শেষ চিঠির দিন

পদত্যাগ (জুলাই ২০২৫)

পল্লব শাহরিয়ার
  • 0
  • 0
ডাকঘরের চারপাশে সকালবেলার কুয়াশা ধীরে ধীরে পাতলা হয়ে আসছে। গ্রামের ওই পুরোনো লালচে দালানটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে, যদিও তার শরীরজুড়ে বয়সের চিহ্ন স্পষ্ট—খসে পড়া রঙ, ফাটল ধরা দেওয়াল আর টিনের চালে জমা শুকনো পাতা।
আব্দুল মজিদ মাস্টার আজ একটু তাড়াতাড়ি এসেছেন। শেষবারের মতো তালা খুলেছেন ডাকঘরের দরজা। আজ তার চাকরির শেষ দিন।
এই গ্রামের পোস্টমাস্টার ছিলেন তিনি গত ৪০ বছর ধরে। এমনও দিন গেছে, যখন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি মানুষ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত চিঠি পাঠাতে, মানি অর্ডার তুলতে বা গোপনে ভালোবাসার চিঠি হাতে পেতে। তখন এই অফিসের চারপাশ ছিল জমজমাট—হাসি, কান্না, উৎকণ্ঠা, প্রত্যাশায় গমগম করত।
আজ?
চিপা একটা টেবিল, ধুলোমাখা রেজিস্টার, আর একটা ছিঁড়ে যাওয়া নীলচে সাইনবোর্ড—এটাই তার রাজ্য।
টেবিলে বসে তিনি ধীরে ধীরে খোলেন এক পুরোনো রেজিস্টার। হাত বুলিয়ে নেন পাতাগুলোর ওপর। প্রতিটি পাতায় তার হাতের লেখা—তারিখ, প্রেরক, গ্রহীতা, ঠিকানা, এবং চিঠির ধরন। ১৯৮৬ সালের ১৭ই জুলাইয়ের পাতায় থেমে যান—সেই দিনেই তিনি প্রথম এই অফিসে ঢুকেছিলেন স্থায়ী কর্মী হিসেবে।
মনে পড়ে, কী উৎসাহ আর গর্ব নিয়ে পরদিন নতুন জামা পরে কাজে এসেছিলেন। গ্রামের সবাই তখন তাকে সমীহ করে ডাকত মাস্টার সাহেব।
হঠাৎ চোখে পড়ে রেজিস্টারের একপাশে আটকে থাকা একটি হলুদ খাম। পুরোনো চিঠি—বহুদিন আগের।
প্রেরক: রেহানা বেগম
গ্রহীতা: আব্দুল মজিদ
চোখ ধাঁধিয়ে ওঠে।
রেহানা। তার কৈশোরের সেই মেয়ে, যাকে নিয়ে একসময় স্বপ্ন দেখতেন। সে বিদেশে বিয়ে হয়ে চলে যায়। কিন্তু একদিন ডাকঘরে এই চিঠিটা পাঠিয়েছিল—মজিদ তখনই সেটা খাম খুলে না পড়েই রেখে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, পরে পড়বেন। পরে আর হয়ে ওঠেনি।
তিনি আস্তে করে খাম খুলে পড়েন— তোমার হাতে চিঠি পৌঁছাবে কি না জানি না, তবুও লিখছি। এই ডাকঘর, এই চৌকাঠ, এই গন্ধ—সবকিছুর মধ্যে তোমায় খুঁজে পেয়েছিলাম। ভালো থেকো।
– রেহানা
মজিদের চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে। একসময় গর্ব করে বলতেন—“আমার হাতে হাজার মানুষের সুখ-দুঃখ পৌঁছায়”—কিন্তু নিজের জীবনের চিঠি যে পড়াই হয়নি! দুপুর গড়িয়ে যায়। কেউ আসে না।
হঠাৎ দরজার ফাঁকে এক বাচ্চা ছেলে উঁকি দেয়। নাম রকি, ক্লাস ফোরে পড়ে। হাতে একটা খালি খাম।
— কাকা, আজ না আপনার শেষ দিন?
— হ্যাঁ রে, আর ক’টা ঘণ্টা। তারপর ছুটি।
— আমি একটা চিঠি দিয়ে যাই?
— দে, কোথায় পাঠাবি?
— আমি ভাবি… অনেক দূর… ভবিষ্যতের কাছে।
সে খামে লিখে: ভবিষ্যতের মানুষ, ডাকঘর আর ছিল না, কিন্তু আমাদের আবেগ ছিল। – রকি

মজিদের ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে। তিনি চিঠিটা তার বুক পকেটে রাখেন। তারপর আলমারি খুলে তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসগুলো বের করেন—একটা লাল খাতা, কিছু পুরোনো ডাকটিকিট, আর
একটা কালি-কলম। লাল খাতার শেষ পাতায় তিনি লেখেন:
তারিখ: ১৫ জুন ২০২৫ আজ আমার শেষ ডিউটি। কেউ আসেনি। কোনো চিঠি আসেনি।
মনে হলো, আমিও এক চিঠি—যাকে কেউ আর খুলে দেখে না।

সন্ধ্যা নামে ধীরে ধীরে। গ্রামের মানুষ এখন ব্যস্ত মোবাইলে ভিডিও দেখা আর নেট স্পিড নিয়ে। কেউ আর চিঠির জন্য অপেক্ষা করে না। কিন্তু মজিদ জানেন, একটা চিঠির ওজন অনেক বেশি ছিল—একটা সম্পর্ক, একটা স্মৃতি, একটা সময়কে বহন করত সেটা। চাবি ঘোরানোর সময় দরজার ফাঁকে রেখে যান নিজের হাতে লেখা একটি খাম। খামের গায়ে মোটা অক্ষরে লেখা:
যদি কেউ কখনও ফিরে আসে।
তারপর তিনি হাঁটতে থাকেন ধীর পায়ে, ধুলোয় মাখা রাস্তা ধরে—একটা সময়ের, একটা জীবনভরের, একটা গল্পের অবসান টেনে।
ডাকঘরের লাল দরজাটা আজ শেষবারের মতো বন্ধ হয়ে গেল।

পল্লব শাহরিয়ার
মোহাম্মদপুর, ঢাকা
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

ডাকঘরের চারপাশে সকালবেলার কুয়াশা ধীরে ধীরে পাতলা হয়ে আসছে।

২০ জানুয়ারী - ২০২৫ গল্প/কবিতা: ৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“ ” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ , থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী