ছেলেটির নাম নাভিদ। বাবা-মায়ের আদর আর যত্নে গ্রামের সরল প্রকৃতির মাঝেই বড় হয়ে ওঠে সে। শৈশবটা তার ছিল রঙিন—সকালবেলা মাঠে ছুটোছুটি, বিকেলে খেলাধুলা আর সন্ধ্যায় বন্ধুদের সাথে আড্ডা; জীবন যেন ছিল এক অবিরাম আনন্দের উৎসব। খুব সৌখিন ছিল নাভিদ—নতুন জামা, ভালো খাবার, সুন্দর জিনিসের প্রতি তার আলাদা টান ছিল সবসময়। তবে তার জীবনে নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য ছিল না। ভাবত, বড় হয়ে কোনো একটা সাধারণ চাকরি করলেই চলবে, আর তাতে পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারলেই তার জীবন সার্থক হবে।
সবকিছুই স্বাভাবিক ছন্দে চলছিল, কিন্তু এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর যেন হঠাৎ করেই জীবনের মোড় ঘুরে গেল। সময়টা ছিল এক অদ্ভুত পরিবর্তনের—বন্ধুরা সবাই কেউ কলেজে ভর্তি হওয়ার কথা ভাবছে, কেউবা শহরে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। আর নাভিদ নিজের ভেতর এক নতুন চিন্তা অনুভব করতে লাগল—ইনকাম করার ইচ্ছে। তার কাছে পকেট খরচের জন্য পরিবারের কাছে হাত পাতা মানে ছিল একপ্রকার লজ্জার বিষয়। কিন্তু সমস্যাটা হলো, পড়াশোনা জানা ছেলেটি তো চাইলেই বড় কোনো চাকরি পাবে না। তবুও মনেপ্রাণে চেয়েছিল নিজের খরচ নিজেই চালাতে, পরিবারের বোঝা হতে চায়নি কখনো।
চাকরির জন্য নাভিদ বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের কাছে খবর দিয়ে রেখেছিল, হয়তো কোথাও সুযোগ মিলবে এই আশায়। ঠিক তখনই তার জীবনে নেমে এলো এক অচিন্তনীয় কালো অন্ধকার—হঠাৎ করেই তার বাবা মারা গেলেন। পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে এক মুহূর্তে কাঁধে এসে পড়ল অসীম দায়িত্বের ভার। ছোট্ট একটি বোন আর মা—এখন তার জীবনের সব ভরসা তাকেই হতে হবে।
পরিবার চালানোর জন্য চাকরি করা তার জন্য আর শুধু ইচ্ছে নয়, একেবারেই বাধ্যবাধকতা হয়ে দাঁড়াল। অবশেষে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে সে একটি ব্যাংকের এটিএম বুথে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি পেয়ে গেল। কিন্তু বেতন এতই কম যে প্রথম মাসের বেতন হাতে পেয়ে তার মন ভেঙে গেল—বাংলাদেশে নতুন হিসাবে বেতনের অঙ্ক যে কত ছোট হতে পারে, তা যেন হাড়ে হাড়ে টের পেল সে।
তবুও নাভিদ থেমে যায়নি। প্রতিদিন সেই সামান্য টাকায় ঘরের খরচ চালানো, মায়ের ওষুধ কেনা, আর বোনের পড়ালেখার খরচ যোগানো—সব কিছু মিলিয়ে সে যেন এক অবিরাম লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। নিজের স্বপ্ন ভুলে গিয়ে শুধু পরিবারের হাসি বাঁচিয়ে রাখাই হয়ে উঠল তার একমাত্র লক্ষ্য।
এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই সব ভেঙে পড়বে—এ কথা নাভিদের স্পষ্ট বুঝতে বাকি রইল না। তাই সে সিদ্ধান্ত নিল, বিদেশে যাবে। কিন্তু সমস্যা একটাই—তার হাতে কোনো টাকা নেই। তখনই মনে পড়ল বাবার ফেলে যাওয়া ছোট্ট একটি জমির কথা। পরিবারের সাথে আলোচনা করে সেই জমি বিক্রি করে, এক আত্মীয়ের মাধ্যমে সৌদি আরবে যাবার প্রস্তুতি শুরু করল। ভাগ্য সহায় হলো—রেস্টুরেন্ট ভিসায় সেখানে যাওয়ার সুযোগ মিলল।
বিদেশ যাওয়ার খবর পেয়ে তার ভেতরে নতুন করে জন্ম নিল অনেক স্বপ্ন। বাবার মৃত্যুর প্রায় দুই বছর হতে চলল, আর এখন তাকে মা আর ছোট বোনকে ছেড়ে প্রবাসে থাকতে হবে। বিদায়ের এই ভাবনা মনকে ভারী করে তুললেও বড় হওয়ার অদম্য ইচ্ছে তার বুক ভরিয়ে দিল সাহসে। বারবার মনে হচ্ছিল—"ওখানে গিয়ে বেশি টাকা ইনকাম করব, মা-বোনকে সুখে রাখব, তাদের সব কষ্ট মুছে দেব।"
প্রবাস জীবনের কষ্ট কেমন হতে পারে, সেই ভয় তার মনে তখন খুব একটা কাজ করছিল না। কারণ বাস্তবের নির্মমতা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে—যত কষ্টই হোক, পরিবারের জন্য লড়াই চালিয়ে যেতেই হবে। আর্থিক দুরবস্থা পেরিয়ে একদিন সবার মুখে হাসি ফোটানোই এখন তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।
দেখতে দেখতে নাভিদের জীবনের নতুন অধ্যায়ের সেই মুহূর্ত এসে গেল—ফ্লাইটের সময়। গ্রামের মানুষ, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন—সবাই তার সাথে দেখা করতে এল, কেউ দোয়া করল, কেউ বা হাসিমুখে সাহস দিল, আবার কারও চোখের কোণে জমল অশ্রু। বিদায়ের মুহূর্তে সবার চোখে এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি—গর্ব, আশা আর বিচ্ছেদবেদনা।
ফ্লাইটের একদিন আগে নাভিদ ঢাকা চলে আসে, সঙ্গে মা-বোনও। রাজধানীর ব্যস্ত সড়ক পেরিয়ে যখন তারা এয়ারপোর্টে পৌঁছাল, তখন বিদায়ের সেই কঠিন মুহূর্ত যেন আরও কাছে চলে এল। চেক-ইন শেষ হওয়ার পর শেষবারের মতো মা-বোনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল নাভিদ। মা হাসিমুখে বিদায় দিলেন, যেন ছেলের সামনে কষ্ট প্রকাশ করতে চান না, কিন্তু বিমানবন্দরের বাইরে পা রাখার পরই তার চোখ ভিজে উঠল। অঝোরে কাঁদতে লাগলেন তিনি।
নাভিদের ছোট বোন নাবিলা মায়ের হাত শক্ত করে ধরে শান্তনা দিতে লাগল—"মা, কেঁদো না, ভাইয়া তো আমাদের জন্যই যাচ্ছে।" দু’জনেই গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকল, যেন শেষ মুহূর্তে একবার বিমানের উড়াল দেখা যায়। আকাশে যখন বিশাল ডানা মেলে কাতার এয়ারওয়েজের বিমান ধীরে ধীরে রানওয়ে ছাড়ল, তখন তাদের চোখে ভেসে উঠল একটাই আশা—এই উড়াল একদিন সুখের দেশে পৌঁছে দেবে তাদের।
বিমান আকাশে মিলিয়ে গেলে মা-বোন গ্রামে ফেরার পথে রওনা দিলেন। আর মেঘের ওপরে বসে নাভিদ জানালার পাশে চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগল—"আমি ফিরব, ফিরব অনেক কিছু নিয়ে, মা-বোনকে সুখী করব।" সেই মুহূর্তে পৃথিবীর সব কষ্ট যেন তার কাছে তুচ্ছ মনে হলো।
এটা ছিল একটি ট্রানজিট ফ্লাইট। প্রথমে কাতারের দোহা পৌঁছাবে, সেখান থেকে আবার উড়াল দিয়ে সৌদি আরবের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। বিমানের নরম আসনে হেলান দিয়ে, চোখের পাতা নামিয়ে, নাভিদ মনে মনে তার নতুন জীবনের গল্প লিখতে শুরু করল—যেখানে ছিল স্বপ্ন, সংগ্রাম, আর ভালোবাসা দিয়ে ভরা প্রতিশ্রুতি।
সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। বিমানের ভেতর যাত্রীরা কেউ ঘুমে, কেউ সিনেমায়, কেউবা চুপচাপ জানালা দিয়ে বাইরের অসীম মেঘরাজ্য উপভোগ করছিল। নাভিদও চোখ বন্ধ করে তার মা-বোনের হাসিমাখা মুখ কল্পনা করছিল। তার মনে হচ্ছিল—আর কিছুদিনের মধ্যেই সে টাকাপয়সা পাঠাতে পারবে, মায়ের হাতে নতুন শাড়ি তুলে দিতে পারবে, বোনের পড়াশোনার খরচ নিয়ে আর কোনো দুশ্চিন্তা থাকবে না।
কিন্তু ভাগ্যের কাছে এসব স্বপ্নের কোনো দাম থাকল না। যখনই কাতারের দোহার আকাশসীমায় বিমানটি প্রবেশ করল, ঠিক তখনই হঠাৎ অ্যালার্ম বেজে উঠল। ককপিটে পাইলটরা আতঙ্কে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করতে লাগল, বারবার গ্রাউন্ড কন্ট্রোলে বার্তা পাঠানো হলো। পাইলট মরিয়া চেষ্টা করছিলেন বিমানটিকে কোনো ফাঁকা জায়গায় নামানোর, কিন্তু প্রতিটি সেকেন্ডের সাথে সাথে নিয়ন্ত্রণ যেন ক্রমেই ফসকে যাচ্ছিল।
শেষ মুহূর্তে, নিয়তির নিষ্ঠুর খেলায়, বিশালাকার সেই Qatar Airways-এর বিমানটি গিয়ে পড়ল দোহার এক স্কুলের ছাদের ওপর। তখন ক্লাস চলছিল, হাসি-খুশি শিশুদের কোলাহল ভেসে আসছিল চারপাশে। মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু বদলে গেল—শত শত শিশুর জীবন নিভে গেল একসাথে, সাথে বিমানটির প্রতিটি যাত্রীও চিরবিদায় নিল এই পৃথিবী থেকে।
সেই যাত্রীদের মধ্যে ছিল নাভিদও—এক তরুণ, যে স্বপ্ন নিয়ে ডানা মেলেছিল প্রবাসের পথে। তার সারাজীবনের আশা, তার পরিবারের জন্য করা প্রতিশ্রুতি, সবকিছু মেঘের ভেতরেই শেষ হয়ে গেল।
এদিকে, বাংলাদেশে তার মা-বোন তখন গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে গেছে। ক্লান্ত শরীরে তারা একটু বিশ্রাম নিতে চাইছিল, এমন সময় টিভির খবর তাদের হৃদয় ছিন্নভিন্ন করে দিল—“দোহার কাছে একটি বিমান দুর্ঘটনায় পড়েছে, বিমানে থাকা কেউ বেঁচে নেই।” পর্দায় যাত্রী তালিকায় নাভিদের নাম দেখে মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবী যেন অন্ধকার হয়ে গেল।
যে মা হাসিমুখে বিদায় দিয়েছিলেন, তিনি এখন বুক চাপড়ে কাঁদছেন। বোন নাবিলা মায়ের কাঁধে হাত রেখে নিজেও কাঁদতে কাঁদতে ভেঙে পড়ছে। তাদের সব স্বপ্ন, সব আশা, সব ভালো দিন আনার পরিকল্পনা—সবই ভেসে গেল এক অজানা ঝড়ে।
এটা শুধু একটি প্লেন ক্র্যাশ ছিল না। এটি ছিল নাভিদের মত হাজারো তরুণ-তরুণীর পৃথিবী ছাড়ার একসাথে বিদায় ঘণ্টা। যে পাখি ডানা মেলেছিল দূরের স্বপ্নে, সে আর ফিরে এল না প্রিয়জনের বুকে।
প্রতিবার এমন দুর্ঘটনায় শুধু কিছু নাম আর ছবি খবরের পাতায় জায়গা পায়, কিন্তু হারিয়ে যায় অসংখ্য অসমাপ্ত গল্প। হাজারো মা-বাবা, ভাই-বোন, সন্তান—প্রতিজন হারায় নিজের পৃথিবী।
এখন সময় এসেছে বুঝবার—আকাশে শুধু স্বপ্ন পাঠাবেন না, পাঠাবেন নিরাপত্তা আগে। কারণ প্রতিটি যাত্রী কেবল সংখ্যা নয়, তারা কারও সন্তান, কারও স্বপ্ন, কারও পুরো পৃথিবী।
নাভিদের গল্প শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু তার মায়ের চোখের জল এখনো শুকোয়নি। নাবিলা প্রতিদিন রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে—"ভাইয়া কি আমাদের দেখছে?" হয়তো কোথাও এক অদৃশ্য আকাশপথে নাভিদ এখনো উড়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার গন্তব্য আর পৃথিবীর কোনো দেশ নয়।
প্রতিটি বিমান দুর্ঘটনা শুধু খবর নয়—এটি কারও হৃদয় ভাঙা, কারও জীবনের কেন্দ্রচ্যুত হওয়া, কারও ভবিষ্যতের চিরতরে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া। আজ যদি নিরাপত্তায় আরও মনোযোগ দেওয়া হতো, হয়তো নাভিদ আজ বেঁচে থাকত, হয়তো তার মা এখন হাসিমুখে বাজার করত, বোন কলেজে গিয়ে ভাইয়ের পাঠানো টাকা দিয়ে বই কিনত।
মেঘের মাঝে থেমে যাওয়া এই স্বপ্ন শুধু নাভিদের নয়—এটি আমাদের সবার জন্য সতর্কবার্তা। কারণ যতক্ষণ না প্রতিটি যাত্রী নিরাপদে ঘরে ফেরে, ততক্ষণ প্রতিটি উড়াল এক অদৃশ্য জুয়ার মতো।
আকাশে স্বপ্ন পাঠাবেন না শুধু—পাঠাবেন নিরাপত্তা আগে। কারণ একবার স্বপ্ন ভেঙে গেলে, তার ধ্বংসাবশেষে শুধু কান্না আর শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই থাকে না।