বয়স সাত কি আট। ভীষন বাউন্ডুলে আর জেদী স্বভাবের ছেলেটা, নাম তার কটা। নাওয়া খাওয়া ছেড়ে সারা দিন বন্ধুদের সাথে টো টো করে ঘুরে বেড়ায়। সকালে বেড়িয়ে যায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে তবু তার বাড়ি ফেরার নাম নেই। বাবার বাউন্ডুলে স্বভাব ছেলেকে পেয়ে বসেছে ভেবে মাঝে মধ্যে ছেলের উপর ভীষণ ত্যক্ত হয় ওকিমন। স্বামীকে শুনিয়ে শুনিয়ে চোদ্দ গোষ্টীর পিন্ডি চটকাতে ছাড়ে না।
সংসারের প্রতি উদাসীন হলেও ফরজ বাউল যে ক'দিন বাড়িতে থাকে ছেলেকে গানের সুরে সুরে সর্বাঙ্গে আদর বুলিয়ে দেয়। শাসন থাক দুরে কোলে বসিয়ে ভাওয়াইয়া গানের সুর সেখায়।
বিয়ের প্রথম দিকে ফকিরান্তিতে যাওয়ার সময় শুধু মাত্র চাউল কিনে দিত ফরজ বাউল। তেল নুন মরিচ এসব কিছুই কিনে দিত না। বাধ্য হয়ে ওকিমন পরের বাড়ি থেকে নুন মরিচ চেয়ে এনে গরম ভাতে পানি ঢেলে খেত। ক্ষুধার তাড়নায় শুধু পান্তা ভাতই ওর কাছে অমৃতের মত লাগত। কিন্তু এভাবে আর কতদিন?
পনের বিশ দিন পর একতারা হাতে মিনসে হঠাৎ একদিন দাওয়ায় বসে এক তারায় সুর তোলে। স্বামীর আগমনি সুর কানে আসতেই হকচকিয়ে দুয়ার খুলে বেরিয়ে আসে ওকিমন। মায়াবী চোখে তাকিয়ে থাকে স্বামীর মুখের দিকে। মনে মনে ভাবে তার জন্য বাউল না জানি কত কি এনেছে। কিন্তু না কিছুই নিয়ে আসে না ফরজ বাউল। বরাবরের মত আবারও হতাশ হয় ওকিমন।
একদিন কৌতূহলী হয়ে বাউলের কাছে জানতে চেয়েছিল ওকিমন।
: আচ্ছা তুমি কিংক্যা মানুষ কও তো? খালি চাউল কিনেন তরকারী, নুন, ঝাল কিছুই তো কিনেন না। সংসার চালাতে এসব যে লাগে তুমি তা জানেন না? আচ্চা হামার সাথে তুমি ইঙ্ক্যা করেন ক্যান কওত?
কথা গুলো শুনে বাউল থতমত খেয়ে যায়। মনে মনে ভাবে এতদিন সংসার যে ভাবে চলছিল ভালই তো চলছিল। হঠাৎ ওকিমনের মুখে এই ধরনের প্রশ্ন বোধক ভারিক্কি জ্ঞানের কথা শুনে ভীষণ বিব্রত হয় ফরজ বাউল। এক পর্যায়ে রেগে গিয়ে বলে ওঠে...
: ঐ মাগী তাই যদি বলিস এখন থিনি চাউলও কিনমু না যা।
স্বামীর এহেন কান্ড জ্ঞানহীন কথা শুনে সেদিন ওকিমন হতবাক নয় বরং ভয়টাই পেয়ে ছিল বেশী। হায় হায় বলে কি লোকটা। চাল না কিনলে যে না খেয়ে মরতে হবে এই সাধারণ জ্ঞান টুকুও কি বাউলের থাকতে নেই? তার চেয়ে বাবা এই ভালো আপাতত চাউলটা যখন কিনছে কিনুক। তরকারী বা আনাজপতি না কিনলেও হবে। আগের মত দু মুঠো পান্তা ভাত তো জুটবে। কিন্তু ঘরে যদি চাউল না থাকে তবে তো আর চলে না। বিয়ের প্রথম দিকে এমনি অনেক জ্বালাতন আর কষ্ট দিত মিনসে। মুখ বুজে তা সহ্য করতে হয়েছে ওকে।
এত গেল পেট পুজার কাহিনী এর পরেও কথা আছে। ফরজ বাউল ফকিরান্তি থেকে যেদিন বাড়ী ফিরে আসে সংগত কারণে ওকিমন বাউলকে কাছে পেয়ে ভীষণ খুশি হয়। স্বামীর যত্ন আত্তি করতে মোটেও অবহেলা করে না। কিন্তু হলে হবে কি রাতে ঘরে শুতে আসে না মিনসে। দাওয়ায় বসে গান করতে করতে দাওয়ায়ই ঘুমিয়ে পড়ে।
শুধু মাত্র একটা সন্তানের আশায় ওকিমন লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে অনেক চেষ্টা তদবির করে স্বামীর সঙ্গে মেলা মেশার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে নেয়। আশায় আশায় থেকে শেষ পর্যন্ত বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় কটা পেটে আসে।
স্বামী সুখের আশা ছেড়ে এবার সন্তান কে ঘিরে ওকিমন নতুন করে বুক বাধে। আগে ফকিরের বউ বলে ডাকত সবাই এখন ওকে কটার মা বলে ডাকে তাই গর্বে মনটা ভরে যায় ওর।
ক'দিন থেকে শীতের তিব্রতা বেড়েছে। ছেলেটা শীত কষ্টে কম্পিত হাত দুটো বুক আর অধরের মাঝে বাতার বাঁধনের মত শক্ত করে বেধে শীতকে পরাস্থ করার ব্যার্থ চেষ্টা চালায় আর থরথর করে কাপে। ওকিমন ছেলের শীত কষ্টের এই দৃশ্য দেখে নীরবে অশ্রু ফ্যালে।
সেই কবে থেকে একটা চাঁদরের বায়না ধরেছে ছেলেটা। অভাবের তাড়নায় ওকিমন ওর আবদার টুকুন পুরণ করতে পারেনি আজও।
বাবা মা ভালো জামা কাপড় কিনে দিতে পারে না কেন সে কথার উত্তর জানা নেই কটার। শুধু এই টুকু জানে ওর বাবা ওর জন্য একটা চাদর কিনে আনবে বলেছে এতেই ভীষণ খুশি হয় সে।
মায়ের আশ্বাস পেয়ে কটা সেদিন বন্দুদের উচু গলায় বলেও এসেছে কাল বাবা আসবে সাথে ওর জন্য একটা লাল চাঁদর নিয়ে আসবে। অথচ দেখে দেখে দুই দিনের মাথায় বাবা আসার কোন নাম নিশানা না দেখে সন্দিহান হয়ে মায়ের কাছে জানতে চায় কটা।
: ক্যা মা আব্বা এখুনো আসতিছে না ক্যা? কাইল তোক হামাক একখান চাঁদ্দর কিন্যা দেওয়াই লাগবি কলাম। হামি সব বন্দুকোক কয়া দিছি কাইল হামার আব্বা একখান নাল চাঁদ্দর কিনা আনবি।
মায়ের নিরবতা কটাকে কতকটা সন্ধিহান করে তোলে। কটা এক প্রকার বুঝেই ফেলে যে মা ওকে মিথ্যে কথা বলেছে। তাই মায়ের গায়ে মৃদু ঝাকুনি দিয়ে কান্না মাখা করুণ সুরে আবার জানতে চায় কটা।
: চাদর না হোলে আইজ হ্যামি লজ্জ্যায় মুক দেখাবার পারমু না। ক্যা মা কতা কইচু ন্যা ক্যা? আব্বা একুনো আসতিছে না ক্যা? হামাক চাঁদ্দর কিন্যা দেওয়াই লাগবি কয়া দিচ্ছি না হোলে হামার মরা মুক দেখপু তোরা।
রাগ আর জেদ মিশ্রিত কন্ঠে কথা গুলো বলে অভিমানে মায়ের মুখের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যায় কটা সন্ধ্যা রাতের আঁধারে........
পিছনে পিছনে ওকিমনও বেরিয়ে এসে ধপাস করে দাওয়ায় বসে পড়ে। বাম হাতের সব কটি আঙ্গুল ভাঁজ করে গালে ঠেস দিয়ে কটার চলে যাওয়া অন্ধকার পথের দিকে হতাশ নয়নে চেয়ে থাকে আর মনে মনে ভাবে হয়ত সূর্য উঠলেই ওরা আসবে.........
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আপেল রহমান
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বর্ণনায় লেখা গল্পটি ভালো লেগেছে।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
বয়স সাত কি আট। ভীষন বাউন্ডুলে আর জেদী স্বভাবের ছেলেটা, নাম তার কটা।
১৯ আগষ্ট - ২০২৫
গল্প/কবিতা:
৩ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।