ধোঁয়া নামার পর

প্লেন ক্র্যাশ (সেপ্টেম্বর ২০২৫)

সুব্রত ভারতী
  • 0
  • ১৬৬

বিকেলের শেষ আলোয় শাহজালাল বিমানবন্দরের কাঁচের গায়ে আগুনের রঙ লেগে আছে। নাফিসা বোর্ডিং-পাসের ওপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকে কাতারে, বুকের ভেতরটা কেমন হালকা কাঁপে। ছোট্ট এক ব্যাগ—ভেতরে কয়েকটা জামা, একটা নরম শাল, আর কক্সবাজারের উখিয়ার শরণার্থী শিবির থেকে নিয়ে আসা শিশুর আঁকা ছবিগুলো; ছবিতে সূর্য সবসময় গোল, খুবই হলুদ, আর ঘর সবসময় চারকোনা—বেরোবার দরজা খুব বড়, যেন যে কোনো সময় পালিয়ে যাওয়া যায়।

মাইকে একবারে স্পষ্ট ঘোষণা ভেসে আসে, চট্টগ্রামগামী ফ্লাইটের যাত্রীদের বোর্ডিং শুরু হয়েছে। নাফিসা জানে, সোজা চট্টগ্রাম নয়—সেখানে নেমে রাতের বাসে বরিশাল। আব্বা হাসপাতালে, হার্টের সমস্যা। মায়ের কণ্ঠে সকালে কেমন থরথর ছিল—“যদি পারিস, একবার দেখে যা।”

মানুষে মানুষে ভরা অপেক্ষাঘর। এক কোণে দেখা যায় মসজিদের দিকে মুখ করে কেউ চুপচাপ বসে আছে, চোখ বুজে হাত তুলে আছে প্রার্থনায়। পাশেই এক তরুণ ছেলেমেয়ের দল—কারও হাতে মেট্রোরেলের কার্ড, কেউ আবার হাতফোনে আত্মীয়কে জানাচ্ছে, “উড়াল দিচ্ছি, দোয়া কইরো।” আরেক পাশে দাঁড়িয়ে একজন নিস্তব্ধ বৃদ্ধ, কাঁধের ব্যাগটা পুরনো, তাতে বাঁধা নীল কাপড়ের ফিতে। নাফিসা তার দিকে তাকিয়ে হাসে। বৃদ্ধও একচিলতে হাসি ফিরিয়ে দেন।

বিমানটায় উঠতেই ঠাণ্ডা বাতাস। জানালার পাশে বসে নাফিসা ব্যাগ থেকে ছবিগুলো বের করে রাখে, অক্ষরে অক্ষরে দেখে—একটা ছবিতে লেখা আছে, “ঘর চাই, আকাশ নয়।” নাফিসা নিঃশব্দে বলে, “আকাশও একদিন ঘর হবে, মা।”

পাশের সিটে যে বৃদ্ধ, নাম তাঁর হাশেম আলী। ময়মনসিংহের এক গ্রামের লোক, চট্টগ্রামে জাহাজঘাটে কাজ করে, মেয়ের চিকিৎসার টাকা নিয়ে ফেরে; মেয়েটার নাম সেতারা, জন্ম থেকে হৃদপিণ্ডে ছিদ্র। একশো টাকার নোটগুলো কাগজের খামে ভরে তিনি বারবার গুনে দেখেন। নাফিসা হাসিমুখে বলেন, “চাচা, এতবার গুনছেন কেন?”
হাশেম আলী চোখ নামিয়ে বলেন, “ভয় লাগে মা, টাকা গুনলে হাশর-বরকত জোটে—আর ভুলে গেলে মন কাঁপে।”
“সেতারা কেমন আছে এখন?”
“এইবার ঢাকা থেকে ডাক্তার কইছে, একটু আশা আছে। মানুষের দুনিয়ায় আশার দাম বেশি, মা—তাই বুকে বেঁধে চলি।”

বিমানের ডানা দুটো মাটির রক্তিম আলো ফেলে দিচ্ছে। টেক-অফের আগে কেবিন কর্মীরা হাসিমুখে নিরাপত্তার নিয়ম দেখিয়ে দেয়। কেউ খেয়াল করে, কেউ করে না। ব্যর্থ সন্তাপের মতোই নিরাপত্তা-নিয়ম—দেখতে ভালো, কিন্তু বিপদের সময় মনে পড়ে না।

বিমান উঠতেই ঢাকা শহর নিচে রঙিন কাঁচের মতো ঝিলমিল করে। মেট্রোরেল সরু সাপের মতো চলে যায়, পদ্মা সেতুর দিকে আকাশের ভেতর অনন্ত কোনে ডুবে যায় সন্ধ্যার নীল।

“আমার মেয়ের যদি একদিন সেতুর ওপর দিয়ে হাঁটতে পারত!”—হাশেম আলীর চোখে ঝট করে জল এসে পড়ে।
নাফিসা জানে, চোখের জল অনেক সময় প্রার্থনার ভাষা। সে চুপ করে থাকে, শুধু স্নিগ্ধ কণ্ঠে বলেন, “সেতারা হাঁটবে, চাচা। সেতু তো কেবল নদীর ওপর নয়, পৃথিবীর ভেতরেও হয়।”

বিমানের ভেতরে পরিচিত এক শোঁ শোঁ শব্দ, মেঘের গায়ে ডানা বুলিয়ে যাওয়ার নরম গর্জন। কিছু যাত্রী ঘুমোতে উনমনা, কেউ কেউ স্ন্যাকসের ছোট্ট বাক্স খুলে দেখে, কেউ বইয়ে মুখ গুঁজে আছে। নাফিসা ব্যাগ থেকে এক চিঠি বের করে—মায়ের শেষ কাগজটা নয়, আরেকটা, নিজে লিখেছিল। বাবার জন্য। বাবার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে—মেয়ের স্বাধীনতা নিয়ে। “তুমি ফিরে এসো, সব ভুলে যাই”—এই বাক্যটা বারবার লিখে, আবার কেটে দিয়েছে। এমনই তো হয়—ক্ষমা করতে ইচ্ছে করে, কিন্তু ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় না।

আকাশের ভেতর আচমকা এক বাঁক। বিমানের শরীর জোরে কেঁপে উঠল। মুহূর্তে সব কথাবার্তা স্তব্ধ। কেবিনে আলো খানিকটা ম্লান। তারপর আবার জ্বলে উঠল। মাইকের শব্দ খটখটে—একজন পাইলট শান্ত গলায় বললেন, “সবাই সিটবেল্টটা বেঁধে নিন। সামনের আবহাওয়া একটু খারাপ।”

নাফিসা হাতের চিঠিটা ব্যাগে ঢুকিয়ে সিটবেল্ট কষে বাঁধে। হাশেম আলী বাম হাতে ব্যাগের ফিতে চেপে ধরেন। কে যেন বিড়বিড়িয়ে বলে, “আয়াতুল কুরসী…।” আরেকজন পড়ে, “গীতার শ্লোক, ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।” একজন বৃদ্ধা চোখ বোজে জপে, “বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি।” অচেনা ভয় মানুষকে একই প্রার্থনায় এনে দাঁড় করায়—এ এক অলৌকিক মিলন, যাকে আমরা নাম দিতে পারি না।

বিমানের গায়ে আলাদা রকম কম্পন। মেঘের গাদায় সূর্য আলো কমেছে। কেবিনের ভেতর কাঁচে কাঁচে হাওয়ার আঁচ লাগে। নাফিসার কানে ভেসে আসে শিশুর কান্না—পেছনের সারিতে বাচ্চার মা কোল চেপে ধরে আছে, “চুপ, আর একটু, ভগবান আছে।”
হাশেম আলী গভীরভাবে বলে ওঠেন, “ভগবান আকাশের ভেতর না মা, আমাদের বুকের ভেতরে। ভয় পাস না।”

তারপর যে শব্দটা এলো, সেটা জীবনে একবার শোনারই কথা—ডানার পাশে একদিকে যেন ধারালো কিছু হানা দিল। বিমানের ভেতর সব মানুষ একসঙ্গে শ্বাস টেনে ধরল। মাইকে এবার আর কথা নেই—শুধু ডানার কারখানার কর্কশ আওয়াজ। কেবিন কর্মীদের মুখে আতঙ্ক গোপন করা হাসি। এক মুহূর্তে বৃষ্টি। অসীম বৃষ্টি।

বিমান নিচে নামছে। তীব্র গতিতে। কেউ বলে উঠল, “আল্লাহু আকবর!”—কেউ “জয় মা”। নাফিসা কান্না আটকিয়ে বুকে হাত রাখে—“হে করুণাময়, আমাদের সহজ ক’রে দাও।”

ঝাঁকুনির পর ঝাঁকুনি। চোখের সামনে সব কিছুর আলোর রেখা বেঁকে যাচ্ছে। আকাশ যেন হঠাৎ নিঃশেষে ভেঙে পড়ল। তারপর—এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, খুব কাছে জল, এক সমুদ্রের গহ্বরের মতো শব্দ, পেটে ধাক্কা, কানে এক অন্ধকার—আর কিছুই নেই।



চেতনা ফেরার আগে গায়ের ওপর গরম কাঁপুনি এসে জড়োয়। দূরে খড়খড়ে কাশবন, নিচে ভেজা মাটি, ধোঁয়ার গন্ধ। কোথাও একটা আগুন, কোথাও কেউ ডাকছে, “বাঁচান! এখানে…!”

নাফিসা ধীরে ধীরে চোখ খুলে দেখে—ভাঙা সিট, ছড়িয়ে থাকা খাবারের বাক্স, মেঝেতে উল্টে থাকা এক জল বোতল। তার হাঁটুতে কাটা, রক্তের লাল দাগ। পাশে হাশেম আলী—তিনি সিটে গুঁজে আছেন, শ্বাসটান গাঢ়। ডান হাতটা উঠে আছে, যেন কারও হাত ধরতে চাইছেন।
“চাচা…” নাফিসা কাঁপা গলায় ডাক দেয়।
হাশেম আলী তার দিকে তাকান। ঠোঁটে খুব ক্ষীণ হাসি—“বেঁচে আছিস?”
“জানি না। আপনি?”
তিনি কিছু বলার আগে কাশির দমকে কেঁপে ওঠেন।

আঁধারে বৃষ্টি থেমে গেছে, কিন্তু মাটি ভেজা। কোথাও অগভীর জল, কোথাও কাদা। বিমানের বরফ-ঠাণ্ডা ধাতুতে হাত রেখে দাঁড়াতে গিয়েই নাফিসা বুঝে—কতজন বেঁচে, কতজন হারিয়ে গেছে, তা বোঝার ক্ষমতা এখনই নেই।

পেছন থেকে চিৎকার, “আমার বাচ্চা! কেউ আছে? বাঁচান!”—বাচ্চার কান্না তীক্ষ্ণ শিসের মতো কেটে আসে।
নাফিসা তার শরীরের ব্যথা ভুলে দৌড়ায়। ভাঙা কেবিনের ফাঁক গলে, সিটের নিচে, এক শিশুর পা কাঁপছে। মা হাত বাড়িয়েও পৌঁছাতে পারছে না। নাফিসা বসে পড়ে, শালটা গুটিয়ে নেয়, বাচ্চার কোমরে পেঁচিয়ে তাকে টেনে তোলে। শিশুটি কাঁদতে কাঁদতে নাফিসার গলা জড়িয়ে ধরে—মা বাচ্চাকে আঁকড়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে।

দূরে গ্রামের মানুষ এসেছে—নৌকা, বাঁশ, দড়ি, টর্চের আলো। কারও শরীরে লুঙ্গি ভেজা, কারও গায়ে সাদা গামছা। তারা দৌড়াচ্ছে, ডাকছে, “কেও বাঁচে আছে?”—“বাঁচান”—“এদিকে”—“সাবধানে”—এইসব মানুষের ভাষা একটাই: মানুষকে বাঁচাও।

নাফিসা আবার হাশেম আলীর কাছে আসে। তাঁর সিট আটকে গেছে ভাঙা কাঠামোয়। নাফিসা চিৎকার করে, “কেউ আছেন? একটু সাহায্য!”
দুজন যুবক ছুটে আসে—একজনের নাম মিতুল, সে বলে, “আমি নদী-পুলিশে স্বেচ্ছাসেবক। দড়ি দাও—ধরেন…!”
দড়ি দিয়ে সিটের কষা ধাতু বাঁধা, তিনজন মিলে টানতে টানতে খানিকটা ছাড়ে। হাশেম আলী ততক্ষণে ফ্যাকাশে। নাফিসা তাঁর কাঁধে হাত রেখে বলে, “চোখ বন্ধ করবেন না, চাচা!”
“সেতারা…”—শব্দটা তাকে ছুঁয়েই থেমে যায়।

“চাচা, আপনার মেয়ের জন্য—আপনি বেঁচে থাকবেন।” নাফিসা নিজেই বোঝে, কথাটা বলার জন্য বলছে।
মিতুলের মুখে আলো লাগে—“একটু কেটার মতো কিছু আছে?”
নাফিসা শালের ভাঁজ থেকে ছোট্ট কাঁচি বের করে। দড়ি, গামছা, বাঁশ—সব মিলিয়ে কাঠামো কেটে কেটে একটু ফাঁক তৈরি হয়। হাশেম আলীর সিট সরানো যায়। তাঁকে টেনে বের করতেই তিনি কাউকে খুঁজতে খুঁজতে ফিসফিস করেন, “খামটা…টাকা…”
নাফিসা নিচের ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে খামটা বার করে দেয়। খামের ওপর লেখা, “সেতারার ওষুধের টাকা।”

নৌকায় একে একে আহতরা ওঠে। অচেনা মানুষের কোল ধার করে অচেনা শিশুরা চুপ হয়ে যায়। ভেজা বাতাসে ঝিঁঝিঁর ডাক। কোথাও আলোর রেখা—সম্ভবত গ্রাম। দূরে নীলচে সেতু। কেউ ফিসফিস—“পদ্মা সেতু ওদিকে।”

নাফিসাকে এক যুবতী ধরে বলে, “আপার হাতে রক্ত—আপা, আপনি আগে যান।”
নাফিসা মাথা নাড়ে—“ওই বাচ্চাটাকে আগে নিন। আর এই মানুষটা—হাশেম চাচা—তিনি…”
হাশেম আলীর শ্বাস আবার ক্ষীণ। নাফিসা শালের ছেঁড়া অংশ দিয়ে কোমরে ক্ষত চেপে ধরে।
“চাচা, আপনার মেয়ের নাম কী?”
“সেতারা…”
“সেতারা আজকে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। আপনি যাবেন তো?”
তিনি কিছু একটা বলতে গিয়েও পারেন না। কেবল খামটা নাফিসার হাতে তুলে দিয়ে বলেন, “যদি…আমি…”—বাকিটা এসে ঠেকে বুকের কোথাও, আর বের হয় না।

উদ্ধারের নৌকা চলে যায়, ফিরে আসে। রাত গভীর হয়। কোথাও রোগীকে তুলতে তুলতে সময় যায়, কোথাও কাদা আটকে দেয়। নাফিসা মাঝে মাঝে টলতে থাকে, তবু নিজেকে ধরে রাখে। সে জানে—আজ বেঁচে থাকা মানে কেবল নিজের প্রাণ ধরে রাখা নয়, আরও অনেকের জন্য আলো জ্বালানো।


হাসপাতালে ভোর ফোটে। সাদা দেয়াল, লবিতে লবণে ভেজা গন্ধ। যাদের চোখে ভয় ছিল, তাদের চোখে এখন ক্লান্তি। নাফিসার হাঁটুতে টান পড়লে ডাক্তার সেলাই দিয়ে দিয়েছে, মাথায়ও হালকা আঘাত ছিল—টিকিটিক শব্দে হৃদ্যন্ত্রের পরিমাপ জানায়, “তুমি বেঁচে আছো।”

মিতুল এসে দাঁড়ায় দরজায়, লাজুক হাসি। “আপা, কেমন আছেন?”
“ভালো। হাশেম চাচা?”
মিতুল থেমে যায়। তার চোখ এড়িয়ে আকাশের দিকে তাকানোর ভঙ্গি—“চলে গেছেন। রাতেই।”

নাফিসার বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায়। মনে পড়ে—“সেতারা আজকে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।” নিজের মুখের কথাই কেমন তলোয়ারের মতো ফিরে এসে বুক কাটে। সে ব্যাগ থেকে সেই খামটা বের করে; কাগজগুলো এখনও ভেজা, তবু টিকে আছে।

“ওনার মেয়ে—আপনি কিছু জানেন?”
“গ্রামের ঠিকানাটা বলেছিলেন। আমি খুঁজে বের করব,”—মিতুল বলে।




দেড় সপ্তাহ পর, ময়মনসিংহের এক গ্রামের মাটির উঠোনে বসে আছে এক কিশোরী—গাঢ় চোখ, পাতলা শরীর, হাসলে গালে টোল পড়ে। সে-ই সেতারা। তার পাশে মা, ঘোমটার আঁচল টেনে রেখেছে। বাতাসে ধানগাছ দুলছে। দূরে মসজিদের মিনার, মেয়েরা জারে পানি আনছে।

নাফিসা সামনে বসে। তার হাতে কাগজের খাম, আর উখিয়ার শিবির থেকে আনা বাচ্চাদের আঁকা ছবির প্যাকেট।
“তোমার বাবা তোমার জন্য টাকা নিয়ে ফিরছিলেন। আমরা উদ্ধার করার সময় খামটা তিনি আমাকে দিলেন। তোমার জন্য রেখে গেলেন।”

সেতারা খামটা বুকে জড়িয়ে ধরে। নীরব কান্নায় তার কাঁধ কাঁপতে থাকে। মায়ের চোখে জল—“আপা, আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন। ওর অপারেশনের টাকা জোগাড় করতে পারছি না—এই টাকাটা একটা আশীর্বাদ।”

নাফিসা ব্যাগ থেকে আরেকটা খাম বের করে। “এটা—আমার। একজন মানুষ হিসেবে আমি আরেকজনের কষ্টে হাতে হাত দিলাম, ব্যস। কিছু সহায়তা আছে ভিতরে। আর এই ছবিগুলো—শরণার্থী শিশুরা এঁকেছে। দেখা হলে তাদের জন্য একটা প্রার্থনা কইরো।”
সেতারা ছবিগুলো দেখে চুপ করে। একটা ছবিতে লেখা, “ঘর চাই, আকাশ নয়।” সে ফিসফিস করে, “আমারও ঘর দরকার, আপা। তবে যদি আকাশের ওপাশে বাবার সঙ্গে দেখা হয়…”—বাকিটা গলায় আটকে যায়।

সেদিন সন্ধ্যায় গ্রামের লোকজন জড়ো হয়। যখন গল্প শোনা হয়, তখন জীবনকে একটু করে বোঝা যায়। নাফিসা সবার সামনে দাঁড়িয়ে ঘটনার কথা বলে—আকাশের ভেতর মানুষের ভয়, ভাঙা কেবিনের অন্ধকার, অচেনা হাতের উষ্ণতা, ভেজা শালের গন্ধ, নৌকার দড়ি, কৃষ্ণাভ জলে বিমানের ধাতু ডুবে যাওয়ার শব্দ। কেউ কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল, “আমার ভাইও ওই ফ্লাইটে ছিল।” কেউ হাত বাড়িয়ে বলে, “আপা, আপনি শক্ত আছেন।”

রাতে নাফিসা একা বসে। আকাশের অগাধ কালো কাপড়ে গা ঠেকিয়ে আছে তারা। দূরের বাঁশবাগান থেকে পেঁচার ডাক আসে। মায়ের শেষ কথাগুলো মনে পড়ে—“শেষ সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোই ভালোবাসার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।” নাফিসা জানে, ভালোবাসা কেবল ইশক নয়—ভালোবাসা মানে মানুষকে মানুষের মতো স্বীকার করা।

পরদিন শহরে ফিরে নাফিসা একটা ক্ষুদ্র তহবিল গড়ে। নাম দেয়—“ধোঁয়া নামার পর।” এই তহবিল প্লেন দুর্ঘটনায় হারানো পরিবারের জন্য, আহতদের পুনর্বাসনের জন্য, কেবল টাকা নয়—মানুষের পাশে মানুষ রাখার জন্য। মিতুল, যে নদী থেকে মানুষকে টেনে তুলেছিল, সে-ও জোটে পাশে। শরণার্থী শিবির থেকে যে ছবিগুলো এনেছিল, সেগুলো নিলামে দেয়। শহরের এক ক্যাফেতে টাঙানো হয় রঙিন ছবি—একটি তে সূর্য উজ্জ্বল, আরেকটিতে ঘর, আরেকটিতে কেবল একটি দরজা। দরজা মানেই তো অনন্ত সম্ভবনা।

পত্রিকা আসে খবর করতে। কেউ জিজ্ঞেস করে, “আপনি তো যাত্রী ছিলেন, আপনি তো নিজেই ট্রমায়—এত কাজ করছেন কীভাবে?”
নাফিসা মৃদু হাসে—“আমি যদি বেঁচে যাই, তবে বেঁচে থাকার দায়ও নিতে হবে। আমার বেঁচে থাকা যেন আরেকজনের আলো হয়।”



মাস দুই পর, সেতারার অপারেশনের তারিখ পড়ে। হাসপাতালের বেডে কুঁকড়ে থাকা কিশোরীর দিকে তাকিয়ে নাফিসা মনে মনে পড়তে থাকে, “হে করুণাময়, আমাদের সহজ করে দাও।” অপারেশন থিয়েটারের দরজা বন্ধ হয়ে গেলে সময় কী অদ্ভুতভাবে দীর্ঘ হয়। হাতফোনে ছোট্ট মেসেজ—মিতুল লিখেছে, “দোয়া করছি।” গ্রাম থেকে সেতারার মা লিখেছে, “অথচ মনে হচ্ছে ওর বাবা এখুনি এসে মাথায় হাত বুলাইয়া দেবে।”

দুই ঘণ্টার পর দরজা খুলে যায়। ডাক্তার হাসে—“ভালো হয়েছে।” এই “ভালো” শব্দটা কেমন এক অনির্বচনীয় স্বস্তির মতো নেমে আসে বুকের ভারে। সেতারার ঠোঁটে ছোট্ট হাসি—“আপা, আমি কি হাঁটতে পারবো সেতুর ওপর দিয়ে?”
“পারবে। নিশ্চয়ই পারবে,”—নাফিসা চোখ মুছে বলে।—“আমরা একদিন একসঙ্গে যাবো। পদ্মা সেতু পেরিয়ে, বড় আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে, বাবার নাম ধরে ডাকবো—সে বাতাস হয়ে তোমাকে জড়িয়ে ধরবে।”



শরতের একদিন, পদ্মার ধারে প্রচুর মানুষ। আকাশ নীল, মেঘ সাদা। নদীর গায়ে রোদ পড়ে চকচক করছে। কাঁচের ঝিলিমিলির মতো ঝরে পড়ছে সময়। ছোট্ট এক সমাবেশ—“ধোঁয়া নামার পর”—আজ প্রতিশ্রুতি নেবে, যে যেখানেই থাকুক, বিপর্যয়ে মানুষকে মানুষ ভাববেই।

সেটাই তো আসল ধর্ম।

সেতারা সেখানে। বুকে সাদা স্কার্ফ, মুখে প্রতিশ্রুতির আলো। নাফিসা সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলে—“আজ এই নদীর ধারে আমরা যাদের হারিয়েছি তাদের কথা মনে করছি। কিন্তু আমরা কাঁদতে কাঁদতে হারিয়ে যাইনি—আমরা হাত ধরেছি। মানুষের হাত। এই হাতই কোনোদিন দড়ি হয়ে দাঁড়াবে, কোনোদিন বাঁচাবে, কখনো কখনো কেবল পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে। প্লেন ক্র্যাশ আমাদের শিখিয়েছে—আকাশ ভাঙলেও আকাশ শেষ হয় না। আকাশ আবার জোড়া লাগে মানুষের বুকের ভিতর।”

কেউ চুপ করে, কেউ কান্না মুছে, কেউ হাসে। হাশেম আলীর স্ত্রীর হাতে আজ নতুন শাড়ি—সেতারা ক্ষীণ হলেও চোখদুটো শোভা পায়। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে মিতুল।

“আপা,”—সে বলে, “আপনি কি কখনো সেই চিঠিটা বাবাকে দিয়েছিলেন? যেটা আপনি লিখেছিলেন?”
নাফিসা দূরের জলরেখার দিকে তাকিয়ে বলে, “শব্দের প্রয়োজন অনেক সময় কম। আমি তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। মৃত্যুশয্যায় তাঁর হাত ধরেছিলাম। ওটাই ছিল আমার চিঠি।”

বাতাসে পাখির ডাক। বাচ্চারা ঘুড়ি ওড়ায়। কেউ ঢাক বাজায়, কেউ কবিতা পড়ে। একজন মৃদু কণ্ঠে বলে, “চলো আমরা এমন এক দেশ গড়ি, যেখানে দুর্ঘটনার খবরের পাশে সবসময় মানুষের হাতের ছবি থাকবে, সাহায্যের খবর থাকবে, ভালোবাসার কাজ থাকবে।”

সন্ধ্যার দিকে আকাশে লালিমা। নাফিসা আকাশের দিকে তাকিয়ে টের পায়—ওখানে কোনো ভাঙন নেই। ভাঙন ঘটে আমাদের ভেতরে। আর সেখানেই আবার জোড়া লাগে।

সে ব্যাগ থেকে উখিয়ার শিশুদের আঁকা একটা ছবি বের করে সকলকে দেখায়—“দেখুন, এই ছবিটায় একটা দরজা আঁকা। দরজাটা খোলা, বাইরে ফসল, ভিতরে আলো। আমি চাই ‘ধোঁয়া নামার পর’—প্রতিটি বিপর্যয়ের পরে—আমরা এই দরজার মতোই খোলা থাকি। ভেতর-বাহিরের ভেদ যেন মুছে যায়।”

লোকজন হাততালি দেয়। কেউ বলে, “আল্লাহ ভরসা।” কেউ বলে, “যতদিন মানুষ আছি, ততদিন এমন হাত ধরাধরি থাকুক।”

রাত নামতে থাকে। পদ্মার ধার দিয়ে বাতাস গাঢ় হয়। নাফিসা বুঝতে পারে, মানুষের জীবন কেবল উড়াল আর পতনের হিসাব না। জীবন মানে যারা পড়ে যায়, তাদেরও তুলে নেওয়ার নীরব আস্থা।

আর সেই আস্থা থেকেই একদিন, হয়তো কোনো শিশুই আর আঁকবে না চারকোনা ঘর আর খুব বড় দরজা। একদিন হয়তো সে আঁকবে বিস্তীর্ণ আকাশ, যেখানে কোনো প্লেন পড়ে না; যেখানে প্রতিটি উড়াল মানে কেবল পৌঁছানো—কারও হৃদয়ে, কারও ঘরে, কারও বাঁচার অধিকারে।

ধোঁয়া নামার পর আকাশটা আরও নীল দেখায়—এ সত্যি। কিন্তু তারও বেশি সত্যি, ধোঁয়া নামার পর মানুষ যদি মানুষ থাকে—তাহলেই সবকিছু আবার জোড়া লাগে।

নাফিসা মাটিতে পা রেখে দাঁড়ায়। নদী বয়ে চলে। আকাশ জ্বলে ওঠে তারায়। কেউ একজন হাত বাড়িয়ে দেয়—সে হাত ধরে।
এভাবেই, দুর্ঘটনার ধ্বংসস্তূপের মাঝেও বেঁচে থাকে এক দেশ, বেঁচে থাকে এক নারী, বেঁচে থাকে এক শিশুর হৃদয়।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মেহেদী মারুফ গল্পে যেভাবে পুরো কাহিনীটা পূঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করেছেন। তাতে মনে হলো সবকিছু যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে৷ বিশেষ করে "নাফিসা ধীরে ধীরে চোখ খুলে দেখে—ভাঙা সিট, ছড়িয়ে থাকা খাবারের বাক্স, মেঝেতে উল্টে থাকা এক জল বোতল। তার হাঁটুতে কাটা, রক্তের লাল দাগ। পাশে হাশেম আলী—তিনি সিটে গুঁজে আছেন, শ্বাসটান গাঢ়। ডান হাতটা উঠে আছে, যেন কারও হাত ধরতে চাইছেন।" এই লাইনগুলোতে তাদের যে পরিস্থিতি। সেটা যেন অকল্পনীয়। যারা এমন মুহুর্তগুলোতে নিজেদের জীবনের বিনিময়ে সাক্ষী হয়ে থাকে। তারা জানে কতটা ভয়াবহ হতে পারে একটা দূর্ঘটনা। বেশ ভালো লিখেছেন সুব্রত ভারতী দাদা। শুভ কামনা রইলো আপনার জন্য। আর আমার গল্প ও কবিতায় আমন্ত্রণ রইলো।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

গল্প “ধোঁয়া নামার পর” মূলত প্লেন ক্র্যাশ বিষয়ের সঙ্গে সরাসরি ও গভীরভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এখানে বিমান দুর্ঘটনার ঘটনাকে কেন্দ্র করে গল্প এগিয়েছে, যেখানে দুর্ঘটনার আগে যাত্রীদের জীবন, আকাশে সংকটের মুহূর্ত, দুর্ঘটনার ভয়াবহতা, এবং পরবর্তী উদ্ধার ও মানবিক সহমর্মিতা—সবকিছুই বিস্তারিতভাবে ফুটে উঠেছে। দুর্ঘটনাটি শুধু রোমাঞ্চকর বা ভয়াবহ চিত্র নয়, বরং মানবিক সম্পর্ক, সহানুভূতি, ত্যাগ, এবং বেঁচে থাকার অর্থকে সামনে এনেছে। প্লেন ক্র্যাশকে গল্পের মূল প্লট হিসেবে ব্যবহার করে লেখক মানবতার বিজয়, মানুষের হাতে হাত রাখার শক্তি, এবং দুর্যোগের ভেতর থেকেও নতুন আশার জন্মকে তুলে ধরেছেন—যা বিষয়ের সঙ্গে পুরোপুরি মিল রেখে পাঠকের মনে গভীর প্রভাব ফেলতে সক্ষম।

২৫ জুলাই - ২০২৫ গল্প/কবিতা: ৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "হতাশা”
কবিতার বিষয় "হতাশা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ সেপ্টেম্বর,২০২৫