আমার মা'র কাছে খোলা চিঠি

মা (মে ২০১১)

আনিসুর রহমান মানিক
  • ২৬
  • 0
  • ৪৮
প্রিয় মা

তুমি কেমন আছ?বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষতার যুগেও তোমার সাথে যোগাযোগের কোন মাধ্যম না পেয়ে খোলা চিঠি লিখছি।মোবাইল, ই-মেইল এর মাধ্যমেও তোমার সাথে যোগাযোগ সম্ভব নয় তাই গল্প কবিতা ডট কমে আমার এই আশ্রয় নেয়া।যদি কখনও কোন সময় আমার এখানে কিংবা অন্য কোন বন্ধুর ওখানে নেটে বসো তাহলে পড়ে নিও চিঠিখানা। এতে হয়তো আমার কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হবে।
কি স্বার্থপরের মতই না কথা বললাম, তাই না মা ! তোমার কষ্ট নিয়ে না ভেবে আমি আমার কষ্টের কথা বললাম।কি করব মা। যাদের তোমার কষ্ট নিয়ে ভাববার কথা ছিল তারাইতো ভাবেনি\\ উপরন্তু তারাই তোমাকে কষ্ট দিয়েছে।
এতক্ষণ শুধুই বকবক করেই চলেছি। আমায় চিনতে পেরেছোতো মা। চিনবে কি করে?আমাকে তো দেখনি।কিন্তু আমার কান্না কি শুনেছিলে?আমি চিৎকার করে কেঁদেছিলাম পৃথিবীকে জানিয়ে দিতে আমি এসেছি।শুধু পৃথিবীকে কেন,আমি আমার পরিবারকে, আমার বংশকে জানিয়ে দিয়েছিলাম আমি এসেছি আর তোমাদের কোন চিন্তা নেই। আমি বংশরক্ষার বিরাট দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে উপস্থিত হয়েছি। পরিবারের সবাই খুশী হয়েছিল। আমাকে নিয়ে সবাই এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে তোমাকে নিয়ে ভাববার সময় তারা পায়নি।
আচ্ছা মা সত্যি করে বলতো তুমি কি আমার কান্না শুনেছিলে?হ্যাঁ আমার কান্না।এক অচেনা অজানা পরিবেশ।সবাই কাঁদে আমিও কেঁদেছিলাম।তোমার শরীরের ভিতরে পানির মধ্যে সাঁতরে বেড়িয়েছিলাম। তুমি আগলে রেখেছিলে।আমি দেখতে না পেলেও বুঝতে পেরেছিলাম।আমার ভালোর জন্যই তুমি কত না সাবধান থাকতে।আর ওরা ! হ্যাঁ,বাড়ির লোকজনগুলোর কথা বলছি।তারা তোমাকে কতই না কষ্ট দিত।এটা খাওয়া যাবেনা,ওটা খাওয়া যাবেনা,ঘুমানো যাবে না ----এরকম কত কি! তুমি তো জানতে এসব যতনা তোমার কিংবা তোমার অনাগত সন্তানের মঙ্গলের জন্য করা হোত তার চেয়ে বেশী করা হত তোমার প্রতি অবহেলা থেকে। তুমি নীরবে কাঁদতে,ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে।আমি শব্দ শুনতে পেতাম না।কিন্তু এখন মনে হয় আমি তোমার জরায়ুর ভেতরে থেকে বুঝতে পারতাম তোমার কান্না ,তোমার কষ্ট।
অথচ দেখো বাড়ির লোকজনের কথা নাহয় বাদই দিলাম কিন্তু তোমার স্বামী মানে আমার বাবা তিনি কি তোমার প্রতি কোন যত্ন নিয়েছিলেন।নেননি। পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজে বংশরক্ষার দায়িত্ব পুরুষের উপর বর্তায়।তাই বংশ রক্ষার দায়িত্ব তুলে নেবার জন্য পুরো পরিবার প্রতীক্ষায় থাকে আমার আগমনের।কবে আসবে একটি পুরুষ শিশু।জন্ম হবে একটি পুত্র সন্তানের।অবশেষে সাতটি কন্যা সন্তানের পর জন্ম হল আমার। পঞ্চম
সন্তানও যখন কন্যা হল তখন মুরুব্বীদের নির্দেশে বংশ রক্ষার অজুহাতে বাবাকে আবার বিয়ে করতে হল।
তুমি বাঁধা দাওনি মা ?দিতে পারনি। তুমি ছিলে গরীবের ঘরের সুন্দরী কন্যা।গরীবের প্রতিবাদ করার শক্তি থাকে না,সাহস তো দুরের কথা। তাই তুমিও প্রতিবাদ করনি।


সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে হবে এটার জন্য যদি কাউকে দায়ী করতে হয় তিনি হলেন বাবা। হ্যাঁ মা বাবা। পিতার সেক্স ক্রোমোজোম নির্ধারণ করে দেয় সন্তানের লিঙ্গ।আজ তাদের জন্য আমার বড় আফসোস হয় কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য যারা তোমাকে দোষারোপ করেছে,অপবাদ দিয়েছে।অথচ বাবার বিয়ে করা দ্বিতীয় ঘরেও জন্ম হল তিনটি কন্যা সন্তানের।
ভাগ্যিস মা আমার জন্ম হয়েছিল না হলে বাবাকে হয়তোবা আবার বিয়ে করতে হোত।

মা তুমি এখন কি করছ? তুমি ভাবছ এটা কোন প্রশ্ন হল?
মার কাছে আবার প্রশ্নের ভালমন্দ আছে নাকি।মায়ের অভাব তোমার রেখে যাওয়া সাতটি কন্যা কখনো বুঝতে দিতে চায়নি।বোনেরা তাদের আদরের ভাইকে মায়ের মমতা দিয়ে বড় করে তুলেছে।
কিন্তু তবুও কিছু থেকে যায়। মা সেতো মাই। ছোট্ট বেলায় যখন বন্ধুদের মাকে দেখেছি তখন হিংসে হয়েছে।আল্লাহকে বলেছি আমার কেন মা নেই। মায়ের স্নেহ ভালবাসা সীমাহীন। আমি জেনেছি , দেখেছি কিন্তু আমি পাইনি। পাইনি বললে আমার বোনদের মন খারাপ হবে হয়তো ,কিন্তু তবুও ভাবি মা ছাড়া সন্তান কি করে বাঁচতে পারে?মায়ের দুধ কখনো খাইনি। খাওয়ার সুযোগ হয়নি।তুমি হয়তো ভাবছ কেন তোর তো আরেক মা ছিল।হ্যাঁ ছিল,সে মায়েরও স্নেহ ছিল। কিন্তু তারপরও তিনি সৎ মা।
আচ্ছা মা সেই মাকেও নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট পেতে হয়েছে। সেও যে কন্যা
সন্তান জন্ম দিচ্ছিল।ভাগ্যিস সে সময় বিজ্ঞানের এত উন্নতি হয়নি তাহলে হয়তো আল্ট্রাসনোগ্রাম করে লিঙ্গ দেখে গর্ভস্থ কন্যা সন্তানকে হত্যা করা হত।
শুনেছি, মায়ের শাড়ীর আঁচলে একটা গন্ধ থাকে । তোমার শাড়ীর আঁচলেও নিশ্চয়ই একটা গন্ধ মাখা ছিল।যখন বুঝতে শিখেছি ,তোমার শাড়ীর আঁচল খুঁজেছি গন্ধ পাবো বলে।
স্কুল থেকে ফিরে এঘর ওঘর তোমাকে খুঁজে বেরিয়েছি। অনেকে হেসেছে। যে ছেলে তার মাকে দেখেনি আর সে কিনা তাকে খোঁজে।
হ্যাঁ মা আমিও ভেবেছি, তাইতো আমিতো মাকে দেখিনি,মায়ের স্নেহ ভালবাসা পাইনি তাহলে কেন খুঁজি। মার ভালবাসা এত স্বর্গীয়, অকৃত্রিম যে হয়তো সে কাড়নেই সবসময় একটা শুন্যতা অনুভব করেছি।
তুমিও হয়তো জীবনে একটা শুন্যতা অনুভব করতে।তোমারও হয়তো একটা প্রতীক্ষা ছিল একটা পুত্র সন্তানের। সেটা নিশ্চয়ই বংশরক্ষা কিংবা তোমার সংসার টিকিয়ে রাখার স্বার্থে নয়। হলেও বা দোষের কি! তুমি তো অন্য কন্যা সন্তানদের স্নেহ ভালবাসা থেকে দুরে রাখতে না। মার কাছে সন্তান তো
সন্তানই। তাইতো তুমিও তাদের স্নেহ ভালবাসা দিয়েছো।
প্রতিবার গর্ভবতী হলে তুমিও হয়তো ভাবতে এবার ছেলে হবে। তাইতো ষষ্ঠ সন্তান জন্মাবার পর আবার যখন গর্ভে সন্তান এল সুন্দর একটা কাঁথা সেলাই করে লিখলে, ওরে আমার সোনা মানিক।
কিন্তু না, ছেলে হল না। আবারও অপেক্ষা। কাঁথাটা সযত্নে রেখে দিলে ছেলে সন্তানকে জড়িয়ে কোলে নিবে বলে।
হ্যাঁ অবশেষে ছেলে সন্তান এল।কিন্তু তোমার আর সুযোগ হল না তাকে সেই কাঁথায় জড়িয়ে কোলে নেয়ার।
আমি সেই কাঁথায় কতই না শুয়েছি। বোনেরা পরম মমতায় সেই কাঁথায় আমায় জড়িয়ে ধরে আদর করেছে,ঘুম পাড়িয়েছে।




সেই কাঁথাটা অনেক যত্নে আমি এখনও রেখে দিয়েছি।এখনও আমার কষ্ট হলে আমি ঐ কাঁথা জড়িয়ে ধরি। ওখানে তোমার পরশ পাই। আমার কষ্ট দূর হয়ে যায়।
মা তুমি দেখতে কেমন ছিলে ?শুনেছি তুমি নাকি অনেক সুন্দর ছিলে। সবাই বলে আমার চোখদুটো নাকি তোমার মত।কেউ কেউ বলে আমি নাকটা পেয়েছি তোমার কাছ থেকে।আমি আয়নার সামনে গিয়ে বসি। তোমাকে দেখতে বড় ইচ্ছে হয়।
আমি আমার হৃদয়ে তোমার একটা ছবি এঁকে নিয়েছি।সেটা আমি কাউকে দেখাই না। আমার মাকে আমি কাউকে দেব না। ভাবছ আমি স্বার্থপর । হ্যাঁ আমি স্বার্থপর।আমি আমার মার কাছ থেকে সব ভালবাসা নেব।
আমি অনুভব করি সবসময় আমার পাশে একটা অশরীরি আত্মা থাকে। জানি সেটা আমার মা। তাইতো এ পর্যন্ত কখনো আমি বিপদে পড়িনি।সেই মাই আমাকে রক্ষা করেন।আমি কখনো খারাপ কিছু করতে পারিনা।সেই অদৃশ্য মানুষটি যেন আমাকে টেনে ধরে। বুঝতে পারি মা আমাকে বাঁধা দিচ্ছেন, অন্যায় কিছু না করতে।সবসময়ই মা আমার পাশে থেকে ভালবেসে চলছেন।
মা এখন অনেক রাত। বোনদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে।বাবা একটা ভাল কাজ করেছেন। মৃত্যুর আগে তার সম্পত্তি দু'ঘরের সন্তানদের মাঝে বণ্টন করে দিয়ে গেছেন।এখানে কোন বৈষম্য করেননি।

বিরাট এ আভিজাত্য ঘেরা বাড়িতে দোতলার এক কোনার ঘরে কম্পিউটার টেবিলে বসে তোমায় চিঠি লিখছি।তোমার পুত্রবধূ মোনালিসা তার দু"বছরের কন্যা সন্তানকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে।আমিও অনেকসময় চোখ বন্ধ করে তোমার কোলে শুয়ে ঘুমাই। তুমি ঘুমপাড়ানি গান শোনাও।রূপকথার গল্প শোনা ও।

রাগ করো না মা। আজ একটু বেশী রাত হয়ে গেল।আমি এখনই ঘুমাতে যাব।চিঠিতে অনেক কথা লিখে ফেললাম,অগোছালোও হয়তো।তুমি কিছু মনে করো না মা।ও আর একটা কথা তোমাকে না বললেই নয়। আমি যখন থেকে ভালমন্দ বুঝতে শিখেছি তখন থেকে আমি আর আমার জন্মদিন পালন করিনা।বলতে পারো একটা অপরাধ বোধ আমার মধ্যে কাজ করে।আমার জন্ম না হলে হয়তো তুমি ------।জন্ম মৃত্যু আল্লাহর হাতে,এটা ভেবে সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করি।তারপরও মনে হয় আমার জন্ম না হলে হয়তো তোমার মৃত্যু হতো না , একলাম্পশিয়ায় তুমি মারা যেতে না।

কম্পিউটার এর কি বোর্ডে আমার আঙ্গুল আটকে যাচ্ছে। আমি আর লিখতে পারছি না। জানালার পর্দা উড়ছে। দোতলার এ ঘর থেকে দামী টাইলস এ বাঁধানো তোমার কবরটা দেখা যাচ্ছে। তুমিও নিশ্চয়ই ওখান থেকে আমাকে দেখছ। কিংবা আরও কাছে হয়তো আমারই পাশে থেকে।
মহান সৃষ্টিকর্তা তোমায় ভাল রাখুন। সব মায়েরাই যেন ভাল থাকেন।

ইতি

তোমার রেখে যাওয়া মানিক সোনা
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আনিসুর রহমান মানিক যারা আমার মা'র কাছে লেখা খোলা চিঠিটি কষ্ট করে পড়েছেন ,তাদের সবার প্রতি রইলো আন্তরিক কৃতজ্ঞতা /মহান সৃষ্টিকর্তা সকল মাকে যেন জান্নাতবাসী করেন ,আসুন সৃষ্টিকর্তার কাছে এই প্রার্থনা করি /
আনিসুর রহমান মানিক যারা আমার মা'র কাছে লেখা খোলা চিঠিটি কষ্ট করে পড়েছেন ,তাদের সবার প্রতি রইলো আন্তরিক কৃতজ্ঞতা /মহান সৃষ্টিকর্তা সকল মাকে যেন জান্নাতবাসী করেন ,আসুন সৃষ্টিকর্তার কাছে এই প্রার্থনা করি /
বিন আরফান. মায়ের প্রতি ভালবাসা দেখে আমি মুগ্ধ. গল্প যদিও তার প্রকৃত রূপ পায় নি. তাতে কি ? মাকে ভালবাসি ভালবাসব তত মন খুলে বলতে পেরেছি. পেরেছি মায়ের শূন্যতা আমায় কতযে যন্ত্রণা দেয় তা প্রকাশ করতে. হৃদয় ছুয়ে গেল. সামনে ভালো গল্প চাই, খোলা চিঠি নয়. শুভ কামনা রইল.
আনিসুর রহমান মানিক ধন্যবাদ আরাফাত মুন্না আপনাকে ,কষ্ট করে মার কাছে লেখা চিঠিটি পড়ার জন্য /
আরাফাত মুন্না তুমি নিজেই অসাধারণ।
আনিসুর রহমান মানিক Shahnaj Akter আপনাকে ধন্যবাদ চিঠিটি পড়ার জন্য /
শাহ্‌নাজ আক্তার khub e abeg die likha ..........valo legeche. shuvokamona..............................
আনিসুর রহমান মানিক আমার মার কাছে লেখা চিঠিটি আপনারা কষ্ট করে পড়েছেন ,সুন্দর মন্তব্য করেছেন ,আপনাদের সবার প্রতি রইলো কৃতজ্ঞতা ও অনেক অনেক ধন্যবাদ /@মৎস কন্যা@শফিকুল ইসলাম @তৌহিদ উল্লাহ শাকিল @মামুন ম.আজিজ /
মামুন ম. আজিজ মাতৃহারা সন্তানের বিস্তর আবেগ।
sakil একটা চিঠি ও অনেক সময় সুন্দর একটা গল্প সুন্দর একটা কাহিনী হয়ে উঠে আপনার চিঠি তা তারই প্রমান boye ane . অনেক সুন্দর একটা লেখা . সালাম ভাই . ...................

২০ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪