এক
শোভনার পায়ের নিচে কার্পেটের শব্দ। EntriTech-এর স্বয়ংক্রিয় দরজা খুলে যায়, রাসেল মাথা নিচু করে, “মর্নিং, ম্যাডাম।”
কোনো হাসি নেই মুখে—সরাসরি এগিয়ে যায়। আজ কেউ যেন কিছু না বলে, এমনই চাওয়া তার।
রিসেপশনের রুবাইয়া বলে, “আজ আপনি... সকাল সকাল?”
“সিস্টেম ক্লিন করতে এসেছি।” কণ্ঠ নরম, কিন্তু স্পষ্ট।
লিফটে উঠে আয়নায় চোখ পড়ে। চোখের নিচে ক্লান্তির ছাপ, ঠোঁট ফ্যাকাসে। এক জুনিয়র চোখ নামিয়ে রাখে—কারণ জানে না, কেবল অনুভব করে আজকের সকাল অন্যরকম।
১৩ তলায় নেমে, ওপেন ফ্লোর প্ল্যানের মাঝে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ব্যাগে রাখা ফোল্ডারটা আঁকড়ে ধরে—ভেতরে তার পদত্যাগপত্র আর একটি অডিও সারাংশ।
ডেস্কে পৌঁছায়—যেখানে প্রতিদিনের যুদ্ধ লড়ত, এখন সেটা যেন অতীতের কোন ঘর। স্ক্রিনে “backup_pleaseGod” দেখে একবার হেসে নেয়।
পাশ থেকে ফারহিন উঁকি দেয়, “আপি... তাইলে সত্যি?”
“সত্যি-মিথ্যা আপেক্ষিক।”
ফারহিন দ্বিধা নিয়ে বলে, “আমি ভাবছিলাম আপনি শুধু বিরতি নেবেন। সবাই বলছে আপনি নাকি ওভার রিঅ্যাক্ট করেছেন…”
“তুমি কি তাই ভাবো?”
চুপ করে থাকে ফারহিন, তারপর কাঁপা গলায় বলে, “আপনি চলে গেলে ভয় লাগছে…”
“তুমি জানো না আমি কেন যাচ্ছি। কিন্তু সবাই ব্যাখ্যা বানাতে চায়।”
এই কথা বলেই আবার স্ক্রিনে চোখ ফেরায় শোভনা। “চা শেষ করো, ভুল যেন না থাকে কোডে।”
এইচআর কেবিনের দিকে তাকায় একবার, তারপর ধীরে ধীরে হাঁটে। সুনীতি রহমান ভেতর থেকে দরজা খোলে, বলে, “বসবে?”
“না। শুধু জমা দিতে এসেছি।”
সুনীতি বলে, “তোমার জন্য নতুন রোল ঠিক হচ্ছিল—টরন্টো অফিসের প্রজেক্ট।”
“ঠিক তখনই ক্লায়েন্ট রিপোর্টে আমার নাম ঢুকে গেছে—যেটা আমি বানাইনি।”
“তিন সপ্তাহ নোটিশ ছাড়া রিলিজ সম্ভব না।”
“আমি আজকেই যাচ্ছি।”
“তুমি গেলে, গল্পটা আমরাই বলব—মিডিয়া, ক্লায়েন্ট, সবাইকে।”
“তাতে কিছু যায় আসে না। আমি কাগজে নয়, লোকজনের মনে থাকব।”
কেবিন থেকে বেরিয়ে আবার করিডর পেরোয়। কনফারেন্স রুমের পাশ দিয়ে হাঁটার সময় মাহির চোখে চোখ পড়ে। তাতে প্রশ্ন—“তুমি পালাচ্ছো?”
শোভনা চোখ সরিয়ে নেয়।
ডেস্কে ফিরে বসে ল্যাপটপ খুলে, পুরনো ফোল্ডারগুলো দেখে। একটায় চোখ আটকে যায়—
"VendorApproval_FINAL_Sh.R.pdf"
নিজের নাম, সিগনেচার। অথচ সে বানায়নি।
প্রোপার্টিজ খুলে দেখে—ফাইলটা সেভ হয়েছে যেদিন সে ছুটিতে ছিল।
তখনি পাশের ডিভাইডার পেরিয়ে কিছু ফিসফিস:
“…সে বুঝবে না…”
“…রোহান কিছু বলছে না…”
শোভনা এবার ফাইল খোঁজে। “InternalAudit” খুলে লগ চেক করতে চায়।
হঠাৎ স্ক্রিনের কোণে একটি নোটিফিকেশন:
“External Device Connected – SH-R_02_Backup”
সে থেমে যায়।
এই ড্রাইভ সে লাগায়নি। তাহলে কে?
মাউস এগিয়ে নেয়—এক অজানা সিস্টেমে প্রবেশ করতে চলেছে সে, যেটার ছায়া অনেক গভীর।
দুই
শোভনা নিজের ল্যাপটপের স্ক্রিন লক করে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ায়। বাতাসে নেমে আসে চাপা নিঃশব্দতা, যেন ডেস্ক থেকে উঠলেই কেউ তাকে লক্ষ্য করছে।
সে সরু করিডর পেরিয়ে কফি কর্নারে যায়।
এখানে একটা স্বয়ংক্রিয় মেশিন, পাশে স্টিলের ছোট ক্যাবিনেট, দুটো কাপ গাদা করে রাখা। দেওয়ালে মোটিভেশনাল পোস্টার—"Teamwork makes the dream work"—শোভনা একবার চোখ বুলিয়ে নেয়, যেন নিজেকে মনে করিয়ে দিতে চায় এটা বাস্তবতা।
সে কাপটা মেশিনে রাখে, বাটন চাপে—"Black (strong)".
বাষ্প ওঠে। কাপে ঢালছে ধীরে ধীরে।
পিছন থেকে ধীরে ধীরে ভেসে আসে চেনা পায়ের শব্দ।
নিয়মিত হাঁটার ভঙ্গি। মাপা। আত্মবিশ্বাসী। … মাহির।
“এখনও কড়া খাও?”— তার গলা ভাঙা।
শোভনা তাকায় না। উত্তরও দেয় না।
“তোমার কফি কখনো বদলায় না। তোমার মতই। সবসময় predictable,” মাহির কণ্ঠে একরকম শ্লেষ, আবার স্বস্তিও—কথা বলা মানেই যেন স্বাভাবিকতা ধরে রাখা।
শোভনা বলে, “সব predictable জিনিস খারাপ না। অন্তত এই জিনিসটা বিশ্বাসঘাতকতা করে না।”
মাহির হালকা হেসে একটা কাপ নেয়, “ল্যাটে। কারণ আমি predictable না, তাই?”
কফি ঢালার আওয়াজের ফাঁকে নীরবতা জমে।
“তুমি যাচ্ছ শুনলাম,” সে বলে, তার চোখ, কাপে।
“তুমি তো দেখেছ।”
“তাও জিজ্ঞেস করলাম। জানোই আমি ‘অফিস রিউমার’ বিশ্বাস করি না।”
“তুমি অফিস রিউমার বানাও,” শোভনার গলা এবার একটু নিচু।
মাহির এবার তাকায়। “তুমি তো জানো, আমি খালি শব্দ বানাই না। প্রুফ ছাড়া কিছু বলি না।”
কাপগুলো পূর্ণ হয়। ধোঁয়া বেরোচ্ছে—তাদের দুজনের মাঝের বাতাসে হালকা কাঁপন।
“তাহলে প্রুফ পেলে কী বলবে? বলবে আমি পালাচ্ছি?” শোভনার কণ্ঠে এক টান, যেন বাঁধা থ্রেড টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে।
মাহির কাঁধ ঝাঁকায়। “পালানো একটা অ্যাকশন, ঠিক যেমন থাকা। তবে তুমি যাওয়ার আগে বুঝে নাও, তোমাকে কেউ ছাপিয়ে যাবে না। শুধু মুছে দেবে।”
শোভনা মুখ ঘোরায়, তাকায় সরাসরি তার চোখে।
“তুমি কি চাইছিলে সেটা?”
মাহির এবার মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া আনেনি। শুধু বলে, “আমি যা চেয়েছিলাম, সেটা তুমি একদিনেই বদলে ফেলেছিলে।”
দুজনেই কফি হাতে দাঁড়িয়ে। কোনো টেবিল নেই, নেই কোন চেয়ার।
শুধু একটা দেয়াল, আর দুই পক্ষ।
এক সময়, শোভনা বলে, “সব ভুল ছিল না, মাহির।”
“ঠিকগুলা খুঁজে পেলেই হবে,” মাহির উত্তর।
তারা দুজন আলাদা দিকে মুখ ফেরায়। কিন্তু শব্দ থেকে যায় দেয়ালের গায়ে— চাপা শব্দ।
“তুমিই তো শুরু করেছিলে,” মাহির গলা এবার একটু নিচু, কিন্তু শব্দগুলো ভারি।
শোভনা পাশে তাকায় না। মগটা ঠোঁটে তোলে, কিন্তু চুমুক দেয় না।
“‘ওটা শুধু প্রজেক্ট’ বলেছিলে, মনে আছে?” মাহির কণ্ঠে হালকা এক হাসির রেখা। “যেন ছয় মাস একসাথে কাজ করাটা এক্সেল ফাইলের মত—‘ডিলিট’ করলেই চলে যায়।”
শোভনা এবার সরাসরি ঠাণ্ডা চোখে তাকায়।
“তোমার ভেতরে সবকিছুর জন্য একটা মেটাফোর আছে, তাই না? একবার Excel, একবার Debug, একবার Server Down.”
মাহির হাসে না এবার। “কারণ সেই ভাষাতেই তুমি কথা বলো, শোভনা। Emotion বোঝাও Data দিয়ে। সবকিছুর Documentation থাকে, শুধু Feeling বাদে।”
“Feeling তো ছিল না, মাহির?” শোভনার চোখ এবার স্থির। “তুমি সেটা ফাইলেও রাখোনি, আচরণেও না।”
একটা দীর্ঘ নীরবতা নেমে আসে।
কফির কাপ ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। দু’জনেই জানে, কেউ না কেউ এবার চলে যাবে, কিন্তু কে?
মাহির কণ্ঠ এবার নিচু, ভারহীন।
“তুমিই তো বলেছিলে, কাজের জায়গায় সম্পর্ক রাখা বোকামি। আমি শুনেছিলাম। মানে ধরো... খুব মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলাম।”
শোভনার ঠোঁটে তীক্ষ্ণ বাঁক। “তুমি শোনো, কিন্তু বোঝো না।”
এক মুহূর্ত কেউ কিছু বলে না।
অবশেষে মাহির গলা একটু ভাঙা শোনায়, “তুমি যাচ্ছো... ভালোই করছো। এই জায়গায় থেকে আর কী পাবে?”
“তুমি না?”—শোভনার ঠোঁট নাড়িয়ে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয় যেন ছুরি।
মাহির এবার চোখ সরিয়ে নেয়।
“আমার নাম আর কাজে থাকবে,” সে বলে। “তুমি শুধু গল্পে থাকবে—'একজন ছিলেন, চলে গেছেন'।”
শোভনা হালকা মাথা নাড়ে। “তোমরা যারা গল্প লেখো, তারা কখনো ভাবো না—শোনার লোকেরা কোনটা বিশ্বাস করে।”
সে ঘুরে দাঁড়ায়। করিডরের দিকে হাঁটতে শুরু করে।
কফি মগে সামান্য শব্দ হয়—বাষ্প আর সাদাটে নীরবতা মিশে যায় করিডরের বাতাসে।
আর পিছনে, মাহির হাত শক্ত করে ধরা কাপটায় ক্র্যাক পড়ে। কিন্তু সে পড়ে যাওয়া ঠেকায়—ঠিক যেমন তার মুখ থেকে পড়া শব্দ থেমে যায় মাঝপথেই।
শোভনা টাইপ বন্ধ করে বসে থাকে।
চারপাশের শব্দ ফের নিঃশব্দ হয়ে গেছে। যেন সবাই একে একে নিজ নিজ মুখোশ পরে নিয়েছে, চেয়ারের সঙ্গে মিশে গেছে। কম্পিউটারের ফ্যানের হালকা গোঁ গোঁ আওয়াজ আর স্ক্রিনে প্রতিফলিত নীল আলো—এই দুই-ই এখন শুধু তার বাস্তবতা।
সে ফাইল একটার পর একটা খুলে দেখে, ক্লিন করতে করতে।
তখনই চোখে পড়ে একটা ফোল্ডার:
“TMP_sync”
টেম্পোরারি ফোল্ডার, যেটা মাঝে মাঝে অন্যের মেশিন থেকে শেয়ার ফাইলে এসে পড়ে। সে জানে, এটা নিজে তৈরি করেনি। কৌতূহল হয়— সে ফোল্ডারটা ওপেন করে।
তাতে শুধু একটি .txt ফাইল—
“draft_notes_mah”
মাউস থেমে যায়।
সে ফাইলটা খুলে।
লেখাগুলো এলোমেলো, অসমাপ্ত, যেন কেউ লিখতে গিয়ে থেমে গেছে।
কিছু প্রোগ্রামিং কমেন্টের মতো লাইনের মাঝে মাঝেই ঢুকে পড়েছে অদ্ভুত এক বিষণ্ন স্বর—
// client-side validations missing
// avoid repeating that part again
/* she looks at me like I’m noise now
but I used to be signal. remember? */
-> change the loop condition [check who waits longer? me or the timeout?]
/* tried again today. same result.
she didn’t even flinch.
maybe I broke it. not the code. something else. */
return false;
শোভনার ঠোঁট চাপা পড়ে একে অপরের সাথে। সে পড়ে না—সে গিলছে শব্দগুলো।
শেষ লাইনে লেখা:
// keep trying? or let it compile without me?
সে জানে, মাহির লেখা। আর কেউ এমনভাবে কোড আর কথা মিশিয়ে লিখে না। এই ফাইল কখনো পাঠানো হয়নি। হয়তো সে ভুল করে সিঙ্ক করে ফেলেছে। হয়তো ইচ্ছে করেই, নিঃশব্দ চিৎকার।
কিন্তু এইসব এখন আর কিছু বদলায় না।
এই অফিসের কেউ আর "সে কে ছিল" এটা মনে রাখবে না। তারা রাখবে “সে কী করেছিল”—বা “তার নামে কী করা হয়েছিল।”
তবু, একটা মুহূর্তের জন্য, শোভনার চোখে পানি আসে না, কিন্তু ভেতরের কোনো কিছু একদম স্থির হয়ে যায়।
সে ফাইলটা ডিলিট করে না।
শুধু মিনিমাইজ করে রেখে দেয়।
তিন
সন্ধ্যা নামে অফিসের জানালার কাচে। আলো ততক্ষণে পাল্টে গিয়েছে—সাদা থেকে হালকা ধূসর, যেন আকাশের দিকেও এখন কোনও স্পষ্টতা নেই।
শোভনার ল্যাপটপ স্ক্রিনে এখনও খোলা আছে সেই নথি—VendorApproval_FINAL_Sh.R.pdf।
সে এবার আর শুধু দেখছে না, বিশ্লেষণ করছে।
রাইট-ক্লিক করে ফাইল প্রপার্টিজে যায়।
Created: Wed, 5:34 PM
Modified By: sr_rahman
Device ID: XN-41Q8A-LPT
তার সিস্টেম আইডি নয়।
সে জানে, তার অফিস ল্যাপটপের আইডি XN-41Q8B-LPT। ‘A’ না, ‘B’।
মাত্র একটা অক্ষর পার্থক্য। কিন্তু এত নিখুঁত হলে কি এটা দুর্ঘটনা?
সে IT Support পোর্টালে ঢুকে এবার পুরো Network Inventory-র ডিভাইস রেজিস্ট্রি খুলে বসে।
XN-41Q8A-LPT
Assigned to: FARHIN AFROZ
Device Active: Yes
Last login: Wednesday, 5:17 PM
শোভনার আঙুল থেমে যায় কি-বোর্ডে।
ফারহিন?
সে এক মুহূর্ত নিজের নিঃশ্বাস টের পায়— বুকটা কিছুটা ভারী হয়ে এসেছে। মাথার ভেতর একদিকে ঠাণ্ডা হিসাব চলছে, অন্যদিকে পুরনো মুখ মনে পড়ছে।
তবু—সবই circumstantial। ফাইল কার মেশিনে ছিল, এটা প্রমাণ নয় যে কে বানিয়েছে।
সে এবার ফাইলটা ওপেন করে Acrobat-এর ইনস্পেক্ট টুলে ঢোকে।
Author Metadata: sr_rahman
Export Tool: EntriPDF_Gen v4.2
Font Library Used: Bengali Unicode – Nikosh, Titillium
সে বুঝতে পারে, এই টুলটা অফিসে কেবল কয়েকজনের কাছে থাকে—এডভান্সড ইউজারদের কাছে। সে নিজে এটা দুই বছর আগে শেষ ব্যবহার করেছিল।
Export Timestamp দেখায়:
Logged IP: 10.0.2.56
শোভনা আবার Company Network Map খুলে আইপি চেক করে।
10.0.2.56 = Assigned to Mahir Hasan, Tech Lead (Static IP)
শরীরের ভেতরে একটানা নিঃশব্দ ঝড় বয়ে যায়।
মাহির সিস্টেম থেকে ফাইল বেরিয়েছে। ফারহিনের মেশিনে তৈরি হয়েছে। তার নামে জমা পড়েছে।
না... এটা দুর্ঘটনা নয়। হতেই পারে না।
তিনজন। তিনটা স্তর। আর মাঝখানে সে— একজন ‘তৈরি’ করা অপরাধী।
শোভনা মাথা নিচু করে বসে থাকে কয়েক সেকেন্ড। হাতদুটো কোলের ওপর স্থির। বাইরে, জানালায় একটানা ট্র্যাফিক লাইটের লাল আলো এসে পড়ে তার ফর্সা গালে।
তারপর হঠাৎ, যেন ভেতরে কোথাও কী ক্লিক করে যায়—সে কীবোর্ডের ওপর আঙুল রাখে।
এবার গন্তব্য একটাই—Company Admin Panel।
প্রথমে নিজের অ্যাকাউন্ট দিয়ে ঢোকে না। লগইন করে ‘Guest Session’—এটা একটা পুরনো অ্যাক্সেস, যেটা আগে টেস্টিংয়ের সময় সে নিজেই বানিয়েছিল। আইটি টিম হয়ত ভুলেই গেছে সেটা রয়ে গেছে।
শোভনা ডিরেক্টরি সার্ভারে ঢুকে Access Logs খুলে।
তারিখ সিলেক্ট করে:
Wednesday, last week
Time window: 5:00 PM – 6:00 PM
এখানে প্রথমেই চোখে পড়ে তার আইডি:
• sr_rahman
o Login IP: 10.0.2.56
o Device ID: XN-41Q8A-LPT
o Session Duration: 12 min
o Tool Launched: EntriPDF_Gen v4.2
o File Saved: VendorApproval_FINAL_Sh.R.pdf
সবই দেখে বুঝতে হয়—ফাইলটা তার ইউজারনেম ব্যবহার করে তোলা হয়েছে, কিন্তু মাহির IP থেকে, আর ফারহিনের মেশিন থেকে।
তবে... একটাই গড়বড়।
একই সময়ে আরেকটি লগইন।
• m_hasan
o Login IP: 10.0.2.56
o Device ID: XN-41Q8C-LPT
o Session Duration: 9 min
o Tool Used: Terminal Remote Sync
দুইটি ইউজার, একই আইপি, overlapping session time।
মানে? মাহির নিজের অ্যাকাউন্টও ওই সময় লগ ইন ছিল।
কিন্তু—সিস্টেমে একসাথে দুই ইউজার লগইন হয় কীভাবে?
শুধু একটাই উপায়:
Remote Impersonation
—মাহির মেশিন থেকে কে যেন শোভনার আইডিতে লগ ইন করেছে, ফারহিনের কম্পিউটার দিয়ে।
এই ত্রিকোণ সংঘাতে এখন সব মুখ চেনা।
শোভনা বুঝে যায়, সে শুধু অফিস ছাড়ছে না। সে হয়তো একটা Trap-এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে—আর কোনো সময়ের আগে সেটা ক্লিক করে যাবে। সন্ধ্যা আরও গাঢ়। অফিসের আলোগুলো এখন অনেক বেশি কৃত্রিম, চোখে লাগে। শোভনা স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে পাশের ডেস্কগুলোর দিকে তাকায়। প্রায় সবাই চলে গেছে। শুধু কয়েকটা মনিটরে এখনও আলো জ্বলে আছে। তার পাশে, ডানদিকের কিউবিকলে বসে আছে রোহান। চুপচাপ। ঠিক যেমন সবসময় থাকে।
কিন্তু এবার হঠাৎ সে বলল, নিচু গলায়,
“তুমি খুব গভীরে ঢুকে গেছো, মনে হচ্ছে।”
শোভনা তাকায়। রোহানের চোখে ঝলক নেই, হাসি নেই। কেবল স্থির এক দৃষ্টি।
সে বলে, “আমি জানি তুমি দেখেছো। VendorApproval ফাইলের activity.”
শোভনা মাথা নাড়ে না, হ্যাঁ-না বলে না।
রোহান নিজের ডেস্ক থেকে USB স্টিক টেনে নেয়। ছোট্ট, কালো। হালকা চেঁচে রাখে দুই আঙুলে।
“উইকএন্ডে আমি ব্যাকআপ সার্ভার স্ক্যান করছিলাম। পুরনো স্ক্রিপ্টগুলা grep করছিলাম। একটা log ফাইল পাই, যেখানে অদ্ভুত একটা রানিং কমান্ড লুকানো ছিল।”
শোভনা স্থির।
রোহান ধীরে ধীরে বলে, “Command টা ছিল—‘login_override --user=sr_rahman --session=ghost’।”
শোভনা ঠোঁট চেপে ধরে। তার কাঁধ আর চোয়ালে হালকা টান পড়ে।
“তুমি কিভাবে...?” তার গলা শুকিয়ে আসে।
“আমি curious ছিলাম। আর একটা জিনিস খেয়াল করলাম—script টা বানানো হয়েছে এমন ভাষায়, যেটা আমরা সবাই বুঝি না। ওই syntax আমি একজনে’র কোডিং স্টাইলের সাথে মিলিয়ে ফেলেছি। guess করো কে?”
শোভনা জানে কে।
রোহান মাথা নিচু করে বলে,
“তোমার নাম খুব যত্ন করে ব্যবহার করা হয়েছে, শোভনা। যেন কেউ বোঝাতে চায়—তুমি নিজের পায়ের নিচে মাটি সরিয়েছো।”
“তুমি এটা অন্য কাউকে বলেছো?”
“না। আমাকেও কেউ টার্গেট করতে পারে। But I hate being used.”
শোভনা একটু চুপ করে থেকে বলে,
“তাহলে তুমি এখন আমার পাশে?”
রোহান একটু মাথা কাত করে, এক রকম ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাসে।
“আমি কোথাও দাঁড়াই না। আমি শুধু খেয়াল রাখি, কে কোথায় দাঁড়িয়ে।”
“তাহলে আমাকে দাঁড়াতে দাও,” শোভনা ধীরে বলে। “আর তুমি শুধু দেখো।”
রোহান কিছু বলে না।
শুধু USB টা ডেস্কে রেখে উঠে দাঁড়ায়।
চলে যেতে যেতে বলে,
“Log ফাইলটার নাম ‘mirror.txt’
তুমি যা দেখবে, সেটা তোমার প্রতিচ্ছবি না, হয়তো কারও ছায়া।”
শোভনা ধীরে USB ড্রাইভটা পোর্টে লাগায়।
ড্রাইভ খুললেই ভেতরে দেখা যায় একটাই ফাইল: mirror.txt
সে নোটপ্যাডে ফাইলটা ওপেন করে।
ডেটা ভরা—লগ স্ট্যাম্প, কমান্ড স্নিপেট, রেকর্ড করা Timestamp এর লাইন। মাঝে মাঝে কোথাও কোথাও হাইলাইট করা চিহ্ন, যেন রোহান নিজে চোখ দিয়ে যাচাই করেছে।
কিন্তু সবকিছুর মাঝে এক লাইন দাঁড়িয়ে আছে নিজের গলায়:
FETCH /user/assets/sig_library/sh_rahman.sig @ 2025-06-12 17:42
শোভনার বুকটা থেমে যায় মুহূর্তের জন্য।
এই ফাইল লাইব্রেরি… এটার অ্যাক্সেস কেবলমাত্র HR হেড, Admin টেক লিড, এবং Deployment Manager-এর কাছে থাকে।
এই ফোল্ডারে থাকে প্রতিটি সিনিয়র এক্সিকিউটিভের ইলেকট্রনিক সিগনেচার—সুরক্ষিত PNG ফর্ম্যাটে। সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন বা PDF জেনারেটর সেগুলোকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বসিয়ে দেয়।
সে জানে—সে এই ফোল্ডার কখনোই খোলেনি।
কিন্তু এখানে এক লাইনে স্পষ্ট লেখা, কেউ তার সিগনেচার ইমেজ নামিয়ে নিয়েছে।
Date: ১২ই জুন
Time: বিকেল ৫টা ৪২ মিনিট
সে আবার Network Admin Tool-এ যায়। এবার Access Log-এ শুধুমাত্র ওই নির্দিষ্ট সময়ে ‘sig_library’ নামের ফোল্ডারের অ্যাক্সেস দেখে।
তিনটি এন্ট্রি—
১. m_hasan
২. suniti.r
৩. System (auto-generated)
তবে সুনীতির নাম সেখানে নেই ১২ জুনের দিনে।
শুধু মাহির।
User ID: m_hasan
Device: XN-41Q8C-LPT
Command: extract asset file - sh_rahman.sig
শোভনা কাঁধ গুটিয়ে নেয়।
মাহির।
সে শুধু ফাইল বানায়নি। সে সই আঁকতে শিখেছে। নাম, প্রমাণ, হাতের লেখা—সব জুড়ে দিয়েছে এক ফাঁদে।
তবে প্রশ্ন একটাই রয়ে যায়: কেন?
প্রেমের প্রতিশোধ? কোনো প্রজেক্ট হাইজ্যাক? নাকি কেউ মাহিকে ব্যবহার করছে?
সে এবার কনফারেন্স রুমের দিকে তাকায়—সেই জায়গাটা যেখানে শেষবার মাহির চোখে ধরা পড়েছিল এক অর্ধেক হাসি।
হয়তো সেটা ছিল সতর্কবার্তা।
হয়তো তাচ্ছিল্য।
হয়তো…
কেউ হাসছে, কারণ সে জানে শোভনা এখন বুঝে গিয়েছে। আর বুঝে যাওয়াটাই এখানে অপরাধ।
চার
দরজার কাচে হালকা নক করে শোভনা। ভেতর থেকে উত্তর আসে,
“Come in.”
সে ঢোকে। হাতে ছোট্ট কালো USB—আঙুলের মধ্যে ধরে রাখলেও যেন ওজন টের পাওয়া যায়।
সুনীতি চেয়ারে হেলে বসে আছেন। কাঁচের জানালায় তখন অন্ধকার পড়েছে, কেবিনের আলোতে তার ঠোঁটের গ্লস একটু বেশি চকচকে লাগছে।
“তুমি আবার?” সুনীতি জিজ্ঞেস করেন, ভ্রু একটু বাঁকিয়ে।
“আমি ফিরিনি,” শোভনা বলে। “আজও যাইনি।”
সুনীতির চোখে একটুখানি কৌতূহল দেখা দেয়। “তবে এসেছো কী করতে?”
শোভনা চেয়ার টেনে বসে। ব্যাগ থেকে ডিভাইসটা টেবিলে রাখে।
আঙুল রাখে তার উপর।
“আমার নাম ব্যবহার করে বানানো ফাইল, যার উৎস মাহির আইপি, ফারহিনের ডিভাইস, আর আমার সিগনেচার লাইব্রেরি থেকে নেওয়া ইমেজ—সব এর মধ্যে।”
সুনীতি স্থির থাকেন। নিঃশ্বাস পড়ে না যেন। তারপর সে কাঁধে ভর দেন চেয়ারটার ব্যাকের উপর।
“তুমি কি চাও আমি ভয় পাই?” কণ্ঠে স্বর ওঠে না, নেমেও যায় না।
“আমি চাই আপনি থেমে যান,” শোভনার গলা এবার শান্ত, তবু লোহায় মোড়া।
“কেন?” সুনীতি এবার সত্যি হাসেন। “তুমি কি ভাবো এটা কেউ দেখতে চায়? প্রমাণ দিয়ে কী হবে? আমরা কি আদালতে যাচ্ছি?”
“যদি প্রয়োজন পড়ে, যেতে পারি।”
“আর যদি না লাগে?” সুনীতির হাসি এবার একটু তীক্ষ্ণ হয়। “এই গল্পটা, শোভনা, কারা শোনে জানো? যারা চাইছে তোমার জায়গায় কারো ঠাঁই হোক। যারা একবারও প্রশ্ন করেনি তুমি, ঠিক না ভুল। তারা শুধু জানে—তুমি যাচ্ছো। That’s the headline.”
শোভনার গলা শুকিয়ে আসে না, কিন্তু তার আঙুল শক্ত হয়ে যায় টেবিলে।
“তবে আপনি ঠিক করেছেন—আমি যাচ্ছি না চুপ করে।”
সুনীতি এবার সামনে ঝুঁকে বলেন, “তুমি যদি যুদ্ধ চাও, তা-ও সম্ভব। কিন্তু তুমি জানো না, তুমি আসলে কাদের সঙ্গে লড়ছো। কেউ একা মিথ্যে বানায় না, শোভনা। এটা একটা সিস্টেম। আর সিস্টেমে কেউ সত্যি হলে অদৃশ্য হয়ে যায়।”
শোভনা এবার চোখ সরিয়ে নেয় না।
“সিস্টেমও তো একদিন তৈরি হয়। আমি যদি একটা ফাঁটল রাখতে পারি, তবেই হয়তো কেউ সেটা বড় করবে।”
এক মুহূর্ত নীরবতা।
সুনীতি পেছনে হেলান দিয়ে বসেন।
তার ঠোঁট আবার গ্লস করে ওঠে আলোয়।
তবে এবার সেই আলোয় তীক্ষ্ণতা আছে।
সুনীতি ড্রয়ার খুলে, তার ভেতর থেকে ধূসর ফাইলে মোড়া একটি নথি বের করে। নিঃশব্দে সেটা টেবিলের মাঝখানে রাখে।
“এইটা তোমার জন্য,” সে বলে।
শোভনা একপলক দেখে, তারপর চোখ নামিয়ে পড়ে প্রথম লাইন:
"Mutual Non-Disclosure and Release Agreement – Between EntriTech and Ms. Shovana Rahman."
তারপর আরো কিছু লাইন—আইনগত টার্ম, কনফিডেনশিয়াল ইনফরমেশন, নন-ডিসপারেজমেন্ট ক্লজ, মিডিয়া সাইলেন্স, ও প্রাইভেট লায়াবিলিটি ক্লিয়ারেন্স। ভাষাটা শুষ্ক, পেশাদার। তবু প্রতিটি বাক্যের নিচে যেন জমে আছে একটুকরো ভয়।
“তুমি যদি সই করো,” সুনীতি বলে, “আজকেই তোমার রিলিজ লেটার যাবে। পুরো হ্যান্ডওভার ব্যতীত—no questions, no audit, no exit interviews.”
শোভনার ঠোঁট বাঁকানো থাকে, তবে কথা আসে না।
“একটা ভালো রেফারেন্স থাকবে,” সুনীতি যুক্ত করে। “একটা প্রফেশনাল প্রস্থান। সবাই খুশি।”
“আর যদি না করি?”
“তাহলে আমাদের ডিসিপ্লিনারি প্যানেল বসবে। ক্লায়েন্ট অ্যাকসেস নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। তোমার হস্তক্ষেপ তদন্ত হবে। আমরা প্রশ্ন করবো—তুমি নিজের ফাইল কিভাবে ভুল fully modify করলে।”
“মানে আমি যদি না বলি,” শোভনার গলা নরম, “আপনারা মিথ্যাকে সত্যি বানিয়ে ফেলবেন?”
সুনীতির হাসি ঠান্ডা। “তুমি জানো তো, সত্যি কী—এই জায়গায় কেউ জানতে চায় না। শুধু জানতে চায় কে চুপ থাকছে।”
টেবিলের ওপর চুপচাপ রাখা থাকে সেই সাদা কাগজের গুচ্ছ।
শোভনা ধীরে বলে, “এই চুক্তিপত্রে একটাই শব্দ নেই—‘ন্যায়বিচার’।”
“কারণ এটা আদালত না,” সুনীতি বলে। “এটা কর্পোরেট।”
এক মুহূর্ত কেউ কিছু বলে না।
তারপর সুনীতি হালকা গলায় জিজ্ঞেস করে,
“তুমি পড়বে? না শুধু সই করবে?”
শোভনা তাকিয়ে থাকে কাগজের ওপর। কেবল নিচের অংশে তার নাম ছাপানো—
Shovana Rahman – Employee ID: ET-2198
আর পাশে ফাঁকা সিগনেচার লাইন।
এত স্পেস—যা ভরার জন্য কেবল একটা কলমের হালকা চাপ লাগবে।
শোভনা চোখ নামিয়ে রাখে সাদা কাগজের ওপরে।
তারা দুজনেই চুপ। কেবিনে ঘড়ির কাঁটার শব্দ শোনা যায়।
সুনীতি চেয়ারে একটু এগিয়ে আসে, হাত রাখে কাগজের পাশে।
“শুধু একটা সই। বাকিটা সহজ।”
“সহজ কার জন্য?” শোভনার গলা শুকনো, কিন্তু চাপা রাগে কাঁপে না।
“তোমার জন্যও,” সুনীতি ঠোঁটে হাসি রাখে। “চাকরি চলে গেলে জীবন শেষ হয় না। তুমি চমৎকার জায়গায় যেতে পারো। কিন্তু তোমার গল্প যত ছোট রাখবে, ততটাই সুবিধে হবে তোমার ভবিষ্যতের জন্য।”
“তাহলে আপনার ভয় কী?”
সুনীতি হেসে ওঠে—একটা প্রশিক্ষিত হালকা হাসি, যেটা নথিপত্র, ছাঁটাই, চুক্তির সঙ্গে মিশে থাকে।
“তুমি ভয় বলো, আমি বলি Damage Control।”
“আপনি Damage Control করেন আর মাহিরা Damage করে,” শোভনা ধীরে বলে।
সুনীতি এক মুহূর্ত থেমে যায়, চোখ সরিয়ে জানালার বাইরে তাকায়।
“মাহির এখানে অনেক পুরোনো। ওর আইডিয়ায় ইনভেস্ট করা হয়েছে। তুমি নতুন, এক্সটার্নাল, স্পষ্টবাদী। তুমি রেকর্ড রাখো। That’s dangerous.”
“আপনার জন্য?”
“না,” সে বলে, “সিস্টেমের জন্য। আর এখানে আমরা কেউই একা না—আমরা সিস্টেম।”
শোভনা এবার হালকা ঝুঁকে পড়ে।
“আপনি তো সব বুঝেই করছেন। আপনি জানেন, কোন ফাইল বানানো হয়েছে, কোন কমান্ড চালানো হয়েছে। তবু আপনি বলছেন, ‘তুমি চুপ থাকো’? কেন?”
সুনীতি এবার ধীরে বলে,
“কারণ তুমিও একসময় করেছো—চোখ বুজে ফাইল পাস করেছো, ভুল বুঝেও চুপ থেকেছো।
এখন তুমি শুধু আরেকটু বেশি ক্ষিপ্র। তুমি ভয় পেয়েছো বলে তুমি ন্যায়ের কথা বলছো।”
এক মুহূর্ত থেমে যায় সুনীতি। কণ্ঠ এবার কোমল, কিন্তু হাড়ের মত ধারালো।
“তুমি ভাবছো তুমি বাঘ। আসলে তুমি এখনই খাঁচার দিকে হাঁটছো। খাঁচা খুলে দিচ্ছি আমি।”
টেবিলের ওপর পড়ে থাকা কলমটা সুনীতি এগিয়ে দেয়।
“নাও,” সে বলে, “সাইন করে ফেলো। এরপর তুমি যা খুশি ভাবতে পারো—সিস্টেম আর কিছু মনে রাখবে না।”
শোভনার আঙুল উঠে আসে কলমের দিকে।
তবু সে ধরে না।
সে কাগজের ওপর ঝুঁকে পড়ে।
চোখ তার ছুঁয়ে যায় প্রতিটি লাইনের কিনারা—‘পরস্পরের সম্মতিতে’, ‘নথিভুক্ত তথ্যের গোপনতা’, ‘ভবিষ্যতে কোনো বক্তব্য প্রদান না করা সংক্রান্ত’…
সে যেন পড়ে যাচ্ছে এই বাক্যগুলোর ভিতরে। প্রতিটি বাক্য তাকে আরেকটু ভেতরে ঠেলে দেয়, যেন সুনীতির কণ্ঠস্বর কাগজের মধ্য থেকে ভেসে আসে—
“তুমি চুপ থাকো। তুমি চলে যাও। তোমার স্মৃতি মুছে যাবে।”
সুনীতি নিঃশব্দে পর্যবেক্ষণ করে, তার রাঙা ঠোঁটে চাপা হাসি।
“সে ভেঙে পড়েছে। হাঃ হাঃ, ভালো।”
কিন্তু ঠিক সেই সময়েই শোভনার আঙুল ছুঁয়ে যায় কাগজের একপাশ, যেন শুধু ওজন মেপে দেখছে—কতটা ভারী হতে পারে একটা নীরবতা। তারপর সে সোজা হয়ে বসে চোখ তোলে।
সুনীতির চোখে কিছু একটায় ছায়া নামে, এক অজানা অস্বস্তি।
শোভনা কিছু বলে না।
তবে তার চোখে এবার যে ভাষা উঠে আসে, তা শব্দে বলে দেওয়ার মতো না। তাতে ভয় নেই। অনুরোধ নেই। তাতে আছে ইচ্ছাকৃত স্থিরতা—যা কেবল জানে, কখন না বলা সবচেয়ে জোরালো প্রতিরোধ। সে কলম ছুঁয়ে দেখে না। সে NDA ফাইলটা ধীরে তুলে নেয়।
ভাঁজ করে না। চেপে ধরে না। শুধু হাতে নেয়, একেবারে নিঃশব্দে।
তখন কেবিনের বাতাসটাও যেন স্থির হয়ে দাঁড়ায়।
সুনীতি কিছু বলতে যায়, হয়তো ঠেকাতে। হয়তো বোঝাতে।
কিন্তু শোভনা দাঁড়িয়ে পড়ে।
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ানোর সেই শব্দ যেন বড় বেশি জোরে বাজে—কেবল কেবিনে না, যেন কর্পোরেট সিস্টেমের বুকে।
সে পিছনে ঘোরে। দরজার দিকে হাঁটে। একবারও পেছনে তাকায় না।
দরজার কাঁচ ঠেলে বাইরে বেরিয়ে যায়।
নীরব। কিন্তু সেই নীরবতা যেন বলে ওঠে—
আমি এখনো যাচ্ছি না। আর যদি যাই, তবু তুমি আমার মুখ চিনে রাখবে।
পাঁচ
স্টিলের সিঁড়ি কেঁপে ওঠে প্রতিটি পা ফেলার সাথে।
EntriTech-এর ১৩ তলার নিচে পুরনো ১২তম ফ্লোরটা এখন কেবল ডেটা ব্যাকআপের জন্য ব্যবহৃত হয়—অবস্থানগতভাবে নিচু, আলো কম, মানুষজন আরও কম। কেউ নিচে আসে না, আসলেও লগ রাখে না। ঠিক সেইজন্যই রোহান এই জায়গাটায় পছন্দ করত।
শোভনা হাঁটছে ধীরে, হাতে সেই ছোট্ট কালো USB, অন্য হাতে চুক্তিপত্রের খোলা পৃষ্ঠা—তাতে আজও সই হয়নি।
পাশে সারি সারি পুরনো সার্ভার র্যাক, বাতাসে কাঁচা লোহা আর গন্ধহীন ধুলো। ফ্যানের একটানা আওয়াজ আর লাল-সবুজ স্ট্যাটাস লাইট জ্বলছে-নিভছে নিঃশব্দে।
এই জায়গা যেন ভুলে যাওয়া প্রতিশ্রুতির মত—কেউ যদি কিছু লুকাতে চায়, এখানে লুকাতে পারে। আর কেউ যদি খুঁজে পেতে চায়…
শোভনা জানে, রোহান অনেকবার এখানে এসে নিজের তৈরি অদ্ভুত স্ক্রিপ্ট রেখে গেছে, নিজের মতো করে যুক্তি সাজিয়েছে—কেউ দেখে না, কেউ আটকায় না।
সে র্যাকের মাঝখানে একটা টুল ক্যাবিনেটের ওপর লিনাক্স টার্মিনাল চালু দেখে একটু থামে।
ডিভাইস ইনসার্ট করে।
প্রম্পট আসে:
Access device SH-R_02_Backup [Y/N]?
সে টাইপ করে: Y
টার্মিনালের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে ফাইল ডিরেক্টরি:
/mnt/SH-R_02_Backup
└── logs/
└── drafts/
শোভনা মাউস ছাড়াই কমান্ড চালায়। হাতে থাকা ফাইল দুটি—mirror.txt আর VendorApproval_FINAL_Sh.R.pdf—সে একসাথে drafts/ ফোল্ডারে কপি করে। তারপর logs/ ফোল্ডারে লেখে ছোট্ট এক README.txt:
If you're reading this,
you’re not the first.
Ask why the first one had to leave quietly.
– SR
এরপর সে দুটি মূল ফাইল encrypt করে।
gpg -c mirror.txt
gpg -c VendorApproval_FINAL_Sh.R.pdf
পাসওয়ার্ড সে এমন একটি ব্যবহার করে যা সে কাউকে কখনো বলে না, তবে রোহান অনুমান করতে পারবে।
– প্রথম সফটওয়্যারের নাম, যেটা তারা একসাথে বানিয়েছিল: crossline42
সবশেষে সে স্ক্রিপ্টের লজিক ফোল্ডার লক করে দেয়।
এখন এই ফোল্ডারে কেউ এলেও, শুধুমাত্র সেই বুঝতে পারবে যার প্রশ্ন আছে। যার তাড়া আছে সত্যি জানার।
তবে একবার ঢুকে গেলে সে দেখবে—এই নাম, এই ছায়া, এই গল্প শুধু হারিয়ে যায়নি। এটা ফেলে যাওয়া হয়নি। এটা ইচ্ছে করে থেকে যাওয়া।
সে টার্মিনাল বন্ধ করে দেয়। ডিভাইস খুলে পকেটে রাখে। আর ফাঁকা হয়ে যাওয়া স্ক্রিনে, শুধু কমান্ড প্রম্পটের দাগ ঝিলমিল করে।
শোভনা ১৩ তলায় ফের ওঠে।
এই তলা আজ একটু ফাঁকা। শুক্রবার বিকেল, কেউ আগে বেরিয়ে পড়েছে—শুধু ডেস্কে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাপ, জলের বোতল, স্ক্রিনসেভারে ঘুরতে থাকা নাম।
সে হেঁটে যায় নিজের ডেস্কের দিকে, হাত থামে একবার।
মনিটর এখনো অন—মাঝে মাঝে স্ক্রিন জ্বলে ওঠে, আবার নিভে যায়।
মাউসে ক্লিক দিলে ভেসে ওঠে ল্যাপটপ স্ক্রিন:
Welcome, S.Rahman
তার নাম, এখনও।
কিন্তু সে জানে, এই স্ক্রিন একসময় অন্য কারও হয়ে যাবে।
এই ডেস্কে বসে কেউ তার গল্প জানবে না। জানলেও, বিশ্বাস করবে না।
সে মনিটর বন্ধ করে দেয়।
ব্যাগটা সামান্য ভারী লাগছে—তার ভেতরে এখনও রাখা আছে সেই NDA ফাইল।
সে জানে, এটাই এখন অনেকের কাছে তার 'মৌন সম্মতি'র দলিল।
কিন্তু সে ফোল্ডার খুলে, খুব ঠাণ্ডা হাতে চুক্তিপত্রটা বের করে নেয়।
চোখ বুলিয়ে নেয় শেষবারের মতো।
তারপর সেটা নিয়ে চলে আসে রিসেপশন ডেস্কের কাছে।
রুবাইয়া তখন স্ক্রিনে মগ্ন। শোভনার ছায়া পড়তেই মুখ তোলে।
শোভনা কোনো কথা বলে না।
শুধু ফোল্ডারটা রাখে ডেস্কের উপরে।
“এইটা?” রুবাইয়া জিজ্ঞেস করে।
“কিছু নয়,” শোভনা বলে। “ভবিষ্যতের জন্য একটা ফাঁকা পৃষ্ঠা।”
তার ঠোঁটের কোণে অল্প হাসি—না বিদ্রূপ, না অভিমান। বলেই সে ঘুরে দাঁড়ায়। কাঁচের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। বাইরে শহর জ্বলজ্বল করছে—লাল, সাদা, হলুদ আলো।
হর্ণ বাজছে না, কিন্তু তার ভেতরে এখনো শব্দ উঠছে—যেগুলো সে আর চাপা দেবে না।
দরজা খুলে যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে।
সে পা বাড়ায়।
দেয়ালের কাচে তার ছায়া পড়ে। এক মুহূর্ত দাঁড়ায় সেখানে।
নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে। তারপর আর কিছু না বলেই…
সে চলে যায়।