শোক গাঁথা

গণহত্যা (অক্টোবর ২০২৪)

Mst Shahanaz Begum
  • 0
  • ৭০
শরতের আকাশ । এখানে ওখানে থোকা থোকা মেঘ । কালো মেঘ, সাদা মেঘ, তুলোর মত মেঘ , মেঘের অন্ত নেই ।যেন পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে । মেঘের ফাঁকে ফাঁকে নির্মল নীল । সুড়ংগপথ দিয়ে বয়ে চলেছে সূর্য । কখনো রোদ হচ্ছে কখনো বৃষ্টি । কোনটায় কম নয় ।প্রখর । রোদে বের হলে মনে হচ্ছে এই বুঝি মাথা ফেটে গেল রে।বৃষ্টি এলেও ভিজে একাকার ।
এই রোদ বৃষ্টিকে তোয়াক্কা না করে পথে নেমে এলো একঝাঁক মানুষ । ক্রমে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে ।এক সময় এমন রুপ ধারণ করল যেন জনসমুদ্র। এরা সবাই ছাত্র । ষোল থেকে ত্রিশের মধ্যে এদের বয়স । যেন আসমান হতে জান্নাতিরা নেমে এসেছে । জান্নাতবাসীরা সবাই ঠিক এই বয়সের হবে ।এদের কেউ ফর্সা কেউ কালো কারো নাক উচু কারোবা চেপ্টা হলে কি হবে এ সব চোখে পড়ছে না , পড়ছে শুধু মানুষ আর মানুষ । যেন একটা ফুলের অনেকগুলি পাপড়ি । শরতের প্রভাতে পুকুরের জলে ফুটন্ত শাপলার মত দেখা যাচ্ছে এদের ।কে যেন কেন এদের মনে হানা দিয়েছে ।ঠিক যেমন মৌমাছির মৌচাকে দুষ্টু চিল হানা দিলে হয়।
এরা আজ পথে নেমেছে অধিকার আদায়ের জন্য । এদের স্লোগানে পথঘাট মুখরিত । মেয়েরাও আছে এখানে। শহরের রাজপথের ধারের বিরাট বিরাট বৃক্ষগুলিতে আর দালানগুলিতে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল সেই স্লোগান । আবালবৃদ্ধবনিতা তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে ।
এই মিছিলের মধ্যমনি হয়ে রয়েছে মাহিন , নদী, আশা, বৃষ্টি, সাগর আর মিজান। এরা আরো অনেকের মত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র । সবার আগে রয়েছে এরা । বেনার ধরে আছে মাহিন ও আশা । হঠাৎ ফটাস করে আওয়াজ ।সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গেল মিজান । ওর বুক দিয়ে ধড় ধড় রক্ত পড়ছে। ওকে তুলতে না তুলতেই আরেকজন,আরেকজনকে তুলতে আরেকজন,আরেকজন ----- ।বিরোধীরা দু হাত দিয়ে গুলি ছুড়ছে ।যেন এরা কেউ না ।পাখির সমানও দাম নাই এদের। ওরায় সব ।
সরকারি পুলিশ আর্মিরাও ওদের পক্ষ নিয়েছে ।
চারোদিকে গুলি ছোড়ার ভটভটানি শব্দ। ইন্টার নেট নন্ধ । কোথাও কোন সংবাদ দেওয়া নেওয়ার উপায় নাই ।কতকগুলো গুলি মিছিলের বাইরের লোকজনদের লাগল ।
ধরা ধরি করে নিয়ে যাওয়া হলো আহতদের হাসপাতালে । অনেকের তখনেই প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল কেউবা বেঁচে রইল পঙ্গুত্বের আশংকা নিয়ে ।

দ্বিতীয় দিন, নিরব নিদাঘ নিলীমায় । কোথাও কোন মেঘ নাই ।বৃষ্টি হওয়ার আজ কোন লক্ষনই নেই । এরকম দিনকে তাপদাহ বলে ঘোষণা দেওয়া হয় । স্কুল কলেজগুলো বন্ধ থাকে ।মানুষকে বাড়িতে অবস্থান করার নির্দেশ দেওয়া হয় । এবারেও স্কুল কলেজ বন্ধ থাকবে কি না তা বোঝা যাচ্ছিল না । ঠিক এরকম একটা বৈরী আবহাওয়ায় বেরিয়ে পড়ল ছাত্ররা । আজ আরো বিপুলহারে সমাবেশ । আজ মূল স্লোগান আমার ভাই মরল কেন ? রুপকথার গল্পতে আমরা শুনেছি যে রাক্ষস পুরির রাক্ষসকে মারতে গিয়ে যদি একটাফোটা রক্ত মাটিতেপড়ে তাহলে আরো শত শত রাক্ষস বেড়ে যাবে । ঠিক তেমিনি ব্যাপারটা ঘটে গেছে । যতই বিরধীদল চেষ্টা করছে দমন করতে ততই বেড়ে যাচ্ছে ।আবারো দুম দুম শব্দ । আবারো রাশি রাশি লাশ ।আবারো রক্তের বন্যা । সৈনিকরা কাঁদুনে গ্যাস ছাড়ল । গরম পানি ছিটাল ।ছত্র ভংগ হলো ছাত্রদের দল ।কোন যোগাযোগ ছাড়ায় কিভাবে যে এতগুলো মানুষ জোগাড় হয়েছিল তা ধারণার বাহির ।
দ্বিতীয় দিনের এই অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছিল নিরব, শামিম , তামিম , মিলি , রুনা আরো কয়েকজন ।
মৃত্যু অবধারিত জেনেও শামিম ও তামিম সামনে ছিল । গুলি লাগলে তো সামনের জনকেই আগে লাগবে। এটা জেনেও ওরা পিছনে হয়নি ।ভাইয়ের মৃত্যুর দাবিতে ওরা পাগলপারা। আবারো ওদের হাসপাতালে নেওয়া আবারো কিছু মৃত্যু আবারো কিছু পঙ্গুত্বের আশংকা ।সাধারণ জনগণও মরল কয়েকজন। আহা বেচারিরা এসেছিল হাটবাজার করতে । চিরোতরের তরে বেচাকেনা শেষ। কে জানে এদের ঠিকানা । ফেসবুকে ছবি দিবে নেট তো নাই। মাঠে খেলছিল কয়েকজন শিশু । গুলি লেগে এদেরও একজন মারা গেল।

তৃতীয় দিন , তুমুল হারে বৃষ্টি নামছে ।বৃষ্টি ছাড়ার কোন লক্ষণ নাই । শরতের আকাশ কোনটায় স্থায়ী নয় । আবার ছাড়তেও পারে ।হ্যাঁ হ্যাঁ বৃষ্টি থামল ,রাস্তায় বেরিয়ে এলো অসংখ্য মানুষ । শুধু ছাত্রই নয় বিভিন্ন পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ ।নারী ও কিশোর কিশোরীও বাদ যায় নি । এরা অনেকেই শহীদ বা আহতদের আত্মীয় আবার অনেকেউ কেউ কারো নয়।জাতীর টানে বেরিয়ে পড়েছে ।এরা এক জাতী ।জাতী বলতে সাধারণ জাতী । এদের কোন কোটা নেই ।এরা বিশেষ কোটা হতে বঞ্চিত । আজ যদি কোটা ধারিরাও বের হত এক কোনার একটি অংশের সমান দেখা যেত । যেন এক বিরাট মাঠে একটা আংটি পড়ে থাকার মত।
এদের আজ একদফা এক দাবি বরোধীদলকে মানতেই হবে ।নইলে শুরু হবে ধর পাকড় ভাংচুর ।এরা কেউ আর মৃত্যুকে ভয় করছে না । এরা এখন মরতে শিখেছে । আজ আর দুম দাম শব্দ হচ্ছে না । এগিয়ে চলছে সমাবেশ । কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌছে যাবে লক্ষ্যস্থানে ।
গোপন কক্ষে আলোচনায় বসেছে বিরোধীদল ।এখানে প্রায় তিনশতজন মানুষ রয়েছে ।সকলেই ভীত সন্ত্রস্ত।এখন কি করা উচিত এরা ভেবে পাচ্ছিল না। দলনেতা বলল ওদের ঠেকাতে। একজন বলে উঠল - কিভাবে ঠেকাব পরিস্থিতি আর সেরকম নেই । এখন ঠেকাতে গেলে নিজেকেই মরতে হবে ।ওরা এদিকেই আসছে । কিছুক্ষনের মধ্যে ঘেরাও করে ফেলবে আমাদের ।
আরেকজন বলল এখনই আমাদের তাড়াতাড়ি সরিয়ে পড়া উচিত, এখনই । কিন্তু কোথায় সরব কীভাবে ?
একজন দলনেতাকে আঙ্গুল তুলে বলল আজ তোর জন্যই তো এরকম হলো ,তুই তো আমাদের গুলি ছোড়ার আদেশ দিয়েছিলি ।
আরেকজন বলল-ও সব বলে এখন লাভ নাই, আগে জীবনটা তো বাঁচাও । হ্যাঁ এখনেই আমাদেরর আয়না ঘরে ঢুকে পড়া উচিত ।মিন্টুর কাছে থাকবে চাবি ও সব খাওয়াদাওয়ার যাবতীয় ব্যাবস্থা করবে ।
দলনেতা আবার বলল – আয়নাঘর তাড়াতাড়ি খালিকরা হোক।বন্দিদের যেভাবে আনা হয়েছিল ঠিক সে ভাবেই ফেলে দিয়ে আস।তারপর ঢুকে পড় সবাই।
যেই কথা সেই কাজ । হিড় হিড় করে ঢুকে গেল সবাই আয়না ঘরে । বাহির থেকে খটাস। তালা বন্ধ করল মনটু ।
কপাল ছিল বামে কিছুক্ষণের মধ্যেই মন্টু ধরা পড়ল জনগণের হাতে । মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল সে ।
আয়না ঘরের খবর আর কেউ পেল না পাবেও না। গলে পচে মরবে সেই ঘরের বাসিন্দারা। আয়না ঘরটা ছিল মাটির নিচে বিশেষ ভাবে তৈরী একটা গোপন কক্ষ।প্রায় দেড়যুগ ধরে এখানে চলছিল নানা অপকর্ম । গোপনে বিদ্রোহীদের ধরে আনা হত শাস্তি দেওয়া হত নানা ভাবে ।
এবার নিজের ফাঁদে নিজেরায় ধরা পড়ল পিসাচের দল।
ক্রমে এগিয়ে এলো ছাত্র জনতার দল । কাউকে পেলনা তারা। নানাভাবে ভাংচুর শুরু করল । হাসল গাইল নাচল। এভাবে নিজ অধীকার আদায় করল তারা।এদের আমি প্রায় সকলকেই চিনি । এরা সবাই আমার আশেপাশের মানুষ, আমার মতই জনসা ধারণ । ইচ্ছা করছে এদের প্রত্যেকের সম্পর্কে অনেক কিছু লিখি । কিন্তু অত কি লেখা সম্ভব? দুনিয়ার কেউ পারবে না এত মানুষের কথা লিখতে ।এমনকি আপনিও না । আমি এখানে দু চার জনের কথা লিখছি । পারলে আপনিও লেখেন । এভাবে ভাগে যোগে লিখলে হয়ত সবার কথা লেখা সম্ভব হবে।আর যারা আয়না ঘরে রয়েছে ওদের কথা লেখা দরকার নাই । কেননা ওরা বহুরুপি। ওরা একেক জায়গায় একেক রূপ ধারণ করে । ওদের সঠিক পরিচয় কেউ জানেনা । লিখবেন কী করে ?
মাহিন ও আশা দু জনেই ছিল ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্র । এ রকমই এক শিউলি ঝরা প্রভাতে প্রথম দেখা হয়েছিল ওদের । তারপর কেটে গেছে কয়েকটি বছর ।ওরা দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসত ।কথাছিল পড়ালেখা শেষে মাহিন একটা ভালো চাকরি নিবে তারপর বিয়ে ।দুজন মিলে সুখের সংসার বাধবে। অনেকগুলো ছেলেমেয়ে হবে ওদের ।সুন্দর করে লালান পালন করে মানুষ করবে তাদের । কিন্তু একি হলো! স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল । স্বপ্নগুলো মিলে গেল ঝরা শিউলি গুলির সাথে । মাহিন শহীদ হয়ে গেছে প্রথম দিনে । আশা এখন আশার স্মৃতিগুলো নিয়ে নিরাশায় ভুগছে । দারুন কষ্ট হচ্ছে ওর ।
ওই দিন পড়ার টেবিল ছেড়ে অধীকার আদায়ের মিছিলে যোগ দিয়েছিল মাহিন । এছাড়া তো উপায় ছিল না । মাহিন ছিল সাধারণ ঘরের ছেলে । বাবা ,দাদা , নানা কেউ মুক্তিযোদ্ধা নয় ।একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে গ্রামশুদ্ধ পুরুষ মানুষকে গণহত্যা করা হয়েছিল । দু একজন ছিটেফোটা হয়ে বেঁচে ছিল। এই ছিটেফোটা মানুষ গুলির একজনের বংশধর মাহিন ।দাদী এখনো পুলিশ দেখলে ভয় পায় । ঢোকে ঢোকে পানি খায় , থর থর করে কাঁপে ।পোষাকধারী মানুষকে দেখলে তার মেলেটারিদের কথা মনে পড়ে তাই সে এমন করে ।
মাহিনের মত আরো একজন শহীদ শামিম । শামিম ছিল পিতামাতার একমাত্র সন্তান । মা বাবা তাকে ছেড়ে একটি দিনও কোথাও কাটায় নি । ছেলের মৃত্যুর পর কি যে অবস্থা তাদের তা কল্পনাতীত ।বাবার ঘাড়ে সন্তানের লাস পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী লাস। বাবা মনে মনে আগে বিরোধী দলের পক্ষে ছিলেন ।আজ এ অপকর্মের জন্য ঘৃণায় তার মন বিগলিত । ইচ্ছা করছে দলনেতাকে পেলে চিবিয়ে খাবেন । তার চোখে আজ পানি নাই সেখানে জ্বলছে প্রতিশোধের বিরাট আগ্নেয়গিরি।
নিরব নামের ছেলেটিও শহীদ হয়েছে । বড়ই শান্ত ছিল ছেলেটি । মা বাবা তাই আদর করে নাম রেখেছিল নিরব। নিরব বরাবরই ফাস্ট হত । পড়া লেখা ছাড়া কিছুই বুঝত না । ইতিমধ্যে সে দু চারটি চাকরির পরীক্ষা দিয়েছে কিন্তু চাকরি হয়নি চাকরি হয়েছে পাশের বাড়ির কোটাধারি ছেলেদের যারা কিনা খুবই অলস প্রকৃতির আর কম মেধাবী। গ্রাম শুদ্ধ মানুষ নিরবকে হেয় চোখে দেখা শুরু করেছিল আর কোটাধারীদের প্রসংশায় পঞ্চমুখী হয়ে পড়েছিল । নিরব এ লজ্জা সহ্য করতে পারেনি । সে যোগ দিয়েছিল এ মিছিলে । তারপর অধিকার আদায় করে বাড়ি ফিরেছিল সে কিন্তু লাস হয়ে ফিরেছিল । এখন গ্রাম শুদ্ধ মানুষ তার জন্য কাঁদে ।তারা এখন আসল ব্যাপারটা বোঝে।
জনগণের গণপিটুনীতে গুটিকয়েক পুলিশও মরে গিয়েছিল যারা এ গণ হত্যা করার ইন্ধন জুগিয়েছিল তারা তো রয়েছে এ সি রুমে বসে আর মরল সাধারণ মানুষ ।
এভাবে যদি লিখতেই থাকি এই শহীদদের কথা শেষ হবে না। এরা আমাদেরই সন্তান । এদের আমাদের চিরোদিন মনেরাখা উচিত ।এরা আমাদের শিখিয়েছে কিভাবে অধিকার আদায় করতে হয় । যে জাতীর বুকের উপর দিয়ে বয়ে যায় শোণিতের বন্যা সে জাতী কখনো উন্নতি লাভ করতে পারেনা । সে বন্যায় ভেসে যায় উন্নতির সকল চাবিকাঠি রয়ে যায় শুধু অফুরান শোকগাঁথা।
শোকগাঁথা

১৪আগস্ট ২০২৪, সংখ্যা গণহত্যা
প্রথম দিন । শরতের আকাশ । এখানে ওখানে থোকা থোকা মেঘ । কালো মেঘ সাদা মেঘ তুলো মেঘ ,মেঘের অন্ত নেই ।যেন পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে । মেঘের ফাঁকে ফাঁকে নির্মল নীল । সুড়ংগপথ দিয়ে বয়ে চলেছে সূর্য । কখনো রোদ হচ্ছে কখনো বৃষ্টি । কোনটায় কম নয় ।প্রখর । রোদে বের হলে মনে হচ্ছে এই বুঝি মাথা ফেটে গেল রে।বৃষ্টি এলেও ভিজে একাকার ।
এই রোদ বৃষ্টিকে তোয়াক্কা না করে পথে নেমে এলো একঝাঁক মানুষ । ক্রমে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে ।এক সময় এমন রুপ ধারণ করল যেন জনসমুদ্র। এরা সবাই ছাত্র । ষোল থেকে ত্রিশের মধ্যে এদের বয়স । যেন বেহেস্ত হতে অপ্সরি নেমে এসেছে । জান্নাতবাসীরা সবাই ঠিক এই বয়সের হবে ।এদের কেউ ফর্সা কেউ কালো কারো নাক উচু কারোবা চেপ্টা হলে কি হবে এ সব চোখে পড়ছে না পড়ছে শুধু মানুষ আর মানুষ । যেন একটা ফুলের অনেকগুলি পাপড়ি । শরতের প্রভাতে পুকুরের জলে ফুটন্ত শাপলার মত দেখা যাচ্ছে এদের ।কে যেন কেন এদের মনে হানা দিয়েছে ।ঠিক যেমন মৌমাছির মৌচাকে দুষ্টু চিল হানা দিলে হয়।
এরা আজ পথে নেমেছে অধিকার আদায়ের জন্য । এদের স্লোগানে পথঘাট মুখরিত । মেয়েরাও আছে এখানে। শহরের রাজপথের ধারের বিরাট বিরাট বৃক্ষগুলিতে আর দালানগুলিতে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল সেই স্লোগান । আবালবৃদ্ধবনিতা তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে ।
এই মিছিলের মধ্যমনি হয়ে রয়েছে মাহিন , নদী, আশা, বৃষ্টি, সাগর আর মিজান। এরা আরো অনেকের মত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র । সবার আগে রয়েছে এরা । বেনার ধরে আছে মাহিন ও আশা । হঠাত ফটাস করে আওয়াজ ।সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গেল মিজান । ওর বুক দিয়ে ধড় ধড় রক্ত পড়ছে। ওকে তুলতে না তুলতেই আরেকজন,আরেকজনকে তুলতে আরেকজন,আরেকজন ----- ।বিরোধীরা দু হাত দিয়ে গুলি ছুড়ছে ।যেন এরা কেউ না ।পাখির সমানও দাম নাই এদের। ওরায় সব ।
সরকারি পুলিশ আর্মিরাও ওদের পক্ষ নিয়েছে ।
চারোদিকে গুলি ছোড়ার ভটভটানি শব্দ। ইন্টার নেট নন্ধ । কোথাও কোন সংবাদ দেওয়া নেওয়ার উপায় নাই ।কতকগুলো গুলি মিছিলের বাইরের লোকজনদের লাগল ।
ধরা ধরি করে নিয়ে যাওয়া হলো আহতদের হাসপাতালে । অনেকের তখনেই প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল কেউবা বেঁচে রইল পঙ্গুত্বের আশংকা নিয়ে ।

দ্বিতীয় দিন, নিরব নিদাঘ নিলীমায় । কোথাও কোন মেঘ নাই ।বৃষ্টি হওয়ার আজ কোন লক্ষনই নেই । এরকম দিনকে তাপদাহ বলে ঘোষণা দেওয়া হয় । স্কুল কলেজগুলো বন্ধ থাকে ।মানুষকে বাড়িতে অবস্থান করার নির্দেশ দেওয়া হয় । এবারেও স্কুল কলেজ বন্ধ থাকবে কি না তা বোঝা যাচ্ছিল না । ঠিক এরকম একটা বৈরী আবহাওয়ায় বেরিয়ে পড়ল ছাত্ররা । আজ আরো বিপুলহারে সমাবেশ । আজ মূল স্লোগান আমার ভাই মরল কেন ? রুপকথার গল্পতে আমরা শুনেছি যে রাক্ষস পুরির রাক্ষসকে মারতে গিয়ে যদি একটাফোটা রক্ত মাটিতেপড়ে তাহলে আরো শত শত রাক্ষস বেড়ে যাবে । ঠিক তেমিনি ব্যাপারটা ঘটে গেছে । যতই বিরধীদল চেষ্টা করছে দমন করতে ততই বেড়ে যাচ্ছে ।আবারো দুম দুম শব্দ । আবারো রাশি রাশি লাশ ।আবারো রক্তের বন্যা । সৈনিকরা কাঁদুনে গ্যাস ছাড়ল । গরম পানি ছিটাল ।ছত্র ভংগ হলো ছাত্রদের দল ।কোন যোগাযোগ ছাড়ায় কিভাবে যে এতগুলো মানুষ জোগাড় হয়েছিল তা ধারণার বাহির ।
দ্বিতীয় দিনের এই অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছিল নিরব, শামিম , তামিম , মিলি , রুনা আরো কয়েকজন ।
মৃত্যু অবধারিত জেনেও শামিম ও তামিম সামনে ছিল । গুলি লাগলে তো সামনের জনকেই আগে লাগবে। এটা জেনেও ওরা পিছনে হয়নি ।ভাইয়ের মৃত্যুর দাবিতে ওরা পাগলপারা। আবারো ওদের হাসপাতালে নেওয়া আবারো কিছু মৃত্যু আবারো কিছু পঙ্গুত্বের আশংকা ।সাধারণ জনগণও মরল কয়েকজন। আহা বেচারিরা এসেছিল হাটবাজার করতে । চিরোতরের তরে বেচাকেনা শেষ। কে জানে এদের ঠিকানা । ফেসবুকে ছবি দিবে নেট তো নাই। মাঠে খেলছিল কয়েকজন শিশু । গুলি লেগে এদেরও একজন মারা গেল।

তৃতীয় দিন , তুমুল হারে বৃষ্টি নামছে ।বৃষ্টি ছাড়ার কোন লক্ষণ নাই । শরতের আকাশ কোনটায় স্থায়ী নয় । আবার ছাড়তেও পারে ।হ্যাঁ হ্যাঁ বৃষ্টি থামল ,রাস্তায় বেরিয়ে এলো অসংখ্য মানুষ । শুধু ছাত্রই নয় বিভিন্ন পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ ।নারী ও কিশোর কিশোরীও বাদ যায় নি । এরা অনেকেই শহীদ বা আহতদের আত্মীয় আবার অনেকেউ কেউ কারো নয়।জাতীর টানে বেরিয়ে পড়েছে ।এরা এক জাতী ।জাতী বলতে সাধারণ জাতী । এদের কোন কোটা নেই ।এরা বিশেষ কোটা হতে বঞ্চিত । আজ যদি কোটা ধারিরাও বের হত এক কোনার একটি অংশের সমান দেখা যেত । যেন এক বিরাট মাঠে একটা আংটি পড়ে থাকার মত।
এদের আজ একদফা এক দাবি বরোধীদলকে মানতেই হবে ।নইলে শুরু হবে ধর পাকড় ভাংচুর ।এরা কেউ আর মৃত্যুকে ভয় করছে না । এরা এখন মরতে শিখেছে । আজ আর দুম দাম শব্দ হচ্ছে না । এগিয়ে চলছে সমাবেশ । কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌছে যাবে লক্ষ্যস্থানে ।
গোপন কক্ষে আলোচনায় বসেছে বিরোধীদল ।এখানে প্রায় তিনশতজন মানুষ রয়েছে ।সকলেই ভীত সন্ত্রস্ত।এখন কি করা উচিত এরা ভেবে পাচ্ছিল না। দলনেতা বলল ওদের ঠেকাতে। একজন বলে উঠল - কিভাবে ঠেকাব পরিস্থিতি আর সেরকম নেই । এখন ঠেকাতে গেলে নিজেকেই মরতে হবে ।ওরা এদিকেই আসছে । কিছুক্ষনের মধ্যে ঘেরাও করে ফেলবে আমাদের ।
আরেকজন বলল এখনই আমাদের তাড়াতাড়ি সরিয়ে পড়া উচিত, এখনই । কিন্তু কোথায় সরব কীভাবে ?
একজন দলনেতাকে আঙ্গুল তুলে বলল আজ তোর জন্যই তো এরকম হলো ,তুই তো আমাদের গুলি ছোড়ার আদেশ দিয়েছিলি ।
আরেকজন বলল-ও সব বলে এখন লাভ নাই, আগে জীবনটা তো বাঁচাও । হ্যাঁ এখনেই আমাদেরর আয়না ঘরে ঢুকে পড়া উচিত ।মিন্টুর কাছে থাকবে চাবি ও সব খাওয়াদাওয়ার যাবতীয় ব্যাবস্থা করবে ।
দলনেতা আবার বলল – আয়নাঘর তাড়াতাড়ি খালিকরা হোক।বন্দিদের যেভাবে আনা হয়েছিল ঠিক সে ভাবেই ফেলে দিয়ে আস।তারপর ঢুকে পড় সবাই।
যেই কথা সেই কাজ । হিড় হিড় করে ঢুকে গেল সবাই আয়না ঘরে । বাহির থেকে খটাস। তালা বন্ধ করল মনটু ।
কপাল ছিল বামে কিছুক্ষণের মধ্যেই মন্টু ধরা পড়ল জনগণের হাতে । মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল সে ।
আয়না ঘরের খবর আর কেউ পেল না পাবেও না। গলে পচে মরবে সেই ঘরের বাসিন্দারা। আয়না ঘরটা ছিল মাটির নিচে বিশেষ ভাবে তৈরী একটা গোপন কক্ষ।প্রায় দেড়যুগ ধরে এখানে চলছিল নানা অপকর্ম । গোপনে বিদ্রোহীদের ধরে আনা হত শাস্তি দেওয়া হত নানা ভাবে ।
এবার নিজের ফাঁদে নিজেরায় ধরা পড়ল পিসাচের দল।
ক্রমে এগিয়ে এলো ছাত্র জনতার দল । কাউকে পেলনা তারা। নানাভাবে ভাংচুর শুরু করল । হাসল গাইল নাচল। এভাবে নিজ অধীকার আদায় করল তারা।এদের আমি প্রায় সকলকেই চিনি । এরা সবাই আমার আশেপাশের মানুষ, আমার মতই জনসা ধারণ । ইচ্ছা করছে এদের সম্পর্কে অনেক কিছু লিখি । কিন্তু অত কি লেখা সম্ভব? দুনিয়ার কেউ পারবে না এত মানুষের কথা লিখতে ।এমনকি আপনিও না । আমি এখানে দু চার জনের কথা লিখছি । পারলে আপনিও লেখেন । এভাবে ভাগে যোগে লিখলে হয়ত সবার কথা লেখা সম্ভব হবে।আর যারা আয়না ঘরে রয়েছে ওদের কথা লেখা দরকার নাই । কেননা ওরা বহুরুপি। ওরা একেক জায়গায় একেক রূপ ধারণ করে ওদের সঠিক পরিচয় কেউ জানেনা লিখবেন কী করে ?
চার
মাহিন ও আশা দু জনেই ছিল ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্র । এ রকমই এক শিউলি ঝরা প্রভাতে প্রথম দেখা হয়েছিল ওদের । তারপর কেটে গেছে কয়েকটি বছর ।ওরা দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসত ।কথাছিল পড়ালেখা শেষে মাহিন একটা ভালো চাকরি নিবে তারপর বিয়ে ।দুজন মিলে সুখের সংসার বাধবে। অনেকগুলো ছেলেমেয়ে হবে ওদের ।সুন্দর করে লালান পালন করে মানুষ করবে তাদের । কিন্তু একি হলো! স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল । স্বপ্নগুলো মিলে গেল ঝরা শিউলি গুলির সাথে । মাহিন শহীদ হয়ে গেছে প্রথম দিনে । আশা এখন আশার স্মৃতিগুলো নিয়ে নিরাশায় ভুগছে । দারুন কষ্ট হচ্ছে ওর ।
ওই দিন পড়ার টেবিল ছেড়ে অধীকার আদায়ের মিছিলে যোগ দিয়েছিল মাহিন । এছাড়া তো উপায় ছিল না । মাহিন ছিল সাধারণ ঘরের ছেলে । বাবা ,দাদা , নানা কেউ মুক্তিযোদ্ধা নয় ।একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে গ্রামশুদ্ধ পুরুষ মানুষকে গণহত্যা করা হয়েছিল । দু একজন ছিটেফোটা হয়ে বেঁচে ছিল। এই ছিটেফোটা মানুষ গুলির একজনের বংশধর মাহিন ।দাদী এখনো পুলিশ দেখলে ভয় পায় । ঢোকে ঢোকে পানি খায় , থর থর করে কাঁপে ।পোষাকধারী মানুষকে দেখলে তার মেলেটারিদের কথা মনে পড়ে তাই সে এমন করে ।
মাহিনের মত আরো একজন শহীদ শামিম । শামিম ছিল পিতামাতার একমাত্র সন্তান । মা বাবা তাকে ছেড়ে একটি দিনও কোথাও কাটায় নি । ছেলের মৃত্যুর পর কি যে অবস্থা তাদের তা কল্পনাতীত ।বাবার ঘাড়ে সন্তানের লাস পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী লাস। বাবা মনে মনে আগে বিরোধী দলের পক্ষে ছিলেন ।আজ এ অপকর্মের জন্য ঘৃণায় তার মন বিগলিত । ইচ্ছা করছে দলনেতাকে পেলে চিবিয়ে খাবেন । তার চোখে আজ পানি নাই সেখানে জ্বলছে প্রতিশোধের বিরাট আগ্নেয়গিরি।
নিরব নামের ছেলেটিও শহীদ হয়েছে । বড়ই শান্ত ছিল ছেলেটি । মা বাবা তাই আদর করে নাম রেখেছিল নিরব। নিরব বরাবরই ফাস্ট হত । পড়া লেখা ছাড়া কিছুই বুঝত না । ইতিমধ্যে সে দু চারটি চাকরির পরীক্ষা দিয়েছে কিন্তু চাকরি হয়নি চাকরি হয়েছে পাশের বাড়ির কোটাধারি ছেলেদের যারা কিনা খুবই অলস প্রকৃতির আর কম মেধাবী। গ্রাম শুদ্ধ মানুষ নিরবকে হেয় চোখে দেখা শুরু করেছিল আর কোটাধারীদের প্রসংশায় পঞ্চমুখী হয়ে পড়েছিল । নিরব এ লজ্জা সহ্য করতে পারেনি । সে যোগ দিয়েছিল এ মিছিলে । তারপর অধিকার আদায় করে বাড়ি ফিরেছিল সে কিন্তু লাস হয়ে ফিরেছিল । এখন গ্রাম শুদ্ধ মানুষ তার জন্য কাঁদে ।তারা এখন আসল ব্যাপারটা বোঝে।
জনগণের গণপিটুনীতে গুটিকয়েক পুলিশও মরে গিয়েছিল যারা এ গণ হত্যা করার ইন্ধন জুগিয়েছিল তারা তো রয়েছে এ সি রুমে বসে আর মরল সাধারণ মানুষ ।
এভাবে যদি লিখতেই থাকি এই শহীদদের কথা শেষ হবে না। এরা আমাদেরই সন্তান । এদের আমাদের চিরোদিন মনেরাখা উচিত ।এরা আমাদের শিখিয়েছে কিভাবে অধিকার আদায় করতে হয় । যে জাতীর বুকের উপর দিয়ে বয়ে যায় শোণিতের বন্যা সে জাতী কখনো উন্নতি লাভ করতে পারেনা । সে বন্যায় ভেসে যায় উন্নতির সকল চাবিকাঠি রয়ে যায় শুধু অফুরান শোকগাঁথা।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
কাজী জাহাঙ্গীর সমসাময়িক বিষয় নিয়ে বেশ ভাল লিখেছেন, অনেক শুভ কামনা আর ভোট থাকলো। কিন্তু গল্পটা পর পর দু’বার ছাপা হয়ে গেছে। এডমিনকে মেইল জানোলে সমস্যার সমাধান হতে পারে। অনেক ধন্যবাদ।
ফয়জুল মহী খুবই সুন্দর ও ঋদ্ধ উপস্থাপন, শ্রদ্ধেয়। মুগ্ধতা রইলো।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

শরতের আকাশ । এখানে ওখানে থোকা থোকা মেঘ

১৩ সেপ্টেম্বর - ২০২৪ গল্প/কবিতা: ৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪