“কি করিম ভাই কি খবর?” “এই আছি আর কি কোন রকম”। “এবার তো ক্রিকেট বিশ্বকাপ আমাদের দেশে হবে। যাবেন নাকি খেলা দেখতে?” “আরে নারে ভাই, টিকেট কেনার ঝামেলার মধ্যে আমি নাই”। “যদি খেলা দেখতে চান আমাকে বলবেন আমি টিকিটের ব্যবস্থা করে দিবো নে। কষ্ট করে লাইন ধরা লাগবে না”। “ও তাই নাকি। আচ্ছা লাগলে জানাব”।
এতক্ষণের এই কথোপকথনটি হচ্ছিল এক সরকারী অফিসের দুই কেরানীর মধ্যে। করিম নামের যে লোকটি এতক্ষণ টিকিট কেনা ও খেলা দেখার বিষয়ে গা ছাড়া ভাব প্রদর্শন করছিলেন আমাদের এই গল্প তাকে ঘিরেই।
করিম নামের এই লোকটি সবার কাছে খেলার ব্যাপারে যতই নিরুৎসাহ দেখান না কেন বাস্তব ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। খুব কাছের কয়েকজন মানুষ ছাড়া বেশিরভাগ লোকই এটা জানেনা যে করিম নামের এই লোকটি ক্রিকেট বলতে একদম অজ্ঞান। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ দলের কোন খেলা তিনি দেখেন নি এমন কখনও হয়নি। হয় মাঠে গিয়ে নয়তো টিভিতে কিংবা রেডিওতে কোন না কোন ভাবে বাংলাদেশের সকল খেলার একাগ্র দর্শক তিনি।
ক্রিকেট নামের খেলার সাথে তার পরিচয় সেই শৈশবে। এরপর যতদিন গড়িয়েছে ক্রিকেট হয়ে উঠেছে তার ধ্যান-জ্ঞান। ছাত্র অবস্থায় পায়ে আঘাত পাবার পর নিজে আর ক্রিকেট খেলতে না পারলেও ক্রিকেটের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন একজন ক্রিকেট পাগল দর্শক হিসাবে। মাঠে বসে তিনি যে কত খেলা দেখেছেন তা তিনি নিজেও মনে করতে পারেন না। অন্তত ঢাকার মাঠে বাংলাদেশের যে কটি খেলা হয়েছে তার প্রায় সবগুলোতেই দর্শক হিসাবে গ্যালারীতে ছিল তার উপস্থিতি। নিজের চোখে তিনি দেখেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বিবর্তন, হয়েছেন ইতিহাসের সাক্ষী।
তার এই ক্রিকেট পাগলামির কথা জানলে অনেকেই সামনে কিছু না বললেও পেছনে পেছনে তাকে নিয়ে হাসে, টিটকারি মারে। আর এজন্যই করিম সাহেব তার এই ক্রিকেট প্রেমী দিকটির কথা সহজে প্রকাশ করতে চান না।
বাংলাদেশ যে এবার বিশ্বকাপ ক্রিকেট আয়োজন করবে এটা তার চেয়ে ভাল আর কে জানে। যেদিন থেকে বাংলাদেশে বিশ্বকাপ ক্রিকেট হবার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে সেদিন থেকেই তার মনে তীব্র ইচ্ছা অন্তত একটি খেলা হলেও তিনি মাঠে বসে দেখবেন। অনেক কষ্টে টিকিটের টাকাও জমিয়েছেন।
কিন্তু এই করিম সাহেবকেই যখন আরেক সহকর্মী রহমত সেধে সেধে টিকেট নেবার কথা বলে তখন তার এরকম নিরুৎসাহের কারণ কি?
কারণ হল করিম সাহেব খুব ভাল করেই জানেন যে উপর মহলের সাহায্য নিয়ে রহমত যে কটি টিকেট জোগাড় করেছে তার কোনটিই সে প্রকৃত দামের দ্বিগুণ তিনগুণের কমে বেচবে না। তার মত দিন এনে দিন খাওয়া কর্মচারীর পক্ষে এত দাম দিয়ে কোনমতেই সে টিকেট কেনা সম্ভব নয়।
তাই করিম সাহেব আর দশজনের মত লাইন ধরেই টিকেট কিনবার প্রস্তুতি নিলেন। এজন্য টিকেট কাটার দিন হিসাব করে অফিস থেকে ব্যক্তিগত কাজের অজুহাত দেখিয়ে দু’দিন ছুটিও মঞ্জুর করিয়ে নিয়েছেন। একদিনের জায়গায় দু’দিন ছুটি নিয়েছেন বাড়তি সতর্কতার জন্য যাতে প্রথম দিন কোন কারণে টিকেট কাটতে না পারলেও যেন দ্বিতীয় দিন কোন ভুল না হয়।
টিকেট ভাউচার নেয়ার প্রথম দিন ভিড় এড়াতে খুব ভোরে ব্যাংকের সামনে উপস্থিত হতেই তিনি দেখলেন তার আগেই আরও প্রায় তিন/চারশ জন লোক লাইনে দাড়িয়ে আছে। তাও মনে মনে প্রবল আশা নিয়ে লাইনে দাঁড়ালেন তিনি। ব্যাংক খোলার সাথে সাথে ভাউচার বিক্রি শুরু হল কিন্তু লাইনের ভেতরে নানা অনিয়ম আর সেই সাথে টিকেট বিক্রির ধীর গতির কারণে যতক্ষণে করিম সাহেব কাউন্টারের কাছাকাছি আসলেন ততক্ষণে দেখলেন যে কাউন্টার বন্ধ করে সেদিনের মত ভাউচার বিক্রির সমাপ্তি ঘোষণা করা হচ্ছে।
করিম সাহেবের মনে তখন জেদ চেপে বসেছে যে করেই হোক টিকিটের ভাউচার তিনি নিয়েই ছাড়বেন। আশেপাশে তাকিয়ে দেখেন ব্যাংক বন্ধ হওয়া স্বত্বেও কেউই লাইন ছেড়ে সরে দাঁড়াচ্ছে না। সবাই পরের দিনের জন্য লাইনে দাড়িয়েই আছে। তখন করিম সাহেব ঠিক করলেন যে তিনিও সারারাত লাইনেই দাড়িয়ে থাকবেন একটু কষ্ট হবে ঠিকই কিন্তু নিজের দেশের স্টেডিয়ামে বসে বিশ্বকাপের খেলা দেখার আনন্দের কাছে এ কষ্ট কিছুই না। তখনই বাসায় স্ত্রীকে ফোনে জানিয়ে দিলেন যে রাতে তিনি বাড়ি আসবেন না টিকেটের ভাউচার কিনে একবারে পরের দিন বাসায় ফিরবেন।
পরের দিন যথারীতি ভাউচার বিক্রি শুরু হল। প্রথম দিনের তুলনায় এদিন ভিড় আরও বেশি। বেলা যত বাড়ছে লোকজনও তত বাড়ছে । তবে এদিন করিম সাহেবের সামনে লাইনে লোকের সংখ্যা কম হওয়ায় তিনি আশাবাদী হলেন যে আজ হয়ত টিকেট কেনা যাবে। লাইনে তার সামনে পিছনে জনা কয়েক ছোকরা গোছের ছেলে দাড়িয়ে। এমন সময় আরও প্রায় ১০-১২টি ছেলে এসে সেই ছেলেগুলির সাথে লাইনে ঢুকে যেতে চাইল। তখন করিম সাহেব তার তীব্র প্রতিবাদ করলেন। এর ফল স্বরূপ যা হলো সেই ছেলেগুলো তখন জোটবদ্ধ হয়ে করিম সাহেবকেই লাইন ভঙ্গকারী বলে অপমান করে বের করে দিল। করিম সাহেব যতই জোর গলায় প্রতিবাদ করেন ততই ছেলেগুলো তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। এভাবে অপমানিত হয়ে টিকেট কিনতে ব্যর্থ হয়ে মনের দু:খে বাড়ি ফিরে এলেন করিম সাহেব।
রাতে খাবার পর করিম সাহেবের স্ত্রী এসে পাশে বসে বললেন- “টিকেট পাবার আর কি কোন ব্যবস্থা নাই?” লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়েন করিম সাহেব। “তুমি না বলেছিলে রহমত সাহেবের কাছে টিকেট আছে উনার কাছে গিয়ে চাওনা”। “খালি চাইলেই তো হবে না। উনি ২০০ টাকার টিকেটের দাম চাইবে ২০০০ টাকা। এত টাকা দিয়ে টিকেট কেনার সামর্থ্য আমার নাই”। তখন করিম সাহেবের স্ত্রী আলমারি খুলে ২০০০ টাকা বের করে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন- “আমি মনে মনে ভেবেছিলাম এরকম কিছু একটা হতে পারে। তাই যেদিন তুমি টিকেট কিনতে যাবার কথা বলেছ সেদিন থেকেই আমি তোমার জন্য এই টাকাটা জমিয়েছি। কালকে রহমত সাহেবের সাথে কথা বলে দেখ একটা টিকেট পাও কিনা। তোমার আবার খেলা দেখার যে শখ”।
স্ত্রীর এই দূরদর্শিতায় কৃতজ্ঞতায় চোখে পানি চলে আসে করিম সাহেবের।
পরদিন অফিসে গিয়ে প্রথমেই রহমতকে খুঁজে বের করলেন তিনি। “রহমত ভাই, আপনি না বললেন টিকেট লাগলে আপনার সাথে যোগাযোগ করতে?” “হ্যাঁ বলেছিলাম তো”। “ইয়ে মানে আমার এক আত্মীয়ের খেলা দেখার খুব শখ। একটা টিকেট দিতে পারলে খুব ভাল হয়”। “করিম ভাই, এতদিন পরে বললেন। আরেকটু আগে বলে রাখলে ভাল হত। যাই হোক একটা গ্যালারীর টিকেট আছে কিন্তু দাম একটু বেশী পড়বে”। “কত?” “সাত হাজার টাকা”। টাকার অংক শুনে হতবাক হয়ে রহমতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন করিম সাহেব। তখন রহমত আবার বলে- “আচ্ছা আপনার জন্য শুধু আপনারই জন্য একটু কম রাখব করিম ভাই। পাঁচ হাজার টাকা দিলেই হবে”। “আচ্ছা ভাই আমি আপনাকে পরে জানাব”। কোনমতে রহমতকে কথাগুলো বলে নিজের টেবিলে ফেরত এসে বসলেন করিম সাহেব।
দুই দিন পর.... গত কয়েকদিনের টিকেট সংক্রান্ত ঘটনা গুলো মনে করে একটু অন্যমনষ্ক হয়ে পড়েছিলেন করিম সাহেব। এমন সময় পিওন এসে জানাল যে বড় সাহেবের কাছে তার ডাক পড়েছে।
বড় সাহেবের রুমে যেতেই তিনি আর একটা অফিসের ঠিকানা দিয়ে বললেন- “করিম এখানে গিয়ে বলবে যে আমার নামে যে ৪টা বিশ্বকাপের টিকেট আছে সেগুলো দিতে। এখনি যাও”।
জ্বী স্যার বলে করিম সাহেব তার চাকরিদাতার জন্য টিকেট আনতে রওনা হলেন।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ওবাইদুল হক
ভালবাসা মানব জাতির এক অনন্য শিকড় এর হারানোর মধ্যে যে তৃপ্তি পাoয়া যায় ্ পাoয়ার মাঝে অনেক ব্যবধান থেকেই যায় । অনকে সুন্দর একটা গল্প ৫==৪ দিলাম ।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।