নীরব বিস্ফোরণ
এটা কোনো ভৌতিক আতঙ্ক নয়—
এটা পেটের গভীর থেকে উঠে আসা এক অচেনা যন্ত্রণা।
প্যানক্রিয়াটাইটিসের সেই দহন, মাকে হারানোর অসহ্য শূন্যতা আর ক্যারিয়ারের অনিশ্চয়তার ছায়া—
এই তিনের মিশ্রণে তৈরি হয়েছে এক নিঃশব্দ ভয়।
এমন এক ভয়, যা শুধু শরীর নয়, মনকেও কুরে কুরে খায়।
________________________________________
শুরুটা নিরীহ দিনেই
কলেজ ছুটি। সকালে কোনো তাড়া নেই—
সায়ান একটু বেলা করে ঘুমাচ্ছিল।
আধঘুমের মধ্যেই হঠাৎ বুকের নিচ থেকে পেটে এক তীব্র মোচড়!
ঘেমে উঠে বসে গেল সে। মনে হলো, ডান পাশটা কেউ ভেতর থেকে পাকিয়ে ধরেছে।
আয়নায় তাকিয়ে দেখল—চোখ ফোলা, মুখ ফ্যাকাসে।
নিজেকে বোঝাল,
“গ্যাস্ট্রিক হবে, ঠিক হয়ে যাবে।”
আবার শুয়ে পড়ল।
কিন্তু ভেতরে শুরু হয়ে গেছে এক নীরব যুদ্ধ।
চুপচাপ মাকে বলল,
“ভাত দাও তো মা, খিদে পেয়েছে।”
মা প্রিয় বাইম মাছ আর সীম দিয়ে রান্না করা তরকারি দিয়ে গরম ভাত এনে দিলেন।
কিন্তু এক চামচ মুখে দিতেই ব্যথা যেন রেগে উঠল—পেটের ভেতর আগুন
জ্বলছে।
মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“ভাত খেলি না? তাহলে কি খাবি?”
সে বলল,
“ঝালমুড়ি খেতে ইচ্ছে করছে।”
মা ভাবলেন, হালকা খাবারে আরাম পাবে, কিন্তু খাওয়ার পর ব্যথা আরও ভয়ানক রূপ নিল।
চোখে জল, ঘামে ভেজা, কথা কম।
মা বললেন,
“ট্যাবলেটও খেলি, কাজ হচ্ছে না কেন?”
সে চুপ। ভেতরে একটা সন্দেহ—এই ব্যথা আগের মতো নয়।
________________________________________
হঠাৎ ফোন, নতুন উদ্বেগ
এমন সময় ফোন এল—বান্ধবীর মা।
“আজ তো আসার কথা ছিল!”
সায়ান বলল,
“হ্যাঁ ফুফু, বিকেলে আসছি।”
ভাবল, “ততক্ষণে ঠিক হয়ে যাবে।”
কিন্তু বিকেলেও অবস্থার উন্নতি নেই।
আবার ফোন এল। বাধ্য হয়ে এক বন্ধুকে নিয়ে রওনা দিল।
সেখানে গিয়েও মুখে হাসি, শরীর অসহ্য যন্ত্রণায় কাঁপছে।
ফুফু নানা খাবার দিলেন, কিন্তু খেতে গিয়ে ব্যথা আরও বেড়ে গেল।
শেষে বিছানায় শুয়ে পড়ল—মুখ বিবর্ণ, চোখ জ্বলছে।
ফুফু সুরা পড়ে ফুঁ দিলেন, মক্কার জমজম পানি ও কৃমির ওষুধ দিলেন—তবুও কিছুতেই ব্যথা কমল না।
অবশেষে ব্যথা সামান্য কমলে সায়ান চুপচাপ বাড়ি ফিরল।
তবে মনে হচ্ছিল—এটা আর গ্যাস্ট্রিক নয়, শরীরের ভেতরে কিছু অজানা, ভয়ানক কিছু শুরু হয়েছে।
________________________________________
ভয় আর অবস্থা ক্রমবর্ধমান
বাড়ির সামনে এসেই রাস্তায় বমি করে দিল সায়ান।
পেছনে দাঁড়িয়ে মা দৌড়ে এলেন,
“বাবা, কী হইছে? ব্যথা কমেনি?”
কিছু না বলেই সায়ান ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
মা ভাবলেন, “আরও একটু সময় দিলে ঠিক হয়ে যাবে।”
কিন্তু রাত ৯টা বাজলেও ব্যথা বাড়তেই লাগল।
চিন্তিত হয়ে খালাকে খবর দিলেন।
খালা, খালাতো ভাই-বোনরা ছুটে এল।
দেরি না করে সবাই মিলে সায়ানকে নিয়ে গেল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।
চোখে-মুখে যন্ত্রণা, ভেতরে এক ভয়ানক অজানা সংকেত—
এটা আর শুধু গ্যাস্ট্রিক নয়…
________________________________________
হাসপাতালে প্রথম রাত
হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরও সায়ানের ব্যথা কমছিল না।
ইনজেকশন, স্যালাইন—সব চলছিল, তবু যন্ত্রণায় চোখ-মুখ শুকিয়ে যাচ্ছিল।
কষ্ট করে কাটল এক বিভীষিকাময় রাত।
ভোর হতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল—ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে।
সকালেই ভর্তি করা হল এক বড় প্রাইভেট হাসপাতালে।
ইনজেকশন দেওয়ার কিছুক্ষণ পর ব্যথা সামান্য কমল।
চোখে-মুখে ফিরল শান্তি।
চিকিৎসার পর জানা গেল—প্যানক্রিয়াটাইটিস।
ভেতরে চলছিল এক ভয়ংকর প্রদাহের যুদ্ধ,
যা নিঃশব্দেই শরীরকে নিঃশেষ করে দিচ্ছিল।
________________________________________
এক বছরের যুদ্ধ ও পরীক্ষা
‘প্যানক্রিয়াটাইটিস’—নামটা প্রথমে শুনেও সায়ান তেমন গুরুত্ব দেয়নি।
রোগটার ভয়াবহতা, নিয়ন্ত্রণের নিয়ম—সবই তার কাছে ছিল এক ঝাপসা স্মৃতি।
চিকিৎসা শেষে আগের মতোই চলতে শুরু করল সে।
ঠিক এক বছর পর, আবার পরীক্ষার সময়েই ব্যথা শুরু হল।
এতটাই তীব্র যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা দিতে পারল না।
মা ভেঙে পড়লেন কান্নায়, অসহায়তায়।
চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে সায়ান বাকি পরীক্ষাগুলোতে অংশ নেয়।
তবে এবার তার সঙ্গে সবসময় ছিল এক অদৃশ্য ভয়—
আবার যদি ব্যথা শুরু হয়!
আর সেটা ঘটলও।
কিন্তু এবার সে থামেনি।
হাতে কেনুলা লাগানো অবস্থায় পরীক্ষা দিয়েছে,
এমনকি পরীক্ষার হলেও ইনজেকশন নিতে হয়েছে ব্যথা কমাতে।
তবুও হাল ছাড়েনি।
ঢাকা যাওয়ার সামর্থ্য ছিল না বারবার।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক ডাক্তার হয়ে উঠলেন তার ভরসা।
তিনি রোগের প্রকৃতি বুঝে প্রতিবার সঠিক চিকিৎসা দিয়ে ব্যথা নিয়ন্ত্রণে আনতেন।
তার সহায়তায় ও নিজের অদম্য মানসিকতায় সায়ান শেষ পর্যন্ত সব পরীক্ষাই দিতে পেরেছিল।
________________________________________
ঢাকা, নতুন জীবন
পরীক্ষা শেষে সায়ান ঢাকায় গেল—গ্রাফিক্স ডিজাইনের কোর্সে ভর্তি।
চাকরির পরিকল্পনা করে নিজের ভরসার জীবন গড়ার চেষ্টা করছিল।
কিন্তু ভালো সময় বেশি স্থায়ী হয়নি।
হঠাৎ তার মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন—ব্রেন স্ট্রোক।
ঢাকায় দ্রুত নিয়ে আসা হল।
তিনটি ভয়াবহ দিন কাটল হাসপাতালে, আইসিইউ-তে।
সেই সময়টা ছিল সায়ানের জীবনের সবচেয়ে কঠিন, আতঙ্কজনক দিন।
মায়ের অবস্থা বুঝতে না পেরে মন টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
বাঁচানো গেল না—মা চলে গেলেন, রেখে গেলেন অমোঘ শূন্যতা।
________________________________________
মায়ের চলে যাওয়া, নতুন দায়িত্ব
এই কঠিন সময়েও সায়ান হাল ছাড়েনি।
মায়ের স্মৃতির শক্তি আর নিজের স্বপ্ন ধরে রেখেই ধীরে ধীরে পথ চলেছে।
মা চলে যাওয়ার পর তার জীবন পুরোপুরি বদলে গেল।
ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরে বুঝল—দুই ছোট ভাইকে রেখে আর যাওয়া যাবে না।
স্বপ্নের গ্রাফিক্স ডিজাইন কোর্স করতে হলো অনলাইনে।
মায়ের অবর্তমানে মন ভাঙছিল,
যন্ত্রণার মধ্যেও ভালো থাকার চেষ্টা করছিল সে।
কষ্ট, একাকিত্ব আর দায়বোধের মাঝেই নিজের পথ খুঁজছিল।
________________________________________
পাশে যারা ছিলেন
এই কঠিন সময়গুলোতে তার বন্ধুরা, বড় ভাইরা পাশে ছিল—
কখনো অবলীলায়, কখনো অবিরাম সহায়তার হাত বাড়িয়ে।
তিনজনের অবদান ছিল বিশেষ:
● বড় ভাই—সাবলীল, ধৈর্যশীল, জীবনের অমূল্য ভরসা।
● চাচা—পরিবারে মমতা ও শক্তির প্রতীক, মানসিক শান্তির কারণ।
● ডাক্তার ভাই—ছোট ভাইয়ের মতো, দূর থেকেও যত্ন, ফোনে পরামর্শ, নিঃশর্ত সহায়তা।
________________________________________
পুরোনো ব্যথা ফিরে আসা
মা নেই—অনেকদিন হয়ে গেছে।
সেই শূন্যতা আজও মন কুরে কুরে খায়।
এবার হঠাৎ শুরু হল পুরোনো ব্যথা।
ঢাকায় চিকিৎসা করতে হল।
ডাক্তার বললেন,
“তোমার অবস্থা ভালো না। সাবধান না হলে বিপদ আছে।”
চিকিৎসা শেষে সায়ান বাড়ি ফিরল।
শরীর ধীরে ধীরে সেরে উঠল।
এরপর আর হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়নি।
কারণ পাশে ছিল বড় ভাইয়ের মতো সেই ডাক্তার, যিনি আত্মীয়ের চেয়েও
বেশি আপন হয়ে ছিলেন।
সায়ান এখন নিজেই নিজের শরীরের ভাষা পড়তে শিখেছে—
কোন ওষুধে আরাম, কখন ইনজেকশন, কখন সাপোজিটরি।
তবুও সবশেষ ভরসা এখনও সেই ডাক্তার ভাই।
________________________________________
ভালোবাসার মানুষ হারানো
শরীরের ব্যথা, জীবনের দায়িত্ব, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা—সব সামলিয়েও
সায়ান বেঁচে ছিল এক ভালোবাসার মানুষের পাশে।
যিনি সবসময় পাশে ছিলেন, না বললেও বুঝতেন।
কিন্তু ঠিক তখনই, যখন সায়ান ঢাকায় চাকরির খোঁজে গেল—
সে তাকে ছেড়ে গেল।
সায়ান চেষ্টা করেছিল, আটকে রাখতে, বোঝাতে, ফিরিয়ে আনতে।
কিন্তু কেউ যখন চলে যেতে চায়, হাজার চেষ্টা করেও তাকে ধরা যায় না।
সেই শূন্যতা, সেই অভাব—আজও সায়ানকে তাড়া করে।
ব্যথা উঠলে যেমন শরীর কুঁচকে আসে, এই অভাবেও তেমনি ভেতরটা ধসে পড়ে।
________________________________________
আজও লড়াই
সায়ান এখন খুব একা।
নিঃশব্দে লড়ছে—না-পাওয়া, না-থাকা, না-ফিরে আসা কষ্ট নিয়ে।
শারীরিক কষ্ট যতই হোক, হৃদয়ের শূন্যতা অনেক গভীরভাবে বাজে।
তবুও সে বেঁচে আছে।
সময়কে ভেসে থাকা এক নামহীন কণার মতো।
মাঝে মাঝে ব্যথা হয়—শরীর কুঁচকে আসে, মাথা ঝিমঝিম করে, বুকের ভেতর অজানা ভয়।
মা নেই, ভালোবাসার মানুষ নেই, নির্ভরতার কেউ নেই।
আছে শুধু নিজেকে বোঝা কিছু ওষুধ, আর এক ভয়—
“হঠাৎ আবার শুরু হলে?”
এই আতঙ্ক নিয়েই সে অফিসে যায়, হাসে, কাজ করে, ছোট ভাইদের সামলায়।
কেউ জানে না, ভেতরে সে কীভাবে বাঁচে।
রাতের ঘুম ভাঙে, পরীক্ষার মাঝপথে, আনন্দের মুহূর্তেও হঠাৎ মোচড় দিয়ে শরীরকে অসহায় করতে পারে।
এটা কোনো গল্প নয়—এটা এক চলমান আতঙ্কের নাম।
প্রতিদিন সকাল মানে নতুন করে ভাবা—
“আজও যদি ব্যথা না ওঠে, তবে সেটা একটি ভালো দিন।”