আশ্রিত জীবনের ছায়া

পরগাছা (আগষ্ট ২০২৫)

আপেল রহমান
  • ৫৯
ঢাকার এক ছোট্ট অলিতে, ছায়াঘেরা শান্ত এক ফ্ল্যাটে থাকেন লতিফা বেগম। বয়স পেরিয়েছে ষাট। এক সময় স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। স্বামী গত হয়েছেন অনেক আগেই। তিন ছেলে—সবাই বিদেশে, প্রতিষ্ঠিত। তবে কারো ঘরেই তিনি আশ্রয় পাননি।
হ্যাঁ, টাকাপয়সার অভাব নেই। সন্তানেরা টাকা পাঠায়। নিয়ম করে ফোনেও কথা বলে। তবুও, মনটা ফাঁকা পড়ে থাকে।

বাড়িতে কাজের মেয়ে রিনা আছে, কিন্তু তার ব্যস্ততা মোবাইল আর নিজের সংসার ঘিরে। বাস্তবিক অর্থেই লতিফা বেগম একা।

একদিন ছাদের কোণে একটি অচেনা লতার জন্ম হয়। পেঁপে গাছের গায়ে জড়িয়ে উঠতে থাকে। রিনা বললো, “এইটা তো পরগাছা, ফেলেই দেই না?”
লতিফা মাথা নাড়েন, “না রিনা, থাকতে দাও। কারো আশ্রয়ে বাঁচতে চাইলে, তাকে কী এভাবে ফেলে দিতে হয়?”

প্রতিদিন সকালে তিনি ছাদে গিয়ে লতার কাছে দাঁড়ান। পানি দেন, কথা বলেন।
পরগাছা নিজে ফল দেয় না, ছায়াও কম। কিন্তু সে বাঁচে। নিজের অক্ষমতা সত্ত্বেও সে আশ্রয় খোঁজে, ভালোবাসা চায় না—শুধু টিকে থাকার অধিকার চায়।

একদিন এক প্রতিবেশী এসে বললেন,
— “আপা, এই পরগাছা তো গাছ মেরে ফেলে! আপনি এটাকে এত আদর করেন কেন?”
— “এই যে, তুমি বলছো ‘মেরে ফেলে’—কিন্তু আমি দেখি সে লেগে থাকে। টিকে থাকে। আমরাও তো কারও না কারও ভালোবাসায়, স্মৃতিতে, সহানুভূতিতে লেগে থেকে বাঁচি। একদম একা হয়ে কেউই তো টেকে না।”

লতিফার পাশের ফ্ল্যাটে থাকে রাফি। চাকরি করে, রাত করে ফেরে। মাকে দেখাশোনা করে। মা আলঝেইমারে আক্রান্ত, ছেলেকে চিনতেও পারেন না।
এক সন্ধ্যায় রাফি এসে বলে,
— “খালা, মা আজকে আমাকে ভাই ভাবছে। আমি কষ্ট পাই। কিন্তু ছেড়ে তো যেতে পারি না। উনিই তো আমার শিকড়।”

লতিফা হেসে বলেন, “তুমি ভাবছো, মা এখন তোমার ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছেন—মানে পরগাছার মতো? কিন্তু জানো রাফি, কখনো কখনো গাছই চায় তার ওপর কিছু একটা জড়িয়ে থাকুক—তাহলেই সে বুঝে, সে এখনো জীবিত।”

রাফির চোখে জল আসে।

কিছুদিন পর পাশের ফ্ল্যাটে উঠে বিত্তশালী পরিবার। তাদের মেয়ে তৃষা—বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, উচ্চাশী, নিজস্ব ফ্যাশন ব্র্যান্ড গড়তে চায়।
একদিন ছাদে এসে সে লতার দিকে আঙুল তুলে বলে,
— “ইউক! এই জিনিসটা কী? এটা তো পরগাছা, useless!”

লতিফা জবাব দেন,
— “তুমি কি তোমার বাবার টাকায়, তার নামের আশ্রয়ে নিজেকে দাঁড় করাওনি?”
— “মানে?”
— “মানে, আমাদের সমাজেই তো হাজার মানুষ এমন, যারা পরগাছা না হয়েও কারও ছায়ায় বেঁচে থাকে। আমরা কেউই একা গাছ না। কারও স্মৃতি, কারও সাহায্য, কারও উপস্থিতিই আমাদের জীবন গড়ে দেয়।”
তৃষা কিছু না বলে ফিরে যায়।

একদিন ডাকবাক্সে চিঠি আসে—ছোট ছেলে আমেরিকা থেকে লিখেছে:
“মা, আমরা তোমার জন্য এখানে অ্যাসিস্টেড লিভিং-এর ব্যবস্থা করেছি। আধুনিক, নিরাপদ, সব সুবিধা থাকবে। আর একাকীত্ব থাকবে না।”

লতিফা চিঠি পড়ে চুপ করে যান।
এখানে অর্থ আছে, কিন্তু সম্পর্ক নেই। সেখানে সুবিধা আছে, কিন্তু স্পর্শ নেই।

তিনি জানেন, সেই জায়গাটায় হয়তো একজন নার্স সকালে ওষুধ দেবে, দুপুরে খাবার দেবে, রাতে বিছানায় শোয়াবে। কিন্তু কেউ তার ছাদে ওঠা পরগাছার গল্প শুনবে না।

এক সকালে দেখা গেল, ছাদ পরিষ্কার করা হয়েছে। পরগাছাটি নেই।
পেঁপে গাছও নেই—কেটে ফেলা হয়েছে।

লতিফা বেগম চুপচাপ ছাদে দাঁড়িয়ে থাকেন। মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো লতার অংশ তুলে হাতে নেন। তার চোখে জল নেই—কিন্তু বুকের ভিতরে যেন ছায়ার ঘর একেবারে খালি হয়ে গেছে।

রিনা এসে বলে, “আপা, ওই গাছটার জন্য এত মন খারাপ? কিছুই তো দিত না আপনাকে।”

লতিফা উত্তর দেন,
— “সে কিছু দেয়নি, ঠিকই। কিন্তু আমি তাকে কিছু দিয়েছিলাম—একটু জায়গা, একটু আশ্রয়। তাতেই আমারও বেঁচে থাকা কিছুটা অর্থ পেয়েছিল।”
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি তিনি জানেন, সেই জায়গাটায় হয়তো একজন নার্স সকালে ওষুধ দেবে, দুপুরে খাবার দেবে, রাতে বিছানায় শোয়াবে। কিন্তু কেউ তার ছাদে ওঠা পরগাছার গল্প শুনবে না। ঃঃ গল্প লেখার হাত বেশ ভালো। তবে হাত আরও পাকবে আশা করি। ধন্যবাদ আপেল ভাই
Muhsin Ahmed আমি অভিভূত হলাম
মেহেদী মারুফ অনেক গভীর চিন্তা থেকে লিখেছেন আপনি। বোঝার অনেক কিছু আছে। ভালো লাগলো।
আপনার মন্তব্যে উৎসাহ পেলাম, অশেষ শ্রদ্ধা আপনাকে।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

গল্পটি "পরগাছা" শব্দটির প্রতীকী রূপ তুলে ধরেছে—যেখানে সম্পর্ক, নির্ভরতা ও মানবিক অস্তিত্বের সূক্ষ্ম বাস্তবতাগুলি চিত্রিত হয়েছে। এখানে পরগাছা শুধু একটি গাছ নয়, বরং একাকী মানুষের বেঁচে থাকার আকুতি, আশ্রয় খোঁজার প্রতীক। গল্পের প্রতিটি চরিত্র কোনো না কোনোভাবে পরগাছার মতো কারও না কারও ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে—এটি গল্পের মূল বিষয়বস্তুর সাথে গভীরভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

১৮ জুলাই - ২০২৫ গল্প/কবিতা: ২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“সেপ্টেম্বর ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী