আমার শাড়ীটা কে নিলো ? চিৎকার করে বাড়িটা মাথায় তুলছেন কাজলের মা।
-কোন শাড়িটা মা ? কাজলের বোন কান্তা প্রশ্ন করে।
-তোর বাবা গত পরশু যে সবুজ শাড়িটা আমাকে এনে দিলো সেই শাড়িটা।
-আমি বলতে পারি,তবে তুমি ভাইয়াকে বলবেনা যে আমি বলেছি।
-তার মানে,তুই জানিস শাড়িটা কোথায়?
-হ্যা জানি। দশ বছরের ছোট্ট কান্তা মাকে বলে। তুমি যদি ভাইয়াকে না বলে দাও তবে বলতে পারি।
-ওটা কি কাজল নিয়েছে?
-হ্যা ।তুমি কিন্তু ভাইয়াকে বলবে না যে আমি বলেছি।
কাজল তার ঘরেই ছিল। মা তার ঘরে ঢুকে চিৎকার করে বলে উঠে, তুই আমার শাড়িটা নিয়েছিস ? তুই শাড়ি নিয়ে কি করবি?
-কোন শাড়িটা?
-কোন শাড়িটা মানে! যেন অবুঝ ছেলে। তুই আমার সবুজ শাড়িটা দিয়ে কি করবি?
মাথা নীচু করে থাকে কাজল। তারপর আস্তে করে বলে আমি যে তোমার শাড়িটা নিয়েছি কে বলেছে ?
-সেটা তোর জানার দরকার নেই। তুই শাড়িটা নিয়ে কি করেছিস সেটা বল।তারপর একটু থেমে বলে, তুই শাড়িটা কাউকে দিয়েছিস?
-মাথা নীচু করেই সে জবাব দেয়, না কাউেেক দেইনি।
-তবে নিয়েছিস কেন?
-ওটা দিয়ে আমি---
-থামলি কেন বল।
-ওটা দিয়ে আমি পতাকা বানাবো। বাংলাদেশের পতাকা।
-কি বলছিস এসব! যেন কাজলের মায়ের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।এতটুকুন একটা ছেলে এসব কি বলছে!
এমন সময় ঘরে ঢোকে কাজলের দাদু। কি হয়েছে ? এত হৈ চৈ কিসের?
-দেখেননা বাবা,কাজল কি বলছে?
-কি বলছে?
-ও আমার সবুজ শাড়ি কেটে বাংলাদেশের পতাকা বানাবে। কি দুঃসাহসরে বাবা। সব ওর বাবার কাছ থেকে পেয়েছে। কাজলের দাদুকে নালিশের সুরে বলতে থাকে তার মা।
ও নির্ঘাত আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে। বাঁচতে দিবে না।
-এসব কি বলছো বউমা! কাজলের দাদু অবাক হয়ে বলে।এটা দিয়ে কি করতে চাচ্ছিস দাদু। জানিস এর পরিণাম কত ভয়াবহ হতে পারে।তোর বাবা সরকারী চাকরী করে। তুই একটা ১৫/১৬ বছরের কিশোর। তুই বাংলাদেশের পতাকা বানাচ্ছিস এটা যদি পাকিস্তানীরা জানতে পারে তাহলে তোর বাবার চাকরীতো যাবেই এমনকি তোকে মেরে ফেলতেও পারে।
মা তার দাদুর কথা কেড়ে নিয়ে বলে, ওর বাবাইতো ওর মাথা খেয়েছে। যতক্ষন বাসায় থাকে ততক্ষন দেশ নিয়ে বাপ ছেলের আলোচনা চলে। নিজের চাকরী,সংসারের দায়িত্ব মাথায় থাকলে এগুলো নিয়ে কেউ ভাবে।
-কি করবা বউমা,দেশের যা অবস্থা। দেশপ্রেমিক কেউ কি চুপ করে থাকতে পারে। বঙ্গবন্ধু সাত মার্চ ভাষন দিয়েছেন।এ্যাসেম্বলী বসছে না।এসবতো ভাল লক্ষন না। কি হবে কে জানে।
-আপনি আপনার নাতিকে এসব থেকে দূরে থাকতে বলেন। সামনে ম্যাট্রিক পরীক্ষা। পড়াশুনা ভাল করে করতে বলেন।
-দে দাদু ,মায়ের শাড়িটা দিয়ে দে।
নিজের বিছানার নীচ হতে অনিচ্ছাসত্ত্বেও শাড়িটা বের করে দেয় মার হাতে।
মা শাড়িটা নিয়ে চলে যায়।
২৫ মার্চ রাত্রিবেলা।ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালীর উপর শুরু হল অপারেশন সার্চলাইট নামের বিশ্বের ইতিহাসের ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞ।
আর পিছানোর পথ নেই।শুরু হল মুক্তিযুদ্ধ । স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ।
অনেকে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে লাগল। বাবা সরকারী চাকরী করেন। তাই তাকে ঢাকাতে থাকতে হচ্ছে।তিনি তার স্ত্রী সন্তানদের তাদের নানুবাড়িতে পাঠাতে চাইলেন। কিন্তু তার মা রাজি হলেননা। তাকে ছেড়ে যেতে চাইলেন না।
কিন্তু তাতে লাভ হলো না।পাকিস্তানী মিলিটারিরা এসে তার বাবাকে ধরে নিয়ে গেল। দাদুসহ বাড়ির সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। দাদু মাকে নিয়ে অনেক দৌড়াদৌড়ি করলেন। অনেকের কাছে গেলেন। তার একমাত্র সন্তানকে ছাড়িয়ে আনবার জন্য। তার মা তার প্রিয়তম স্বামীর খবর জানবার জন্য,তাকে একটু দেখবার জন্য কতজনের কাছে কত অনুনয় করলেন। কিন্তু ফলাফল শুন্য। ফলাফল যে এরকম হবে সেটা কাজল আগেই জানতো। সে ক্ষোভে ফুঁসে উঠতে লাগল। মনে মনে বলল, পাকিস্তানী মিলিটারী কুত্তারা বাবাকে জামাই আদর করার জন্য নিয়ে যায়নি। ওরা বাবাকে নির্যাতন করছে। হয়তোবা মেরে ফেলবে কিংবা মেরে ফেলেছে।
দাদু বাহির হতে মার সাথে ফিরে এসে কাজলকে বলল, দাদু ভাই শীগগীর কাপড়চোপড় গুছিয়ে নাও।
-কেন কি হয়েছে দাদু? বাবার কোন খোঁজ পেয়েছেন ?
-না দাদু। এ শহরে এখন আর তোমরা কেউ নিরাপদ নও। শীগগীর তোমাদের তোমার নানুবাড়িতে পেঁৗছে দিয়ে আসি।আর----একটু থেমে দাদু বলেন,
তুই ছোট তুই বুঝবিনা। তোর মা তোর বাবার খোঁজে যাওয়া নিরাপদ নয়। আমি তোদের রেখে এসে তোর বাবার খোঁজ করব।
কাজলের ইচ্ছে করে এক্ষুনি বাড়ি ছেড়ে চলে যায়,যুদ্ধে। যুদ্ধ কি করে করতে হয় সে জানেনা।কিশোর কাজল তবে জানে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। তার বাবা তাকে ন্যায় অন্যায় শিখিয়েছেন।যে কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে বলেছেন।কিন্তু তার এখন প্রধান কাজ তার অসহায় মাকে নানু বাড়ি নিয়ে যাওয়া। তার দাদু, মার সাথে নানুবাড়ি যাওয়া।
নানুবাড়িতে তাদের রেখে তার দাদু ফিরে যান শহরে।যাবার সময় কাজলের মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করেন। চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন, দাদু ভালো থাকিস।মার দিকে খেয়াল রাখিস।তোর বাবাকে ওরা কিছু করতে পারবে না।তোর বাবা মুক্ত হবে।
কাজল দাদুর হাতটা টেনে নিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, আর দেশ ? দেশের কি হবে ?
-কি হবে মানে! দেশ স্বাধীন হবে। হয়তো এখন কিংবা আরো পরে।
-এত আত্মবিশ্বাস নিয়ে আপনি বলছেন কি করে ?
-আমিতো আমার দেশের মানুষকে জানি। আমার সন্তানদের চিনি। আমার নাতিদের চিনি।আমার সন্তানরা না পারলে আমার নাতিরা পারবে। তারাও যদি না পারে তাদের বংশধররা, তবুও দেখিস এদেশ স্বাধীন হবেই।----বলেই কাজলকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠেন দাদু।
সারাক্ষনই অস্থির থাকে কাজল। কি করবে,কিভাবে করবে কোথায় যাবে কিছু বুঝতে পারেনা সে। নানুবড়িতে তারচেয়ে দু"বছরের ছোট, ক্লাস এইটএ পড়া মামাতো ভাই রিস্তি আছে। সে তাকে কিছু বলতে পারেনা।কোথায় মুক্তিযোদ্ধারা আছে,গ্রামের কারা যুদ্ধে গেছে। কোথায় যোদ্ধাদের ক্যাম্প আছে।
ওসব জানার জন্য বসে থাকার কোন মানে হয়না। যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে যোদ্ধা হতে হয়। ঘরে বসে থেকে যোদ্ধা হওয়া যায়না।
শুধু রিস্তিকে জানিয়ে রাত্রিবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে কাজল।শুরু হয় কাজলের নতুন এক পথচলা।
এদেশীয় দোসর রাজাকাররা পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে তুলে দেয় কাজলের মাকে। পাকিস্তানী মিলিটারীদের ক্যাম্পে চলতে থাকে তার উপর নির্যাতন।
মুক্তিযোদ্ধার ক্যাম্পে দেখা হয় রিস্তির সাথে কাজলের।
রিস্তিকে দেখে অবাক হয়ে কাজল প্রশ্ন করে, কিরে তুই?
-আমিও যুদ্ধে এসেছি, যুদ্ধ করতে।
-মা কেমন আছে? নানু নানী তারা কেমন আছে?মামা মামীরই বা খবর কি!
-ভাইয়া বোঝোনা, তারা কেমন আছে?তারা কেমন থাকতে পারে?
-ঠিকই বলেছিস রিস্তি,আসলেইতো তাই। এখনতো কারোরই ভালো থাকার কথা নয়।
-ভাইয়া--থেমে যায় রিস্তি।
-কিরে কিছু বলবি? রিস্তির দিকে তাকিয়ে থাকে কাজল।
-ভাইয়া ফুপুকে সৈন্যরা ধরে নিয়ে গেছে। গ্রামের মাতব্বর পাকসেনাদের নিয়ে এসেছিল বাসায়।
-কি বললি? দাঁড়িয়ে পড়ে কাজল।
-ফুপুকে মুক্ত করতে যাবেনা? কাজলের হাত ধরে জানতে চায় রিস্তি।
কিছুক্ষন চুপ থেকে কাজল বলে,আজযে সবার চাইতে বড় মাকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধে নেমেছি। এটায় আগে সফল হই তারপর মাকে মুক্ত করবো। এরকম অসংখ্য মা আজ পাকসেনাদের হাতে বন্দী।তারা নির্যাতন সহ্য করছে।সবইতো বাংলা মাকে মুক্ত করবার জন্য। এই মাকে ঐ কুত্তাদের, শুয়োরের কাছ থেকে আগে মুক্ত করে নেই তারপর সব মায়েদের মুক্ত করবো।রাগে কাঁপতে থাকে কাজল।তারপর হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সে।
রিস্তি কাজলের চোখ মুছে দিয়ে বলে আমি আমার মাকে কথা দিয়ে এসেছি দেশ স্বাধীন করে তবেই ফিরবো।
-তুই মামীকে বলে এসেছিস?অবাক হয়ে জানতে চায় কাজল।
-হ্যা।
-মামী তোকে আসতে দিলেন?
-হ্যা আম্মাইতো আমাকে জোর করে পাঠিয়ে দিলেন। আমি সাহস পাচ্ছিলাম না।আম্মা বললেন, তুই এখনো ঘরে বসে আছিস।আজ কাজলের মাকে ধরে নিয়ে গেছে। কাল তোর মাকে ধরে নিয়ে যাবে।ওরা মানুষ না পশু। ওদের মেরে ফেল। যা যুদ্ধে যা।
দেশের বিভিন্ন এলাকা শত্রুমুক্ত হতে থাকে। রিস্তি ফিরে আসে বাড়িতে। তার বাবামা তাকে ফিরে পেয়ে খুশী হয়। কাজলের খবর জানতে চায়। রিস্তি কিছু বলতে পারেনা। তারা দুজনে আলাদা আলাদা জায়গায় থেকে যুদ্ধ করে। বাড়ির সবাই কাজলের প্রতীক্ষায় থাকে।সে ফিরে আসবে।
ফুপুকে দেখে দৌড়ে উঠোনে বেরিয়ে আসে রিস্তি।
চিৎকার করে বলে, মা বাবা ,ফুপু আসছে।দেখেন ফুপু আসছে।
পা ছেঁচড়ে তার হাঁটতে কষ্ট হয়। কাজলের মায়ের শরীর মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
রিস্তির বাবামা দৌড়ে এসে তাকে টেনে বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে শুইয়ে দেয়।ফুপুর শরীরে সবুজ শাড়ি। শাড়িতে অনেক জায়গায় রক্ত লেগে আছে।
ফুপু কোঁকাতে কোঁকাতে বলতে থাকে,আমার কাজল কই? কান্তা কই?
-বুবু এইযে তোমার কান্তা । কান্তাকে এগিয়ে দেয় তার বাবা।
-কাজল কই?
-ও এখনও ফিরেনি। দেশ এখনও স্বাধীন হয়নি।
-তোরা দেখিস কাজল দেশ স্বাধীন করে ফিরবে।
-হ বুবু তুই চুপ কর। তোকে ঘরে নিয়ে যাই। তুই ক্লান্ত। তোর বিশ্রাম দরকার। খাবার দরকার।
-হ্যা আমি ক্লান্ত। যুদ্ধ করেছি, অনেক যুদ্ধ। তোরা মনে রাখিস দেশের জন্য অনেক কষ্ট, অনেক কষ্ট করেছি।
-রিস্তি?
-জ্বী ফুপু বলেন।
-পরনের এই শাড়িটা কাজলকে দিস। ও এটা দিয়ে পতাকা বানাতে চেয়েছিল। আমি রাগ করেছিলাম।ও ফিরলে এটা ওকে দিস। ও পতাকা বানিয়ে স্বাধীন দেশে উড়িয়ে দেবে।লাল সবুজের পতাকা---
নীরব হয়ে যান তিনি । নিথর হয়ে পড়ে তার দেহখানা ।
কাজলের আর তার মায়ের শাড়ীটা দিয়ে পতাকা বানানো হয়না। এমনকি সে পতাকা ওড়াতেও পারেনা।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরদিন তার লাশ পাওয়া যায়।
স্কুলের মাঠটাতে মায়ের রক্তমাখা সবুজ শাড়িটা দিয়ে পেঁচিয়ে রাখা হয়েছে লাশটা। না এটাতো কেবল শাড়ি নয়। এ যেন মুক্তিযোদ্ধার লাশ লালসবুজ পতাকা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।যেন কাজল নয়,ও তো বাংলাদেশ। এরকম লক্ষ লক্ষ মায়ের রক্তমাখা সবুজ শাড়ি জড়িয়ে রাখা হয়েছে লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা শহীদদের। যেন পতাকায় আবৃত স্বাধীন বাংলাদেশ।
২০ জানুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৪০ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪