। মাস ব্যপী প্যাকেজ অনেক টাকা নেয়।
-কি বাবা মোটেও এমনি নাই- বলেছি আমাকে একটা সেট কিনে দাও না !! মাত্র বারো হাজার টাকা।
-আচ্ছা দিবনে বাবা, একটু অপেক্ষা করো, হাতে টাকাটা জমাই নেই।
-কবে আর জমাবা দুইহাজার পঞ্চাশ সালে??
ছেলের কথা শুনে আরমান অবাক হয়ে যায়, এই ছেলে এত মুখে মুখে কথা শিখছে কোথা থেকে !! বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পরে নিশ্চয়ই ।ছেলে আবার অনুযোগের সুরে বলে যাচ্ছে-
-গতকালও রিপনের বাবা একটা ফোন ওকে কিনে দিছে- বাইশ হাজার টাকা। আমি তো সেইটা চাচ্ছি না। আসলে আমার সন্দেহ হয় তুমি আমার বাপ না। -অভিমানে মুনতাসির বলেই ফেলে।
এইটুকুন ছেল যে কিনা আরমানের কোলে কিছুদিন আগেও ন্যাংটা বসে থাকত সেই ছেলে এত বড় কথা বলেছে – মাথাটা আর ঠিক রাখতে পারেনি।
-কি বললি- এসব অশ্লীল কথাবার্তা শিখেছিস কোথায়??-
বলেই ঠাস ঠাস করে সপাটে দুই গালে দুই চড় লাগিয়ে দিল –মুনতাসির একটা অবাক বিস্ময় আর অসহায় চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে, ও জানত ওর বাবা কখনোই ওকে মারতে পারে না, এটা ওর একটা গর্ব ছিল বলা চলে।
আরমানের মনে হল এটা তো সেই মুনতাসির যখন তার বয়েস তিন বা চার একটু ধমক দিলেই ভীতিময় চেহারা নিয়ে স্থির তাকিয়ে থাকত- একটুও নড়তে পারত না, সেই ছেলেই তো।
-যা আমার সামনে থেকে।
আরমান সব সময় তার বাচ্চাদের ‘বাবা’ তুমি” বলে ডেকে যাওয়া সেই ছেলেকে ‘তুই’ বলে ধমক দিয়েছে- মিনু রান্নাঘরে ছিল ও থাকলে হয়ত ছেলেকে আগেই আটকে দিত, এতটা বাড়তে দিত না। মিনু এসেও থ বনে গেল। যে ছেলেকে বাবা একটা টোকাও কখনো দেয়নি চোখের শাসানি আর ধমক এর উপরেই চলেছে সেই বাবা তার আদরের ছেলেকে চড় দিয়েছে। মুনতাসির তার মাকে দেখে এবার আর আবেগ ধরে রাখতে পারেনি। হাউমাউ করে কেঁদে দিল- অথচ কখনোই ছেলেকে আরমান চিৎকার করে কাদঁতে দেখেনি,মিনু যখন মেরেছে বা অন্য কোন কারণে ।
বাচ্চাদের রুমে দৌড়ে চলে গেল মুনতাসির। ওর মাও পিছে পিছে গেল। আরমানের এতটা খারাপ কখনোই লাগেনি । ছেলেটা কি বলেছে এসব – ও মনে হয় ভাল বন্ধুদের সাথে মিশছে না।
খ.
অল্প একটু ঘুমের পরেই ছটফট করে ঘুম ভেঙ্গে গেছে। মাঝে দুবার উঠে গিয়ে দুই ভাইকে দেখে এসেছে। এক বিছানায় শুয়ে আছে গভীর ঘুমে। ছেলেদের গায়ে লেপটা ভাল করে তুলে দিয়ে মসারিটা গুজে দিয়েছে।
ভোরের আলো ফুটতেই বারান্দার উপরের জানালাটা খুলে দিল- বাইরে বাতাস ঠান্ডা কিন্তু তেমন কুয়াশা না, এটা আরমানের স্বভাব। ওর মা বলতেন
-ভোর বেলার হাওয়া লাখ টাকার দাওয়া ।।
ভোরের আলো ফুটতেই তিনি বাড়ির সব জানালা খুলে দিতেন। সেই অভ্যাস। সকালের স্নিগ্ধ আলোতে ছেলের মুখটা বড়ই মায়াবি লাগছে- নড়াচড়ায় মাথা-মুখ থেকে লেপ সরে গেছে- মুনতাসিরের গালের দাগটা এখন আর দেখা যাচ্ছে না। রাতে দেখে আরমানের বাবার হৃদয় কেঁপে কেঁপে উঠেছে ।ঘুম আর আসেনি। আসলেই কি ও একটা ব্যর্থ বাবা। ছেলের কথা অনুযায়ী ওর বাবাই না। আবারো আরমানের চোখের পানি আটকে রাখা কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ছেলেটার মাথায় লেপ দিয়ে ঢেকে চলে গেল।
মিনু উঠে গেছে, নামাজ পড়বে –ছোট মেয়ে সাবিহা মা-বাবা দুজনের মাঝে থাকে। মিনু বলে বেশি ভালবাসার ফল –ওদের সাবিহা। সেই কারণে মাঝে মাঝে আরমানকে সতর্কও করে অনিয়ন্ত্রিত বেশি ভালবাসা না বাসতে-নয়তো চতুর্থ ভালবাসা দেখা যেতে পারে, তিনটা বাচ্চাই নরমাল হয়েছে- আল্লাহর অশেষ রহমতে, সিজার হলে হাসপাতাল ডাক্তার খরচ এগুলোর ঝামেলায় পরতে হতো।
-এখন একটু ঘুমাবা ??
-না গো- ঘুম আসছে না, ছেলেটাকে খুব জোরে মারছি, কেন যে হঠাৎ এত ক্ষেপে গেলাম।
-আচ্ছা আমার গলার চেইনটা দেখো না বিক্রি করে মুনতা কে একটা মোবাইল দেওয়া যায় কিনা।–ওরা দুজন বিশেষ করে মা, ওদের ছেলেকে আদর করে মুনতা ডাকে।
-কি বলো !! – একটাই মাত্র তোমার স্বর্ণের চেইন – মায়ের দেয়া। আর এগুলো তো সেই মান্ধাতার আমলের । স্বর্ণ কি আছে নাকি। কিছুই পাওয়া যাবে না।
সেই মান্ধাতার আমলের চেইন টা নিয়েই তো আছি।
আরমান মিনুর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকালো। বুঝতে পারছে মিনুও খোঁচা দিচ্ছে। কারণ বিয়ে হয়েছে আজকে চৌদ্দ বছরে আর কোন অর্নামেন্টস আরমান মিনুকে গড়িয়ে দিতে পারেনি। একটা নাকফুল ছাড়া। অথচ এ নিয়ে মিনু কখনোই আক্ষেপ করেনি, অভিযোগ ও না। আজকে সুযোগে কথাটা বলে দিয়ে একটা খোচা দিল- ব্যর্থ স্বামী।
মিনু বুঝতে পারছে আসলে ভুলটা সে কোথায় করেছে। আরমান কষ্ট পেয়েছে। ওর মুখটা সকালের আধো আলোতে অসহায় দেখে বুঝতে পারল। সেটা কাটিয়ে উঠবার জন্য দ্রুত বলল
-আচ্ছা- আমি মুনতা কে বলব নে, আর কয়েকটা দিন হলেই তো ডিসেম্বর শেষ। এর পরে আর এত মোবাইল লাগবে না।
মিনু আরমানকে আরো বুঝাতে চাইছে বন্ধুবান্ধবের সাথে রাতে বা সন্ধ্যার পরে একটু অনলাইনে আড্ডার জন্য -
-ওর তো স্কুল ও পরীক্ষার সাথে সাথে সাথে চ্যাট করার জন্যই সে এটা চাচ্ছিল।
গ.
আজকে ফিরতে ফিরতে একটু বেশি রাতই হয়ে গেল। দশ টার মত। বাইরের ওয়ালের গেটটা খুলে লাগিয়ে দিয়ে ঘরের দরজায় টোকা দিতেই বরাবরের মত মুনতা বলল কে
-আমি, বাবা- আরমানের সেই চিরচেনা গলা। চারটা মিনি বার্গারের প্যাকেট। রাস্তার ট্রলিতে বানানো – এটা মুনতাসিরের ও ওদের সবার খুব প্রিয় খাবার। বেশি দাম নয় পঞ্চাশ টাকা করে। দরজা খোলা মাত্রই খাবারের জালি প্যাকেট টা একটু সামনে বাড়িয়ে রাখাতে মুনতাসির দেখেও চলে যাচ্ছিল, অথচ অন্য সময় এলেই বলত চোখ মুখ আনন্দ নিয়ে খাবার এনেছ বাবা !! অভিমানটা যায়নি এখনো।
-কিরে বাবা খাবার টা নিবি না -বলে মুনতাকে বাবা ডাকল
মুনতা ঘুরে নিশব্দে খাবার প্যাকেটা টা নিতে ফিরতেই বাবা পিছন থেকে ডান হাতে স্যাংসাং সেটের বক্স টা ধরা মাত্রই মুনতা হা হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কোন মতে জড়তা কাটিয়ে চিৎকার দিয়ে বলল-
-মোবাইল আনছ বাবা ??- প্যাকেট টা নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে দিল। আবার না জানি কি হইছে মিনু ছিল শুয়ে দৌড়ে এলো, চিলতে ঘরটা থেকে যেখানে ও নামাজ টা আদায় করে।
মিনুর মুখে হাসি – এতটা প্রশান্তির হাসি আরমান খুব কমই দেখেছে।
ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল-
-বাবা পড়াশোনাটা ঠিক মত করিস- অনেক কষ্ট হয়েছে তোর সেট টা কিনতে।
যে খাবার নিয়ে ভাই বোন বিবাদ লেগে যায় সেই খাবার মুনতা তার ভাই বোনকে দিয়ে দিয়েছে। দ্রুত দৌড় দিয়ে ব্যাগ থেকে ওর মায়ের নামে কেনা সিম টা বের করল। মুনতা- আহা সেট না কিনেই আগে সে সিম কিনেছিল স্বপ্ন টা আজ পূর্ণ হলো। আরমান বুদ্ধি করে ছেলের জন্য মোবাইল স্টান্ড ও একটা ইয়ার ফোন ও কিনে নিয়েছে। রাত এগারটার দিকে খেতে বসে আরমান শুনছে ছেলে তাদের বন্ধুর সাথে কথা বলছে ওদের হোয়াটস এপ গ্রুপে। কালকে সে খুব সকালের স্যারের ক্লাসে জয়েন করতে পারবে বলছে।
ঘ.
হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে আরমান। মুনতা এখন প্রায়ই বাবার পাশেই থাকে। ওর বাবা হয়ত বাঁচবে না এরকমই ডাক্তার বলছে । কোলন ক্যান্সার। সরকারী হাসপাতাল। ওদের সামর্থ্য নাই- প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে কেমো দিয়ে চিকিৎসা করার। যেই বাবা কত লম্বা চওড়া ছিল সেই বাবা এখন কাঠির মত ক্ষীনকায় হয়ে গেছে। ফোর্থ ডিগ্রী স্টেজে চলে গিয়েছিল। কিছুই করার নাই- করোনাকালের দোহাই দিয়ে অল্প কিছু সহায়তা করেছিল- অফিস –তা দিয়ে দুটো কেমো দেওয়া গেছে। এর পরে আর কোন প্রগ্রেস নাই।
এই মোবাইল সেটটা কিনার তিন মাস পরেই বাবার কোলন ক্যান্সার ধরা পরে। মুনতার বুকে খুব কষ্ট লাগে বাবাকে কত প্রেসার দিয়েছে এই মোবাইল সেটটা কিনে দিবার জন্য। মুনতা ওর মার কাছে শুনেছে। ওর জন্য একটা মোবাইল কিনবে বলেই বাবা পুরনো যে এভন বাইসাইকেল টা দিয়ে অফিসে যেত সেটা দিয়েই সন্ধ্যার পরে এপসকল এর খাবার ডেলিভারি দিয়ে টাকা জমিয়ে আর কিছু কলিগের কাছ থেকে ঋণ করে মুনতার হাতের সেট টা বাবা কিনে দিয়েছে
-বাবা আমার এই সেটটা বিক্রি করে দেই- আমাদের বন্ধু আছে অনেকে কিনবে ।-
আরমানের চিকিৎসার জন্য মুনতা যখন এই কথা বলেছিল, আরমান মুনতার গাল আর মাথা হাতিয়ে বলেছিল
-না রে বাবা। এই অল্প কয়েকটা টাকায় কি হবে। আমি তো আর থাকব না। তোর কাছে এই সেটটা রেখে দিস। আমার কথা মনে পড়বে, দেখবি আর মন দিয়ে লেখাপড়া করবি।
আরমান মনে মনে গর্ব ভরা বুকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পেরেছিল। ওর ছেলে সঠিক পথে আছে। নষ্ট হয়ে যায়নি, যাবার আগে আরমানের মনে শান্তনা ছিল এটাই- ওর অফিস ইন্টার পর্যন্ত পড়া ওর স্ত্রী মিনুকে একটা নিচু পদে নিয়োগ দিয়েছে। যেন সংসারটা চলে।
শেষ.
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের রেজাল্ট হলে পরে-সবাই মুনতাসির কে নিয়ে হই হুল্লোর করছে । বিশাল একটা ট্রিট এর প্লান আছে রুমের আর পাশের রুমের বন্ধু আর জুনিয়র ভাই বেরাদর এর। মুনতাসির খাওয়াতে পারবে। সে ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করে হলে থাকতে থাকতেই রেজাল্ট হয়ে গেছে। ও যে টিউশনি করে সেই পয়সা দিয়েই হয়ত দিব্যি খাওয়াতে পারবে-মানি ইজ নো প্রবলেম।
রিফাত তো এবার বলেই ফেলল-
-মুন ভাই এবার আপনার এই পুরনো মোবাইল সেট টা বদলান। রিয়া আপাকে বলব আপনাকে এইবার যেন আইফোন কিনে দেয়।
ক্যাম্পাসে সবাই মুনতাসিরকে মুন ডাকে। কে যে এই নামের উৎপত্তি করেছে, তবে মুনতাসিরে ধারনা রিয়াই ওর মুখ থেকে এই নাম বের করেছিল প্রথম। রিয়া একই ব্যাচ এ ওর সাথে সিভিল এ আছে।
-না রে ভাই এটা আমার বাবার দেয়া সেট- আমি শুধু টু-জি মুডে কথা বলি এটা দিয়ে। আরো বিশ বছর কথাই বলতে চাই, পরে এটা আমার শো কেসে থাকবে। মুন গর্ব করে বাবার দেওয়া স্যামসাং এর সেই পুরনো সেটটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছে সবাইকে আর চিৎকার করে বলছে-
-আছে তোমাদের – এরকম বাবার দেয়া ।
আসলে কারও কাছে নেই- বাবার দেয়া সেট সেই কোন আমলে পুরনো হয়ে কোথায় চলে গেছে, কে রাখে।
- আমার যা কিছু নেট রিলেটেড তা তো ল্যাপটপেই। তাইলে আর মোবাইল সেট কেন।
গাড়ী থেকে রিয়া,মুনতাসির নেমে এলো – রিয়া যেতে যেতেই মুনতা গিয়ে ওর মায়ের পাশের দরজাটা খুলে দিল- মিনু প্রতিবছর এই সময়টাতে ওর শ্বশুর বাড়ী আসে। কবরটার পাশে দুর থেকে দোয়া পড়ে। মুনতাসির ওর বাবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দোয়া করছে, পাশে দাঁড়িয়ে ওর চার বছরের ছেলে আবরার।
রিয়া শুনতে পেল ওর শাশুড়ি বিড়বিড় করে বলছেন-
-মুনতা’র বাপ শুনতে পাচ্ছ, তোমার মুনতা এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার, মুক্তাদির স্কলারশিপ নিয়ে অস্ট্রেলিয়াতে গেছে এক বছর হলো, আর সাবিহা বুয়েটে ঢুকছে- বৌমা রিয়া এডমিনে আছে আর নাতী আবরার চারবছর হলো, তোমার কবরের পাশে দেখো দাঁড়িয়ে দোয়া পড়ছে। সেই তো আমাদের কষ্টের সময়ে- করোনা কালে চলে গেলে । সুখটা দেখে গেলে না।
রিয়া শাশুরীর কাধে হাত রেখে বলল- মা কাঁদবেন না , বাবার আত্মা কষ্ট পাবে, বাবার জন্য দোয়া করেন। রাব্বীর হামহুমা কামারাব্বায়ানিস সাগীরা- রিয়া পড়তে লাগল শাশুরীর পাশে।
মুনতাসির রিয়ার দেয়া আইফোনের সাথে ধরে রাখা বাবার দেয়া সেই স্যামসাং এর ‘গ্যালাক্সি এ-টেন এস’ সেটটি মনে হয় যেন সেদিন বাবা কিনে দিয়েছে, পরম মমতায় বুলিয়ে বুলিয়ে পকেটে রেখে ছেলে আবরার কে খুঁজছে। আবরার গ্রামের কবরের এই সবুজ ঘাস পেয়ে দৌড়ে ঘাসের ঝোপের শেষ প্রান্তে দাড়িয়ে আছে, অবাক হয়ে দেখছে।
-আবরার বাবা চলো চলো।
-বাবা আমি একটু থাকি এখানে ,খুব ভাল লাগছে। দাদা ভাই আসবে না আমাদের সাথে দেখা করতে ??
-না না বাবা এখানে যারা শুয়ে থাকে তারা কখনোই আর আসেন না।
-বাবা আমরা কবে আসব এখানে শুতে ??
-যে কোন সময় –বাবা, চলো এবার বাসায় যাওয়া যাক।
-কেন বাবা এটা কি বাসা না?
মুনতাসির নীরব হয়ে রইল। ছেলেকে ততক্ষণে কোলে নিয়ে নিয়েছে ।
(সমাপ্ত)।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
একটি শিশু থেকে কৈশরে পা দেয়া ছেলে -মুনতাসির, দরিদ্র চাকুরী করা বাবা তাকে একটি স্মার্ট মোবাইলে কিনে দিবে এই করোনাকালে -সেটা পুরণ হয়েছিল -তবে অনেক স্বপ্নই ভেংগে দিয়ে সেই গল্প।
২০ জানুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৫ টি
সমন্বিত স্কোর
৪.৮
বিচারক স্কোরঃ ২.১ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ২.৭ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪