একটি পথশিশুর আতঙ্ক

আতঙ্ক (নভেম্বর ২০২৫)

MD. ALIM
  • 0
  • 0
  • ২৬
ডিসেম্বর মাসের শেষ রাত। ঢাকা শহর তখন এক জাঁকজমকপূর্ণ উন্মাদনায় মেতেছে। রাত বারোটা বাজতেই শুরু হলো নিউ ইয়ার সেলিব্রেশনের রাজকীয় আয়োজন। রাতের আকাশ বরাবরের মতো নিস্তব্ধ থাকার কথা থাকলেও, আজ সেজে উঠেছে এক রঙ্গিন প্রতিযোগিতার মঞ্চে। আকাশ জুড়ে চলছে আতশবাজির বিলাসবহুল প্রদর্শনী – সবুজ, নীল, সোনালী, লাল – শত রঙের রঙিন বিস্ফোরণে ঢাকা যেন এক আলোকোজ্জ্বল স্বর্গনগরী।

শহরের বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টগুলোতে চলছে ভূরিভোজের আয়োজন। চাইনিজ, থাই, ফ্রেঞ্চ ফুডের সুঘ্রাণে বাতাস ম-ম করছে। কাঁচা কয়লার ধোঁয়ায় গ্রিল, কাবাব আর দামি বিফ স্টেকের সুস্বাদু গন্ধ ভেসে আসছে। দামি ব্র্যান্ডের অ্যালকোহল আর সফ্ট ড্রিঙ্কসের ফোয়ারা ছুটছে পার্টিগুলোতে। ক্যাসিনোগুলো আর আবাসিক হোটেলগুলোর নিয়ন আলোয় বান্ডিল বান্ডিল টাকা উড়ছে, যেন টাকার কোনো মূল্যই নেই। পুরো শহর এক অভিন্ন দৃশ্যে বাঁধা – জাঁকজমক, আনন্দ-উল্লাস আর এক কৃত্রিম রাজকীয়তায় ভরপুর।

কিন্তু এই উৎসবের জাঁকজমক, উল্লাসের ধ্বনি আর আতশবাজির মিশ্র শব্দের ভিড়ে চাপা পড়ে গিয়েছিল সেই ভয়াল রাতের নৃশংস বাস্তবতা। এই শহরেরই এক পরিত্যক্ত কোণে, ময়লার ভাগাড়ের ঠিক পাশে, কনকনে ঠান্ডায় ছেঁড়া পাতলা  কম্বলে মুড়ি দিয়ে বসেছিল নয় বছর বয়সী পথশিশু সবুজ।

সবুজকে ঠিক ভীত বলা যায় না, কারণ আপনার-আমার মতো সে রাতের অন্ধকারকে বিন্দুমাত্র ভয় করে না। তেলাপোকা, ইঁদুর, পোকামাকড়ের প্রতিও তার কোনো ভীতি নেই। বরং এই অন্ধকার, এই নিস্তব্ধতাই তার সঙ্গী। ময়লার স্তূপ আর পোকামাকড়ের সাথেই তার সহাবস্থান, কারণ শহরের পরিষ্কার, ঝকঝকে পথে তার প্রবেশ যে বারণ। জনমুখে কথিত আছে, তারা অর্থাৎ পথশিশুরা নাকি ধুরন্ধর চালাক, পকেটমার। তারা অসহায়ত্বের অভিনয় করে মাস শেষে মোটা অঙ্কের টাকা তোলে। 'টোকাই', 'নেশাখোর', 'বস্তির ছেলে' – এমন অসংখ্য তকমা তো আগেই তাদের নামের পাশে সেঁটে দেওয়া হয়েছে। এই সমস্ত অপবাদই যেন তার জন্য অদৃশ্য এক দেয়াল তুলে দিয়েছে।
যে শিশুটি অন্ধকার, পোকা-মাকড়, এমনকি মৃত্যুর ভয়ও করে না – তাকে নির্ভীক বলাই উচিত। তবুও আমি তাকে নির্ভীক বলতে পারছি না। কারণ তার চোখে মুখে সর্বদা এক আতঙ্ক, এক চাপা ভয় কাজ করে। এক পোড়া লাশের অর্ধগলিত, বীভৎস চেহারা বারবার তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এই চেহারাটি আর কারও নয়, তার প্রয়াত বাবার। মায়ের মৃত্যুর পর শ্রমিক বাবাই ছিল সবুজের একমাত্র আশ্রয়। এক রাতে কারখানায় ভয়াবহ আগুন লেগেছিল; বহু শ্রমিকের সঙ্গে পুড়ে ছাই হয়েছিলেন সবুজের বাবাও। সেই পোড়া, বিকৃত মুখটাই আজও সবুজকে প্রতি মুহূর্তে আতঙ্কিত করে তোলে।

শুধু কি এইটুকুই? একবার গভীর রাতে এক কালো গাড়ি এসে মুখে রুমাল চেপে তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল সেই ময়লার ভাগাড় থেকে। উদ্দেশ্য ছিল তার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করা। কিন্তু সে শুনতে পেয়েছিল এক ডাক্তারকে বলতে: "এই শিশু নর্দমার পচা নোংরা খাবার খেয়ে ফুড পয়জনিংয়ে ভুগছে, কিডনির অবস্থাও প্রায় শেষ। ও খুব শীঘ্রই মারা যাবে। একে দিয়ে আমাদের দু'আনাও লাভ হবে না।" সেই থেকে সবুজ শুধু তার বাবার পোড়া মুখ নয়, কালো গাড়িকেও ভয় করতে শুরু করল।

কালো গাড়ির লোকগুলো সেদিন তাকে ভীষণ মেরেছিল। একজন তার সাথে ঘটিয়েছিল এক চরম খারাপ কাজ। সবুজ চেয়েছিল সব কথা কোনো এক 'ভদ্রলোক'কে বলতে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া কোর্ট-টাই পরিহিত এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা গোছের মানুষকে দেখে সে সাহায্য চাইতে গেল। ভিড়ের মধ্যে তার ডাক শুনতে না পারার কারণে , সাদাসিধা শিশু সবুজ পেছন থেকে ভদ্রলোকের কোট টেনে ধরেছিল মনোযোগ আকর্ষণ করতে। সঙ্গে সঙ্গেই ভদ্রলোক তাকে 'চোর' তকমা দিয়ে মারতে শুরু করলেন। মুহূর্তের মধ্যে ভিড়ের সমস্ত মানুষ একই সাথে তাকে মারতে শুরু করল। মারতে থাকা মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে সবুজ যেন ক্রোধ, হিংসা আর এক আদিম জন্তুর প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছিলো। আর যারা দেখছিলো, তারা যেন কোনো এক রোমাঞ্চকারী দৃশ্য দেখে চোখের তৃপ্তি মেটাচ্ছে। সেই দিন থেকে সবুজ মানুষকেও ভয় করতে শুরু করলো। এখন থেকে সে মানুষ, কালো গাড়ি আর কল্পনায় তার বাবার মুখ – সবকিছুকেই ভয় পায়।

চরম শীতের রাতে পড়ে থাকা ছেঁড়া পাতলা কম্বল আর তীব্র ক্ষুধায় সে কাতরাতে থাকে। শীত আর তীক্ষ্ণ ঠান্ডা বাতাস ধারালো বর্ষার ফলার মতো তার শরীরের উপরিভাগকে যেন বার বার আঘাত করছে। আর শরীরের ভেতরে ক্ষুধা নামক ভয়াল পশু যেন তীক্ষ্ণ সূচ দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষুধার এক তীব্র চিত্র অঙ্কন করছে।

পরদিন ভোরে উৎসবের রেশ কাটতে না কাটতেই পাওয়া গেল এক শিশুর লাশ। এই শিশুই সেই সবুজ। সবুজের নিথর মুখে আধপচা নর্দমা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া এক টুকরো বাসি রুটি, যেনো ক্ষুধাকে হারানোর শেষ চেষ্টার প্রতীক। হাতের মুঠোয় ধরা ছিল একটি ছোট্ট চিরকুট, সেখানে লেখা:




"তারা বলেছিল শিশুশ্রম বন্ধ করো, আমি কাজ হারালাম।

তারা বললো চুরি করা বন্ধ করো, আমি কখনোই চোর ছিলাম না।

তারা বললো ভিক্ষাবৃত্তি নিকৃষ্ট কাজ, আমি কখনো ভিক্ষা চাইনি।

তারা বলেছিল অপহরণ বন্ধ করো, তাদের নেতার সন্তানকে বাঁচানোর জন্য আমাকে অপহরণ করা হয়েছিল।

তারা বললো কর্মপরিবেশ নিরাপদ করো, তাদের একজনের কারখানায় আমার বাবার মৃত্যু হলো।

তারা বলেছিল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করো, আমি ঘরহীন হলাম।

তারা বলেছিলো আমরা মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করেছি, আমি খাদ্যাভাবে মারা যাচ্ছি।

তারা বলেছিলো অপচয় বন্ধ করো, তাদের একদিনের আমেজ আমাকে ১ বছর খাদ্যের যোগান দিতে পারতো।

আমি ভীষণ ভয় পাই মানুষকে।
আমি ভীষণ ভয় পাই ক্ষুধাকে।
আমি ভীষণ ভয় পাই শীতের এই দুঃসহ যন্ত্রণাকে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

ডিসেম্বর মাসের শেষ রাত। ঢাকা শহর তখন এক জাঁকজমকপূর্ণ উন্মাদনায় মেতেছে।

১২ ডিসেম্বর - ২০২৩ গল্প/কবিতা: ৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "মুক্তিযুদ্ধ”
কবিতার বিষয় "মুক্তিযুদ্ধ”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৫