গাঁয়ে মেলা বসেছে।বৈশাখী মেলা। বাংলা নতুন বছরের ঐতিহ্যবাহী এ মেলা যেন গাঁয়ের প্রাণ। একটি বছর ধরে অপেক্ষায় থাকে গাঁয়ের মানুষ এই দিনটির জন্য, এই মেলাটির জন্য।মেলায় এসেছে সাদা রঙ লাল পেড়ে শাড়ি পড়ে নয়না। কপালে লাল টিপ,বেশ সেজেছে। সবারই নজর কাড়ছে সে।তবে তার চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে তার মনের মানুষ রূপমকে। রূপমও সাদা পাঞ্জাবী সাথে সাদা পায়জামা,লাল ওড়না পড়েছে।তাকেও বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে।স্যাটেলাইটের এ যুগে গ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেলার সাথে আধুনিকতার ছোঁয়া-ভালই লাগছে গ্রামের এ পরিবেশ।সাথে রূপম নয়নাকেও।
দুজনে বেশ মজা করছে। মেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে,নাগরদোলায় চড়ছে।বাতাসা খাচ্ছে। ঝালমুড়ি খাচ্ছে। দু"জনের যেন গল্প আর ফুরোয় না।তাদের এ ভালবাসা দু"পরিবার যে জানে না তা নয়।তবে তাদের ভালবাসা মেনে নেবে কিনা সেটা অবশ্য স্পষ্ট নয়। রূপম উপজেলা ডিগ্রি কলেজ থেকে ডিগ্রি পাশ করে ছোটখাট একটা ফটোকপি ও ষ্টেশনারী দোকান করছে। আর নয়না ডিগ্রী পড়ছে। নয়নার বাড়ি থেকেই হয়তো আপত্তি আসতে পারে। আর তাতেই দু"জনের ভয়। নয়নার রূপ,অপেক্ষাকৃত অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের তুলনায় রূপম সেরকম যোগ্য কোন পাত্র নয়।কিন্তু ভালবাসাতো আর এসব মানেনা। তাইতো দু"জনেই ঠিক করেছে দু"পরিবার মানুক কিংবা না মানুক নতুন এ বছরেই তারা বিয়ে করবে। নতুন ঘর বাঁধবে। নতুন সে ঘর বাধার স্বপ্ন নিয়েই তারা মেলা হতে ফিরে আসে। সন্ধ্যা থেকেই আকাশ কালো মেঘে ঢেকে যায়। একটু একটু বাতাস বইতে শুরু করে। লোকজন ভয়ে মেলা থেকে বাড়ি ফিরে যায়। মেলার দোকনগুলো বন্ধ হয়ে যায়। রাত নয়টা বাজতেই বাতাসের পরিমান অনেক বেড়ে যায়। বৃষ্টি পড়া শুরু করে। সাথে ঝড়ো হাওয়া। অল্পক্ষনের মধ্যেই কালবৈশাখী ঝড় শুরু হয়ে যায়।নতুন বছরের প্রথম দিনেই আকস্মিক এ কালবৈশাখী ঝড়ে সবাই হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। আতঙ্কিত মানুষের চিৎকার পুরো গ্রাম জুড়ে চলতে থাকে। মাত্র আধা ঘন্টার সে ঝড়ে পুরো গ্রাম লন্ডভন্ড হয়ে যায়। নতুন বছরের প্রথম দিনটা সকালে যেভাবে শুরু হয়েছিল শেষটা পুরোটাই উল্টোরূপে গ্রামকে জানান দিয়ে গেল। পরদিন সকাল। পুরো গ্রামে গতকাল রাতের ঝড়ের ধ্বংসযজ্ঞ।বাড়িঘরের কথা নাইবা বলা হলো,কতজন মানুষ মারা গেল তার হিসাব চলতে থাকল।অসংখ্য আহত মানুষের আহাজারি গ্রাম ছাড়িয়ে শহরের জেলা হাসপাতালে পৌছে গেছে।গাঁয়ের মেলার দোকানপাটের অবশিষ্ট বলে আর কিছু নেই।পুরো গ্রামের কয়টা বাড়ির কয়টা ঘর অক্ষত রয়েছে হাতে গুনে সেসব হিসাব কষতে লাগল মানুষ। নয়নাদের বাড়িসহ গায়ের মোটামুটি স্বচ্ছল যাদের পাকা ঘর ছিল সেগুলোই শুধুমাত্র অক্ষত ছিল।আর বাকি যাদের টিনের ঘর কিংবা বেড়ার ঘর ছিল তাদের অধিকাংশেরই কোনটার হয়তো ঘরের চাল উড়ে গেছে,কোনটা ভেঙ্গে পড়েছে,কোন ঘর কিংবা হেলে পড়েছে। রূপমদের বাড়িটার অনেক ক্ষতি হয়েছে। আবার নতুন করে ঘর বাঁধতে হবে। অভাবের এ সংসারে নতুন করে ঘর বাঁধা চাট্টিখানি কথা নয়। সে চোখে অন্ধকার দেখতে থাকে। বৃদ্ধ বাবা মা আর ভাইবোনের বড় এ সংসারে উপজেলার দোকানটি তাদের আয়ের একমাত্র অবলম্বন। সে দোকানটিরও ক্ষতি হয়েছে। আবাদি জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে।
নয়না এসে তাকে সাহস যোগায়।কিন্তু সাহসই সবসময় সবকিছু নয় সে আর্থিক সহযোগিতা করতে চায়। রূপম আগ্রহী হয় না। চেষ্টা করে অন্য অনেকের মত সেও আবার মাথা উচু করে দাঁড়াতে। বাড়ির গরুটি মারা গেছে। তবুও আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানায় তারা বেঁচে আছে বলে। অনেকেতো মারা পড়েছে। পুরো দেশের দৃষ্টি চলে আসে এ গাঁয়ের প্রতি। সরকারী বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি গাঁয়ের মানুষদের সাহায্যে এগিয়ে আসে।
কয়েকদিন পর বেসরকারী একটি প্রতিষ্ঠানের অন্য অনেক সাহায্যকর্মর্ীর সাথে সে গাঁয়ে আসে একদল স্বেচ্ছাসেবী। যার মধ্যে আবীর আছে। সে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ করছে। বিত্তশালী পরিবারের সন্তান সে। দেখতে সুদর্শন।বেশ মিশুক।মাত্র দুদিনেই বেশ আলাপ জমিয়ে ফেলে রূপমসহ গাঁয়ের অনেকের সাথেই। নয়নাকে প্রথম দেখাতেই তার ভাল লেগে যায়। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের মেয়ে হওয়াতে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে তার সাথে কথা বলার বেশ সুযোগ পেয়ে যায় আবির। সে ভালবেসে ফেলে নয়নাকে।গাঁয়ের মানুষদের পুনর্বাসনের কাজে বেশ কদিন থাকতে হচ্ছে আবিরদের এ গ্রামে। আবীর আর নয়না দুজনের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে।বিষয়টা রূপমের চোখ এড়ায়না। সে আতঙ্কিত হয়,কষ্ট পায়। নয়নার কাছে জানতে চায়।কেন সে আবীরকে বেশী সময় দিচ্ছে। তার সাথে কিসের এত সখ্যতা! নয়না বিরক্ত হয় রূপমের এ প্রশ্নে। তুমি আমায় সন্দেহ করছো। ওরা এসেছে কাজ করতে,আমাদের সাহায্য করতে।কাজ শেষ হলে চলে যাবে। -সেজন্যেইতো জানতে চাচ্ছি ওর সাথে এত ঘনিষ্ঠতার দরকার কি? -ও আমাদের বাড়িতে আসে । কথা বলব না! ওর সাথে গ্রামে কাজ করলে অসুবিধাটা কোথায়? কিন্তু নয়না মুখে না বললেও কিংবা স্বীকার না করলেও রূপম বুঝতে পারে নয়না আবীরের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ছে।রূপম কি করতে পারে এখন ? সে চিন্তায় পড়ে যায়। আবীরের কাছে আসে রূপম।বাড়িঘর ঠিক করছে লোকজন। তাদের তদারকি করছে আবীর। -কিছু বলবেন?রূপমকে দেখে আবীর জানতে চায়। -জ্বী একটু যদি এদিকে আসেন।
একটু দুরে ফাঁকা জায়গায় দুজনে যায়। -বলুন। -দেখুন আমি নয়নাকে ভালবাসি।রূপম বলে। -নয়না কি আপনাকে ভালবাসে ? ওতো কিছু বলেনি। -দুজনে দুজনকে ভালবাসি। আমাদের ঠিক করা আছে আমরা দুজন এবছরই বিয়ে করব। -এসব আমাকে বলছেন কেন? বিরক্ত নিয়ে কথাটা বলে আবীর। -আপনাকে কেন বলছি এটা না বোঝার মত মানুষ আপনি নন। আপনি ঝড়ে আক্রান্ত মানুষগুলোর সাহায্য করতে এসেছেন। তাদের পুনর্বাসনে সহায়তা করছেন। এজন্য আমরা আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু ঝড়ে দূর্গতদের সাহায্য করতে এসে অন্য এক ঝড়ে তছনছ করে দিয়েননা অকৃত্রিম এক ভালবাসার বন্ধনকে। ভেঙ্গে দিয়েননা দুজনের স্বপ্নকে। তারপর একটু থেমে রূপম বলে,নয়না রঙিন এক স্বপ্নের দোলাচালে ভাসছে।সম্ভ্বব হলে আপনি এখান থেকে চলে যান।
কথা আর বাড়ায় না আবীর। মনে মনে ভাবে তাইতো তারতো ক্ষনিকের জন্য আসা এখানে। রূপম আর নয়নার মাঝে ঝড় হয়ে সে তাদের সম্পর্ককে তছনছ করে দিতে পারেনা। তার চলে যাওয়াই উচিত।
-হ্যা আমি আজ চলে যাচ্ছি। -এত তাড়াতাড়ি যে!নয়না অবাক হয়ে জানতে চায়। সে কথার জবাব না দিয়ে বলে আবীর,রূপম তোমাকে ভালবাসে।তুমিও নিশ্চয়ই তাকে ভালবাস,ভালবাসতে। কিন্তু আমি ও যে আপনাকে.. -তুমি কি বলতে চেয়েছিলে বা চাইছ সেটা আর জানতে চাইনা। তোমায় সত্যি করে বলি,আমিও তোমায় ভালবেসেছিলাম,ভালবেসেছি। এটা যে ঝড় হতে পারে বুঝতে পারিনি। তাই টর্ণেডো হয়ে ঝরার পূর্বেই চলে যেতে চাই। -আপনাকে বাঁধা দেবো না। তবে এটুকু অনুরোধ ঝড় থেমেও যায়। কিন্তু তবুও তার ক্ষতচিঞ্চ রয়ে যায়। যা কখনো শুকোয়না। -সময়ই সব ঠিক করে দেয়। ভাল থেকো।
পিছন ফিরে আবীরের দেখতে ইচ্ছে করে নয়নাকে। সব ইচ্ছে সব সাধ সবসময় পূরণ করতে হয় না। সে বড় রাস্তার দিকে হাঁটতে থাকে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সূর্য
গল্পের চরিত্রগুলো সবসময় নিষ্কলুষ হবে এমন নয়, তবে গল্পে আমরা আমাদের না পাওয়াগুলোর পূর্ণতা দেখতে চাই বলেই নয়নার আবীরের সাথে মাত্র কয়েকদিনের পরিচয়ে রূপমের সাথে সম্পর্কে ফাটল ধরার ইঙ্গিত নয়নার চরিত্রের দুর্বলতা মনে হয়েছে। যদিও বাস্তবে এমন হরহামেশাই দেখতে পাচ্ছি হা হা হা। মানিকের গল্প সব সময়ই পড়ে মজা পাই এটাও পড়লাম ভাল লাগা নিয়েই।
সেলিনা ইসলাম
আপনার লেখা সবসময়ই বেশ পরিপক্ক হয় তবে এই গল্পটায় শুরুটার যে গতিছিল তা আবীরের আসার পরে ব্যাহত হয়েছে সম্ভবতঃ গল্পটা বড় হয়ে যাচ্ছে এই দিকটা মাথায় রাখার ফলে এমন হয়েছে । উপস্থাপনা বরাবরের মতই সাবলীল - ভাল লেগেছে আনন্দের পাশাপাশি বৈশাখের বিভীষিকাময় রূপ তুলে ধরার বিষয় ...। শুভেচ্ছা ও শুভকামনা
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।