বইয়ের পাতায় আঁকা স্বপ্ন

ছোটবেলা (জানুয়ারী ২০২৫)

Sunil Akash
  • ২৮
১.
পৌষের হিমেল হাওয়া বইছে। পানির কিনারে বসে আরজু ঠান্ডায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। এত ঠান্ডায় ও আসতে চায় নি, বলাই দা জোর করে ধরে এনেছে। ও দুবার করে বলেছিল বাড়ি যাওয়ার কথা, বলাই দা ‘চড় খাবি, চুপ করে বোস’ বলে থামিয়ে দিয়েছে।
বিলের পানিতে জনা পঞ্চাশেক মানুষ, পলো নিয়ে নেমেছে। টানের সময়, বিলে পানি কম। পলো চেপে চেপে মাছ ধরছে সবাই। স্টেথোস্কোপ চেপে যেমন রোগীর নাড়ি বোঝা যায়, তেমনি পলো চেপে মাছের অস্তিত্ব বোঝার চেষ্টা করা হয়। পলোতে মাছে ঘাই মারলে পলোর মুখ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে মাছ ধরে।
বলাই দা একটু পর পর শোল আইড় শিং মাছ ধরে আনছে, আরজু সেগুলো হাড়িতে রাখছে। মাছভর্তি হাঁড়ির জিম্মাদার ও। ঠক ঠক করে কাঁপলেও কাজটা করছে নিষ্ঠার সাথে। কিন্তু হঠাৎ অসাবধানে ধাক্কা লেগে হাঁড়িটা হাত ফস্কে গেল। ঢালু পাড়, হাড়ি ধরতে গিয়ে আরজুও গেল পড়ে। ব্যথা তো পেলই, জামায় কাদাও লেগে গেল। কিন্তু বলাই দা’র সেদিকে খেয়াল নেই। ও ক্ষেপে গেল এতক্ষণের সাধনার ফল সব মাছ পানিতে পড়ায়। পাড়ে এসেই আরজুর চুলের বেণী ধরে জোরে একটা টান দিয়ে পিঠে দুম করে এক ঘা বসিয়ে দিলো
‘শাঁকচুন্নি! এইটুকু কাজ ঠিকমত করতে পারিস না?’
‘আমায় মারলে বলাই দা!’
‘মেরেছি বেশ করেছি’
‘আমি ছোট থাকতে মারতে; এখন বড় হয়ে গেছি, এখনও সবার সামনে মারো!’
‘ওরে আমার বড় রে! পরিস মোটে ক্লাস ফাইভে! তুই বড় নারে, বুড়ি হয়ে গেছিস!’
বলাই দা অট্টহাসি হাসতে লাগল। দেখাদেখি অন্য ছেলেপুলেরাও দাঁত কেলিয়ে হাসতে লাগল। আরজুর চোখে পানি এসে গেল। চোখের পানি গোপন করতে বিলের ধার থেকে উঠে এলো। পেছন থেকে বলাই দা অনেক করে ডাকছে। ডাকুক! আর কোনোদিন ওর সাথে কথা বলব না।
‘কী রে মা, কী হইছে?’
আরজুর ছলছলে চোখ দেখে মা জিজ্ঞেস করল। আরজু একটা কথাও না বলে ঘরের ভেতর চলে গেল। বলাই দা’র ওপর ভীষণ অভিমান হচ্ছে। দুটো মাছের জন্যে ওকে মারতে পারল!
ছোটবেলা থেকে বলাইয়ের হাতে মার খেয়ে খেয়ে ওর পিঠের চামড়া শক্ত হয়ে গেছে। তবু কেন জানি ওর পিছু ছাড়তে পারে না। এবারেও তা-ই হলো, সকালের মার বিকেলেই হজম! গোধুলি বেলায় দুজনকে দেখা গেল ক্ষেত থেকে মটরশুঁটি তুলছে।
কোঁচড়ভর্তি মটরশুঁটি নিয়ে বাড়ি ফিরে আরজু খুশি হয়ে গেল। খেজুর রসের ঘ্রাণে চারপাশ ম-ম করছে। মা চুলায় খেজুর রস জ্বাল দিচ্ছে। আজ পিঠা বানানো হবে! রসে ভেজানো চিতই পিঠা আরজুর খুব পছন্দের। আরজু মায়ের গায়ে গা এলিয়ে দিয়ে বসল।
‘বউ মা, আমার পান…’
‘যা তো মা, তোর দাদীরে পান দিয়ে আয়’
আরজু পানের বাঁটা থেকে একটা পানের অর্ধেকটায় চুন সুপারি দিয়ে মুড়িয়ে দাদীর হাতে দিলো।
‘জর্দা দিলা না বুবুজান?’
‘জর্দা খাওন যাইব না দাদী। জর্দা খাইলে ক্যান্সার হয়’
‘ক্যান্সার! এইটা আবার কী?’
‘গলায় ঘাউ, কইলজাউ ঘাউ এইসব’
‘তুমি ক্যামনে জানলা এইগুলা’
‘স্কুল থিকা’
‘বাহ! আমাগো আরজু অনেক কিছু শিখতাছে রে তৈয়ব’
আসলেই আরজু অনেক কিছু জানে। ব্রেন আছে মেয়েটার। কিন্তু তৈয়ব ওকে আর বেশিদিন পড়াতে পারবে না। বর্গাচাষের আয়ে এত বড় সংসার চলছে না। এরমধ্যে একটা ভালো সম্বন্ধ এসেছে, আরজুর ছবি দেখে পছন্দ করেছে। এখনো বাড়িতে আলাপ করে নি। মাসখানেক পর আরজুর ফাইনাল পরীক্ষা। তারপর ওরা মেয়ে দেখতে আসবে। সব ঠিক থাকলে সেদিনই তুলে নিয়ে যাবে।
তৈয়ব আলী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। লেখাপড়া গরিব ঘরের মেয়েদের জন্যে না!

২.
মাস্টার মশাই আরজুদের বাড়িতে প্রায় ছুটতে ছুটতে এলেন। হাতে রেজাল্ট কার্ড।
‘তৈয়ব আলী, ও তৈয়ব আলী! তুমার মাইয়া তো বিরাট রেজাল্ট করছে! ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাইছে, পুরো জিলার মধ্যে ফার্স্ট…’
প্রদীপ দাস খুশীতে এতটাই আত্মহারা যে পুরো বাড়ি যে বিয়ের সাঁজে সজ্জিত তা খেয়াল করেন নি।
মেয়েটা বড়ই মেধাবী, প্রদীপ মাস্টার ওকে ফ্রিতে পড়িয়েছেন। আরজুর বাবা যখন বলেছিল মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেবেন তখন তিনি অনেক করে বুঝিয়েছিলেন এখনই বিয়ে না দিয়ে মেয়েকে পড়াতে। কিন্তু অভাবের সংসারে মেয়েকে বড় ক্লাসে পড়ানোর সামর্থ্য তার নেই।
প্রদীপ আরজুকে জান লাগিয়ে প্রস্তুত করেছেন যাতে সে বৃত্তি পায়। তাহলে অন্তত টাকার অজুহাতে তার লেখাপড়া বন্ধ হবে না। কিন্তু সুখবরটা আনতে বড্ড দেরি হয়ে গেছে! আরজু ততক্ষণে শ্বশুরবাড়ির পথে।
প্রদীপ মাস্টার ক্ষণিকের হতবিহ্বল ভাব কাটিয়ে ছুটলেন রেলস্টেশনের দিকে। আরজুদের ট্রেন বিকেল ৪টায়। প্রদীপ দূর থেকে দেখলেন পাংশা যাবার ট্রেন স্টেশন ছেড়ে যাচ্ছে…

৩.
মেয়েটার বিয়ে হয়েছিল মাত্র বারো বছর বয়সে। ছোটবেলার দিনগুলো কাটার কথা ছিল উচ্ছ্বল আনন্দে বাবা মায়ের আদরিনী হয়ে। অথচ সেই বয়সে তার ওপর চেপে বসে সংসারের ঘানি। গেরস্ত বাড়ির নিত্যকার কাজ সামলানোর ভার বইতে বইতে মেয়েটার ভেতরেও জন্মে আরেক ‘বোঝা’। শৈশব থেকে কৈশোরে পা দিতে না দিতেই মেয়েটা পোয়াতি!
মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে সন্তান জন্মদানের সক্ষমতা মেয়েটার ছিল না। মৃত সন্তান প্রসব করে মেয়েটাও পাড়ি জমায় ওই পাড়ে।
সেদিন প্রদীপ মাস্টার প্রতিবাদ করেছিলেন, কিন্তু প্রতিকার করেন নি। হয়ত ভেবেছিলেন দায়িত্ব নিয়ে বিয়ে ভাঙার পর যদি কোনো অঘটন ঘটে তাহলে জনমভর তার দায়ভার তাকে বইতে হবে। কিন্তু তিনি ভুল করেছিলেন! দায়িত্ব না নেয়ার আক্ষেপ তাকে এখনো পোড়ায়। নিজের ভাইঝির জন্যে যা তিনি করতে পারেন নি তা করলেন আরজুর জন্যে।
সেদিন পরের ট্রেনেই তিনি রওনা হন পাংশা। ইউএনও অবন্তী সাহা ওনার সাবেক ছাত্রী। তাকে নিয়ে নিয়ে তিনি পৌঁছে যান আরজুর শ্বশুরবাড়ি।
বিয়ে হয়ে গেলে সেটা ভাঙা যায় না। তবে একজন নাবালিকার জন্যে মুসলিম আইন একটা বিধান রেখেছে, বিনা সম্মতিতে হওয়া বিয়ে বয়ঃসন্ধিকালে বাতিল করতে পারে সে।
বিয়ে অস্বীকৃতির মতো এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার পথে পারিবারিক সামাজিক অনেক চাপ আসবে। আসুক! ততদিন ছোটবেলাটাকে উপভোগ করুক ছোট্ট মেয়েটি। সেই সঙ্গে গড়ে নিক নিজের জীবন। মাচায় আশ্রিত পুঁইলতা না, সে হয়ে উঠুক হাজারো প্রাণের আশ্রয় বটবৃক্ষ।

৪.
ছোটবেলার ক্ষতটা কাটিয়ে উঠে আরজু আবারো জীবনে ফিরে যায়। আবারো তাকে দেখা যায় শর্ষেক্ষেত, বিলের ধার আর পেয়ারার ডালে। আবারো চলে বলাই দার সাথে খুনসুটি। আবারো সে রাত জেগে পড়তে পড়তে পড়ার টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়ে আর স্বপ্নে আঁকে অবন্তীর দি’র মতো ‘বড় সরকারি অফিসার’ হয়ে শৈশব হারাতে বসা মেয়েদের জীবন ফিরিয়ে দেয়ার।
দিন মাস বছর পেরিয়ে যায়। একদিন বিকেলে সে বাড়ি ফেরে উরু বেয়ে গড়িয়ে নামা রক্তধারা নিয়ে। বাল্যকালের বিয়েটা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসে গেছে!
মুশকিল সিদ্ধান্ত! কিন্তু সামনে লক্ষ্য যখন পরিষ্কার তখন কি মুশকিল বলে কিছু থাকে?
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মাহাবুব হাসান বাহ সুন্দর তো! ভালো লাগল পড়ে।
ধন্যবাদ। গল্পটা আপনার ভালো লেগেছে জেনে আনন্দিত হলাম।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

পৌষের হিমেল হাওয়া বইছে। পানির কিনারে বসে আরজু ঠান্ডায় কেঁপে কেঁপে উঠছে।

২৫ নভেম্বর - ২০২৩ গল্প/কবিতা: ৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ভালবাসা”
কবিতার বিষয় "ভালবাসা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ জানুয়ারী,২০২৫