লাভ নেভার ডায়েড

আতঙ্ক (নভেম্বর ২০২৫)

মেহেদী মারুফ
  • 0
  • 0
  • ১৭
১.
আমি দীর্ঘ সময় ধরে লিজার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। এতটা সময়ের মধ্যে একটা বারও ওর চোখের পলক পড়েনি। অথচ আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। এভাবে দীর্ঘ সময় আসলে চোখের পলক না ফেলে থাকা যায় না। চোখ শুকিয়ে যায়, যার কারণে পানি চলে আসে।
হঠাৎ লিজা নীরবতা ভেঙে বললো, “তুমি তো আবার হেরে গেলে।”

আমি মৃদু হেসে উত্তর দিলাম, "কথা সত্যি, আমি বারবার তোমার কাছে হেরে যাই। তবে জানো? এই হার আমি কোনোদিন পরাজয় মনে করি না। তুমি নিজেই আমার জন্য সবচেয়ে বড় বিজয়।"

লিজা প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, "বাদ দাও এসব কথা। তুমি ফিরবে কখন? রাত তো অনেক গভীর হয়ে এসেছে।"
—"হোক না আরও গভীর। আজ আর ফিরবো না। তোমার সাথেই এই রাতটা কাটিয়ে দেবো।"

ও চোখ নামিয়ে নরম সুরে বললো,— "তুমি এখনও আগের মতোই পাগলামি করো। তোমার ভয় করে না? লোকে তো দিনের বেলাতেও এই এলাকা দিয়ে যায় না। আর তুমি এত গভীর রাতে এখানে বসে আছো!"
আমি শান্তভাবে বললাম,— "আমাকে যেতে বলো না, লিজা।”
ও হঠাৎ কঠিন গলায় বললো,— "না, প্লিজ! তুমি চলে যাও।"

লিজা এক প্রকার জোর করেই আমাকে ঠেলে দিলো বাইরে। আমি সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে নেমে এলাম পরিত্যক্ত ভবনের নিচে। নামার সময় হঠাৎ করেই কানে ভেসে এলো এক নবজাতকের কান্না। সেই কান্নার শব্দের সঙ্গে মিশে গেলো ঝিঁঝি পোকার অবিরাম ডাক, দূরে কোথাও কুকুরের গর্জন, আর বাঁশঝাড়ে শনশন করে বয়ে চলা হাওয়া—সব মিলিয়ে চারপাশে যেন এক ভয়ংকর, অচেনা নিস্তব্ধতা নেমে এলো।

হালকা জ্যোৎস্নার আলোয় পথ চিনে হাঁটতে হাঁটতে আমি ভবনটা পেছনে ফেলে এগিয়ে গেলাম। এই জায়গায় দিনের বেলাতেও কেউ খুব বেশি আসে না, প্রয়োজন ছাড়া কেউই না।

২.
হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে গেলো আমাদের প্রথম দেখা, বারো বছর আগের কথা।
লিজার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিলো ভার্সিটিতে। পরিচয়ের তিন মাস কেটে গিয়েছিলো—তবুও আমি জানতাম না, লিজা খ্রিস্টান। একদিন হঠাৎ ও আমাকে "মেরি ক্রিসমাস" এর শুভেচ্ছা জানিয়ে বললো,
— "আজ সন্ধ্যায় আমাদের বাসায় আসবে? সবাই মিলে উদযাপন করবো।” সেদিন আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেল থেকে চারজন ওদের বাসায় গিয়েছিলাম। ওদের বাড়ি বেশ পরিপাটি, নিখুঁতভাবে সাজানো। দেয়ালজুড়ে টানানো অসংখ্য পেইন্টিং—কোনোটায় পাহাড়, কোনোটায় মুখশূন্য মানুষ, আবার কোথাও শুধু রঙের বিশৃঙ্খলা। আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিলাম।

পেছন থেকে লিজার কণ্ঠ ভেসে এলো,
— “এগুলো সব আমার চয়েজ করা।”
আমি হেসে বললাম,
— “বাহ, তোমার রুচি সত্যিই অসাধারণ।”

ওদের বাড়ির পাশেই ছিলো একটা ছোট চার্চ। হঠাৎ ঘণ্টাধ্বনি বাজলো—গভীর, মন্থর, যেন সময় থেমে গেলো। লিজা আমার হাত ধরে বললো,
— “চলো, তোমাকে আমাদের চার্চ দেখাই।”

আমি কিছু বলার আগেই ওর পিছু নিলাম। চার্চের ভারী কাঠের দরজা ঠেলে ও ভেতরে ঢুকলো, তারপর পেছন ফিরে হাতের ইশারায় আমাকে ভেতরে ডাকলো—
আমি থেমে গেলাম কয়েক মুহূর্ত। ভেতরে ঢুকিতেই শরীর একদম ঠান্ডা হয়ে এলো।

যেন কোন মাটির ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছি। সামনে ওদের যীশু খ্রষ্টের মূর্তি ক্রস চিহ্নের সাথে আটকানো। লিজা সেটার সামনে দাড়িয়ে কি যেন প্রার্থনা করলো। এরপর আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে বললো, "আমি আমার জেসাসের কাছে তোমাকে চেয়েছি। তুমি জেসাসের কাছে কাকে চাইবে?"

--"আমি চাইলে আমার আল্লাহর কাছে চাইবো। আর চাইবো যে, তুমিও যেন আমার আল্লাহকে চাও।"
লিজার মুখটা মুহুর্তের মধ্যে শুকিয়ে গেলো। কারণ ও ভেবেছিলো আমিও ওর মত খ্রিস্টান। ও চার্চ থেকে বেরিয়ে যাবার সময় শুধু বললো, "চলে এসো।"


৩.
লিজা ওই দিন আমার সাথে আর কোন কথা বলেনি। খুব সম্ভবত ব্যাপারটা ও মানতেই পারেনি, আমি কেন খ্রিস্টান নই অথবা আমি কেন মুসলিম? ও হয়তো মনে মনে আমাকে নিয়ে তার পুরো জীবন কাটানোর একটা পরিকল্পনা করেছিলো।
যাই হোক, পরবর্তী এক সপ্তাহ লিজাকে আর ভার্সিটিতে দেখতে পাইনি। ওর ফোনও বন্ধ। একদিন একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এলো। আমি রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটা মেয়ে কন্ঠ আমাকে সালাম জানালো। চিনতে পারলাম কন্ঠটা লিজার। আমাকে বললো দেখা করতে।

সাতদিন পর ওর খোঁজ পেয়ে আমিও কিছুটা এক্সসাইটেড ছিলাম। সামনাসামনি দেখা, বেশ অনেক পরিবর্তন দেখলাম ওর মাঝে। আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলো। আমিও ওর হাসির জবাবে হাসি দিলাম। --"কি ব্যাপার? হঠাৎ হারিয়ে গেলে। আবার এখন পুরো চেঞ্জ হয়ে সামনে আসলে? ঘটনা কি বলো তো?"

--"আমি তোমার আল্লাহকে আমার আল্লাহ হিসেবে গ্রহণ করতে চাই। আর তার মাধ্যম হবে তুমি। আমি তোমাকেও আমার নিজের করে গ্রহণ করতে চাই। আমি এই সাতদিন অনেক ভেবেছি। এরপর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি আমার পরিবার, ঘরবাড়ি সবকিছু ছেড়ে তোমার কাছে চলে এসেছি। তুমি আমাকে গ্রহণ করবে? তোমার আল্লাহ আমাকে গ্রহণ করবে?"

আমি লিজার এত গভীর ভাবনায় আশ্চর্য হয়ে গেলাম। ও সব ফেরার পথ বন্ধ করে দিয়ে আমার কাছে ছুটে এসেছে। ওকে আমি কি করে ফিরিয়ে দিই? আমি তখন লিজার হাত ধরে আমার সাথে নিয়ে গেলাম। যা হবার হবে। ও যদি আমার জন্য সব ছাড়তে পারে, তবে আমি ওর জন্য পৃথিবী ছাড়তে পারবো।

লিজা ধর্মান্তরিত হওয়ার পরে কাজী অফিসে আমাদের বিয়ে সম্পন্ন হলো। এখন পুরো পৃথিবী একদিকে আর আমাদের সম্পর্ক একদিকে।


৪.
দেখতে দেখতে সাত মাস চলে গেলো। চেনা শহর ছেড়ে অনেক দূরে আশ্রয় নিয়েছি, যেখানে আমাকে আর লিজাকে কেউ সহজে কেউ খুঁজে পাবে না। গোপনে খবর নিয়েছি, লিজার বাড়ি থেকে এখনও তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছে ওকে খুঁজে পাওয়ার জন্য। আর আমি এটা নিয়েই বেশি আতঙ্কে পড়ে গেছি। যদি আমাদেরকে খুঁজে পেয়েই যায়, তবে কি মেনে নেবে নাকি বিচ্ছেদ করিয়ে দেবে? নাকি আমাকে মেরে ফেলে ওকে নিয়ে চলে যাবে? এইসব বিষয় আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো।

আমি কাজের জন্য বাইরে থাকি, আর কাজ শেষে বাসায়। এর বাইরে আমার কোন রুটিন নেই। এদিকে লিজা চার মাসের অন্তসত্ত্বা। ওর প্রতি দায়িত্ব যেমন বেড়ে গেলো, তেমনি অজানা আতঙ্ক। আমি কাজে গেলেও চিন্তিত হয়ে থাকি৷ লিজা বললো, "এই যে তুমি আমাকে নিয়ে এত দুঃশ্চিন্তায় থাকো। আমি যদি সত্যিই কখনও তোমার থেকে হারিয়ে যাই?

--" আমি ওর মুখ চেপে ধরে বললাম, "চুপ! এই কথা যেন দ্বিতীয় বার না শুনি।" কথাটা বলে বুকের মধ্যে টেনে নিলাম।
লিজা ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, "আজকে আমার পরিবারের কথা খুব মনে পড়ছে।"
--"তুমি গেলে তো তোমাকে আটকে রাখবে হয়তো। আমার কাছে ফিরতে দেবে না।"
--"আমার পেটে বাচ্চা জানলে হয়তো সবকিছু মেনেও নিতে পারে।"
--"তুমি কি যেতে চাও?" লিজা হ্যাঁ জানিয়ে মাথা নাড়লো। আমিও আর বাঁধা দিতে চাইলাম না। ওকে ওর পরিবারের কাছে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলাম।


৫.
এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলো লিজা ওর বাবার বাড়িতে গেছে। কিন্তু ওর কোন সংবাদ পাইনি আমি। যাবার সময় বারবার বলে দিয়েছি আমাকে ওর খবর জানাতে। ওর ফোনটা বন্ধ। আবার খুব জরুরী ভেবে আমার অফিসের ল্যান্ডফোনের নম্বরও দিয়েছিলাম। আমি আর এইসব চিন্তা মাথায় নিয়ে রাতে ঘুমাতে পারলাম না। পরদিন কিছুটা ছদ্মবেশ ধারণ করে লিজাদের এলাকায় চলে গেলাম। ওদের বাড়ির সামনে গিয়ে দাড়াতেই একটা থমথমে ভাব। মনে হচ্ছে দীর্ঘদিন এই বাড়িতে কেউ থাকে না।

পাশ থেকে যাওয়া এক লোককে জিজ্ঞাসা করলাম, "ভাই, এই বাড়িতে লোকজন কেউ নেই?" সে উত্তরে বললো, "আপনি কি অন্য শহর থেকে এসেছেন?"
--"জ্বি।"
--"এই বাড়ির একটা মেয়ে সাত মাস নিঁখোজ ছিলো।সপ্তাহখানিক আগে কোত্থেকে যেন ফিরে এসেছিলো। ওর বাবা মেয়েকে দেখামাত্রই বন্দুক দিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এরপর মেয়ে হত্যার দায়ে পরিবারের সবাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। তারপর থেকে নাকি রাতের বেলায় এই বাড়ির ভেতর থেকে একটা মেয়ে আর একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। দিনের বেলায় মানুষ এ পথ দিয়ে গেলেও রাতে কেউ এদিক দিয়ে যায় না।"

লোকটা চলে যাওয়ার পরে আমি রাস্তার ওপরেই ধপ করে বসে পড়লাম। আমি কেন লিজাকে পাঠাতে রাজি হলাম? কেন ওকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলাম? কেন আমার সন্তানকেও ওর সাথে হারিয়ে ফেললাম?? ওর বাবা কেন এমন কাজ করলো নিজের মেয়ের প্রতি? তীব্র অনুশোচনা আর বুকফাটা কান্না এলো।


৬.
এভাবে আরও দশ বছর পেরিয়ে গেলো। আমি পাগল বেশে এই বাড়ির সামনেই পড়ে থাকি। রাত হলে ছুটে যাই বাড়ির ভেতরটাতে। ওখানে আমার লিজা আর আমার বাচ্চাটা থাকে। আমি শুধু লিজাকে দেখতে পাই। বাচ্চাটাকে দেখতে পাই না। তবে ওর আওয়াজ শুনতে পাই। লিজা আমাকে বলেছে বাচ্চাটা ছেলে। হাসে, কাঁদে, খেলা করে--

সবাই বলে, এই পরিত্যক্ত বাড়িতে ভুত থাকে। একটা মেয়ে ভুত, যেটা কিনা লিজার। আর একটা বাচ্চার ভুত, যে আমার সন্তান। লিজা অন্তসত্ত্বা ছিলো, এইটা ওর পরিবার কোনদিন জানতেও পারেনি। ভুতের আতঙ্কে এলাকার মানুষ বাড়ির সামনে থাকা পথ দিয়ে যাওয়া আসা করে না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, এখানে আমার পরিবার থাকে। আমার প্রিয়তমা স্ত্রী আর আমার আদরের সন্তান। আমি প্রতিদিন ওদের সাথে সাক্ষাৎ করে আসার পরে লিজার কবরটা জিয়ারত করে ওর কবরের পাশেই ঘুমিয়ে পড়ি..!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

গল্পের শুরুতে বলা হয়, এলাকার মানুষ একটা পরিত্যক্ত ভবনের পাশ দিয়ে সচরাচর চলাচল করে না। কারণ সেখানে নাকি ভুতেরা বাস করে। আর গল্পের একটা জায়গায় ভালোবাসা হারিয়ে ফেলার আতঙ্ক তৈরি হয়। এই ব্যাপারগুলো গল্পের নির্ধারিত সংখ্যা "আতঙ্ক" এর সাথে সামঞ্জস্য।

১১ মে - ২০২৫ গল্প/কবিতা: ১০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "মুক্তিযুদ্ধ”
কবিতার বিষয় "মুক্তিযুদ্ধ”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৫