উপহার

বন্ধু (জুলাই ২০১১)

আনিসুর রহমান মানিক
  • ৬৮
  • 0
পিয়নের কাছ হতে চিঠিটা নিয়ে দরজা লাগিয়ে ভিতরে চলে আসে নীলা।খামের উপরে প্রেরকের নাম দেখে খুশীতে মন ভরে ওঠে তার।সুদূর আমেরিকা থেকে এসেছে চিঠিটা।বন্ধু শাহিনের চিঠি।খামটা খুলে চমকে ওঠে নীলা । এতগুলো কাগজ।পাতাগুলো উল্টাতে থাকে।এত্ত বড় চিঠি।অবাক হয় নীলা। কি এত লিখেছে শাহিন।ভিতরের বারান্দায় চলে আসে নীলা।চেয়ারটা টেনে বসে পড়ে তাতে। চিঠিটা পড়তে শুরু করে-

প্রিয় বন্ধু নীলা,
কেমন আছিস?নিশ্চয়ই ভাল।আশা করি তুই সুস্থ আছিস।স্বামীকে নিয়ে তোর সুখের সংসার শান্তিতেই চলছে।আজ আমি ঠিক করেছি,না আজ নয় কদিন ধরেই ভেবেছি তোকে একটা চিঠি লিখব,বিশাল বড় চিঠি। যে চিঠি পড়তে পড়তে দিন শেষ হয়ে যাবে।কিংবা রাত্রে পড়লে রাত শেষ হয়ে ভোরের আলো উঠবে। তবে হ্যা এখন আর সে সুযোগ নিশ্চয়ই নেই,মানে রাত জেগে পড়ার।তোর কি মনে আছে,ভার্সিটিতে আমাদের আড্ডার সময় তুই আফসোস করে বলতি কেউ তোকে চিঠি লিখে না।তুই বলতি-"আমাকে তোরা কেউ একজন একটা বড় চিঠি লিখ,যেটা আমি রাতে পড়া শুরু করব এবং পড়তে পড়তে রাত শেষ হয়ে যাবে"।আমি তখন বলেছিলাম-ঠিক আছে আমি লিখব।কিন্তু মোবাইলের এ যুগে তখন আর লেখা হয়ে ওঠেনি।আজ এতদিন পর লিখতে গিয়ে পুরনো দিনের অনেক কথাই বারবার মনে পড়ছে।ভার্সিটিতে তো কত ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়,কতজনের সাথে বন্ধুত্ব হয় কিন্তু আমাদের মত মানে আমরা নয়জন কি আনন্দেই না,বন্ধুত্বের গাঢ গভীরে মিশে গিয়েছিলাম।যেখানে ছিল বন্ধুত্বের প্রতি ভালবাসা,সম্মান।তুই যখনই গুনগুন করে গাইতি"কফি হাইজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই----"শুভ্র তোকে প্রথম দুতিন লাইনের পর আর গাইতে দিত না।বলত-'নারে আমরা গানের বন্ধুদের মত হতে চাইনা,আমরা অনন্তকাল বাঁচতে চাই এবং আজীবন বন্ধু থাকতে চাই।অথচ দেখ সেই শুভ্রই সবার আগে আমাদের ছেড়ে এই দুনিয়া থেকে চলে গেছে।
এই শোন তুই চিঠি পড়ছিসতো নাকি ঘুমিয়ে পড়েছিস।নাকি রান্না করছিস স্বামীর জন্য।আচ্ছা তুই তোর স্বামীকে নিশ্চয়ই খুব সুন্দর করে রেধে খাওয়াচ্ছিস।তুই কি আজ সর্ষে ইলিশ রেধেছিস?তোর স্বামী নিশ্চয়ই তোর ভাল বন্ধু হয়েছে।তোর কি মনে আছে-শ্রাবণের এক বৃষ্টির দিনে তুই আমাদের সর্ষে ইলিশ রেধে খাওয়াইছিলি।মাঝে মাঝেই তোর বাড়িতে চলত আমাদের খাবার আয়োজন।খালাম্মাকে এজন্য কখনো বিরক্ত হেেত দেখিনি।তোর নিশ্চয়ই মনে আছে কাজলটা কিরকমই না খাদক ছিল।সে তোদের সবার ব্যাগ হাতরে খাবার খুঁজত।আর তোরাও যেন কেমন ছিলি ব্যাগে সবসময়ই ওর জন্য চকলেট,চুইংগাম,চিপস রেখে দিতি।কাজল বলত-বন্ধু বন্ধুই।এ এক মধুর বন্ধন।আমি কখনো বন্ধুকে বিয়ে করবো না।বন্ধু সেতো শুধুই বন্ধু,তাকে অন্য কিছুতে জড়ানো ঠিক না।অথচ , সেই কাজলই আমাদের আর এক প্রিয় বন্ধু স্বপ্নাকে বিয়ে করে ফেলল।ওরা এখন দারুন সুখী।আর তোরাওতো সুখী।নীলা শোন,তোর স্বামী কিন্তু বেশ হ্যান্ডসাম। কিরে মনে আছে তোর সাকিবকে? সাকিবও কিন্তু বেশ হ্যান্ডসাম ছিল।সে আমাদের দলে ভিড়তে চেয়েছিল,বন্ধু হতে চেয়েছিল।কিন্তু সে বন্ধুত্ব ছিল তোকে ভালবাাসার জন্য।ও কিন্তু তোকে প্রচন্ড প্রচন্ড ভালবাসত।ওকে তুই বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে চাসনি।বলেছিলি-যেখানে স্বার্থ থাকে,দেনা পাওনার হিসাব থাকে ,সেখানে বন্ধুত্ব বলে কিছু থাকে না।তুমি আমাকে ভালবাসো,আমার ভালবাসা পাওয়ার জন্য তুমি আমাদের বন্ধু হতে চাও।"প্রতিউত্তরে সাকিব বলেছিলো-হ্যা অমি তোমাকে ভালবাসি,প্রচন্ড ভালবাসি।তোমাকে নিয়ে আমি ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখি,ঘর বাঁধতে চাই।"কিন্তু তার আর তোকে নিয়ে ঘর বাঁধা হয়নি।আর তোকে নিয়েই শুধু কেন,আমি কিছুদিন আগেও জেনেছি,সাকিব বিয়েই করেনি।আর তুই,তুইইবা শুধু কেন,আমরা সবাই বিয়ে করে সংসার করছি।সুখে আছি।


তুই ছিলি বড্ড চাপা স্বভাবের।বন্ধুত্বের গন্ডী পেরিয়ে তুইও যে আমাকে ভালবেসে ফেলেছিলি তা আমাকে আগে কেন বলিসনি?বোকা মেয়ে।আর আমিও যেন কেমন।তোর ভালবাসার কথা বুঝতে পারিনি,জানতে পারিনি।যদিনা সেদিন দীপক,সুমন,লোপারা আমাকে তোর ভালবাসার কথা বলত।
তোর বিয়ের কথা যখন প্রায় চুড়ান্ত তখন একদিন বিকেলে ওরা তিনজন এসেছিল আমার রুমে।লোপা বলল-শাহিন,নীলা তোকে ভালবাসে।আমি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলাম-কেন তোরা ভালবাসিস না?দীপক আমার পিঠে হাত রেখে বলল_শাহিন এ ভালবাসা শুধু বন্ধুত্বের ভালবাসা নয়। এ ভালবাসা চিরস্থায়ী বন্ধনের। সে তোকে নিয়ে সংসার গড়তে চায়। আমি আশ্চর্যান্বিত হয়ে পড়লাম,বললাম-একি বলছিস তোরা! ওরা আমাকে অনুরোধ করল যেন আমি তোকে বিয়ে করি।তোর এ বিয়ে বন্ধ করে দেই।আমি শুধু ওদেরকে বললাম-আমি আসলে ওকে বন্ধু হিসেবেই দেখেছি,এভাবে কোনদিন ভেবে দেখিনি।ঠিক আছে আমি ভেবে দেখি।"
একদিন দু'দিন গেল।ভেবে যখন কোনকিছুই মিলাতে পারছিলাম না ঠিক তখনই,মনে আছে? বুধবার বিকাল পাঁচটায় কি সাড়ে পাঁচটায় তুই আমার রুমে এসে হাজির।তোকে সেদিন অপূর্ব সুন্দর লাগছিল।হ্যারে সত্যি বলছি।সেদিন ওরকম পরিস্থিতিতে তোকে যে সুন্দর লাগছে সে কথা বলার সাহস ,ইচ্ছা কোনটাই ছিল না।তুই আমার হাতে বিয়ের কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলি-আমার বিয়েতে অবশ্যই আসবি।বলেই চলে যেতে নিতেই তোকে থামতে হয়েছিল।বলতো কেন?নিশ্চয়ই ভুলে গেছিস।আমি পিছন থেকে তোর হাত টেনে ধরেছিলাম।বলেছিলাম-আমরাতো বন্ধু রইলাম।তুই শুধু মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে চলে এসেছিলি।দু'এক ফোঁটা চোখের জল অজান্তেই ফেলে এসেছিলি মেঝেতে।
এই যা অনেক কথা লিখে ফেললাম।তুই কাঁদছিছ নাতো ?তুইতো আবার ছিচকাঁদুনে।অল্পতেই কেঁদে উঠিস।ও হ্যা তোর ঔষধ খাওয়ার সময় হয়নিতো।হলে খেয়ে নে।তারপর আবার পড়।শরীরের প্রতি যত্ন নিবি।কেননা তোর দেহে যে এখন দুজন রয়েছে।দুজন রয়েছে মানে! চমকে উঠলি?আরে হ্যা তোর শরীরে যে অন্যের কিডনি।তোকে যেমন নিজেকে সুস্থ থাকতে হবে তাকেও তো সুস্থ রাখতে হবে।দেখ আমরা বন্ধুরা মিলে মানুষের জন্য কত কিছুই না করার চেষ্টা করেছি।জুয়েলের জন্য কনসার্ট,ছোট্ট শিশু লাবণ্যর হার্টের ভাল্ব নষ্ট হয়ে গেছে,ওর অপারেশনের জন্য টাকা দরকার।আমরা অনুষ্ঠান করে লাবণ্যর অপারেশনের জন্য টাকা যোগাড় করলাম।তুই বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিকিট বিক্রি করলি।লাবণ্য সুস্থ হয়ে উঠল।তোর সে কি আনন্দ!কারো রক্তের প্রয়োজন পড়লেই আমরা বন্ধুরাই সবার আগে ছুটে যেতাম রক্ত দিতে।অথচ দেখ সেই তুই-ই কিনা অসুস্থ হয়ে পড়লি।তুই এতই চাপা স্বভাবের যে,তোর শরীরে এত কঠিন অসুখ নিয়ে বসে আছিস,আমাদেরকে জানতেও দিসনি।তুই স্বার্থপর ,নিজে কষ্টটা বয়ে বেড়িয়েছিস,বন্ধুদের সাথে শেয়ার করিসনি।তোকে দোষ দিয়েই বা লাভ কি?আসলে অসুখতো আর শেয়ার করা যায় না।কিন্তু কষ্টটাতো শেয়ার করা যায়।যায় নয় কি?তোর মনে নেই,আমরা যখন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত জুয়েলের পাশে গিয়ে বসেছিলাম,ওর চোখে মুখে কি আনন্দই না প্রকাশ পেয়েছিল সেদিন।ও জানত ওর মৃতু্য অতি সনি্নকটে অথচ তার কষ্টটা আমরা শেয়ার করেছিলাম বলেই ও হাসতে পেরেছিল।
আর তুই!তোর কষ্টটা নিজেই চাপিয়ে রেখেছিলি।ভেবেছিলি আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে যাবি।কিন্তু বন্ধুত্বের বন্ধন সহজে ছিড়ে না।আমি টিপুর কাছ হতে খবরটা পাই তুই যেদিন হাসপাতালে ভর্তি হস।আমি খবরটা শুনে প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারিনি।একি হল!একটা কিডনি নষ্ট হলে না হয় হোত,কিন্তু দুটো কিডনি দুটোই নষ্ট।বুঝতে পারলাম না কি করব?সুদুর আমেরিকা থেকে মাথায় কিছু বুদ্ধি খেলল না।দুদিন পর চলে এলাম দেশে।হাসপাতালের বিছানায় তোকে ওভাবে অসুস্থ অবস্থায় শুয়ে থাকতে দেখে আমি নিজেকে আটকে রাখতে পারিনি।অঝোর ধারায় কেঁদেছিলাম।তোর পুরো শরীর ফুলে গিয়েছিল।আমি শুধু বলেছিলাম-তুই এত চাপা কেন?তুই জবাবে বলেছিলি-মানুষের জন্মইতো মৃতু্যর জন্য,আমি না হয় কদিন আগেই চলে যাচ্ছি।তোর সে কথার জবাবে আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম,তোকে এভাবে মরতে দেব না।তোকে বাঁচাবই।মনে মনে ভাবলাম-ছাত্রাবস্থায় আমরা বন্ধুরাই মিলে কতজনের জীবন বাঁচাতে চেষ্টা করেছি,তাদের জন্য কনসার্টের আয়োজন করেছি,মানুষকে রক্ত দিতে উদ্বুদ্ধ করেছি।তাহলে এখন কেন পারব না।অবশ্যই তোকে বাঁচিয়ে তুলব।তোকে আারও কটা দিন বাঁচিয়ে রাখব।যদি তা ৭দিন,৩দিন কিংবা ১ দিনও হয়।
বাইরে এসে বন্ধুদের সাথে বিষয়টা নিয়ে কথা বলতেই আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম।লজ্জা পেলাম।তাইতো!ওর স্বামীরতো টাকার অভাব নেই।আর আমরা বন্ধুরা,আমাদেরও মোটামুটি টাকা আছে।কাজেই ওর জীবন বাঁচানোর জন্য টাকারতো প্রয়োজন নেই।নেই টাকা সংগ্রহের জন্য কোন কনসার্ট আয়োজনেরও।নীলার প্রয়োজন কিডনি,একজন সুস্থ মানুষের কিডনি।
কি করা যায়?ইতোমধ্যে তোর স্বামী জানিয়ে দিয়েছে যে কোন কিছুর বিনিময়ে হলেও তোর জন্য সে কিডনি নেবে।সে তোকে সুস্থ করে তুলবে।তোর প্রতি ওর ভালবাসা দেখে কিছুটা হলেও হিংসে হোল।দীপকরা মিলে ঠিক করল পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিবে এবং বিজ্ঞাপন দিয়েও দিল।পাশাপাশি আমরা সবাই চিন্তা করলাম আমরা কিডনির জন্য আবেদন চেয়ে পোষ্টার ছাপাব।আমরা যখন এ চিন্তা করছি তখন তুই কথাটি জেনে গেলি এবং বললি-না তোরা এ কাজ করিস না।অন্যের শরীর হতে আমি কিডনি নিতে পারব না।তোরা আমাকে ছোট করিস না।অর্থ দিয়ে মানুষের শরীর হতে অঙ্গ কেটে নিস না।
ইতোমধ্যে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়ার বেশ কদিন পার হয়ে গেছে।কিন্তু কোন ডোনার তখন পর্যন্ত আমাদের সাথে কিংবা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেনি।আমরা আশাহত হলাম।হাসপাতালের তোর কথাগুলো অনবরত ভাবতে লাগলাম।আমরা বন্ধুরা মানুষের জীবনের জন্য,মানুষকে বাঁচানোর জন্য কত কিছুই না করেছি,অথচ আজ নিজেদের স্বার্থে টাকার লোভ দেখিয়ে অন্যের শরীর হতে তার অঙ্গ ছিনিয়ে নিতে চাইছি।সে ব্যক্তিই কিডনি দেবে যার প্রয়োজন অর্থ।যেখানে নেই কোন মমতা,নেই ভালবাসার বন্ধন।
কাজল টিপু,সুমন ওরা বস্তিতে বস্তিতে ঘুরছে।মানুষকে কিডনি দিতে বলছে।তারা মানুষকে বোঝাচ্ছে একটা কিডনি দিলে কিছু হয়না,অন্য কিডনি নিয়ে বেঁচে থাকা যায়।বরঞ্চ কিডনির বিনিময়ে ১ লাখ,২ লাখ,৩লাখ যত টাকা চাইবে পাবে।কিন্তু তারা হতাশ হয়ে ফিরে আসে।
রাতে ঘুম এল না।নিজের শরীরের দিকে তাকালাম।হাত দিয়ে অনুভব করতে চেষ্টা করলাম কিডনিদুটোকে।হ্যা আমি জেনেছি মানুষ একটা কিডনি নিয়েও বাকি জীবন স্বাভাবিকভাবে পার করে দিতে পারে।তবে আমি কেন পারব না!বন্ধুর জন্য এ উপহারটা না হয় আমিই দেব। উপহার।হ্যা উপহার বলতে পারিস।এবার আমেরিকা থেকে আসার সময় ভেবেছিলাম তোর জন্য কি নিয়ে আসব?কোন উপহারে তুই খুশী হব?িরুম্পা মানে আমার স্ত্রী বলেছিলো-সে তো অসুস্থ,ও এখন উপহারের চেয়ে তোমাকে পেলেই বেশী খুশী হবে,তুমি যত শীগগীর পার যাও।তাইতো আমিও চলে এসেছিলাম,তোর জন্য কোন উপহার নিয়ে আসতে পারিনি।
রাতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম এবং সেই সাথে নিজেকে ধিক্কার দিলাম।যা আমার কাছে আছে অথচ বন্ধুর জন্য সেটা না দিয়ে আমি মানুষের কাছ থেকে অর্থ দিয়ে কিনতে চাইছি।ছিঃ ছিঃ।ভোরেই ফোন করলাম রুম্পাকে।আমার সিদ্ধান্তের কথা জানালাম।ওর মতামত জানাতে বললাম।কিছুটা ভেবে সে বলল-আমি কালই দেশে আসছি,এসে তোমাকে আমার সিদ্ধান্ত জানাব।এই একটা দিন যে আমি কিভাবে পার করেছি তা তোকে বলে বোঝাতে পারব না।আমি স্থির থাকতে পারছিলাম না।নিজেকে খুব অসহায় মনে হতে লাগল।মনে হল বিয়েটা করেই ভুল করেছি হয়তোবা! নইলে স্বাধীনমতো সিদ্ধান্ত নেয়া যেত।কিন্তু এখনতো তা আর সম্ভব নয়।
রুম্পা যে আসছে এটা আমি বন্ধুদের কাউকে তখনো জানাইনি।এয়ারপোর্টে আমি ওকে আনতে যাই।গাড়িতে বসেই আমি ওকে ওর সিদ্ধান্তের কথা বলতে বলি।ও বলে-তোমার সিদ্ধান্ত জানাটা কি খুবই জরুরী?-হ্যা আমি রুম্পার হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বলি-কিডনি না হলে যে নীলা বাঁচবে না। রুম্পা বলে-চল আগে হাসপাতালে যাই।
রুম্পাকে দেখে তুই খুব অবাক হয়েছিলি তাইনা!আমি অবশ্য তোর চোখমুখ দেখে সেটা বুঝতে পেরেছি।রুম্পাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে তুই বলেছিলি-আমি আর বাঁচবো নারে রুম্পা,আমি আর বাঁচবো না।রুম্পা তোর মাথায় হাত বুলিয়ে সান্তনা দিতে দিতে বলেছিলো-কেন নীলা আপু বাঁচবেন না,অবশ্যই বাঁচবেন।কিডনি যোগাড় অবশ্যই হবে।আমার মাথায় তখন একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল কিডনি দিতে পারবো তো!


বাড়িতে এসে রুম্পা বলল-আমি কেন দেশে এসেছি জান?আমি ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠি-আমাকে নিয়ে যেতে?রুম্পা আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠে-না তোমাকে সঙ্গ দিতে।তুমি হাসপাতালে ভর্তি হলে তোমার সেবা শুশ্রুষা কে করবে।আমি আনন্দে চিৎকার করে রুম্পাকে জড়িয়ে ধরলাম।নিজের চোখ মুছতে মুছতে
রুম্পার দিকে তাকিয়ে দেখি রুম্পা কাঁদছে।সে বলল-বন্ধুর প্রতি তোমাদের এত টান।তুমি তোমার বন্ধুকে তোমার জিনিস উপহার দিবে সেটায় তুমি আমার মতামত চাইছ।আমি কি বন্ধুত্বের মাঝে দেয়াল হয়ে দাড়াতে পারি?
এরপর সমস্যা হলো আমি যে কিডনি দিচ্ছি এটা তোকে জানানো যাবে না।জানলে তুইতো নিবিনা উল্টো কোন অঘটন ঘটাতে পারিস।আবার বন্ধুদের জানালেও একান ওকান হতে তোর কানে চলে যাবে এবং দেয়ার আগেই সমস্যা বেড়ে যাবে।তাই রুম্পা আর আমি দুজনে মিলে পরিকল্পনা করলাম এবং রবিবার ১০ তারিখ বিকেলে আমেরিকার উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করছি বলে বন্ধুদের জানালাম।আমাদের ঢাকা ত্যাগের খবরে বন্ধুরা বেশ মুষড়ে পড়ল।আমি যাবার আগে শুধু বললাম-এত চেষ্টা করেওতো কিডনি পাওয়া গেলনা,তখন আর থেকে কি লাভ! তার চেয়ে ফিরেই যাই।রুম্পাও এসেছে আমাকে নিতে।
১০তারিখ রাতে মোবাইলে ফোন পেলাম বন্ধু সুমনের।টিভিটা ইশারায় রুম্পাকে কমিয়ে দিতে বলে চিৎকার করে উঠলাম-কি বললি,কিডনি পাওয়া গেছে।পরশু দিন অপারেশন হবে।আমার চোখে জল চলে এল।রুম্পা এগিয়ে এসে চোখের জল মুছে দিতেই আমি বললাম-এ জল আনন্দের জল,আমাদের বন্ধু বেঁচে উঠবে,এ জল পড়তে দাও।
বন্ধুুরা জানল আমরা আমেরিকা চলে গেছি।অথচ ড্রইংরুমে বসেই সুমনের সাথে কথা বললাম।
ইতোমধ্যেই রুম্পা ডাক্তারের সাথে সব কথাবার্তা সারল।কিডনির বিনিময়ে তিন লাখ টাকা নেয়া হল।হ্যা তোর স্বামী ডাক্তারের মাধ্যমে তিন লাখ টাকা দিয়েছে।আমাদের দিক থেকে শর্ত থাকল কে কিডনি দিয়েছে তার নাম ঠিকানা তারা জানতে পারবে না।ফলে তোর স্বামী,বন্ধুরা কেউ জানল না।সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ তোর শরীরের সাথে আমার কিডনিটা মিলে যাওয়াতে।টাকাটা কেন নিলাম জানবিনা?যদি টাকাটা না নেই,তাহলে তো সন্দেহ হতে পারে।কে তোর শুভাকাঙ্খী,যে টাকা না নিয়ে শুধু কিডনি দিয়েছে,এমনকি নাম ঠিকানাও বলেনি।যেমনটি সিনেমায় দেখা যায়।তাই টাকাটা চেয়েই নিয়েছি এবং সবাইকে বুঝাতে চেয়েছি টাকার প্রয়োজনে কিডনি বিক্রি করা হচ্ছে।
সন্ধ্যায় একই হাসপাতালে ভর্তি হলাম।কিছুটা নিরাপদ দুরত্বে কেবিন নেয়া হল যাতে কারো সাথে দেখা না হয়।আর আমার সাথে সর্বক্ষন থাকল রুম্পা।
বুধবার সকাল ৯টায় ওটিতে নিয়ে যাওয়া হল আমাকে।তোকে বোধহয় সাড়ে নয়টায় নিয়ে গিয়েছিল ওটিতে।পাশাপাশি দুটো ওটি।মাঝে কাচের দেয়াল আর একটা দরজা।বেডে শুয়ে কাচের মধ্য দিয়ে আমি তোকে দেখতে চেষ্টা করলাম।তুই বিছানায় শুয়ে আছিস।তোর চেহারাটা বোঝা যাচ্ছে না।
আস্তে আস্তে ওটি ওুম ডাক্তার ,নার্স দিয়ে ভরে গেল।আমি চোখ বন্ধ করলাম।চোখ বন্ধ করতেই ভার্সিটির বকুল গাছটাকে দেখতে পেলাম।ওখানে একজন দুজন করে ৯জন জড়ো হচ্ছে।গোল হয়ে বসে তাদের মধ্যে চলছে রাজ্যের আড্ডা।বাদাম চিবুতে চিবুতে কিংবা চানাচুর খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে চলছে পড়াশোনা,রাজনীতি,দেশসেবা ইত্যাদি আরও কত কিছু নিয়ে আলোচনা।আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে আসে দৃষ্টি।আর মনে করতে পারি না___।
এই কি খুব ভয় পেলি?হ্যা আমিও ভয় পেয়েছিলাম।ভেবেছিলাম যদি মরে যাই,যদি বেঁচে না উঠি।কিন্তু ভয়কে জয় করার মধ্যেইতো সত্যিকারের আনন্দ।কি বলিস!এই তুই আমার কিডনিটার যত্ন নিচ্ছিসতো।বেশী করে পানি খাবি।ডাক্তার যেভাবে বলে সেভাবে চলবি।আমার কিডনিটার ক্ষতি হলে কিন্তু-----।এই যা তোকে তো বলাই হয়নি আমি বেশ ভাল আছি,সুস্থ আছি।দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছি।আমি একমাস হল ফিরে এসেছি।হাসপাতালে বেশ কদিন ছিলাম।তোর আগেই অবশ্য আমি হাসপাতাল ছেড়েছি।
যেদিন চলে আসব সেদিন এয়ারপোর্টে টিপুর সাথে দেখা।আমাকে হুইল চেয়ারে বসে থাকতে দেখে ও দৌড়ে এগিয়ে এসেছিল।ওকে মিথ্যে বলতে পারিনি।শুধু ওকে অনুরোধ করেছিলাম এখনই তোকে না জানানোর জন্য।বলেছিলাম-নীলা সুস্থ হলে আমিই ওকে জানাব।জানিনা টিপু আমার কথা রেখেছে কিনা!

তোর অপারেশন শেষ হওয়ার পর কাজল ফোন করেছিল।রুম্পা ফোন ধরেছিল।কাজল বলেছে-অপারেশন সাকসেসফুল।ক'দিন পরে কাজল আবার ফোন করেছিল।আমিই ফোন ধরেছিলাম।কাজল বলল-তুই এমন, চলে গেলি।নীলার এ সময়ে কাছে থাকলি না।তারপর বলল-আমরা যখন জানলাম তুই চলে যাচ্ছিস,তখন নীলা বলল-শাহীন পালিয়ে গেল,আমার কাছ থেকে বিদায়ও নিল না"।
দেখলি পালিয়ে কি থাকা যায় বন্ধুর কাছ থেকে।তুই কি পালাতে পেরেছিস,তুইতো পালাতে চেয়েছিলি।নিজের অসুখের কথা চেপে রেখে মৃতু্যকে আলিঙ্গন করে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলি।ঠিকই ধরা পড়ে গেলি।হ্যা আমিও পালাতে পারিনি।আমিও ধরা খেয়ে গেছি।বন্ধুত্বের কাছে,ভালবাসার কাছে।যেখানে বন্ধুত্বের বাইরে স্বার্থের কোন বেচাকেনা নেই।
ও হ্যা টাকার কথা মনে আছে।তোর স্বামীর কাছ থেকে যে তিন লাখ টাকা নিয়েছিলাম।ওটা আমি দেশে রেখে এসেছি।আমার এ্যাকাউন্টে।তুই ,কাজলসহ তোরা ভেবে দেখ এই টাকাটা দিয়ে কি করা যায়।তোর স্বামীকে বা তোকে টাকাটা ফেরত দিব না।তোদেরতো অনেক টাকা।তবে বন্ধুরা মিলেই ঠিক করব টাকাটা কোন ভাল কাজে ব্যবহার করা যায়।সেই যেমন ছাত্রাবস্থায় মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে কোন মহৎ কাজ করা হত।ঠিক তেমনি।এখন টাকার পরিমানটাতো বেশী ,তিন লাখ।কারো জীবনটা যদি বাঁচানো যায়,কিংবা কারো আয়ু যদি আরো কিছুদিন বাড়ানো যায় এরকম কিছু চিন্তাভাবনা কর।কি সিদ্ধান্ত নিলি জানাবি।টাকাটা সেখানে ট্রান্সফার করে দেব।
অনেক বড় হয়ে গেল চিঠিটা।চিঠিতে দুরকম লেখা ঠিকই ধরতে পেরেছিস।আমার লেখাতো চিনিস।বাকি অংশগুলো রুম্পার হাতের লেখা।আমি বলেছি আর ও লিখেছে।ও আমার শুধু স্ত্রী নয়,সী ইজ মাই বেষ্ট ফ্রেন্ড অলসো।কি হিংসে হচ্ছে,হোক।এখানে এখন সূর্য উঠছে।একটু ঠান্ডা বাতাস বইছে।রাতে লেখা শুরু করেছিলাম।কিভাবে যে রাতটি শেষ হয়ে গেল টের পেলাম না।
তুই ভাল থাকিস।চিঠিটা ইচ্ছে হলে তোর স্বামীকে দেখাতে পারিস,আবার নাও পারিস।টুকরো টুকরো করে ছিড়ে আকাশে উড়িয়ে দিস কিংবা আগুনে পুড়িয়ে দিতে পারিস।তোর যা ইচ্ছা তা করিস।চিঠিতো শুধু কাগজে কলমের অাঁকিবুকি।এতো আর বন্ধুত্বের বন্ধন নয়।তোর স্বামী তোর বাড়িতে বন্ধুদের আসা পছন্দ না করলেও,তোকে তোর বন্ধুদের সাথে মিশতে দিতে না চাইলেও কি হবে,আমি ঠিকই তোর স্বামীকে ফাঁকি দিয়ে তোর শরীরে জায়গা করে নিলাম।কি ঠিক বলিনি!কোন দেয়ালই যে সত্যিকারের বন্ধুত্বের পথে বাঁধা হয়ে দাড়াতে পারে না।
ভাল থাকিস বন্ধু আমার,সুস্থ থাকিস,সুখে থাকিস।
ইতি
তোর বন্ধু
শাহীন

আকাশের দিকে তাকায় নীলা।সূর্য কখন যে পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে খেয়ালই করেনি নীলা।গোধুলীর লাল টকটকে সূর্যের আভা ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে।শাড়ীর অাঁচলটাও চোখের জলে কখন যে ভিজে গিয়েছে টেরই পায়নি সে।কোমড়ের বাম পাশে হাত দিয়ে কিডনিটা অনুভব করার চেষ্টা করে নীলা।নিজের অজান্তেই বলে উঠে সে-কিরে বন্ধু কেমন আছিস।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আনিসুর রহমান মানিক এমদাদ হোসেন নয়ন ,তোমাকে অনেক ধন্যবাদ /
আনিসুর রহমান মানিক সেলিনা ইসলাম ,গঠনমূলক মন্তব্যের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ /
আনিসুর রহমান মানিক Fatema Tuz Johra আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ,আপনার অনুভুতি সুন্দরভাবে প্রকাশের জন্য /
সেলিনা ইসলাম নিঃসন্দেহে সুন্দর গল্প তবে বন্ধুর অগোচরে উপকার করে যেমন মহত্বের পরিচয় দিয়েছে ঠিক তেমনি কথাটা আবার চিঠির মারফত দিয়ে নিজেই নিজেকে ছোট করেছে । গল্পের প্রথম থেকে চিঠি পড়ার আগ পর্যন্ত অনেক গম্ভীরতা গল্পে ফুটে উঠেছে তবে শেষের প্যারাটা গল্পের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও ক্ষুন্ন করেছে । তারপরও অনেক অনেক ভাল লিখেছেন ।আশা করি আরও ভাল লেখা অদূরে আমাদেরকে উপহার দিবেন । শুভ কামনা ।
Tahajul Islam Faisal Fatema Tuz Johra আপনি ঠিক বলছেন/
Fatema Tuz Johra একজন মানুষ অন্য মানুষের বিপদে যদি এরকম এগিয়ে আসত আর সবার বন্ধুত্ব যদি এমন হত তাহলে কতইনা ভালো হত.....খুব ভালো লাগলো আপনার গল্পটি.
আনিসুর রহমান মানিক Tahajul Islam Faisal ,সুন্দর মন্তব্যের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ /

২০ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪