রাতের অন্ধকার যখন ধীরে ধীরে চারপাশে জড়িয়ে আসে, শহরের রাস্তাগুলো যেন এক মুহূর্তে পরিণত হয় এক নির্জন গ্রামে। আলো ম্লান হয়ে যায়, মানুষের ব্যস্ততা থেমে যায়, আর শহরের চিরচেনা শব্দগুলো নিস্তব্ধতায় বিলীন হয়ে যায়।
নিশো, ছোটো একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে, ধীরে ধীরে অফিস থেকে বাসার পথে হাঁটছিল। তার এক হাতে শক্ত করে ধরা একটি ছোট্ট স্প্রে — যেন একরকম প্রহরী, যা তাকে অদৃশ্য কোনো আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে।
তার চারপাশে একটা অদৃশ্য ভারী বোঝা — ভয়।
সে জানে, এই রাস্তাগুলোয় সে একা হাঁটছে না। এই অন্ধকারে অচেনা চোখ লুকিয়ে আছে, বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে বিষাক্ত কথা আর অবাঞ্ছিত দৃষ্টি। প্রতিটি পদক্ষেপ যেন একেকটা প্রশ্নের মতো মনে হয় তার:
“আজ কি আমি নিরাপদ? এই নিস্তব্ধ অন্ধকারে কেউ কি আমার ওপর চোখ রাখছে? কেউ কি আমাকে ছুঁয়ে যাবে? ভেঙে ফেলবে?”
হঠাৎ, দূরের একটি গলি থেকে হাসির একটি দল তার পেছনে এসে ঠেকে। কণ্ঠস্বরগুলো ঠোঁটের কোণে অশ্লীল ইঙ্গিত হয়ে ফিসফিস করে ওঠে। দৃষ্টিগুলো ছিল অস্বস্তিকর — শিকারির চোখের মতো।
নিশোর হৃদপিণ্ড ঝাঁকুনি খেয়ে ওঠে, শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে, গলায় ভার জমে ওঠে। গা শিউরে ওঠে, মনে হয় শরীরের প্রতিটি সেল যেন আলাদা হয়ে যেতে চাইছে।
সে দ্রুত পা বাড়ায়। তবু মনে হয় পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। মনে মনে কেবল একটাই প্রার্থনা করে —
“শুধু আজকের রাতটা যেন নিরাপদ থাকে।”
কিন্তু সে জানে, কালকের রাতও ঠিক এমনই হবে। কালকের অন্ধকারও ঠিক একই আতঙ্ক নিয়ে আসবে তার জন্য।
---
নিশোর জীবন মানেই এক অবিরাম যুদ্ধ। প্রতিটি রাত তার সঙ্গে লড়াই করে — একাকীত্ব, আতঙ্ক আর সমাজের নীরব সহিংসতার বিরুদ্ধে।
বাসায় ফিরবার পথ তার কাছে কখনো স্বস্তির নয়। এটা যেন প্রতিরাতের এক কঠিন পরীক্ষা।
সে বারবার মায়ের বলা কথাগুলো মনে করে —
“রাত হলে একা বাইরে যেও না, সাবধান থেকো।”
কিন্তু জীবিকার তাগিদে তাকে বাধ্য হয়ে এই ভয়ঙ্কর রাস্তায় হাঁটতে হয়।
ভয় কেবল অন্ধকারে নয় — বাসের ভিতর, ভিড়ের মাঝে, সড়কের মোড়ে মোড়ে... সে জানে, কেউ তাকে সরাসরি ‘সাবধান’ বলে না, কেউ বলে না, “আমি আছি তোমার পাশে।”
এই ভয় আসলে সমাজের — এক নিঃশব্দ, পুরুষতান্ত্রিক শৃঙ্খল।
একটা কণ্ঠস্বর, যেটা নারীকে সবসময় নির্ভরশীল আর দুর্বল ভাবতে শেখায়।
---
বাসায় এসে দরজা লক করে, জানালাগুলো বন্ধ করে নিশো বোঝে —
রাতের অন্ধকার কেবল বাইরের নয়, তা তার মনেও ঢুকে গেছে।
একাকীত্বের ছায়া তার মনের ভেতরে ঘন হয়ে আসে।
নিস্তব্ধতা বিষাদের নীড় গড়ে তোলে।
দিন দিন এই ভয় বেড়ে ওঠে, নিস্তব্ধতা ভারী হয়ে পড়ে। একাকীত্ব তাকে ধাক্কা দেয়, তার আত্মবিশ্বাসের শেষ সুতিটা ছিঁড়ে ফেলে।
মাঝেমধ্যে নিশোর মনে হয়, সে ভয় আর হতাশার গভীর গর্তে আটকে গেছে — যেন আর উঠে আসার কোনো পথ নেই।
সে নিজের কণ্ঠস্বর শুনতে পায় না।
মনের ভিতরের যন্ত্রণার শব্দ গলায় আটকে যায়।
আত্মবিশ্বাসের চাদর ছিঁড়ে ভেঙে পড়ে, আর তখনই সে শুরু করে নিজের সঙ্গে এক নতুন যুদ্ধ —
ভয়কে হারানোর যুদ্ধ।
---
সে জানে, এই ভয়কে সে জীবনসঙ্গী করতে পারে না।
নিজেকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় —
“আমি শুধু ভয়ের সৃষ্টি নই, আমি সাহসেরও জন্ম।”
সে চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নেয়, নিজের অন্তরে একটি ছোট্ট আলো জ্বালানোর চেষ্টা করে —
একটি আলো, যা অন্ধকারকে বিদীর্ণ করবে, তাকে নতুন শক্তি দেবে।
এই লড়াই সহজ নয়।
ভয় আবার ফিরে আসে, হতাশা তার দরজায় কড়া নাড়ে।
তবু নিশো ঘুরে দাঁড়ায়।
ছোট্ট স্প্রেটা আরও শক্ত করে ধরে রাখে —
এক নতুন দিনের জন্য হাঁটা শুরু করে।
রাত যতই গভীর হোক, একদিন তার ভেতর আলো জ্বলে উঠবেই।
নিভে যাওয়া আলো আবার জেগে উঠবে।
এই গল্প শুধুই নিশোর না —
আমার মতো অনেক নিশো,যারা প্রতিদিন 'নিরাপত্তা'র বদলে 'সতর্কতা' বেছে নিতে বাধ্য হয়।
এই সমাজে রাত এখনো নারীর নয়।
আলো নিভে গেলেও যদি আমরা চুপ থাকি,
তাহলে সেই অন্ধকারই চিরস্থায়ী হয়ে যাবে।
এখনই সময় —
চোখ মেলে দেখার, কণ্ঠ মেলানোর, এবং বলার: "এই শহর, এই রাত — আমাদেরও।"
---
শেষ কথা:
রাতের নিস্তব্ধতা কেবল অন্ধকার নয়,
এটা মেয়েদের স্বপ্নের ওপর জড়িয়ে থাকা এক নিঃশব্দ আতঙ্ক।
যে আতঙ্ক তাদের স্বাধীনতার পথ রুদ্ধ করে,
যে আতঙ্ক সাহসকে ভেঙে দেয়।
তবু সেই ভয়ের মাঝেই জন্ম নেয় লড়াইয়ের আলো,
যা একদিন ভেঙে দেবে সব বাঁধা শৃঙ্খল,
আর নিয়ে আসবে মুক্তির এক নতুন ভোর।
—
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
রাতের অন্ধকার যখন ধীরে ধীরে চারপাশে জড়িয়ে আসে, শহরের রাস্তাগুলো যেন এক মুহূর্তে পরিণত হয় এক নির্জন গ্রামে।
১০ সেপ্টেম্বর - ২০২৫
গল্প/কবিতা:
৪ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৫